Monday 2 October 2017

চৈনিক নৈর্ব্যাক্তিকতার সাথে লাস ভেগাস ম্যাসাকারের সম্পর্ক আছেতো।

French painter Christian Poirot Nanjing Massacre. [Photo/Xinhua]
আজকের চৈনিক বিপ্লবি বর্মি ভিক্ষুকে বলছে মুসলিমদের মারো।সে বাংলাদেশে বলছে জিহাদি বোমাবাজ হচ্ছে শ্রেনিসংগ্রামি।তার মার্কিন সংস্করন স্টিভ ব্যানন বলছে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রকেও আমরা চিনের মত আবার কারখানাতে ভরে ফেলতে চাই।
 
লোকজন যেইমাত্র যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের জন্য জোর দাবি জানালো, চৈনিক বিপ্লবি জানালো, আমি বরাবর মুক্তিযুদ্ধ্বের চেতনার পক্ষ্যে।এই পক্ষ্যে আসার ঠিক আগে সে শামসুর রাহমানকে নাহক সাম্রাজ্যবাদ এবং ইহুদিবাদের চর আখ্যা দিলো।শামসুর রাহমান আক্রান্ত হলো।আবার চৈনিক বিপ্লবির জমজ জামাতি মার্ক্সিস্ট ঘোষনা করলো যে শাহবাগিরা নাস্তিক।এসবে বাংলাদেশের মত সঙ্খ্যাগুরু অশিক্ষিতের দেশে কি পরিমান রক্তপাত হতে পারে তার ভুক্তভোগি আমরা সকলে।এরা অস্থিতিশিলতার স্ক্রিপ্ট সাজিয়ে রেখেছে অনেক বছর ধরে, টাইমলাইন ঠিক করে করে ছাড়ছে।

সেই চৈনিক বিপ্লবির পেছনে যেমন পেট্রো ডলার, তার মার্কিন সংস্করন স্টিভ ব্যাননের হাতে সেরকম কাড়ি কাড়ি ডলার, শক্তিশালি রেডিও স্টেশান, অনলাইন।এদের কাজ হলো স্পর্শকাতরতার জায়গাগুলো থেকে লোকজনকে সরিয়ে দেয়া, লোকজনকে হেইট স্পিচ দিয়ে মারমুখি করে দেয়া, জনপদকে অস্থিতিশিল করে দিয়ে যেভাবে পারা যায় নিজেদের লাইমলাইটে রাখা।আমরা স্পঞ্জের মত এদের ঘৃনাবোধকে, হিনমন্যতাকে নিজের করে ভাবতে থাকি, আমাদের প্রানসঞ্জিবনি আলো এদের কুহক চক্করে পড়ে জোনাক পোকার মত আত্মাহুতি দিতে থাকে।

এই চৈনিক বিল্পবিরা যতই মেধাবি হোক, তারা নকলনবিশের চেয়েও বদমাইশ।এক দংগল কিশোরকে উস্কে দিয়ে যারা নির্বিচারে ধর্শন, জবাই করাতে পারে, যারা কবিদের ওপর সহিংশ হেনস্থা করাতে পারে, তার থেকে যদি আপনি প্রতিদিন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান নিতে থাকেন, তাহলে আপনিও কিন্তু এইসব নারকিয়তার একজন অংশিদার।চৈনিক বিপ্লবিরা আমাদের একাংশকে ব্যাবহার করছে আরেক অংশের বিরুদ্ধ্বে।প্রায় প্রতিটি কিশোরকেই হয় এরা ঐশির মত, নয় হোলি আর্টিজান ক্যাফের হত্যাকারিদের মত হয় সরাসরি কেমিকেল মাদকে, নয় জিহাদি মাদকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে।কে কবি, কে শিল্পি তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের সাফ কথা যে যেহেতু আমরা বিপ্লবের এবং জিহাদের বিশেষ সঙ্কর জায়গিরদার, সেহেতু এইসব আলতু ফালতু কবিতা আমাদের নয়।এই চৈনিক বিপ্লবি একসাথে বয়স্ক এবং কিশোরদের বিভ্রান্ত করে কি করতে পারে, তা আমরা হেফাজতের তান্ডবে দেখেছি।

মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে সংগিতপ্রেমিদের ওপর নির্বিচার গুলি চালালো এক ষাট বছর বয়সি লোক।যারা আল্লার বিচার বলে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, ধর্শন চালাচ্ছে তাদের হাতে এই পরিমান অস্ত্র দিয়ে দেখুন।আল্লার বিচারের নামে তারা তখন খুন করাকে হবি বানায়ে ছাড়বে।হবির প্রয়োজনে, খুনের নেশায় সিরিয়াল কিলিং করে বলবে যে এটা আল্লার বিচার।
 
GOYA, Francisco The Shootings of May Third 1808
বাংলাদেশে এরকম ভয়ংকর দুজন হচ্ছে সলিমুল্লাহ খান এবং ফরহাদ মজহার।এরা আমাদের মুলধারার রাজনিতির দুই ধারায় ঢুকে গেছে এবং বিবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ফর্মুলা দিয়ে যাচ্ছে।সামরিক শাষকেরা আমাদের সাহিত্যের, কবিতার প্রানরস নিংড়ে নিয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট ও এঞ্জিওর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব বৈষম্য ঢুকিয়ে দিয়েছে, তার ফোকর গলে বেরোচ্ছে একের পর এক সলিমুল্লাহ ও ফরহাদ।দুজনেই চৈনিক প্লাস দক্ষিনপন্থি রাজানিতির মিশেল প্রডাক্ট।সাধারনত শঙ্কর প্রডাক্টের জোর বেশি থাকে।খোন্দকার আশরাফ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতো, 'তিন রমণীর ক্বাসিদা''' ছিল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ।কি থেকে কি হলো, সলিমুল্লাহর দেখাদেখি সে  শহীদ কাদরীকে গালাগাল করতে থাকলো ফরাসি কবিতার তস্কর বলে। আশরাফের তখন বয়স ষাট প্রায় পেরোনো।একজন নরম কবিকে যদি এরা ক্ষেপিয়ে এ জায়গায় নিয়ে আসতে পারে, তাহলে কবিতার নান্দনিকতার সাথে সম্পর্করহিত একজন কিশোর, কিশোরি স্পঞ্জ টাইপকে এরা কোন রক্তের চৌবাচ্চায় ডুবিয়ে দিতে পারে তা লেখা বাহুল্য।যখনি কোথাও কোন নারকিয় হত্যাযজ্ঞ ঘটে তখন যতই বলা হোক যে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এসবের পেছনে কোন মেধাবির নৈর্ব্যাক্তিক, ঠান্ডা মাথা্র ধারাবাহিক শয়তানি থাকে।
 
নৈর্ব্যাক্তিক ঠান্ডা মাথার ধারাবাহিক শয়তানির আরেক নাম সামাজিক এঞ্জিনিয়ারিং।তত্বের নামে, আদর্শের নামে, শত্রু নিধনের নামে, দেশপ্রেমের নামে, ধর্মের নামে, জাতিয়তার নামে, বর্নাশ্রমের নামে এই সামাজিক এঞ্জিনিয়ারিং এর শিকার আজকের পৃথিবির মিলিয়ন মানুষ।আর এই এঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেছনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, রাজনিতির গুরুরা, ধর্মের পুরোহিতেরা।যখন আদর্শের নামে, বিপ্লবের নামে, শ্রেনি সংগ্রামের নামে, দেশরক্ষার নামে এই রক্তপাত ঘটানো হয়, তখন ব্যাক্তিকে সামাজিক অব্যাহতি দিয়ে দেয়া হয়।যেরকম ১৯৭১এর গনহত্যার দায় থেকে  পাকিস্তান অব্যাহতি দিয়েছে তার জেনারেলদের।গনতন্ত্রের একটা দুর্বলতা যে তাকে এই বিদ্বেষ সঙ্ক্রামকদের সহ্য করে নিতে হয়।কিন্তু এই বিদ্বেষ যদি গনতন্ত্রকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়, তাকে থামানো যায় সমষ্টিক প্রতিরোধে।কিন্তু দুই পক্ষে যদি সলিমুল্লাহ, ফরহাদেরা ঢুকে যায়, আর এক পক্ষ্যে যদি ট্রাম্পের মত লোক, বুশ রিগানের মত লোক লিঙ্কনের রিপাবলিকান পার্টিকে হাইজ্যাক করে ফেলে, তখন ব্যাক্তির জন্য সামাজিক শুন্যতা তৈরি হয়।তখন ব্যাক্তি একই সাথে শিকার এবং শিকারি হয়ে উঠে।প্রত্যেক ম্যাসাকারের ভেতর সম্পর্ক আছে, আর যারা সেই ম্যাসাকারগুলোকে জায়েজ করে তাদের ভেতরেও ক্ষ্মতায়নের সম্পর্ক আছে।
 
Guernica (1937) was Picasso’s reaction to the bombing of the Basque town Guernica by German and Italian warplanes during the Spanish Civil War in 1937
রাস্ট্র থেকে ঘটানো হোক, আর রাস্ট্রের বাতাবরনের বাইরে ব্যাক্তির পক্ষ্য থেকে ঘটানো হোক, সেটা ম্যাসাকার হোক আর একটি বা দুটি হত্যাকান্ড হোক, সেই হত্যাকান্ডগুলোকে যখন বিচারিক কাঠামোর আওতায় আনা হয় না, তখন একের পর এক হত্যার চেইন তৈরি হয়।সেই চেইনের সিভিল সাইডে আমরা পাই সলিমুল্লাহ, ফরহাদদের।আর উর্দিধারি সাইডে পাই র‍্যাব জাতিয় বিচার বহির্ভুত সংস্থা।এই মানষিকতা যে সমাজে, সে সমাজে ব্যাক্তি যদি অস্ত্রের অধিকারি হয় এবং তাকে বোঝানো হয় যে বন্দুকের নলই ক্ষ্মতার উৎস, তখন তাকে অহিংসার নৈতিকতা বোঝানো কঠিন।সেরকম গান্ধি, ম্যান্ডেলা আমাদের আশে পাশে নেই।'সিন্ডলার লিস্ট' সিনেমাতে সিন্ডলার এক পর্যায়ে এক ফ্যাশিস্ট অফিসারকে বলে, বন্দুকের অধিকারি হবার পর এবং ট্রিগার টেপার ক্ষ্মতা থাকা স্বত্ত্বেও যখন একজন ট্রিগার টেপেনা সেটাই প্রকৃত ক্ষ্মতায়ন।এখন একজন কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ তার মালিকের হয়ে মুনাফার জন্য জনগনের দিকে তাক করে যেসব ট্রিগার টিপছে তাও মানুষকে যে কোন সময় সহ্যের শেষ সিমায় নিয়ে যেতে পারে।কর্পোরেট হোক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক,  আমরা সলিমুল্লাহদের, ফরহাদদের, স্টিভ ব্যাননদের হাতে  সামাজিক এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ট্রিগার তুলে দেই।এখানেই এখনো আমরা ব্যাক্তিক প্রতিরোধের জায়গায় দুর্বল এবং যে দুর্বলতার খেসারত আমরা প্রায়ই দিচ্ছি চড়ামুল্যে।
 
মর্মান্তিক আয়রনি এখানেই, যে-চিনারা জাপানিদের হাতে ব্যাপক গনহত্যার শিকার হয়েছিল, তারাই বিপ্লবের পর তিব্বতিদের ওপর নিজের ইতিহাসের পুনরাবৃতি চাপিয়ে দিয়েছে, বিপ্লবের তুঙ্গাবস্থায় পাকিস্তানিদের হাতে বাংলাদেশিদের গনহত্যায় নিরব থেকেছে।আর আজকের কর্পোরেট চিন বার্মাতে রোহিঙ্গা গনহত্যায় নিরব থাকছে।আমরা পাচ্ছি ব্যাক্তিকে রাস্ট্রের সাফাইকারি, রাস্ট্রের তল্পিবাহক আদর্শের ধ্বজাধারি হিশেবে।আবার যখন সেই একই চিনের শিল্পি ওয়েই ওয়েইকে ব্যাতিক্রমিভাবে রাস্ট্রের বিপক্ষে গিয়ে ব্যাক্তির পাশে দাড়াতে থাকি, আমরা আবারো বিশ্বাস করি যে বন্দুকের নলের আগায় নয়, রাস্ট্রের ইচ্ছার অধিনে নয়, তত্বিয় বা ধর্মিয় বিপ্লবের ছত্রচ্ছায়ায় নয়, ব্যাক্তির সহমর্মিতায় লুকিয়ে আছে মানবিক বিবর্তনের জিয়নকাঠি।প্রত্যকটা বুলেটের বিরুদ্ধে আমরা একেকজন সেই জিয়নাকাঠির অনির্বান জলাধার হয়ে জেগে রই, পাশাপাশি সামনে এগোই বিপুল, তুমুল সাগরের দিকে।
 
চয়ন খায়রুল হাবিব
৩/১০/১৭
ব্রিটানি