![]() |
Queen Victoria and Dwarkanath Thakur. Covent Garden, London. |
১
আমার 'বিবিধ রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে দ্বারকানাথের জন্য বিশেষ জায়গা রাখবো। এটি তেমন বড় গ্রন্থ হবে না। অনেকগুলো চটির একটি সেটের অংশ। রবীন্দ্র-পাঠ নিয়ে ভাবনা সেখানে প্রধান।
দ্বারকানাথ এবং দেবেন্দ্রনাথের দ্বন্দ্বে আমি দেবেন্দ্রনাথকে দেখছি কট্টর মৌলবাদী হিসেবে, দ্বারকানাথকে দেখছি আন্তরিক সংস্কারক হিসেবে। যে দ্বন্দ্ব রবীন্দ্র মানসে এতটা গভীর রেখাপাত করেছিলো যে তিনি 'ছিন্নপত্রে' বলছেন, ''আমি অন্তরে অসভ্য অভদ্র- আমার জন্যে কোথাও কি একটা ভারি সুন্দর অরাজকতা নেই, কতকগুলো ক্ষ্যাপা লোকের আনন্দমেলা নেই।''
দ্বারকানাথ ঠাকুরকে নিয়ে বিশদ পড়াশোনা করছি। ওনাকে ভালো লাগছে। ওনার বিপুল ব্যবসায়ীক বৃত্তান্ত উচ্চতর বাণিজ্যে বিশ্ব-পাঠ্য হতে পারতো। কিন্তু ছেলে দেবেন্দ্রনাথ এবং তার ১৫ সন্তান পারিবারিক ইতিহাসের মোড় ঘোরাতে সেগুলো ধ্বংস করেছিলো।
![]() |
A commemoration to Dwarkanath Tagore at Kensal Green Cemetery on 11 August 2018 was organised by Bengal Heritage Foundation. |
২
বাঙালি বাতিকের এক প্রধান অনুষঙ্গ ব্যবসায় এবং ব্যবসায়ীকে অপছন্দ করা। যে যত বড় ব্যবসায়ী তাকে তত বেশি অপছন্দ করতে পারা, তাকে কলঙ্কিত করা বাঙালি নীতি-বাতিকগ্রস্থতার সিলেবাসে পি,এইচ,ডি সমান মর্যাদা পায়। ফলে রাষ্ট্রীয় সেবা মাধ্যমগুলোকে মুনাফা-মুখি এবং ব্যাবাসায়ীক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। আবার রাষ্ট্র বলতে বোঝানো হয়, ব্যবসায়ের পথকে কত ভাবে লাল ফিতার দৌরাত্মে বাধা যায়, তার আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা। ব্যবসায়ীকে এ কারণে তার ব্যবসার পরিশ্রমের পাশে মসজিদ কমিটি, মন্দির কমিটি, হজ, তীর্থযাত্রা, যজ্ঞ, মিলাদ, ওয়াজে খরচ করে সজ্জন তকমা নিতে হয়, এসব না করলে দুরাত্মা হিসেবে পরিচিত হতে হয়।
সর্বভারতীয় পর্যায়ে ভারতের প্রথম শিল্পপতি দ্বারকানাথ ঠাকুর দেশে, বিদেশে নিজ গুনে এতোটা পরিচিত ছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের দাদা, দেবেন্দ্রনাথের বাবা এসব পরিচয় তার গুন বৃদ্ধি করে না। বরং সন্তান দেবেন্দ্রনাথের কট্টর মৌলবাদী আচরণ, আর নাতি রবীন্দ্রনাথের তাতে সায়, দ্বারকানাথ সম্পর্কে কৌশলে বিস্তারিত মিথগুলোকে আমরা ঐতিহাসিক সত্য বলে গ্রহণ করতে শুরু করে দিয়েছি। দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের জীবনীকারদের অতি উৎসাহী পক্ষপাত এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করে নাই। নিজের অযোগ্যতা ঢাকতে দেবেন্দ্রনাথের বাবার প্রতি সিসিলিয়ান অমের্তা আরোপকে জীবনীকারেরা বিভিন্ন ভাবে পলিশ দিয়েছে।
ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে বলা চলে মা দিগম্বরী দেবী অর্থাৎ দ্বারকানাথের স্ত্রীর দীর্ঘজীবী পুরুষ সংস্করণ। দেবেন্দ্রনাথ বাবার কীর্তিকে ঢাকতে, তার অপব্যাখ্যায় ১৫ সন্তানকে আজীবন ব্যস্ত করবার সাধনায়, মায়ের জীবনী লেখার আর অবকাশ পান নাই। সেটা হলে অধুনার ভারতীয় হিন্দুত্ব-বাদীরা ঠাকুর বাড়িতে তাদের একজন প্রতিমা পেতেন। যদিও আদি-সূত্রে ব্রাক্ষন হলেও সতেরশো শতকের কিছু ধর্মান্তরিত জ্ঞাতির কারণে তাদের পিরালি-ব্রাক্ষন বলা হতো, তার পরও দিগম্বরী দেবীর আচার-সর্বস্বতা যে কোনো ধর্মের মৌলবাদে সর্বোচ্চ আসনে বসানো যাবে।
দিগম্বরী দেবীর ধনাঢ্য যজ্ঞ-প্রিয়তা, আচারসর্বস্বতার সুযোগে ব্রাক্ষন পুরোহিতদের দ্বারকানাথের খেয়ে দ্বারকানাথের ওপর শাপ শাপান্তে দ্বারকানাথ কিছু মনে করেন নাই। পুরোহিতেরা দ্বারকানাথকে ডাকতো ম্লেচ্ছ। আর দিগম্বরী দেবীর প্রতি তাদের ফতোয়া ছিলো, সে ম্লেচ্ছকে দেখলে, শুনলে দিগম্বরীকে সাত ঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
হতে পারে, পিরালি-ব্রাক্ষনের একঘরে তকমার কারণে ঠাকুর পরিবারের অনেকে সাধারণের চেয়ে বেশি ধর্মাচারে সময় দিতো। মনে রাখতে হবে এ তকমার বর্ণগত বৈষম্যের কারণে ঠাকুর পরিবারের কোন সদস্য এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত কোন কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন নি। কাছাকাছি খিদিরপুরের বনেদী গার্ডেন রিচ এলাকার ধনশালী আইনজীবী রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে মধুসূদন থেকে মাইকেল হওয়াতে যেসব অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটেছে, তাও নিশ্চয় ঠাকুরবাড়ির মুরুব্বিদের কানে এসেছিলো।
এসব ফতোয়া, বাতিকের যন্ত্রণায় দ্বারকানাথ একই এলাকায়, তার নামে নামাঙ্কিত দ্বারকানাথ লেনে আলাদা বাড়িতে উঠে গেলেন, সে বাড়ির নাম হলো 'বৈঠক খানা'। বেলগাছিয়াতে বানালেন প্রমোদ ভবন। বিচ্ছেদ নেন নাই, দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাই, কোনো রক্ষিতার নাম পাওয়া যায় না। জোড়াসাঁকোর বিপুল ব্যয়ের পুরোটার সংস্থান হতো তার আয় থেকে, ছেলেরা কেউ কখনো কোনো জীবিকা সংস্থান করে নাই। ইংরেজ সব ব্যবাসায়ীক বন্ধুকে ডেকে নতুন বাড়ি এবং বেলগাছিয়াতে বিপুলভাবে আপ্যায়ন করতেন। জানতেন যে পুরোহিতদের টাকা দিয়ে, দেবোত্তর সম্পত্তি দিয়ে ফতোয়া নিজের দিকে ফেরানো যায়। কিন্তু কাজে ও বিশ্বাসে সংস্কারবাদী রাজা রাম মোহনের এ বন্ধুটি সেদিকে যান নাই। শিল্প বিপ্লব যুগের আপাদমস্তক পুঁজিবাদী, পাশাপাশি সংস্কার সচেতন এবং প্রয়োগে বিশ্বাসী দ্বারকানাথ পুরোপুরি ডুবে ছিলেন টাকা দিয়ে টাকা বানানোর খেলায়।
তবে সামন্তবাদী সে সময়ে, যখন কৃষি-পণ্য একমাত্র পূঁজির উৎস, তার বিকাশ তত সহজ ছিলো না। তার ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে টেক্কা মেরে দ্বারকানাথকে পূজির বিকাশ করতে হয়েছিলো। চিরস্থায়ী বন্দবস্তের চোরাগলিতে একের পর এক জমিদার তখন রাতারাতি সর্বস্বান্ত হচ্ছে। দ্বারকানাথ সে সব ফোকর এত ভালো বুঝেছিলেন যে তরুণ বয়সে পেশাদার আইনি পরামর্শক হয়ে যান। তার ফন্দিফিকিরে আস্বস্ত কোম্পানি তাকে একের পর এক প্রকল্পে দেওয়ান, সেরেস্তা করতে থাকে।
তবে এই লোক কেরানী বাঙ্গালের জাত নন। ব্রজেন দাস যে শক্তি বুকে নিয়ে সাতরে চ্যানেল পার হয়েছিলেন, দ্বারকানাথের ডি,এন,এ সে শক্তিতে নির্জিত। অপমানিত কম হন নাই। সর্বভারতীয় সবচেয়ে বড় শিল্পপতি, বিলাতে রানি ভিক্টরিয়া, প্যারিসে রাজা লুই তাকে আতিথ্য দিয়েছে, এক চেকে সে কালে তার ব্যাঙ্ক এক কোটি টাকা ঋন দিতে পারে, কিন্তু ভারতীয় বলে বেঙ্গল ক্লাবের সদস্যপদ দেয়া হয় নাই। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া রেলওয়ের অংশিদারিত্ব চেয়েছিলেন, তাও ভারতীয় বলে ফেরানো হয়েছে। ধর্ম গৌরবে দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এই অপমানের উত্তর দিলেন না, শান্তি নিকেতনে দ্বারকানাথের নাম, নিশানা মুছে দিলেন।
![]() |
Dwarkamath Tagore by Henry Weekes. National Library, Calcutta. |
৩
আমার দেখায়, আজকে যে বিশ্ব ভারতী বিজেপি পন্থীদের খপ্পরে পড়েছে, এই যে কিছু দিন আগে সেখানে অমর্ত্য সেনের ওপর বক্তৃতা পন্ড হলো, তার বীজমন্ত্র দ্বারকানাথের উদার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দেবেন্দ্রনাথের মৌলবাদী যাপনের কট্টরতায় নিহিত, যাতে পরে রাবীন্দ্রিক-হৃস্বীকরণ যোগ হয়েছে।
যে অমর্ত্য সেন বিশ্বভারতীর পাঠশালায় পড়ে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন, তিনিও দ্বারকানাথ কিভাবে তার সময়ে জমিদার, শিল্পপতি থেকে ব্যাঙ্ক মালিক, পত্রিকা সম্পাদক হলেন, তার বিশদ জানলেন না। কিম্বা কথিত শুদ্ধতার আচ্ছাদনে জানতে দেয়া হলো না। লালনকে জানা যাবে, দ্বারকানাথকে নয়।
বিশ্বভারতী অনুমোদিত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত রবীন্দ্র জীবনীতে দ্বারকানাথ সংশ্লিষ্ট তথ্যাবলীকে ক্রস রেফারেন্সে আমার একেবারে অপদার্থ মনে হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথের ঈক্ষণ, বীক্ষণ, আরোপণ এরা তথ্য বলে চালিয়েছে।
দ্বারকানাথের ব্যাপারে এবং তার সাথে ছেলেদের সম্পর্কের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য হচ্ছে, দেবেন্দ্রনাথের নাতি ক্ষীতিন্দ্রনাথের লেখা জীবনি।
হেমেন্দ্রনাথের ছেলে ক্ষীতিন্দ্র এটি লেখেন ১৯০৮ সালে। রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুর পরিবারের কর্তারা বইটি প্রকাশে আপত্তি তোলে। পড়লে বোঝা যাবে সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছিলো ক্ষীতিন্দ্রের বাবা হেমেন্দ্রনাথ থেকে, জীবনাচরণে যিনি দেবেন্দ্রনাথের কার্বন-কপি।
ক্ষীতিন্দ্রনাথের চোখে দ্বারকানাথ হচ্ছেন যাপনের এবং জীবন ডাইনামিকসের কেন্দ্রছুট কারিগর, আর দেবেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথেরা যাকে তপস্যা, আধ্যাত্ম বলছেন, তা পুরুষতান্ত্রিক অলসতার অজুহাত।
দাদা দেবেন্দ্রনাথ ১৫ সন্তানের বিপুল সংসার, বাবা হেমেন্দ্রনাথ ১১ সন্তানের সংসারের বিত্ত, বৈভব সব চালিয়েছেন দ্বারকানাথের রেখে যাওয়া সম্পদে, জীবনে এক কানাকড়ি আয় করেন নাই। তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্রাক্ষ ধর্মের প্রচার, প্রসারও হয়েছে দ্বারকানাথের বৈভবে, কিন্তু তারা বিভিন্ন অজুহাতে দ্বারকানাথের নাম ঠাকুরবাড়ি থেকে লোপাট করে দেন এবং তার পক্ষে অনেক আজগুবি কাহিনী দাড় করান।
পাহাড়ে, পর্বতে যেখানেই তপস্যা করতে যান, দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন নিয়ন্ত্রণ বাতিক গ্রস্থ, বাত্যয় চলবে না। একবার এক অবিবাহিত নাতনি চাকুরী নিয়ে অন্য প্রদেশে যেতে চাইলে, দেবেন্দ্রনাথ আরোপ করেন যে সারা জীবন বিয়ে না করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেতে হবে, এবং যাবার আগে তার পৌরহিত্যে তলোয়ারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। অর্থাৎ সে নাতনিকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। ব্রাক্ষ, ফ্রাম্য ধর্ম যেটাই বলুন, প্রচার করুন না কেন, বেশ কিছু আচরণকে এক সুতোয় গেঁথে মনে হয়েছে, দ্বারকানাথের এই সন্তানটি রামমোহনদের সতীদাহ প্রথা বিলোপের বিরোধিতা করতেন।
বেশ কিছু উপাত্তে ক্ষীতিন্দ্র দ্বারকানাথ সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ এবং নিজের বাবা হেমেন্দ্রনাথের বয়ান খণ্ডন করেছেন। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়ে দেবেন্দ্রনাথের কার্বনকপি হেমেন্দ্রনাথ যে কি পরিমাণে রুষ্ঠ হয়েছিলেন, তা বইটির প্রকাশনার বিলম্ব বলে দেয়।
৪
দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের অনুসারীদের বয়ানে আমরা যে দ্বারকানাথকে পাচ্ছি, এবং যা আজকের ওয়াইকিপিডিয়াতেও গ্রাহ্য হয়েছে, তা হলো, উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকের ব্যবসায়িক মন্দা এবং নবলব্ধ আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন মিলে, তিনি বহু ব্যক্তি ও কোম্পানির কাছে ঋণী হয়ে পড়েন। এ ঋণের বোঝা তার মৃত্যু পর্যন্ত ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পরিণামে তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে পিতার ঋণের দায় বহন করতে হয় এবং গোটা পরিবারকে দায়মুক্ত করতে তার সারাজীবন কেটে যায়।
কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের নাতি ক্ষীতিন্দ্রনাথ, তার 'দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী' গ্রন্থে লিখেছিলেন একেবারে উল্টো কথা। ক্ষীতিন্দ্রনাথ এ জীবনী লেখেন ১৯০৮ সালে। ঠাকুর বাড়ির অভিভাবকদের আপত্তিতে বইটি তার এবং রবীন্দ্রনাথের জীবতকালে প্রকাশ পায় নাই। প্রথমবার প্রকাশ হয় ১৯৭০ সালে, যা থেকে বোঝা যায় ঋনভারের কাহিনীটি প্রায় ১০০ বছর ধরে ফুলিয়ে, ফাপিয়ে প্রচার করা হয়েছে। ক্ষীতিন্দ্রনাথ তার গ্রন্থে যা লিখেছিলেন তার চুম্বক অংশ এখানে দেয়া যাক,
‘’একটি বৃহৎ কারবার চালাইতে গেলে যে বুদ্ধি, যে দূরদর্শিতা এবং সর্বোপরি যে সংযম আবশ্যক, সত্যের অনুরোধে বলিতে বাধ্য যে দেবেন্দ্রনাথ প্রভৃতি তিন ভ্রাতার কেহই তাহা প্রাপ্ত হন নাই। পরিশ্রম করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া অর্থোপার্জ্জনের পক্ষে তাঁহারা তিন জনেই অসমর্থ ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হয় না।’’
“দ্বারকানাথ জীবিত থাকিতে ইহার দেনা সম্বন্ধে একটি কথাও উঠে নাই। বাস্তবিক দেবেন্দ্রনাথের লেখামত যদি ধরা যায় যে কারবারের দেনা এক কোটি ছিল এবং পাওনা সত্তর লক্ষ, অসংস্থান ত্রিশ লক্ষ। একটি বিস্তৃত চলতি কারবারে এই অসংস্থান যে অত্যান্ত ভয়াবহ ছিল তাহা তো বোধ হয় না। আরও দেখিতে হইবে যে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পূর্বেই বা কি দেনা ছিল এবং তাহার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যেই বা কি দেনা হইল। দেবেন্দ্রনাথ গীরিন্দ্রনাথের কথায় সায় দিয়া তাহাঁর হাতে কার্য্যভার সমর্পণ করিয়া ধর্ম্মবিষয়ক চিন্তায় মনোনিবেশ করিবার প্রচুর অবসর পাইয়াছিলেন, তাহাতেই আনন্দিত। এই কারবার রক্ষা করা, পৈতৃক বিষয় প্রাণপণে রক্ষা করা যে একটা বিশেষ ধর্ম্ম তাহা তাঁহার বুদ্ধিতে তখন প্রবেশ করে নাই। ঈশ্বরের কৃপায় তাঁহার পৈতৃক বিষয় যেন রক্ষা পাইয়া গেল, তাহা না হইলে, হাউসের দেনার দায়ে বিকিয়ে গেলে তাঁহার কি অবস্থা হইত? তিনি যে ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠাঢ় জন্য সমস্ত জীবন অতিবাহিত করিলেন, তাহার কি অবস্থা হইতো?.....নির্ঝঞ্জাটে প্রয়োজন মতো টাকাকড়ি জমিদারী হইতে আসুক, তাহা হইলেই দেবেন্দ্রনাথ সুখী।… তিনি তাঁহার পিতাকে খুব অল্পই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এ অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথ তাঁহার পিতার বিশ্বতোমুখী প্রতিভাকে যে আয়ত্ত করিতে পারেন নাই, তাহা কিছু আশ্চর্য নহে।’’
৫
আমার বিবিধ রবীন্দ্রনাথ একান্তই রবীন্দ্রপাঠ ঘিরে। ''আমার ওকাম্পোঃ রবীন্দ্রনাথ'কে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছে'' লিখেছিলাম,
'হাত বদল হতে হতে কারখানা থেকে পাইকারে বা মুদি ঘরে
কখনো বাসরে কখনো কবরে
ঠোট পোড়ানো শিতে ফাটা ঠোটের আশ্লেষে
ভালোবেসে নিজের দহন
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ আস্ফালন'
সে আস্ফালনের জিন-গদিটি রবীন্দ্রনাথের শিরা, উপশিরাতে এসেছিলো দ্বারকানাথের রক্তকণিকা থেকে।
চয়ন খায়রুল হাবিব
২১/০৮/২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স
'বিবিধ রবীন্দ্রনাথ' পাণ্ডুলিপির অংশ।