Thursday 6 July 2023

ফ্রান্সের চিঠি ২ : সাম্প্রতিক রায়ট এবং দ্য গলের আদি-পাপ!

নন্তেয়ারে নাহেল মার্জুকের মৃত্যু কেন্দ্রীক দাঙ্গায় ধ্বংশপ্রাপ্ত যানবাহন 

প্রাককথন : ভলটেয়ার বনাম ওরিয়েন্টালিজম :

টানা কয়েক মাস বাংলাদেশে কাটিয়ে  এ-বছরের ২৪শে জুন দক্ষিণের নিস বিমানবন্দর ছুঁয়ে, প্যারিসের শার্ল দ্য গল ধরে পশ্চিম উপকুলে  চ্যানেল পারে ভ্যান শহরের ডেরাতে এসে পৌছাই ২৫শে জুন। নিস, প্যারিস, আমার ছোট্ট সাগর তীরের শহর, সবখানে গরম কালের অবকাশ-কালীন আমেজ। সে আমেজের রেশ ধরে ফ্রান্সের চিঠি ১ এর শিরোনাম দেই, 'নিসের অপরূপ নীল নগ্নতায়'। কয়েক দিন পর ২৭শে জুন পুলিশের গুলিতে নিহত নাহেল মার্জুকের নিহত হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যাপী যে ধংশাত্বক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে তার জন্য কেউ প্রস্তুত না থাকলেও, পর্যবেক্ষকেরা খুব একটা আশ্চর্য হয় নি।

প্যারিসের উপান্তে নন্তেয়ারে পুলিশের হাতে নাহেলের নিহত হবার কিছুক্ষন পর ফরাসি রাস্ট্রপতি ম্যাক্রো একে 'ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ' বলে অভিহিত করে এবং প্রতিবাদকারীদের ধ্বংশাত্মক দাঙ্গা থেকে বিরত থাকবার আহ্বান জানায়। সাম্প্রতিক দাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিলিওন ইউরোর চেয়ে বেশি।.১০ দিনের বেশি সময় ধরে চলা দাঙ্গায় ৭০০র বেশি প্রতিবাদকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পেনশন সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে মুখোমুখি পুলিশ ও আন্দোলনকারীগণ

কিছুদিন আগে বাংলাদেশে থাকাকালীন ফ্রান্সের পরিচিতদের থেকে পেনসন সংস্কার আন্দোলনের তীব্রতার খবর আমার কাছে নিয়মিত পৌঁছেছে । ছোট, বড় সব শহরে সর্বস্তরের জনগণের লাগাতার ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বিশেষ ডিক্রি জারি করে ফরাসি সরকার পেনশন সংস্কার বিল পাশ করিয়ে নেয়। সব শ্রেণীর, সব পেষার সংখ্যাগুরু ফরাসি নাগরিক জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐ পেনশন সংস্কারের বিরোধীতা করলেও সরকার যেভাবে জবরদস্তি তা আইনসিদ্ধ করে তাতে কোনো কোনো ইস্যুতে ফরাসি রাষ্ট্রের একচোখামির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যে ফরাসি রাষ্ট্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সাংবিধানিক সাম্যতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ডান ও বামপন্থী বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন আন্দোলন ও জনতার দাবির মুখেও পুলিশি আইনের যথেষ্ট সংস্কার করে নি।

বাংলাদেশে মিডিয়া পেনশন সংস্কারে ফরাসি জনগণের ব্যাপক আন্দোলনকে তেমনভাবে প্রচার না করলেও নাহেল মার্জুকের হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী দাঙ্গা বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। বাংলাদেশে  কিছুকাল আগে চা-বাগান কর্মিরা যখন একজোট হয়ে তাদের দৈনিক বেতন বাড়াবার আন্দোলন করেছিলো, তখনো অবশ্য কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে মিডিয়া হাউসগুলো সরকার এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করে। নাহেল মুসলিম হবার কারণে কি বাংলাদেশি মিডিয়ার এরকম তোড়জোড়? আদতে হয়তো তা নয়। নিজেদের দৈনন্দিনতায় বাংলাদেশিরা এতরকম পুলিশি হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়,  কোথাও কেউ দলবেঁধে এই দমন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, তাতে য্যানো নীরব একটি জনগোষ্ঠী অন্যের আয়নায় নিজের বিচূর্ণ প্রতিফলন দেখতে পায়। একই সেন্টিমেন্ট কাজ করেছে দূর এমেরিকাতে যখন কালো জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের হাতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। বিশ্ববাসীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশিরাও বলেছে, I Want To Breath! 

বাংলাদেশে ৫ মাস ধরে গ্রামে, নগরে মৌলবাদী জীবনযাপনের ব্যাপক সংক্রমণ এবং ফ্রান্সে ফিরে পুলিশি হত্যাকাণ্ড ঘিরে দাঙ্গা দেখে আমার মনে পড়ে যায় ভলটেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি : 

“যারা তোমাকে দিয়ে অযৌক্তিক কিছু বিশ্বাস করায়, তারা তোমাকে দিয়ে একইসাথে নৃশংস  কিছুও করায়।”

জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, বর্ণ ঘিরে যেসব বিশ্বাসকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অবশ্য পালনীয় করে তোলা হয় এবং শিশুদের ভেতর এসবের বীজ বপন করা হয়, তার দিকে ইঙ্গিত করেই ভলটেয়ার  ওপরের উক্তিটি করে। অযৌক্তিক ভাবে যেরকম, যুক্তি এবং কুযুক্তি দিয়েও মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। ইয়োরোপীয় রাজতন্ত্রগুলো খ্রিস্টীয় ভ্যাটিকানের সাথে মিলিয়ে নিজেদের ধর্মের অভিভাবক হিসেবে দেখাতে থাকে এবং প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে অধর্ম, অত্যাচারের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত তৈরি করে। বিভিন্ন অধ্যায়ে যখন জনতা রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তখন তা চার্চের প্রতিও নির্দিষ্ট ছিলো। আদিবাসী পর্যায় থেকে রাজতন্ত্র পেরিয়ে জাতীয়তাবাদের উন্মেষেও ধর্মের প্রভাব বজায় ছিলো এবং এখনো আছে। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, শৃঙ্খলার মিশেলে ইউরোপে তৈরি হয় ওরিয়েন্টালিজম, যার তাত্ত্বিক কাঠামো ইউরোপিয়ানদের নিজেদের মহান এবং বিজেতাদের হীন ভাবতে সহায়ক হয়ে ওঠে। দাশ-ব্যবসা এবং দাশদের ধর্মান্তর সব কিছুকে ওরিয়েন্টালিজম স্বাভাবিক ধর্মিও আচরণ বলে দেখাতে শুরু করে এবং এর থেকে ইয়োরোপের শাসক এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ সান্ত্বনা পেতে থাকে।

ফরাসি বিপ্লবের গভীরে যে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমের বীজ নিহিত,  ভ্যাটিকান সহ অপরাপর খ্রিস্টীয় চার্চ তাতে পেছনের দরজা দিয়ে ওরিয়েন্টালিজমকে ঢুকিয়ে দেয়। আরেকভাবে দেখলে মুসলিম মৌলবাদ, বৌদ্ধিক জাতীয়তাবাদ এবং বর্তমানের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ বিভিন্নভাবে একাডেমিক ওরিয়েন্টালিজম থেকে যুক্তি এবং অপযুক্তি ধার নিয়েছে।ফ্রান্স সাংবিধানিকভাবে এবং চেতনায় সেকুলার, এগালেটারিয়ান হলেও বিভিন্ন সামাজিক উপসর্গে এই ওরিয়েন্টালিজমের বিষ ফণা তুলে সমাজকে ছোবল মারতে আসে।শুধু মাত্র একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ যে বুঝে বাঃ নয়া বুঝে এই বৈষম্যমূলক ওরিয়েন্টালিজম প্রয়োগ করছে তাই নয়। দেখা যাবে একজন অশ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান বাঃ এশিয়ান তার নিজের দেশেও এই বৈষম্যমূলক আচরণ করছে এবং তার পক্ষে এমন কি মিথ্যাচার করতেও প্রস্তুত আছে। এটা অনেকটা নব্য ধর্মান্তরির বাড়াবাড়ি গোঁড়ামির মত, যতটা সে করছে বিশ্বাস থেকে, তার চেয়ে বেশি করছে লোক দেখাতে। এই গোঁড়ামি, লোক দেখানো বাড়াবাড়িগুলো রুখতে ফরাসি সংবিধানে একের পর এক অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, কিন্তু আদি-পাপের ফণাগুলো বিভিন্ন আদলে, বিশেষ করে আইন রক্ষার ছদ্মবেশে সমাজকে দংশাচ্ছে!

আলজিয়ার্সে স্বাধীনতাকামী জনতার মুখোমুখি ফরাসি সাঁজোয়া বাহিনী

দ্য গলের আদি-পাপ : 

আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফরাসি রাষ্ট্র যে পুলিশ বাহিনীকে স্বাধীনতা আন্দোলন বর্বরভাবে দমনের জন্য ব্যাবহার করেছিল, মিত্রশক্তি জার্মানির দখল থেকে ফ্রান্স মুক্ত করবার পর, ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীর প্রধান এবং পরে রাষ্ট্রপতি দ্যাগল, সেই উপনিবেশিক পুলিশ বাহিনীকে আলজেরিয়া থেকে এনে ফ্রান্সে পুনর্বাসিত করে। আলজেরিয়া প্রত্যাগত পুলিশ বাহিনীর নেতারা সে সময় থেকে আজ অবধি ফরাসি উগ্র ডান রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে আসছে, যার উত্তরাধিকার হিসেবে এমন কি আজকের উত্তর আধুনিক ফ্রান্সের প্রধান পুলিশ ইউনিয়নগুলো যে কোনো নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোকে সমর্থন করে, যা প্রকারান্তরে মধ্য ডান ও মধ্য বাম উদারনৈতিক দলগুলোকে পুলিশি আইন সংস্কারে রক্ষণাত্মক, আপোষমূলক অবস্থানে নিয়ে আসে।

আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে এবং সেখানে ফরাসি শাসকদের, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর দমন, নিপীড়নের বিপক্ষে ফরাসি মূল ভূখণ্ডে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছিল। এসময় রাজধানীসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সরকার বিরোধী মিছিলে ছাত্রদের পাঁশে শিক্ষকেরাও শরিক হয়। এসব ক্যাম্পাস মিছিল পরে বিভিন্ন পেশাজীবীদের অংশগ্রহণে রাজপথের আন্দোলনে গড়ায়। এরকম একটি মিছিল থেকে প্যারিসের পুলিশ তখনকার খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী জা পল সারত্রেকে গ্রেফতার করে। সে সংবাদ শুনে রাষ্ট্রপতি দ্য গল পুলিশ সদর দফতরে ফোন করে বলে যে, 'ভলটেয়ারকে ফরাসি রাষ্ট্র গ্রেফতার করতে পারে না।'

ওপরে দ্য গলের উক্তি থেকে ফরাসি শাসক গোষ্ঠীর স্ববিরোধ বোঝা যায়। একদিকে তারা ফরাসি বিপ্লব থেকে আসা ভলটেয়ার, ভিক্টর হুগোদের সমবাদী, প্রতিবাদী ধারাকে ধারণ করতে চাইছে, আরেক দিকে তারা ধর্মিও শক্তি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতর সংগুপ্ত জাতিবিদ্বেষপ্রসুত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে টিকে থাকতে দিচ্ছে। পরে দ্য গলের নির্বাচনে পরাজয় থেকে বোঝা যায় যে তার এই স্ববিরোধী সামাজিক আপোষ জনতা প্রত্যাখ্যান করেছিল।

জার্মান দখলমুক্ত প্যারিসে বিজয়োৎসব
ইয়োরোপীয় অন্যান্য ফ্যাসিবাদী প্রবর্তনার মত ফরাসি উগ্র ডানও দাঁড়িয়ে আছে জাতিগত বর্ণবাদের ওপর। আলজেরিয়া প্রত্যাগত অনেক ফরাসি সৈনিক বামপন্থী ধারায় সক্রিয় হলেও সেখানকার পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। আলজেরিয়া সহ মাঘরেবের অন্যান্য অঞ্চলে উপনিবেশিক ফরাসি পুলিশের মূল বিবেচনা ছিলো সাম্রাজ্য রক্ষা, নাগরিকের সুরক্ষা সেখানে অগ্রাধিকারপায় নি।আবার নাগরিকত্বের বেলায় উপনিবেশে স্থানীয়দের দ্বিতীয় শ্রেণীতে নামিয়ে আনা হয়েছে, যেখানে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবার বদলে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়ে উঠেছিল পুলিশের মূল দায়িত্ব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান ফ্যাসিবাদের সহচর ফরাসি ভিশি সরকার এই নিয়ন্ত্রণমূলক পুলিশি ভূমিকা বজায় রাখে এবং ইহুদি নিধনে হিটলারের আয়োজনে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে আলজেরিয়াতে স্থানীয় মুসলিম নাগরিকেরা হয়ে ওঠে  ফরাসি পুলিশের ইহুদি সম্পূরক।ফ্যাসিবাদী শক্তির সামরিক পরাজয় এবং মিত্রশক্তির জয়ের মুখে জাতি, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে সাম্যতার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে এবং তার ফলশ্রুতিতে জেনেভা সনদে মানবাধিকারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিশেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। স্বীকৃতি আর অনুশীলন এক ব্যাপার নয়। যে পুলিশ বাহিনী আলজেরিয়াতে স্থানীয়দের সাথে চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, বিশ্বযুদ্ধ এবং আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পর সেখান থেকে প্রত্যাগত পুলিশ যে বিভিন্ন অজুহাতে একই আচরণ চালিয়ে যাবে তা লেখা বাহুল্য।সে সময়ের পুলিশ নেতারা তাদের আচরণকে পুরোপুরি মৌলবাদী ধার্মিক জঙ্গিবাদের পর্যায়ে নিয়ে এসে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন উগ্র জাতিবিদ্বেষ তত্ব ছড়াতে থাকে, যাতে এই আজকের পুলিশ বাহিনীও সংক্রমিত।

দ্য গলের হাতে ছিলো বিশ্বযুদ্ধত্তোর ফ্রান্স নবায়নের চাবিকাঠি। কিন্তু তখন ফ্রান্স জাতিগত বিদ্বেষের বিষবাস্পে এক আবদ্ধ পরিস্থিতিতে পৌছেছে। দখলদার জার্মান ফ্যাসিবাদের সহচর হিশেবে ফ্রান্সের ভিশি সরকার সব ধরনের জাতিবিদ্বেষি আচরণ করে এসেছে। একদিকে যেরকম সেই দখলদার এবং তাদের সহচরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরে গন প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, আরেক দিকে জনগণের একাংশ এই সরকারকে সমর্থন করেছে, যার ভেতর শিক্ষক, আমলা, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ, চিকিৎসক, উকিল, মেয়র, কৃষক সব স্তরের পেশাজীবীরা জড়িত ছিলো। দ্যাগল যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন অর্ধেক ফরাসি জনতা ফ্যাসিবাদী জার্মানির দখলদারির দোষে অপরাধী। পল ক্লোদেলসহ অনেক খ্যাতিমান কবি, লেখক জার্মান সহযোগী ফরাসি সরকারের একেবারে শেষ অবধি কাজ কওরে এসেছিলো। সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন এক জিনিস, আর উপনিবেশি পুলিশের পুনর্বাসন আরেক জিনিস। দ্য গলের সে সময়ের অদূরদর্শী ভুলের মাশুল এখনো দিয়ে যাচ্ছে ফরাসি জনগণ।

স্বাধীনতা নামের রমণী জনতাকে বিপ্লবের পথ দেখাচ্ছে।
ইউজিন দেলাক্রোয়া, ১৮৩০।
 বিপ্লবের স্ববিরোধ : কুর্বে ও প্রদোর কথোপকথন : 

গত এক যুগ ধরে, বিভিন্ন সময় ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া দাঙ্গাগুলোর আলোকে আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে,  সক্রিয়ভাবে মৃত্যদন্ড বিরোধী একটি রাষ্ট্রে বার বার আইনরক্ষি বাহিনীর হাতে নাগরিকের প্রাণনাশ হচ্ছে কেনো?

সম্প্রতি প্যারিসের প্রান্তে পুলিশের গুলিতে তরুণ নেহাল মার্জুকের মৃত্যু এবং তার পরের ব্যাপক দাঙ্গা সারা বিশ্বের মিডিয়াতে দেখানো হয়েছে। এটি এবং আগের কয়েকটি দাঙ্গার পর্যালোচনার আগে, ফরাসি বিপ্লব থেকে আজকের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী ফরাসি গণতন্ত্রের যাত্রাপথের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিচে করা যাক।  ক্ষুধার্ত জনতার রুটির দাবিতে ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত, নেহাল মার্জুক যে মার্সেডেজ বেঞ্জ গাড়িটি চালচ্ছিলো, তা কিনতে বর্তমান ফ্রান্সেও উঁচু আয়ের দরকার!

১৭৯৯ থেকে ১৭৮৯ পর্যন্ত ১০ বছর ধরে চলমান ফরাসি বিপ্লবের শুরু হয়েছিল বাস্তিল কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্ত করে এবং শেষ অধ্যায়ে রাজা লুইয়ের শিরোচ্ছেদ ও ফরাসি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে, যে সংবিধানের প্রধান স্তম্ভগুলো এখনো অটুট আছে। ফরাসি বিপ্লব ছিলো ব্যাপক ভুখা, মজলুমের সাথে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র, অভিজাত শাসক শ্রেণী এবং তার এজেন্ট সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। এই স্থায়ী পরিবর্তন সূচক গন-বিপ্লব যখন শোধবোধ, বদলা নেবার উগ্র নৃশংসতায় সব পক্ষে সংক্রমিত হয়, তখন বিপ্লবী ও রাজতন্ত্র বিরোধী উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের ভেতর এক সমঝোতা হয় যা  এখনো ফরাসি সমাজে মধ্য ডান ও মধ্য বামের ভেতর ভারসাম্য বজায় রেখেছে। ফ্রান্সে বামপন্থা এবং উদারনৈতিক, ডানপন্থী বুর্জোয়াজির সীমাসরহদ্দ বুঝতে প্রথম এনার্কিস্ট প্রদো এবং বাস্তববাদী চিত্রকর গুস্তাভ কুর্বের নিচের কথোপকথনটি প্রণিধানযোগ্য। কুর্বের এক প্রদর্শনীতে বিশাল এক ক্যানভাসে, গরমকালের হ্রদের ধারে স্নানরতা নগ্ন কয়েকজন নারীর দিকে তাকিয়ে প্রদো বলে উঠলো,

বন্ধু : তুমি সবসময় বুর্জোয়া মোটা মহিলাদের আঁকো কেনো?

কুর্বে : ভালো করে দ্যাখো।

প্রদো : তা দেখলাম, কিন্তু প্রশ্নটা জারি থাকছে।বুর্জোয়া মোটা মহিলাদের দিকে তোমার এতো টান কেনো?

কুর্বে : পায়ের দিকে তাকাও

প্রদো : হ্যাঁ, বেশ ভারি ভারি উরু।

কুর্বে : কাছাকাছি গিয়ে প্যাঁ গুলো আরো খুটিয়ে দ্যাখো।

প্রদো : আচ্ছা আরো কাছে যাচ্ছি।হ্যাঁ, দেখলাম সব খানেই বেশ পুরুষ্ঠ, ভারি।

কুর্বে : পায়ে ময়লার দাগ দেখতে পাচ্ছো না ?

প্রদো : আরে জ্বালা, খালি পায়ে হ্রদের ধারে পায়ে ময়লা লাগবে না?

কুর্বে : বুর্জোয়া নারীদের পায়ে ময়লা লাগে, ময়লা হয়ও, কিন্তু ময়লা দাগ থাকে না।

এদের সবার পায়ে গোড়ালিতে ময়লার দাগ।

প্রদো : আরে তাইতো, আরে তাইতো।বেশ গাড়ো ময়লা দাগ সবার গোড়ালিতে!

তাহলে ওরা বুর্জোয়া মোটা মহিলা নয়?

জেনারেল নেপোলিয়ন এই ভারসাম্যকে হাইজ্যাক করে নিজেকে সম্রাট এবং বিল্পবের বরপুত্র ঘোষণা করে। নেপোলিয়ন ও তার অনুসারীরা বিপ্লব রফতানির নামে স্পেনে কায়েম করে এক নৃশংস এবং দখলদারি, রাশিয়াতে চালায় ধংশাত্বক সেনা অভিযান। ইয়োরোপের সম্মিলিত শক্তির হাতে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়ে বন্দী হলে, ফ্রান্সে আবারো সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। বিপ্লবের আগে ভলটেয়ারের লেখা থেকে বিপ্লব পরবর্তী ভিক্টর হুগো এবং তাদের সমকালীনদের লেখা থেকে ফরাসি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভেতর সাম্যবাদের প্রতি সক্রিয় সমর্থন দেখা যাবে।

ফরাসি বাস্তবতাবাদের গুরু চিত্রকর গুস্তাভ কুর্বেকে দেখা যাবে, প্রথম নিজেকে এনার্কিস্ট ঘোষণাকারী পিয়ের প্রদোকে Pierre-Joseph Proudhon অনুসরণ করতে। বিখ্যাত চিত্রকর পল গগ্যার নানি ফ্লোরেত ত্রিস্তানকে দেখা যাবে ক্যারিবিয়ানে, লন্ডনে শ্রমিক পাড়াগুলোতে সমবাদী ইস্তাহার বিলি করতে।গোঁড়া থেকে ফরাসি সাম্যবাদের ভেতর উপ্ত ছিলো ব্যক্তিক অভিব্যক্তির প্রতি সমর্থন এবং তার পক্ষে সক্রিয় প্রচারণা।ফরাসি উপনিবেশবাদ থেকে যে ওরিয়েন্টালিজম বা সুপ্রিমেসি ধারনা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ফরাসি কায়েমি স্বার্থবাদি গোষ্ঠী ফ্যাসিবাদী জার্মানির সাথে আপোষ করে ফ্রান্সকে উপনিবেশে পরিণত করা ছিলো ফরাসি বিপ্লবের প্রবর্তনা বিরোধী।প্রদো, ভিক্টর হুগো, ফ্লোরেত ত্রিস্তান, জা পল সার্ত্রে, সিমন দ্যা ব্যুভোয়া ইতিহাসের বিভিন্ন মোড়ে যে সমবাদী রাজনীতিকে সমর্থন করেছে, তার সাথে রাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নিয়ম কানুন মেলেনা। ফরাসি সাম্যবাদে মানুষের মানবিক দোষত্রুটিসহ তার বাক স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তত্বের ওপরে, যা পরে এবং বর্তমানে ইয়োরোপীয় রাজনৈতিক অঞ্চল বা ইইসিকে মৃত্যুদণ্ড বিরোধী অঞ্চলে রূপান্তরিত করেছে।

নাহেল মার্জুকের হত্যাকারী পুলিশ এবং চার্লি হেবদোর সাংবাদিক বাঃ শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির হত্যাকারীদের ভেতর কোনো পার্থক্য করা যাবে কি? এই তিন হত্যাকাণ্ডেই মূল কারণ হচ্ছে, একজনের আচরণ বা অভিব্যক্তি আরেকজনের ভালো লাগে নি, সুতরাং অপছন্দনিয়ের প্রাণনাশ করা যাবে,  এধরনের মনোভাব। এধরনের উগ্র, সহিংস মনোভাব উস্কে দেবার জন্য ধার্মিক, রাজনৈতিক সংগঠনের অভাব নেই এবং তাদের সভ্যরা বিভিন্ন লেবাসে পূর্ব, পশ্চিমে বিরাজ করছে। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে বিহারিদের সাথে যেরকম অন্যায্য আচরণ চলছে, বর্মা এবং বাংলাদেশ মিলে রোহিঙ্গাদের যে ঘেঁটো জীবনে বাধ্য করেছে, ভারতে সরকারি সমর্থনে যে রকম মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা ঘটানো হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর ঢাকা থেকে যেভাবে রাতারাতি বিপুল সঙ্খ্যক আর্মেনীয় উধাও হয়ে গেছিলো, ফ্রান্সে মুসলিম জনগোষ্ঠীর কোনো কোনো অংশের সাথে সরকারি বাহিনীর সংঘাত তার সাথে কিছুটা মিলবে, আবার পুরোপুরি মিলবে না।

হায় ছায়াবৃতা  :

ফ্রান্সে মুসলিম অধিবাসীদের যে বড় বড় ডিয়াস্পোরাগুলো আছে তারা মূলত আফ্রিকার মাঘরেব অঞ্চল অর্থাৎ আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো থেকে আগত, এই অঞ্চলসহ আফ্রিকার ব্যাপক অংসে ফ্রান্স অন্যান্য ইয়োরোপীয় শক্তির সাথে মিলে উপনিবেশ কায়েম করেছিলো এবং দাস ব্যবসাসহ আরো সব চূড়ান্ত মানবতা-বিরোধী এক তরফা আর্থিক  কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলো।যে ফ্রান্স ব্রিটিশ বিরোধী মার্কিন স্বাধীনতাকামীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল, সেই একই ফ্রান্স একই সময় আফ্রিকাতে চালিয়েছিল অত্যাচারের স্টিম রোলার।সুদূর ভারতে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিল,

'হায় ছায়াবৃতা,

কালো ঘোমটার নিচে

অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ

উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।

এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে

নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,

এল মানুষ-ধরার দল,

গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।

সভ্যের বর্বর লোভ

নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।''

(আফ্রিকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/১৩৪৩ বঙ্গাব্দ)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন ফ্যাসিবাদী জার্মান দখলদারদের বিরুদ্ধে ফরাসি জনগণের একাংশ প্রতিরোধ যুদ্ধ করছে, তখন আরেক অংশ জার্মানির হাতে তুলে দিয়েছে আফ্রিকার ভাগ্য। মিত্র শক্তির সহায়তায় দ্যাগল যখন ফ্রান্সকে জার্মান দখলদারি থেকে মুক্ত করলো এবং পরে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলো, তখন তার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিলো আলজেরিয়াসহ অন্যান্য মাঘরেব দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেয়া। কিন্তু দ্যাগল সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা নয়া করে আগের মত উপনিবেশিক, বৈশম্যবাদি শাসন চালু রাখতে চেয়েছিলো এবং তা কায়েম করতে পুরো মাঘরেবজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড়, গণহত্যা চালায় ফরাসি বাহিনী। এসময় আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপুল পরিমাণ আলজেরিয় শরণার্থী ফ্রান্সে মূল ভূখণ্ডে এসে আশ্রয় নেয়। এদের ভেতর শ্বেতাঙ্গ, অশ্বেতাঙ্গ সবাই কয়েক প্রজন্ম ধরে আলজেরিয়াতে বসবাস কওরে আসছিলো।

কমব্যাট পত্রিকা, ১৯৪১-১৯৭৪।
আলবেয়ার কামু সম্পাদক, ১৯৪৩-১৯৪৭

নোবেল জয়ী ফরাসি উপন্যাসিক আলবেয়ার কামুর জন্ম আলজেরিয়াতে এরকম একটি দরিদ্র ফরাসি পরিবারে। কামুর মতো অনেকে ফ্রান্সে এসে যেভাবে নিজদের নতুন জীবন গড়ে নিতে পেরেছিলো, বিপুল সঙ্খ্যক আরব বংশোদ্ভূত আলজেরিয় শরণার্থীর পক্ষে তা সম্ভব হয় নি। ফরাসি মূল সমাজের একাংশ এদের প্রটি সহানুভূতিশীল হলেও, অন্য একটি অংশ, বিশেষ করে দক্ষিনপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা এদের প্রটি কখনো সহানুভূতি দেখায় নি।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফরাসি মূলধারার রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক দল শক্তিশালী হওয়া শুরু করলে মধ্য ডান, মধ্য বাম দুদিকেই সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে  সামাজিক অগ্রাধিকার দেবার বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয় এবং এ লক্ষ্যে বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে প্রায়োগিকভাবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হতে থাকে। কাগজ, কলমের নিতি থেকে মাঠ পর্যায়ের বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও সামাজিক সম্পর্কের দিক থেকে মূল ধারার সাথে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক এখনো সহজ হয়ে ওঠে নি। এখানে নিচে বানলিউ কালচারটি ব্যাখ্যা করলে এই অসহজ সম্পর্কটি বোঝা যাবে।

প্যারিসের প্রান্তে একটি বানলিউতে শিশুরা।

বানলিউ সংস্কৃতি :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসের বিভিন্ন প্রান্তে  বিভিন্ন স্বনির্ভর উপ-শহর গড়ে তোলা হয় সরকারি আবাসন প্রকল্পের অধীনে। এগুলোকে বলা হয় বানলিউ। এসব বানলিউতে আশ্রয় দেয়া হয় ফ্রান্সেরউপনিবেশ থেকে আগত শরণার্থীদের এবং অল্প আয়ের মানুষদের। একই সাথে এসব বানলিউতে আশেপাশের বিভিন্ন সেবা মাধ্যমে কর্মরত লোকজনকেও আবাসন দেয়া হয়। একই বানলিউ ভবনে দেখা যাবে একই স্কুলের শিক্ষক এবং পরিচ্ছন্ন কর্মি সেখানে বসবাস করছে।অনেকেই উঁচু আয়ের সুযোগ তৈরি করে বানলিউ থেকে অন্য এলাকায় চলে যায়। কিন্তু সর্বোপরি বানলিউগুলোতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষার হার কম। আবার ফরাসি বিভিন্ন ধরনের নিয়োগে অঘোষিত বর্ণবাদ বিরাজ করায় বানলিয়ুগুলোতে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান তুলনামূলকভাবে কম। যেখানে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান কম, সেখানে অনানুষ্ঠানিক বা বেআইনি কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। এই ফোকর গলে বানলিউগুলোতে একদিকে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটেছে, আরেক দিকে মাদক ব্যবসার থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুনাফা-বাজের সংখ্যাও বেড়েছে, যাদের ভেতর অনেকেই তরুণ বা কিশোর।

২০০৫ এ প্যারিসের বানলিউগুলো ঘিরে তিন সপ্তাহ ব্যাপী ব্যাপক দাঙ্গাবাজির পর, এসব অঞ্চলে শিক্ষা ও উন্নয়নে কয়েক দফা বিনিয়োগ বাড়ানো হয়, যার ফলশ্রুতিতে অঞ্চলগুলোতে স্নাতকের সংখ্যা এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নিয়োগ বাড়ে। ২০০৫ এর দাঙ্গার সূত্রপাতও ঘটেছিল পুলিশের ধাওয়া থেকে বাচতে দুই কিশোরের পাওয়ার হাউসে আশ্রয় নেয়া এবং সেখানে বিদ্যুতস্পৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর পর।  ২০০৫, ২০২৩ এর দাঙ্গা ঘটেছে পুলিশি অত্যাচার থেকে।  আবার ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে চার্লি হেবদো হত্যাকাণ্ড, বাটাক্লান গণহত্যা কোনো পুলিশি কারণে ঘটেনি, ঘটেছে উগ্র বিশ্বাস-কেন্দ্রিক অসহনশীলতা থেকে।

মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলো যেসব অঞ্চল থেকে এসেছে, সেখানে কোথাও রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের অধিকারমূলক সম্পর্ক দেখা যায় না, গণতন্ত্র সেসব অঞ্চলে নির্বাচন স্বত্বেও স্বৈরতন্ত্রে গড়ায়।আবার মুসলিম পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামোর সাথেও ফরাসি মূল ধারার মেলে না। দেখা যাবে মুসলিম দেশগুলোর ভিন্নমতাবলম্বীদের অনেক কে পশ্চিমি দেশে আশ্রয় নিতে। এদের সাথেও এরই ভেতর কয়েক প্রজন্ম ধরে পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মিও আচার পালনকারীদের একই ভাষাভাষী হওয়া স্বত্বেও একটা সাংস্কৃতিক বিরোধ থাকে, যে বিরোধ ফ্রান্সে আমদানি করা হয়েছে ছেড়ে আসা দেশগুলো থেকে। ফ্রান্স যখন তার সমবাদী/এগালেটারিয়ান প্রবর্তনা থেকে সরকারি স্কুলে কোনো ধরনের ধর্মিও পোশাক নিষিদ্ধ করলো, তখনো মুসলিম অনেক সঙ্ঘের সাথে মূল সমাজের বিরোধ বাঁধলো। সেসব সঙ্ঘ খেয়াল করতে রাজি হলো না যে সংখ্যাগুরুর খ্রিস্টান পোশাক, প্রতীকও সরকারি স্কুলে নিষেধ করা হয়েছে। সাগর সৈকতে কথিত বুর্কিনি নিষিদ্ধ নিয়েও অনেক হল্লাচিল্লা হয়েছে।হল্লাচিল্লা এক কথা, আর হত্যাকাণ্ড আরেক কথা।

শেষ কথা বলে কিছু নেই :

একদিকে য্যামন ফরাসি মূল সমাজের বিভিন্ন অংশ ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে বাক স্বাধীনতা নিয়ে জোরালো আন্দোলন করে এসেছে, আরেক দিকে সমাজের এক ব্যাপক অংশ এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পুলিশকে একের পর এক  কালো আইন হাতে তুলে দিয়েছে এবং তাদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। 

ফরাসি সমাজতান্ত্রিক নেতা ফ্রাসোয়া হল্যান্ড তার রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে এরকম অনেকগুলো আইন পাশ করিয়েছিল। বিপুল ভোটে জেতা হল্যান্ডকে বলা যায় ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গণ-প্রত্যাখ্যাত রাষ্ট্রপতি। সে যেই দক্ষিনপন্থী সার্কোজির বিরুদ্ধে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিল, কার্যত সেই সার্কোজির অপনিতিগুলোকেই আইন হিশেবে পাশ করিয়েছিল। ২০০৫ পুলিশের ধাওয়াতে দুই কিশোরের মৃত্যু হলে এই সার্কোজি ঢালাওভাবে বানলিউগুলোকে চোর, ডাকাতের আড্ডা বলে অভিহিত করেছিল।

একেকটা দাঙ্গা বাধে, আর দক্ষিনপন্থীরা তার জন্য ঢালাওভাবে অভিবাসীদের দায়ী করে।অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিশোদগার করা এখন ইউরোপীয় রাজনীতিতে দক্ষিনপন্থীদের মূল হাতিয়ার। এই বিশোদগারে ইংল্যান্ডে যেরকম প্রিতি পাটেল জাতীয় অভিবাসীদের ছেলেমেয়েরা ইন্ধন যোগায়, ফ্রান্সে গত নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী এরিখ জিমুর ইহুদি হওয়া স্বত্বেও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ফ্যাশিস্ট মন্তব্য করা শুরু করে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নিরন্তর বিশোদগার করা হলে যে তাদের সন্তানেরা রক্ষণাত্মক হীনমন্যতায় ভুগবে তা লেখা বাহুল্য। তখন এই অভিবাসীদের পরের প্রজন্ম স্বাগতিক অধিবাসীদের দেখানোর জন্য আরো বেশী করে অন্য কোনো অভিবাসী গোষ্ঠী কেন্দ্র করে বিশোদগার করবে। দীর্ঘকাল বিলাতে বসবাসের সময় আমি কিছুদিন ম্যানচেস্টারে ছিলাম।সেখানে আমি আমার এক বাংলাদেশি বন্ধুকে দেখেছি প্রায়শ পূর্ব ইউরোপীয়দের নিয়ে বিশোদগার করছে। এধরনের মনোভাবই প্রিতি প্যাতেলদের শক্তিশালী করেছে এবং প্রকারান্তরে ব্রেক্সিট ঘটিয়েছে।

ধর্মিও জঙ্গিবাদীদের হাতে হত্যা, পুলিশের হাতে হত্যা দুটাই বিদ্বেষজনিত হত্যা। ঘৃণা, বিদ্বেষ থেকে বেরিয়ে সাম্যতার চিন্তায় আসার জন্য যে সামাজিক পরিশীলনের দরকার, অনেক সময় কায়েমি স্বার্থবাদিরা তাতে বাধার সৃষ্ঠ করে। অনেক সময় কালো আইন তৈরি করে রাষ্ট্র এসব হত্যাকারীদের রক্ষা করে।দেখা যাবে, যে তত্বের আওতাতেই পুলিশি রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, সময়ের ব্যবধানে তা জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরোটাই ধ্বসে পড়েছে পুলিশি যাঁতাকলে।শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছি,  মৃত্যদন্ড বিরোধী ইইসি রাজনৈতিক অঞ্চলে আইনরক্ষি বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত মৃত্যু ঘটছে কেনো? এখানে তো গণহত্যাকারি খুনিকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় না, গাড়ি চালিয়ে পালানো অবৈধ চালক দূরে থাক। তাহলে কি মানবতাবাদী, মৃত্যুদন্ড বিরোধী ইইসি রাজনৈতিক অঞ্চলে কি প্রবর্তনার সাথে পরিশীলনের বিরোধ ঘটছে ? ভু-রাজনীতিতে বৈষম্য বজায় রেখে  বিচ্ছিন্ন ভাবে যে এই পরিশীলন অর্জন সম্ভব নয় তা ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এবং জনতা অনেকটা বুঝতে পেরেছে। এ-কারণে সংখ্যাগুরু, বিভ্রান্ত বিলেতবাসী ব্রেক্সিট করে বেরিয়ে গেলেও, পিছিয়ে পড়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে সম্পদ, শ্রম, শিক্ষা বণ্টনে ফ্রান্সের জনগণ এখনো পিছপা হয় নি। একই মনোভাব যদি ফ্রান্স তার সাবেক উপনিবেশগুলোর প্রতি দেখাতে পারে এবং সেখান থেকে আগত, বর্তমানে ফরসি নাগিরকত্ব প্রাপ্তদেট প্রতি হীন চোখে তাকানো বন্ধ করতে পারে তাহলে আক্ষরিকভাবে আখেরে সব পক্ষ্যের লাভ। 

এক পক্ষ্যের ওপর পরিচয় সঙ্কট চাপিয়ে দিলে, অপর পক্ষ্যের জন্যও তা সুখকর  হয় না। পরিচয় সঙ্কট এবং ধার করা পরিচয় মূলত চেতনার এক বিভ্রান্ত পর্যায়। প্রতিটি দাঙ্গাই এই আরোপিত বিভ্রান্তি বা সামাজিক প্রকৌশলের কায়েমি বিস্ফোরণ।

দেখা যাবে বাংলাদেশের র‍্যাবসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় ত্রাস সঞ্চারক বাহিনীগুলো তৈরি হয়েছে পশ্চিমের কালো বাহিনীগুলোর আদলে, 'ডিজিটাল সিকিউরিটি' জাতীয় কালো আইন দিয়ে যেসব বাহিনীকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে, জনগণের জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছে। আমি বাংলাদেশে থাকতে র‍্যাব ও পুলিশ হেফাজতে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর শুনেছি, মিডিয়াতে পড়েছি। ২০২৩ এর মার্চ মাসে নওগাঁতে র‍্যাব হেফাজতে মৃত্যু ঘটে স্থানীয় ভূমী দফতরের সহকারী সুলতানা জেসমিনের।হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকারকে জানাতে বলে যে কোন কোন র‍্যাব অফিসার এতে জড়িত ছিলো এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে।কাউকে  ব্যাপারে গ্রেফতার করা হয়েছিল বা বিচার হয়েছিল কি নয়া, তা আমার জানা নাই।

বাঙালি ১৯৭১সালে দানবীয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলো। এখানে এখন কল্পনা চাকমা, সুলতানা জেসমিনদের নিয়ে কিছু কাগুজে এক্টিভিজম হলেও মূলধারার রাজনীতিতে তা ছায়াপাত করে না।মূলধারার রাজনীতিবিদরাও অমানবিক আইনরক্ষি বাহিনীগুলোকে জবাবদিহিতায় আনবার জন্য এমন কি মুচলেকা দেবার প্রয়োজনও বোধ করে না। সেই বাংলাদেশেই কাশ্মীর, ইসরাইলি অধিকৃত ভূখণ্ডে হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করা হয়। 

আমরা দেখতে পাচ্ছি যেসব ন্যক্কারজনক, প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কারণে জর্জ ফ্লয়েড, নেহাল মার্জুকেরা নিহত হয়েছে তাতে সংশ্লিষ্টদের চাকুরিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে, তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। এটা ঘটবার কারণ, এমেরিকা, ফ্রান্স তাদের ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে, ইতিহাসকে জায়েজ না করে ইতিহাসকে পেরিয়ে আসতে চাইছে এবং ব্যাক্তিকেও সেদিকে উৎসাহিত করতে চাইছে। এখানে ব্যাক্তি ও সমাজের দায় সম্পূরক বলেই একজন নাগরিকের মৃত্যু কেন্দ্র করে অপর নাগরিকেরা রাস্তায় নেমে আসছে।সেই ব্যাক্তি সহ অপর সব ব্যাক্তির প্রাণ ধারণকে এরই মধ্যে ইইসি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে সবচেয়ে বড় মর্যাদা বলে সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি হয়েছে এবং তার আওতাতে মৃত্যুদন্ড বাতিল করা হয়েছে। এই প্রবর্তনাতে প্রাণ-ধর্মের রঙ, বর্ণ, জাতীয়তা একটাই, আর তা হলো মানবিকতা!        

ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং খরগোস-নন্দন : 

ইয়োরোপে চ্যানেলের দুই পারে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা আমার ছেলেমেয়ের মতো ইয়োরোপে অনেক অনেক নাগরিক মিশ্রে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের আবহে জীবনযাপন করছে।তুলনামূলকভাবে ফ্রান্সে মিশ্র বর্ণ, মিশ্র ধর্ম, মিশ্র ভাষাভাষী পরিবার ইয়োরোপের অনেক দেশের চেয়ে বেশি।

কট্টর ধার্মিক, পারিবারিক, গন্ডিবদ্ধ আবহে বেড়ে ওঠা অনেক ছেলেমেয়ে ষকুল, কলেজ, ভ্রমণ সূত্রে অন্য সংস্কৃতিকে জানবার সুযোগ পায়, নিজেকে মিশ্র সংস্কৃতিতে মেলে ধরে।অনেকের ক্ষেত্রে এই মেলে ধরবার বাঃ বিকাশের সময় তাদের পরিবার ডানা ছাটার নামে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

অনেকে বিভিন্ন সঙ্গে, উপসঙ্গে আরোপিত পরিচয় সঙ্কটে ভোগে, কট্টর মেরুকরণে চলে যায়, যা থেকে ঘটে বিচ্ছিন্নতা, হীনমন্যতা, সহিংসতা।দেখা যাবে দীর্ঘকাল গৃহযুদ্ধে জড়িত অঞ্চলগুলোর পরের প্রজন্মগুলো বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক মেরুকরণে চলে যায়, চরমপন্থি হয়ে ওঠে, অনেক সময় এরা সরকারের বাঃ জনতার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের নৈর্ব্যাক্তিক মেরুকরণে ব্যাবহার করে।এদের কাছে লোকজনের অবয়ব ব্যক্তিক পরিচয় নয়া হয়ে, যান্ত্রিক সঙ্খ্যাবোধক হয়ে ওঠে। এর প্রতিষেধক হচ্ছে মেলামেশার অর্গল খুলে দেয়া, মুক্ত কওরে দেয়া। আবার বদ্ধ সামাজিক পরিবেশ থেকে, আপাত মুক্ত পরিবেশে এসে অনেকের সাংস্কৃতিক ভাবে শকড হয়, দ্বন্দ্বে ভোগে।

আমি বাসার পেছনের বড় সম্মিলিত উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওখানে তিন কিশোরী এক জোড় খরগোশ নিয়ে খেলছে। তিন জনের পরনে প্যান্ট ও গরমের হালকা টি শার্ট। একজনের মাথায় হিজাব, সে ককেশীয় হতে পারে, আবার এশিয়ান বা আফ্রিকানও হতে পারে, স্মর্তব্য যে আলজেরিয় বার্বার জনগোষ্ঠী শ্বেতাঙ্গ। আরেক কিশোরী কালো আফ্রিকান। তৃতীয় কিশোরী সোনালী চুলের স্বেতাঙ্গিনী। তিন কিশোরী ধুসর খরগোসগুলো নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে কত ভাবে যে ফটো তুলছে। ঐ তিন কিশোরী একটা সমাজের ফসল, আবার এই তিন কিশোরীর মননেই একটা সমাজ চলিশ্নুভাবে বেড়ে উঠবে তার রূপ, রস এবং খরগোস-নন্দন নিয়ে! আমার শুধু মনে পড়ে যায় যে আমার সব প্রকাশিত বাংলা নাটক, কবিতা, প্রবন্ধের পাণ্ডুলিপি নির্মিত, বিনির্মিত হয়েছে এই ফরাসি চ্যানেল পারের ব্রিটানি উপকুলে। আমার নিজেকে এখানে কখনো হুমকির মুখোমুখি মনে হয় নি। 


চয়ন খায়রুল হাবিব 

৬/০৭/২৩

ব্রিটানি, ফ্রান্স