অশনিসংকেত, দুর্ভিক্ষ সিরিজ, আত্মজা ও একটি করবী গাছ
সত্যজিৎ, জয়নুল এবং হাসান আজিজুল হকপ্রাককথন
‘নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৫’এ আমি একটি থিমেটিক কিউরেটিং চিন্তা করছি, যাতে মিশ্রকলার জায়গা থেকে হাসান আজিজুল হক, সত্যজিৎ রায় এবং জয়নুল আবেদিনের কাজের আবহে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সময় পরিক্রমা উঠে আসে। একই ‘নন্দন বিশ্বমেলাতে’ যেরকম বেহুলা থিম কেন্দ্র করে ‘মঙ্গল কাব্য’, জহির রায়হান এবং জীবনানন্দ পাশাপাশি প্রদর্শিত হবে, এই ‘৪৩/৪৭’ থিমটিও তেমন।
‘৪৩/৪৭’ থিমটি সাজাবো সত্যজিতের ‘অশনিসংকেত’, জয়নুল আবেদিনের ‘দুর্ভিক্ষ সিরিজ’, হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ কেন্দ্র করে। এতে অংশ নিতে নিমন্ত্রণ জানাবো চিত্র নির্মাতা আকরাম খান, চিত্র শিল্পী মাহমুদুর রহমান দীপনকে। অন্যদেরও আমন্ত্রণ জানাবো, এক্ষণই হুট করে মনে পড়ছে না। ‘৪৩/৪৭’ কিউরেটিং থিম নিয়ে নিচের আলোচনাটা একান্ত ভাবে একাডেমিক নোটস, ফলে একটু প্রক্ষিপ্ত। প্রকাশ্যে প্রথম বারের মত নোটসগুলো আকরাম, দীপন এবং ‘নন্দন বিশ্বমেলার’ সমন্বয়কারী ডা. শাহনাজ পারভীনের সাথে শেয়ার করছি।
১৯৪৩এর মন্বন্তর, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি মানুষের জীবন, সমাজ এবং সংস্কৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। এর ফলে সৃষ্ট দুঃখ-যন্ত্রণা বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে উঠে এসেছে। জয়নুল আবেদিনের ‘দুর্ভিক্ষ সিরিজ’, সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনিসংকেত’ এবং হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ দেশভাগ এবং তার সাথে সম্পর্কিত মানবিক বিপর্যয়কে বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে।
অশনিসংকেত
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটি ১৯৪৩-এর মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রায় গ্রামীণ জীবনের সহজিয়া পরিবেশের বিপরীতে দুর্ভিক্ষের আগমনের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবের একটি নৃশংস চিত্র।
দুর্ভিক্ষ সিরিজ
জয়নুলের চিত্রকর্ম ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তরের ভয়াবহতাকে তুলে ধরে, যা দেশভাগের আগে ঔপনিবেশিক শাসনের নিদারুণ শোষণের ফলাফল। এসব চিত্র বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের ভয়াবহ দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ এবং মানুষের অসহায়ত্বের মূর্ত প্রতীক। দেশভাগ-উত্তর মানবিক সংকটের একটি পূর্বসূচনা হিসেবে এটি কাজ করে।
আত্মজা ও একটি করবী গাছ
দেশভাগ-উত্তর বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে উদ্বাস্তুদের দুঃখ-যন্ত্রণা এবং সামাজিক সংকটের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিফলন। গল্পটি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সংকটের সমন্বয়ে একটি গভীর মানবিক ব্যঞ্জনা তৈরি করে, যেখানে করবী গাছ প্রতীকীভাবে সমাজের নিষ্ঠুরতার চিত্র হয়ে ওঠে।
১৯৪৩, 'অশনিসংকেত', পটভূমি
১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে, গঙ্গাচরণ এবং অনঙ্গবালা একটি ছোট গ্রামে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে। গঙ্গাচরণ প্রাথমিকভাবে তার ব্রাহ্মণ্য মর্যাদা ধরে রাখতে চেষ্টা করে, কিন্তু ক্রমেই দুর্ভিক্ষ তার নৈতিকতা এবং সামাজিক অবস্থানকে নড়বড়ে করে তোলে। গ্রামবাসী ধীরে ধীরে জীবিকা ও সম্মান হারাতে থাকে। অনঙ্গবালা, তার নিজের ত্যাগ এবং সংগ্রামের মাধ্যমে, দুর্ভিক্ষের বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। গল্পটি একটি গ্রামীণ সমাজে দুর্ভিক্ষের বিধ্বংসী প্রভাব তুলে ধরে।
১৯৪৩,'দুর্ভিক্ষ সিরিজ'
১৯৪৩ সালের বাংলা দুর্ভিক্ষের সময় জয়নুল আবেদিন তার বিখ্যাত ‘দুর্ভিক্ষ সিরিজ’ আঁকেন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভয়াবহ এক সংকটকাল। বাংলায় দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়। দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকারের ‘মনোপলি বাইং’ নীতি, যা খাদ্য সংকট তৈরি করেছিলো।
এ চিত্রকর্মে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কঙ্কালসার দেহ, মায়ের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা, এবং মরতে বসা মানুষের কষ্টকর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। এটি একটি শোকের চিত্র যা সরাসরি এ সময়ের মানবিক বিপর্যয়কে চিত্রিত করে। স্কেচগুলো ছিল মূলত কালো কালিতে আঁকা, যা মানুষের কষ্ট এবং দুঃখকে বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তোলে।
১৯৪৭, দেশভাগ : আত্মজা ও করবী গাছ
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র "কেশো বুড়ো" নামে পরিচিত। তার পূর্ণ নাম "কেশব চন্দ্র।" যিনি দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তার কন্যা রুকু এবং তিনি চরম দারিদ্র্য ও সামাজিক অবহেলার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিন যুবক—ফেকু, সুহাস, এবং ইনাম—রুকুর প্রতি কু-দৃষ্টি নিয়ে তাদের বাড়িতে আসে। কেশো বুড়ো তাদেরকে প্রতিহত করতে না পেরে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন।
রুকু আসলে গল্পে এমন এক চরিত্র, যে তার নিজের ইচ্ছা বা চিন্তাধারার কোনো প্রকাশ ঘটাতে পারে না। সমাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে কেবল একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখে। তার বাবা তাকে রক্ষা করতে সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করলেও, তার দারিদ্র্য এবং সামাজিক অবস্থান তাকে ব্যর্থ করে দেয়।
গল্পের শেষে, রুকুর সুনির্দিষ্ট ভাগ্য বা পরিণতি সরাসরি বর্ণিত হয়নি, কিন্তু পরিস্থিতির ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। করবী গাছের বিষাক্ত বিচি দিয়ে কেশো বুড়ো নিজের জীবনের ইতি টানার কথা ভাবেন। এতে বোঝা যায় যে তিনি রুকুকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ইঙ্গিত পাঠকের মনে রুকুর ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শূন্যতা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
প্রভাব
জয়নুল আবেদিন এবং সত্যজিৎ রায় দুজনেই ব্রিটিশ-ভারতের প্রভাব অনুভব করেছিলেন। জয়নুলের ক্ষেত্রে এটি ছিল দমনমূলক ব্রিটিশ নীতির সরাসরি ফল। সত্যজিতের ক্ষেত্রে এটি ছিলো ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারতের দারিদ্র্য এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন।
হাসান আজিজুল হকের সময়কার পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) ছিলো পাকিস্তানি শাসনের নিপীড়নমুখী। তার সাহিত্য তৎকালীন শাসনব্যবস্থা এবং সামাজিক দমননীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
তিনজনের কাজেই নিপীড়িত মানুষদের গল্প বলার প্রবণতা দেখা যায়। তারা তাদের সময়ের ইতিহাসকে নিজেদের কাজের মাধ্যমে ধরে রেখেছে
প্রতীক, চিত্রায়ণ, দৃষ্টিকোণ
জয়নুল আবেদিন : চিত্রকর্মে লাইন এবং ছায়া-আলোর সাহায্যে মানব জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার ‘চিতা টানা কঙ্কালসার মানুষ’ মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক।
সত্যজিৎ রায় : ‘অশনিসংকেত’-এ প্রকৃতি, মাটি, এবং বৃষ্টিকে প্রতীকীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রামীণ জীবনের ধ্বংসকে সিনেমাটিক ভাষায় প্রকাশ করেছেন রায়।
হাসান আজিজুল হক : করবী গাছকে বিষাক্ততা, রুক্ষতা এবং রূপের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে গল্পের গভীর অর্থ তৈরি করেছেন। করবী গাছ গল্পে ব্যক্তির অবস্থা এবং সমাজের নিষ্ঠুরতাকে বোঝানোর একটি শক্তিশালী উপকরণ।
'অশনিসংকেত' একটি বৃহৎ ঐতিহাসিক দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত। 'আত্মজা' ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক শোষণের গল্প, যা তৎকালীন পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। 'অশনিসংকেত' সামাজিক এবং ঐতিহাসিক, 'আত্মজা' ব্যক্তিগত এবং প্রতীকী।
'অশনিসঙ্কেত' এবং 'আত্মজায়' যে অন্তরঙ্গ বিপর্জয়ের কথা বলা হয়েছে, জয়নুল 'দুর্ভিক্ষ সিরিজের' বহিরঙ্গে, তার ক্যানভাসে তাই তুলে ধরেছেন।
চয়ন খায়রুল হাবিব
৪/০১/২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স