তুলনা : মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বিজয় তেন্ডুলকর, গিরীশ কার্ণাড, সার্ত্রে, কামু, সোয়িঙ্কা
![]() |
Lairembigee Eshei (Song of the Nymphs) by Ratan Thiyam |
থিয়ামের থিয়েটার দেখবার আলোকে, আমার নিজস্ব থিয়েটার চর্চার দৃষ্টিকোণ, ভারতীয় এবং বিশ্ব থিয়েটার চর্চার তুলনামূলক অবস্থান থেকে এখানে থিয়ামের থিয়েটার চর্চা আলোচনা করেছি। তুলনা করে দেখিয়েছি মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বিজয় তেন্ডুলকর, গিরীশ কার্ণাড, সাত্রে, কামু সোয়িঙ্কার থিয়েটার চর্চার সাথে দূরত্ব এবং পার্থক্য। থিয়াম এক সময় পেইন্টিং চর্চা করতেন, সেখান থেকে নাটক লেখায়, নির্দেশনায়, মঞ্চ নক্সায়, সঙ্গীতের চর্চায় কিভাবে থিয়েটার যাত্রায় আচার সর্বস্বতাকে কেন্দ্রানুগ চর্চা করে তুললেন সেদিকটি প্রথমে দেখা যাক।
নাট্যভাবনা ও শিল্পধারার মূল প্রতিপাদ্য
রতন থিয়ামের নাটকীয় ভাবনা মূলত রিচার্ড শেকনারের "পরফরম্যান্স থিয়োরি", এশিয়ান থিয়েটারের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক রূপ এবং গ্রিক ট্র্যাজেডির আকার-কাঠামোর মধ্যে এক সেতুবন্ধন গড়ার প্রয়াস। তার দৃষ্টিতে নাটক শুধু বিনোদন নয়—তা দর্শকের আত্মিক উত্তরণ, মানসিক বিকাশ এবং রাজনৈতিক আত্মজিজ্ঞাসার এক পবিত্র পরিসর।
তিনি যে নাট্যরীতিতে কাজ করেন, তা “থিয়েটার অব রিচ্যুয়াল” বা "আচারভিত্তিক থিয়েটার" নামে পরিচিত। এই ধারায় অভিনয়, নৃত্য, সংগীত, মঞ্চস্থাপন এবং আলোকসংগঠন একত্রে এক যোগানুভব তৈরি করে যা দর্শকের ভেতর দার্শনিক উত্তরণ ঘটায়।
উল্লেখযোগ্য নাট্যকর্ম
১. Chakravyuha (চক্রব্যূহ)
রতন থিয়ামের অন্যতম বিখ্যাত নাটক চক্রব্যূহ, যা মহাভারতের অভিমন্যুর মৃত্যুকথাকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এখানে থিয়াম আধুনিক যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতা এবং রাজনৈতিক জটিলতা তুলে ধরেন। মঞ্চসজ্জা, আলো এবং মুখোশের ব্যবহার নাট্যগাথাকে এক মেটাফোরিক উচ্চতায় নিয়ে যায়।
২. Uttar Priyadarshi (উত্তর প্রিয়দর্শী)
নাগার্জুন রচিত মূল পালার এই রূপান্তর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর পুত্র অশোকের বোধির অভ্যন্তরীণ যাত্রা তুলে ধরে। নাটকটি বৌদ্ধ দর্শনের শান্তি, ক্ষমাশীলতা ও আত্মপরিশুদ্ধির বার্তা বহন করে। থিয়ামের ব্যাখ্যায় অশোক যেন আধুনিক রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
৩. Andha Yug (অন্ধ যুগ)
ধর্মবীর ভারতীর এই নাটক অবলম্বনে থিয়াম একটি যুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত সমাজের প্রতিচিত্র আঁকেন। এখানে শ্রীকৃষ্ণের অনুপস্থিতি, যুদ্ধের ক্লান্তি ও মানবিক দুর্বলতা দর্শকের নৈতিক জিজ্ঞাসাকে তীব্র করে তোলে।
৪. Lengshonnei (লেংশন্নেই)
এ নাটকে থিয়াম তুলে ধরেন আধুনিক মণিপুরের রাজনীতি, সামরিক উপস্থিতি, এবং নাগরিক দমননীতিকে। মৈতেই সংস্কৃতির আচার ও দেবদেবীর গূঢ় চিহ্ন এতে মিশে আছে।
রতন থিয়ামের নাট্যভাষা ও শৈলী
থিয়ামের নাট্যশৈলী মূলত দেহভাষা ও রূপক-ভাষার সমন্বয়। অভিনেতাদের চলন, দৃষ্টি, ঘূর্ণন এবং মুখোশের অন্তর থেকে বের হওয়া উচ্চারণ—সব মিলিয়ে এক ধরনের 'ঋত্বিক' অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। তিনি কেবল সংলাপে নির্ভর করেন না, বরং মৌনতা, অনুচ্চারিত দেহাভিব্যক্তি ও রূপকথামূলক চিত্রগাথায় আস্থা রাখেন।
মঞ্চব্যবহার:
রতন থিয়ামের মঞ্চ কখনোই শূন্য বা কৃত্রিম নয়। আলো, শব্দ ও আবহ সঙ্গীতের সংগে অভিনেতার চলন মঞ্চকে এক জীবন্ত প্রাণে রূপ দেয়। তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত এবং নৃত্যরীতিকে নাট্যে অন্তর্ভুক্ত করে একটি "টোটাল থিয়েটার" বা পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা গড়েন।
মুখোশ ও রূপকল্প:
মণিপুরী ধর্মীয় আচারে ব্যবহৃত মুখোশগুলো নাটকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঈশ্বর, মৃত্যু, অন্যায় কিংবা ক্ষমার রূপক হিসেবে এই মুখোশ দর্শকের সামনে এক বহুমাত্রিক পাঠ খুলে দেয়।
![]() |
'The Shrine', the main theatre of Ratan Thiyam's Chorus Repertory, Imphal |
সমালোচনা ও বিতর্ক
রতন থিয়ামের নাট্যচর্চা ভারতীয় আধ্যাত্মিক ও সংস্কারমূলক চেতনার এক গভীর প্রতিফলন হিসেবে বহুবার প্রশংসিত হয়েছে। তার নাটকে প্রতীক, মুখোশ, আচারানুষ্ঠান, দেবভাষা ও মিথের বুনন এক অনন্য আবহ সৃষ্টি করে। তবে এই শিল্পশৈলীর সূক্ষ্ম এবং চড়াদাগের সীমাবদ্ধতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে।
একটি প্রধান সমালোচনা হলো—থিয়ামের থিয়েটারে “ব্যক্তির আত্মানুসন্ধান বা একক চেতনার জাগরণ” প্রায় অনুপস্থিত। তার আচারনির্ভর, সমষ্টিকেন্দ্রিক ও রিচ্যুয়ালনির্ভর নান্দনিকতা ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দ্বিধা, বা আত্মসংঘাতের নাট্যরূপকে প্রায়শ চাপা দেয়। নাট্যশালা এখানে হয়ে ওঠে দেবালয়—যেখানে চরিত্ররা নিজস্ব মননচর্চার চেয়ে অধিকতরভাবে এক নির্ধারিত ঐশিক গাম্ভীর্যে আবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে সমালোচকরা বলেন, থিয়ামের নাটকে "ব্যক্তি নেই, আছে প্রতীক; প্রশ্ন নেই, আছে বোধিপথ"।
তার নাটকের আচারনির্ভর গঠন ও ভাষার পরম্পরা অনেক দর্শকের জন্য দুর্বোধ্য, এমনকি দূরবর্তী। অনেক সময় এতে দর্শক-নাটকের মাঝে এক অলঙ্ঘ্য দূরত্ব তৈরি হয়, যা নাট্যকলার অন্তরঙ্গ সংলাপ-প্রবণতাকে ব্যাহত করে। বিশেষ করে আধুনিক মানুষের আত্মগত প্রশ্ন—যেমন অস্তিত্বের সংকট, একাকিত্ব, ভোগ আর নৈতিকতার দ্বন্দ্ব—এসব কিছু থিয়ামের নাটকে কেবল সমষ্টির ছায়াতলে রূপ পায়, পৃথক চৈতন্যের অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান নয়।
এই অভিজাতবাদী, কখনো কখনো আনুমানিক বা উচ্চরুচিকেন্দ্রিক অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে থিয়াম বলেন,
“সত্য, ন্যায়, ঈশ্বর ও নিঃসঙ্গতার প্রশ্ন—এগুলো সব শ্রেণির মানুষের অভিজ্ঞতা।”
তার মতে, দর্শকের মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন যেমন রয়েছে, তেমনি নাট্যকারেরও দায়িত্ব আছে জাগ্রত দর্শক গঠনের। এ বক্তব্যে একদিকে যেমন শিল্পের দায়বদ্ধতা স্বীকার করা হয়, তেমনি প্রশ্ন জাগে—নাট্যশিল্প কি তখন কেবল দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক উত্তরণে সীমাবদ্ধ থাকে, না কি মানুষের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, প্রতিদিনের দুঃসহ বাস্তবতাও নাটকের অধিকারভুক্ত?
এ দ্বন্দ্ব রতন থিয়ামের থিয়েটারকে একদিকে বিস্ময়করভাবে ঐশ্বর্যশালী ও গভীর করে তোলে, অপরদিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা মানসিক ঘনিষ্ঠ নাট্যরীতির সঙ্গে এক দূরত্বও তৈরি করে।
ওপরের বিমূর্ত সমালোচনাকে মূর্ততা দিতে আমার পাঠ, থিয়েটার চর্চা, বিশ্ব মঞ্চের বিভিন্ন আঙ্গিকের থিয়েটার দেখার ভিত্তিতে নিচে কয়েক জন নাট্যকার এবং প্রায়োগিক থিয়েটার চর্চাকারির সাথে থিয়ামের চর্চার তুলনা করছি।
রিচ্যুয়াল বনাম ব্যক্তি : থিয়ামের নাটকে অস্তিত্বের সংকটের অনুপস্থিতি
রতন থিয়ামের নাট্যশৈলীর মূল ভিত্তি রিচ্যুয়াল, আচার, এবং সমষ্টিমনস্ক ধর্মীয় প্রতীক। তার নাটকে চরিত্ররা যেন দেবতা, পুরাণনায়ক বা ঐশিক দূতের প্রতিরূপ, যেখানে মানুষের সাধারণ, সংকটময় অস্তিত্ব বা নৈর্ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব সেভাবে উঠে আসে না। দর্শককে তিনি নিমজ্জিত করতে চান এক পরিশুদ্ধ পরাবাস্তবতায়—যেখানে ব্যক্তি নয়, সমষ্টি, মিথ ও ঈশ্বরতুল্য নির্ভরতাই মুখ্য। এ প্রবণতা সার্ত্রে ও কামুর নাট্যচিন্তার ঠিক বিপরীতে অবস্থান করে।
সার্ত্রে ও "অস্তিত্ববাদী থিয়েটার":
জাঁ-পল সার্ত্রের মতে, থিয়েটার হলো ব্যক্তির নৈতিক সিদ্ধান্তের সংকটময় পরিসর। তার নাটক Les Mains Sales বা Huis Clos-এ আমরা দেখি ব্যক্তি কিভাবে নিজের রাজনৈতিক, নৈতিক এবং আত্মিক সংকটের মুখোমুখি হয়—নৈঃসঙ্গ্য, অপরাধবোধ, বা রাজনৈতিক ভ্রান্তি সেখানে কেবল প্রতীক নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা।
রতন থিয়ামের বিপরীতে, সার্ত্রের থিয়েটারে রিচ্যুয়াল বা আচার নেই—আছে ব্যক্তির নিজস্ব চেতনার সংকট ও উন্মোচন। তার চরিত্রেরা মঞ্চে ঈশ্বরের জন্য অপেক্ষা করে না, তারা নিজেদের ভেতরে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি খুঁজে পায়।
কামু ও "বিদ্রোহী ব্যক্তি":
আলবেয়ার কামুর নাট্যধারণা থিয়ামের ঠিক বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁর Caligula, The Just Assassins বা The Misunderstanding নাটকে প্রতিটি চরিত্র নিজের অস্তিত্বের অর্থ, নৈতিক সিদ্ধান্ত এবং বিদ্রোহের মূল্য অন্বেষণ করে। কামুর মতে, মানুষ একা, ঈশ্বরহীন, কিন্তু তবুও তার সিদ্ধান্তই তার পরিচয়।
তাঁর "বিদ্রোহী ব্যক্তি" (L'Homme révolté) সময়কে প্রতিরোধ করে; সে কোনও পূর্বনির্ধারিত আচার বা ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকে না। থিয়ামের নাটকে যেখানে মানবিক যন্ত্রণাকে ঈশ্বরের বা ধর্মীয় প্রতীকের ভাষায় উপস্থাপন করা হয়, সেখানে কামু সেই যন্ত্রণাকে মানবিক পরিণতির চূড়ান্ত ও গভীরতম সত্য হিসেবে মেনে নেন।
ভারতীয় পরিসরে :
রতন থিয়ামের থিয়েটার চর্চা, তার নাট্যশৈলী বা ধারা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য চার মহৎ নাট্যব্যক্তিত্ব—মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয় তেন্ডুলকার এবং গিরীশ কার্ণাডের নাট্যচিন্তার তুলনায় কোথায় এবং কত দূরে অবস্থান করে তা নিচে পর্যালোচনা করা হলো।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত: ব্যক্তি-দ্রোহের নাট্য-কাব্য
মধুসূদন ইউরোপীয় ধাঁচে নাটক লেখার পথে বাংলা নাটকের ভেতর ট্র্যাজেডি, পৌরাণিক বিদ্রোহ ও ব্যক্তিমানুষের নৈতিক দ্বন্দ্ব প্রতিষ্ঠা করেন (শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী, পদ্মাবতী)। তর নাটকে পৌরাণিক চরিত্র থাকলেও, তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি নয়—তারা একেকজন বিদ্রোহী আত্মা, যারা নিয়তি, সমাজ ও প্রেমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
দূরত্ব: রতন থিয়ামের চক্রাকারে গঠিত নাট্যবিশ্ব ব্যক্তিকে সমষ্টির আচারনির্ভর প্রবাহে জড়িয়ে রাখে। সেখানে মধুসূদনের নাটক, বিশেষ করে বিদ্রোহী নারীচরিত্রের মতো (যেমন শর্মিষ্ঠা), আত্মস্বত্বার উচ্চারণ বেশি প্রবল—ঈশ্বরনির্ভর নয়, আত্মনির্ভর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : আত্মদর্শনের নাট্য-আঙ্গিক
রবীন্দ্রনাথের নাটকে যেমন আছে পৌরাণিক পুনর্বিন্যাস (অচলায়তন, বিসর্জন, রক্তকরবী), তেমনি আছে গভীর নৈতিক জিজ্ঞাসা, ব্যক্তিমানুষের আত্মসংঘাত, এবং সমাজ-ঐতিহ্যের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার দ্বন্দ্ব। তাঁর থিয়েটার চেতনার মধ্যে ‘মনুষ্যত্ব’ এক কেন্দ্রীয় দর্শন—যা কখনো ধর্ম, কখনো রাষ্ট্র, কখনো সমাজব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
দূরত্ব: রতন থিয়ামের নাট্যচিন্তা দর্শককে ভাবায় ঈশ্বর, ধর্মীয় রীতিচর্চা এবং সমষ্টির প্রতি আনুগত্যের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এই আনুগত্যকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন, যেমন অচলায়তন-এ তিনি রিচ্যুয়ালের অন্ধ অনুসরণ ভেঙে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার হলো রিচ্যুয়াল-বিরোধী আত্মানুসন্ধান, যেখানে থিয়ামের থিয়েটার অনেকাংশে রিচ্যুয়াল-মাধ্যমে অস্তিত্বচিন্তা।
বিজয় তেন্ডুলকার: সামাজিক বাস্তবতার নির্মম উন্মোচন
তেন্ডুলকারের নাটক (ঘাশিরাম কোতওয়াল, সখারাম বাইন্ডার, সাইলেন্স! দ্য কোর্ট ইজ ইন সেশন) ভারতীয় সমাজের অন্তর্লীন হিংসা, নিপীড়ন, যৌনতা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার, ও পিতৃতন্ত্রের নগ্ন চেহারা উন্মোচন করে। তার নাটকে প্রতীক আছে, কিন্তু তা বাস্তবতার মুখোশ খোলার হাতিয়ার।
দূরত্ব: থিয়ামের থিয়েটার বাস্তব থেকে অনেকটা দূরে, এক ধরনের আধ্যাত্মিক বা অনাত্মীয় পরিসরে দাঁড়িয়ে। তিনি রাষ্ট্র বা সমাজের নির্মমতা কখনো তুলে ধরেন, যেমন Lengshonnei-তে, কিন্তু সে ভাষা অবচেতনার প্রতীক ও আচার-প্রবাহে ঢেকে যায়। তেন্ডুলকার যেখানে দর্শককে কনক্রিট সামাজিক হিংসার মুখোমুখি দাঁড় করান, থিয়াম সেখানে দর্শককে ধ্যানমগ্ন প্রতীকী রূপান্তরে নিয়ে যান। একপক্ষ বলিষ্ঠ বাস্তব, অন্যপক্ষ গূঢ় প্রাচীনতা।
গিরীশ কার্ণাড: পৌরাণিক পুনর্ব্যাখ্যায় ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব
গিরীশ কার্ণাড (হয়বদন, নাগমণ্ডল, তুগলক) ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাসকে আধুনিক অস্তিত্ববাদের পরিসরে দাঁড় করান। তার চরিত্রেরা পৌরাণিক হলেও গভীরভাবে আত্ম-প্রশ্ন-জর্জর ও দ্বিধাগ্রস্ত—তারা প্রেম চায়, স্বাধীনতা চায়, আবার ভয় পায় নিজের সিদ্ধান্তকে। তার নাট্যজগত একজন মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক পরিসরের দ্বৈরথ।
দূরত্ব: গিরীশ কার্ণাডের নাটকে পৌরাণিক চাদরের নিচে থাকে মানবিক জটিলতা; থিয়ামের নাটকে পৌরাণিক চাদরই অনেকসময় মুখ্য হয়ে ওঠে। কার্ণাড ‘ঈশ্বর ও মানব’ দ্বন্দ্বকে পুনরায় রচনা করেন, থিয়াম তা পূজার ছকে স্থাপন করেন।
তাছাড়া, কার্ণাড নিজে মুখোমুখি দর্শকের প্রতিক্রিয়া চেয়েছেন, থিয়ামের মঞ্চে দর্শক এক প্রকার নিশ্চুপ উপাসক—যিনি অভিভূত হন, কিন্তু বিরোধিতা বা প্রশ্নের জায়গা পান না।
সারসংক্ষেপ: থিয়ামের থিয়েটার—এক আচারময় মুক্তি বনাম বাকিদের থিয়েটার—এক ব্যক্তিময় বিদ্রোহ
![]() |
Ratan Thiyam's Urubhangam |
রতন থিয়ামের থিয়েটার ভারতীয় মঞ্চনাট্যে এক অনন্য সাধনা, কিন্তু তা মূলত সমষ্টিকেন্দ্রিক, আচারনির্ভর এবং আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ। অন্যদিকে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, তেন্ডুলকার ও কার্ণাড প্রত্যেকে নাটকে ব্যক্তি, দ্বন্দ্ব, আত্মসন্ধান ও প্রতিরোধের সুর প্রবল করেছেন। এই দুই ধারা—আচারনির্ভর সামষ্টিকতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মচর্চা—উপমহাদেশীয় নাট্যঐতিহ্যের দুই মেরু। এই বিভাজন আমাদের ভাবায়: নাট্যকলা কি আত্মমুক্তির পথ, না সমষ্টি-আচার-মিশ্রিত এক অলৌকিক আয়োজন?
নোবেলজয়ী নাইজেরিয়ান নাট্যকার ওলে সোয়িঙ্কার নাটকে রিচ্যুয়াল ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিসত্তার উন্মেষের মাধ্যম হিসেবে। তার নাটক যেমন "Death and the King's Horseman" বা "The Strong Breed"-এ দেখা যায়, আচার-অনুষ্ঠান ব্যক্তিমানবের আত্মদ্বন্দ্ব ও সামাজিক অবস্থানের পরিস্ফুটনে ভূমিকা রাখে। সোয়িঙ্কার রিচ্যুয়াল নাটকে ব্যক্তিকে প্রশ্ন তোলে, তাকে সমাজ ও আত্মার দ্বন্দ্বে স্থাপন করে। সে নাটকে আচার কোনো অলঙ্ঘনীয় বিধান নয়, বরং নাট্যপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বদলে যাওয়া জীবন্ত অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে, রতন থিয়ামের নাটকে রিচ্যুয়াল হয়ে ওঠে পবিত্র, নির্ধারিত ও অবিচল এক কাঠামো, যার উদ্দেশ্য দর্শককে এক ধ্যানমূলক অভিজ্ঞতায় নিয়ে যাওয়া। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক চেতনা ও আত্মবোধ অপেক্ষাকৃত গৌণ হয়ে পড়ে। ফলে থিয়ামের নাট্যভাষ্য কখনও কখনও দর্শকের অভ্যন্তরীণ বোধকে স্পর্শ না করে এক ঋদ্ধ অথচ দূরত্বময় আচারনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করে।
এই দুই নাট্যচিন্তার তুলনা থেকে স্পষ্ট, সোয়িঙ্কা রিচ্যুয়ালকে ব্যবহার করেন ব্যক্তি-সমাজ দ্বন্দ্বকে মঞ্চে উন্মোচনের জন্য, আর থিয়াম রিচ্যুয়ালকে স্থাপন করেন আধ্যাত্মিক নিঃশব্দতা ও ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তির উপাস্যরূপে।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
রতন থিয়ামের নাট্যদর্শন শুধু মণিপুর বা ভারতের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছে বার্লিন, টোকিও, নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে প্যারিস পর্যন্ত। তার প্রতিষ্ঠান Chorus Repertory Theatre মণিপুরকে আন্তর্জাতিক নাট্যমানচিত্রে স্থাপন করেছে।
তিনি ভারতের জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের (NSD) প্রাক্তন পরিচালক ছিলেন, এবং তার ছাত্রছাত্রীরা আজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে থিয়েটার আন্দোলনে সক্রিয়।
উপসংহার
রতন থিয়াম কেবল একজন নাট্যকার বা নির্দেশক নন—তিনি ভারতীয় শিল্পচেতনার আধুনিক পূর্ণ রূপ। তার নাট্যচর্চা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, শিল্প কখনো শুধু বিনোদন নয়—তা এক দায়বদ্ধ অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক রূপ। ভারতীয় মিথ, দর্শন, রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার একটি সুষম সংলগ্ন রূপ যদি আমরা কোথাও খুঁজতে চাই, তবে রতন থিয়ামের নাট্যভুবন আমাদের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।
তার কাজ আমাদের চেতনাকে জাগিয়ে তোলে, আমাদের স্মরণ করায়—নাটক কেবল মুখের উচ্চারণ নয়, আত্মার অনুরণন।
চয়ন খায়রুল হাবিব
২৪/০৭/২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সূত্র:
NSD Archives, Delhi
Interviews with Ratan Thiyam in The Hindu, Frontline
“Performing the Sacred: Ratan Thiyam’s Theatre” – Routledge
Chorus Repertory Theatre archives