Sunday 2 July 2023

ফ্রান্সের চিঠি ১ : নিসের অপরূপ নীল নগ্নতায়!

অরি মাতিস, নীল নগ্নতা।Henri Mattise, Blue Nudes।

প্রায় ৫ মাসের ওপর বাংলাদেশে কাটিয়ে এবার ফ্রান্সে ফেরার সময় প্যারিসের চার্লস দ্যাগল বিমান বন্দরে না নেমে, কুয়েত এয়ারওয়েজের প্লেনটি প্রথমে অবতরণ করলো দক্ষিণের সাগর ঘেঁষা নিস আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। সাগরের গা ঘেঁসে বিমান বন্দরটি য্যানো আরেকটি বিশাল পাল তোলা জাহাজ। 

প্লেনে ওঠা, নামার সময় জুন মাসের দুপুরে নিস শহরের আকাশে, বিমান বন্দর ঘেঁষা সাগরে দেখতে পেলাম ভুবন-রহস্যময় সেই গভীর নীল রঙ, যে নীল তাকে ছুঁতে দেয়, ধরতে দেয়। আমার দীর্ঘ কবিতা 'বাঙালির পরিচয় কাব্য' তালপাতার পুঁথি হিসেবে ঢাকার কেন্দ্রীয় জাদুঘরে সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী উপলক্ষে মেগা-নগরে কয়েক মাস তুমুলভাবে এপাশ-ওপাশ বিদ্ধস্ততার পর এই নীল অবগাহন হয়ে উঠলো আমার সুগভীর প্রোবায়োটিক সঞ্জীবন!

সাগর ছোঁয়া, পাহাড় ঘেরা নিস বিমান বন্দর।

 



গ্রীষ্ম কালে নিস বিমান বন্দরের ব্যস্ততা অনেক দেশের রাজধানীর বিমান বন্দরের ব্যস্ততাকে হার মানায়। ছড়ানো রানওয়েগুলোতে প্রতি মিনিটে কয়েকটা বিমান সূর্যপিপাসুদের নিয়ে উঠছে, নামছে।পুরোটা গ্রীষ্মকালে ফ্রান্স প্রত্যাগতদের প্রথমে প্যারিসে না এনে নিস এয়ারপোর্টে নিয়ে আসে কুয়েত এয়ার। এর কারণ হলো, কুয়েত সহ মধ্য-পাচ্যের ধনি দেশগুলোর বিপুল সঙ্খ্যক যাত্রী গ্রীষ্মে অবকাশ কাটাতে আসে নিস শহরে। আমার পাশের দুই সিটে এবং সামনের তিন সিটে বসা পাঁচ বোন যাচ্ছিলো নিসে। ওরা পাঁচ জন বালিকা, কিশোরী ও তরুণী, জন্ম কুয়েতে, গায়ের রং উজ্জ্বল তামাটে, সবার চুল সোনালী রঙে রাঙ্গানো, পরনে ঢিলেঢালা পশ্চিমি পোশাক।কুয়েত ছোট জায়গা, পরিচারকদের জ্যাষ্ঠজন দেখলাম ৫ বোনকেই চেনে। ঢাকা বিমান বন্দরের  হাড় জ্বালানো গরম এবং কুয়েত এয়ারের বাজে খাবারের বিষম অনেকটুকু কেটে গেলো কুয়েতি ললনাদের চাপা হাসির কলরোলে।

নীল ট্রেন রেস্তোরা, গ্যার দ্য লিওন, প্যারিস।
আমি নিজে নিস শহরে যাই নি। ছেলে মাতিস-জ্যোতি ১৬ হবার পর, ওর বড় বোন লন্ডন নিবাসী এলিস ঠিক করেছিলো ওরা দুজন নিস শহরে বেড়াবে। সে অনুযায়ী ২০২০সালের জুলাই মাসে মাতিসকে  প্যারিসের দক্ষিণগামী ট্রেন স্টেশান গার দ্যু লিয়নে গিয়ে নিস গামী ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। গার দ্যু লিয়নের সবচেয়ে দ্রষ্টব্য ব্যাপার হচ্ছে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত 'লে ট্রা ব্লু রেস্তোরা/নীল ট্রেন রেস্তোরা', যা একসাথে ধরে রেখেছে ফ্রান্সের রান্নাবান্নার ঐতিহ্য এবং দেয়াল, ছাদ জুড়ে জমকালো সব বারোক ম্যুরাল। রেস্তোরার নামাঙ্কনে ঐ নীল শব্দটা এসেছে নিসের সাগর ধোঁয়া মেঘদলের অপরূপ নীল থেকে।মাতিসকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে, বিশেষ অনুমতি নিয়ে স্টেশানের সেই নীল রেস্তোরা পুরোটা খুটিয়ে খুটিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছিলাম।

নীল নগ্নতা, ইভ ক্লা।
নিস থেকে ফিরে মাতিস শুনিয়েছিলো ফরাসি নভ্যু রিয়ালিজমের গুরু, নিসে জন্ম নেয়া শিল্পী ইভ ক্লার কথা। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে কান চলচ্চিত্র উৎসবে হার্ট এটাকে মারা যাবার আগে ইভ ক্লা বিশ্বের শিল্পাঙ্গনে নাম রেখে যাবার মত বিস্তর কাজ রেখে গেছে। এই ইভ ক্লা ছিলো নীল রঙের নেশাতে মাতোয়ারা, তার অনেক কাজ শুধুই একমাত্রিক নীল রঙে সম্পন্ন। নীলে বুদ ইভের আরেকটা অবদান হচ্ছে তার নিজের ধরনে একটা নীল বিশ্বকে উপহার দিয়ে যাওয়া, যার নাম, IKB/International Klein Blue/আন্তর্জাতিক ক্লা নীল!

পুত্র মাতিস নিস থেকে ফিরে আরো জানিয়েছিল ওর নামের মিতা কিম্বদন্তিতুল্য ফরাসি শিল্পী অরি মাতিসের নামে মিউজি মাতিস/মাতিস শিল্পশালাতে দেখা মাতিসের বিপুল শিল্পকর্মের কথা। ১৬ শতকের এক ভবনে নিস পুরসভা গড়ে তুলেছে মাতিস সংগ্রহশালা। 

মাতিস এই শহরে বসবাস করেছিল ১৯১৭ থেকে টানা ১৯৫৪সাল অবধি। ১৯৬৩তে সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন হবার পর মাতিস তার বিপুল সঙ্খ্যক কাজ এখানে দান করে, পরে তার বংশধরেরাও এর সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করে। পুরো জীবনব্যাপী মাতিস বিভিন্ন রঙকে খেলিয়েছে বিচিত্রভাবে। ১৯৪১সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হলে অস্ত্রোপচারের পর তার পক্ষে ক্যানভাসে রঙ চড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসময় দীর্ঘকাল শুয়ে শুয়ে মাতিস কাগজ কাচি দিয়ে কেটে কেটে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করতো, যা তার শিল্প জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় বলে এখন বিবেচিত হয়। এই কাটা-কাগজ বা কাট-আউটগুলোতে চড়া নীল রঙের ব্যাবহার লক্ষণীয়। ১৯৫৪ সালে মাতিসের মৃত্যু হয় ৮৪ বছর বয়সে নিস শহরের বাসায়। একই শহরে সিমিয়েজ কবরস্থানে প্রয়াত স্ত্রী আমেলি নোয়েলির পাঁশে তাকে সমাহিত করা হয়।

অরি মাতিস মিউজিয়াম, নিস।

নীল নিয়ে আমি নিজেও মেতেছি শাব্দিক, নান্দনিক খেলায়,

''নীল আশ্বস্ত হয় শুধুমাত্র অন্যান্য নীলে

নীল বদলে যায় আকাশচুম্বী বিদ্যুতের নীল

কাতর নীল পূর্ণিমা হেঁটে যায়

বাংলার রাজকীয় বাঘের থাবায়

ক্ষিপ্ত বৈশাখের বিক্ষিপ্ত মহামল্লারে

নীলে নীলে নীল নীল-পাহাড়ি মূর্ছনায়

আমার দেহঘড়ির চোদ্দতলায় চোদ্দ নীলের জালা

শিশু নীল সবসময় ঘুমোচ্ছে

নৌনীল ভালোবাসে সাগরে ডুবসাঁতার

তাহলে কোন নীল সবচেয়ে সত্যিকারের নীল

এর উত্তরে নীল রানার বয়ে আনে

মহানীল পদ্মসূত্রের  শ্লোক

যখন শেষবারের মতন থামে নীল হৃৎস্পন্দন

যখন ধনুর জাতক চিৎকার করে ওঠে : নির্বাণ নীল''

(রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ /২০০৭/চয়ন খায়রুল হাবিব)


পিকাসোও একটা দীর্ঘ অধ্যায় পার করেছে সব রকম ক্যানভাসে নীলের আবেশে। পিকাসোর সেই অধ্যায় কেন্দ্র করে নীলের আরেক নাম পিকাসো-ব্লু, যাকে মূর্ছনা না  বলে, বলা যাবে মেলাঙ্কোলিয়া। সে সময় পিকাসো অন্যান্য অনেক শিল্পীর মত প্যারিসের জেলখানাতে গিয়ে বন্দী মানুষদের ছবি একে রাখতো। আশ্চর্য লাগে যে আকাশের, সাগরের প্রতীকী মুক্ত-নীলের সাথে পিকাসো বিষণ্ণতাকেও নীলাবেশ দিয়েছিল। ইভ ক্লা, পিকাসোর নীল ভাবতে ভাবতে, ক্লান্ত চোখে নিস বিমান বন্দরে যখন আকাশ ও সাগরের নীল দেখছিলাম,  তখন নিরাপত্তা কর্মিরা তন্ন তন্ন করে যারা প্যারিসের দিকে চলে যাচ্ছে তাদের হাত ব্যাগগুলো খুলে দেখছিলো, আবার  পরিচ্ছন্নতা কর্মিদের কাজের তদারকিও করছিলো। যেখানে পর্যটকের ভিড়, সেখানে মাদকেরও প্রসার, আর এসব নিরাপত্তা কর্মিদের যোগসাজশেই ঘটে থাকে মাদক পাচার।


ভাবতে চাইছিলাম, নিসের যে অপূর্ব নীল, তা কি আমাদের বাইরে না কি ভেতরে? মার্কিন কবি এডগার এলান পো, ফরাসি কবি বোদলেয়ার, বাংলার কবি জীবনানন্দ সরাসরি 'নীল' শব্দটি ব্যাবহার না  করলেও সমুদ্র, আকাশ নিয়ে যেসব স্তবকগুলো আমাদের জন্য রেখে গেছে, তা কিন্তু নীলের প্রতি নৈবেদ্য!  এডগার এলান পোর 'টু হেলেন' কবিতার শুরুতে আছে,

'Helen, thy beauty is to me

Like those Nicean barks of yore

That gently, o'er a perfumed sea,

The weary, way-worn wanderer bore

To his own native shore.'

(To Helen/Edgar Alan Poe)

হঠাৎ করে মনে হয়, পো'র এই 'নিসিয়া' ফ্রান্সের দক্ষিণের এই নিস শহর। আদতে পো'র 'নিসিয়া' হচ্ছে তুরস্কের পশ্চিম উপকুলের এক প্রাচীন শহর। এডগার এলান পো তে আচ্ছন্ন জীবনানন্দ আত্তীকৃত ভঙ্গিতে লিখেছিলো,  

'হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন'

(বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ/১৯৩৫)


একই এডগার এলান পোতে আত্মহারা বোদলেয়ার লিখেছিলো,

'বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?

আমি ভালবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ...উঁচুতে…ঐ উঁচুতে...

আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।'

(আশ্চর্য মেঘদল/বোদলেয়ার/অনুবাদ, বুদ্ধদেব বসু)


এলান পো, বোদলেয়ার,  জীবনানন্দ তাদের কবিতাগুলোতে 'নীল' শব্দটা সরাসরি ব্যাবহার না  করলেও, উল্লেখিত  প্রত্যেক শব্দ ও চরণের ফাঁকে আমি একটা নীল সাকো দেখতে পাই। সেই নীল সাকো ধরে পো, বোদলেয়ার, জীবনানন্দ সম্পর্কিত হয় অরি মাতিস, ইভ ক্লা, পিকাসোর সাথে। সেই নীল সাকো ধরে  নিস, প্যারিস ঘুরে চলে আসি আটলান্টিক তীরে আমার নিবাসে ব্রিটানির কমলাভায়, যা অমর হয়ে আছে পল গগ্যার ক্যানভাসে। পলের সে কমলাভা নিয়ে হবে আরেক বেলা, আরেক পোস্টে!


চয়ন খায়রুল হাবিব 

২/০৭/২৩

ব্রিটানি, ফ্রান্স