Thursday 28 December 2023

দীপা হক : ঝর্নাজলে নির্জন কোলাহলে

।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।

দীপা হক, আত্মপ্রতিকৃতি।১৯৯৬।

বর্তমান আলোচনাটি 'বিশ্বায়িত দর্পণে দেশজ চার চারুশিল্পী' শিরোনামে প্রকাশিতব্য আমার একটি বইয়ের অংশ। তরুণ ঘোষ, দীপা হক, শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, সমকালীন যে চার শিল্পীর বিকাশ পর্ব আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তাদের  শিল্পচর্চার তুলনামূলক পর্যালোচনায় প্রথমত শান্তিনিকেতন ও বরোদা ঘরানার সীমাসরহদ্দ, সংক্ষেপিত ইতিহাস, দ্বিতীয়ত সত্তর দশকের 'ঢাকা পেইন্টার্স' এবং আশির দশকের 'সময়' শিল্পী সঙ্ঘের প্রবর্তনা তুলে ধরেছি। তৃতীয়ত দীপা হকের মৃত্যু পূর্ববর্তী ১৯৯৮সালে রেট্রোতে প্রকাশিত বইটিতে অধ্যাপক, শিল্প সমালোচক, শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের শিল্প এবং নারীত্ব বিষয়ক কিছু বক্তব্যের সাথে বর্তমান আলোচনায় দ্বিমত পোষণ করেছি। 'বিশ্বায়িত দর্পণে দেশজ চার চারুশিল্পী' বইটির একাংশ এখানে পরিবেশিত হলো। চখাহা।

দীপা হক : ঝর্নাজলে নির্জন কোলাহলে



কথিত আর্ট ক্যাম্পের ভিড়ে উপচানো চা, ফুচকা, জয়ন্তীর মচ্ছবে চিন্তাশূন্য, জলো, অগভীর ওয়াল পেপার ধরনের কাজগুলো থেকে দীপা হকের জগত অনেক, অনেক দূরে। আবার সাগর পারের শামুক, শঙ্খ, সিন্ধু সারসের মত কাছে ডাকা নিজস্ব এক নিভৃতি, অংশগ্রহণ করতে দেয়। দীপার যে কোনো সময়ের আত্মপ্রতিকৃতিগুলোতে সবচেয়ে আগে দাগ কাটে চোখ, স্পর্শকাতরতার চড়াই, উৎরাই ধরে জীবন্ত, জলজ চোখগুলো ধাপে, ধাপে আমাদের মগ্ন চেতনাকে দোলায়। নগ্নতা নিয়ে তার যে দ্বিধা ও উচ্ছ্বাস তাও জীবনের নিরাভরণ, নির্মেদ উদযাপনের জলপ্রপাত থেকে উৎসারিত।


ভীড়ের ভেতর একা একজন কিভাবে সহ-শিল্পীদের  ভেতর এতো উত্তাপ ছড়িয়েছিলেন, ক্যানভাসে এতো রকম নিরীক্ষা ধারণ করেছিলেন, ভেবে অবাক মানতে হয়। ১৯৭৪ সালে সতীর্থদের সাথে গঠন করেছিলেন, ‘ঢাকা পেইন্টার্স’। সহ-শিল্পী কাজী রকিব লিখেছেন, ''আমরা বুঝে গিয়েছি তখন, আঁকার জন্য জানা দরকার।……দীপা আমাদের অনুবাদ কোরে শোনাতো ব্রেতো। এই জন্য যে আমরা স্যুররিয়ালের দিকে ঝুঁকেছিলাম।’’       


রওশন হক দীপা, যিনি পরে দীপা হক নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তার জন্ম ঢাকাতে, ৭ই জানুয়ারি  ১৯৫৩ সালে। ১৯৭৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ। ঢাকা আর্ট কলেজে আসার আগে কিছুকাল কাটিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে, সেখানে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন রশীদ চৌধুরীকে। বরোদার এম, এস, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেইন্টিংএ স্নাতকোত্তর। ১৯৮৭র গ্রীষ্মকালে আবাসিক শিল্পী হিসেবে যোগ দেন নিউ ইয়র্কের সারাটোগা স্প্রিং এর স্কিডমোর কলেজে। তাকে বলা যেতে পারে ক্ষুধার্ত, সতৃষ্ণ একজন শিল্পী। 


১৯৯৭সালে ক্যানসার নির্ণয় এবং প্রচণ্ড যাতনাদায়ক কেমোথেরাপির পর বেশ কয়েকটি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন। শিল্পের তত্ব ও সমালোচনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তা নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লিখতেন, ‘দা লন্ডন ম্যাগাজিনে’ তার লেখা ছাপানো হয়েছে। ‘আর্ট’ নামে বাংলাদেশে সেসময় একমাত্র চতুর্মাসিক ফাইন আর্টস ম্যাগাজিন শুরু করেছিলেন। তার সময়ের সবগুলো এশিয়ান বিএনাল প্রদর্শনীতে অংশ নেন। শেষ একক প্রদর্শনী হয় ১৯৯৮সালে, ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি গ্যালারিতে, মৃত্যুর এক বছর আগে, এখানে তার নির্বাচিত কাজগুলো প্রদর্শিত হয়। শিল্পকলা একাডেমি এ-উপলক্ষে ‘দীপা হক’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিল।


'ঢাকা পেইন্টার্স', ১৯৭৪। ওপরে বা দিক থেক, উত্তম দে, কাজী রকিব, সুকুমার পাল।
মাঝে বা দিক থেকে, নজরুল হোসেন, তরুণ ঘোষ, বিমল বণিক।
মাঝে কালো পটভূমিতে দীপা হক।
নিচে বা দিক থেকে মাসুদুল আলম, ফাউজুল কবির, শাহনাজ নাসির কুহু।
সৌজন্য, সুকুমার পাল।

দীপা হককে বলা যায় এমন একজন শিল্পী, যিনি বার বার নিজের সীমারেখা অতিক্রম করে যেতে চাইছেন। সমাজ তার ওপর কি কি সীমা, কি কি অবগুণ্ঠন আরোপ করছে, তা নিয়ে তিনি সচেতন এবং অন্বেষায়, জ্ঞানতৃষ্ণায়, অঙ্গিকারে তা পেরিয়ে যেতে সক্রিয়। অকাল প্রয়াত শিল্পী দীপা হকদের(১/৭/১৯৫৩, ৪/০১/১৯৯৯) ব্যাচ যখন ১৯৭০সালে শেষ দিকে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াধীন, তার কয়েক মাসের ভেতর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীপাদের ক্লাস শুরু হয় ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ব্যাচ। দ্বিতীয় বর্ষে, ১৯৭৪এ বন্ধুদের সাথে গড়ে তোলা ‘ঢাকা পেইন্টার্স’কে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম শিল্পী সংঘ বলা যেতে পারে।  তার সাথে ছিলেন উত্তম দে, কাজী রকিব, সুকুমার পাল, নজরুল হোসেন, তরুণ ঘোষ, বিমল বণিক, মাসুদুল আলম, ফাউজুল কবির, শাহনাজ নাসির কুহু।


দীপাকে নিয়ে লিখেছেন তার সতীর্থ কাজী রকিব এবং শিল্প সমালোচক, অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। ‘ঢাকা পেইন্টার্স’ তাদের ঘোষণায় বলেছিলো যে ‘একাডেমিক চর্চার বাইরে আসা’ তাদের লক্ষ্য। সে সময় অর্থাৎ ১৯৭৪সালের প্রথম দিকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা সৈয়দ মঞ্জুর  ‘ঢাকা পেইন্টার্সের’ প্রথম প্রদর্শনীটি দেখেন(১৯৭৪) এবং ‘অবজারভার’ পত্রিকায় মন্তব্য সূত্রে পরে স্মৃতিমূলক রচনায় লেখেন যে এদের বেশির ভাগ কাজ তখনো একাডেমিক গণ্ডিতে ঘুরপাক খেয়েছে, তবে ‘নজর কাড়া কাজ’ ছিলো দীপা হক এবং তরুণ ঘোষের। একই প্রদর্শনী উপলক্ষে সৈয়দ মঞ্জুর দীপা হক সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সত্যিকার প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী।’


‘ঢাকা পেইন্টার্সের’ তাত্ত্বিক রূপকার ছিলেন দীপা। বিদেশি বিভিন্ন চিত্র এবং সাহিত্য আন্দোলনের ইস্তাহার বন্ধুদের অনুবাদ করে শোনাতেন। গোষ্ঠীটির কার্যক্রম শেষ হয়ে যায় ১৯৭৭ সালে এবং পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মন্তব্য করেন যে একে অন্যকে অনুপ্রাণিত করলেও গোষ্ঠী হিসেবে এরা অঙ্গীকারকে ফলপ্রসূ করতে পারে নি। আমি তার সাথে একমত নই।


১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭, তিন বছরে ‘ঢাকা পেইন্টার্স’ ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়াতে ছয়টি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। শিক্ষকেরা শেখাবার আগে এ গোষ্ঠীর সদস্যরা তেল রং আয়ত্ত করে অসীম সাহসে ক্যানভাসে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝাঁপ দেয়া বলাই সঙ্গত,শুধু চারুশৈলীর ক্ষেত্রে নয়, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকদের কাছ থেকে কোনো শৈলী পেতে অনেক অনেক দেরী হয়ে যায়। নব্বই দশকের শুরুতে বরোদা থেকে স্নাতকোত্তর করে ফেরা ‘ঢাকা পেইন্টার্স’ সদস্য তরুণ ঘোষ উপস্থাপন করেন ‘বেহুলা সিরিজ’, আমার বিবেচনায় যা একটি কালোত্তীর্ণ কাজ এবং একাডেমিক চর্চার বাইরে বেরিয়ে এসে উদ্ভাবনী সৃজনশীলতার যে ঘোষণা গোষ্ঠীটি  দিয়েছিলো তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ্তরুণ ঘোষের বেহুলার মুখ সরাসরি কোনো মডেল থেকে আসে নি। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হতে পারে, এটা কি দীপা হকের মুখ?   


আনুষ্ঠানিক চারুকলার সাথে অনানুষ্ঠানিক বিকাশগুলোর যে একটা দূরত্ব বা মিসিং লিঙ্ক  আছে, তা খুব সচেতনভাবে বুঝেছিলেন দীপা এবং সতীর্থদের এ ব্যাপারে সচেতন করতে চেয়েছিলেন।

   

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ধারায় বিচিত্র সব উদ্ভাবনী সঙ্ঘ তুমুলভাবে নিজেদের প্রকাশ করেছে। সংগীতে আমরা পাই মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের নেতৃত্বে 'উচ্চারন' ব্যান্ড, ফিরোজ শাই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীরের 'স্পন্দন'। ১৯৬৩সালে কবি রফিক আজাদ  প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাক্ষর’ সাহিত্য আন্দোলনের রেশ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আরো শক্তিশালী হয়েছে এবং তাতে যোগ দিয়েছে আবদুল মান্নান সৈয়দ, মুস্তফা আনোয়ারের মত শক্তিমান লেখকেরা। যৌনতা বিশেষ করে নাগরিক যৌনতা নানা মাত্রায় উঠে এসেছিল ‘স্বাক্ষরে’, পরাবাস্তবতা ছাড়াও অন্যান্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপর আলোকপাতেও এগিয়ে ছিলেন এখানকার লেখকেরা। আশির দশকে আমার যে ছোট ছোট ছবিধর্মি কবিতাগুলোকে আবিদ আজাদ বলেছিলেন, 'অসংলগ্নতা-স্নাত আত্ম-উন্মীলন', সেগুলোও ছিলো খোলামেলা যৌন অবলোকন।


স্বাধীনতা পরবর্তী মাল্টাই জন্রে মাত্রায় সবচেয়ে সফল বলা যেতে পারে ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন’কে, যা লেখার, মঞ্চ নক্সার, নাটক পরিবেশনার দর্শকের সাথে সম্পর্কিত হবার রীতিকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছিলো। তখনকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্ণধার শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার টেলিভিশন প্রযোজনায় বেশি মনোযোগ দেন অনানুষ্ঠানিকভাবে বিকশিত ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে’ জড়িত লেখক, শিল্পীদের ওপর। নবায়নের এ প্রাণের মেলায়  দীপা উজাড় করে দিয়েছিলেন রঙ, তুলি, মেধা।


বলা যেতে পারে চারুশিল্পীদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর সম্পর্ক যতটা বেগবান হয়েছে, অপরাপর সৃজনশীল অনানুষ্ঠানিক আন্দোলনগুলোর সম্পর্ক তেমন বেগবান হয় নি। দূরত্ব কমানোর তাগিদ এখনো তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ দূরত্ব থেকে আমরা এডভার্ড মাঞ্চের সাথে ইবসেনের সাথে সম্পর্ক বুঝতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথ, ভিক্টর হুগো, উইলিয়াম ব্লেক, এলিজাবেথ বিশপ, গার্সিয়া লোরকা, সিলভিয়া প্লাথ, মিরা মুখার্জি, গুন্টার গ্রাস, সত্যজিৎ  রায়দের জীবনে কোথায় সাহিত্য এবং শিল্প সম্পূরক তাও আমাদের শিল্পীদের কাছে পঠিত বিষয় হয়ে ওঠে নি। যে বরোদাতে দীপা স্নাতকোত্তর করতে গিয়েছিলেন সেখানকার পুরোধা জি, এম, শেখের কাছে কাব্য চর্চা এবং শিল্পচর্চা সমার্থক, কবিতা লিখবার পাশাপাশি প্রতিটি বাক বদলে শেখ শরণাপন্ন হয়েছেন কবিরের কবিতার।


দীপা, তিন নারীর মাঝখানে।

বরোদা থেকে ফিরবার কিছুকাল পর দীপা প্রথম একক প্রদর্শনী করেন ১৯৮৬সালে। এ প্রদর্শনীর ক্যাটালগে দীপা লেখেন যে তিনি এখনো ‘অন্বেষণরত’। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দীপার মৌলিক প্রণোদনাকে জটিল ভাবে উপস্থাপন করে লেখেন, ''দীপা আমাদের জানান যে তিনি পরিণত হয়েছেন একজন অন্বেষণকারীতে। তিনি খুঁজছেন না, কারণ যিনি খোঁজেন, তিনি জানেন, তিনি কি খুঁজছেন; বিপরীতে যিনি অন্বেষণকারী, তিনি এমন জিনিসের পেছনে ছোটেন, যার পরিচয়টি তিনি জানেন না, বোঝেন না।’’


শব্দের সাথে অর্থের দাঙ্গায়, কিম্বা কথার মারপ্যাঁচে ওপরের মন্তব্যে আমি আর সৈয়দ মঞ্জুরের অভিপ্রায় এখানে বুঝতে পারি না। 'অন্বেষণ' এবং 'খোঁজ', দুটোই সমার্থক বিশেষ্য পদ। অন্বেষণ অর্থ অনুসন্ধান, গবেষণা। খোঁজ অর্থ সন্ধান, অন্বেষণ, তত্ত্ব।  দীপার অন্বেষা যে অধরা সোনার হরিণ বা অলৌকিকের প্রতি অনুরাগ  নয়, শেষ বেলায় তার নিজের কথায় স্পষ্ট। প্রকৃতি উপস্থাপনায় তিনি এক ধরনের আরাম বোধ করছেন, কিন্তু সে আরাম তাকে আবার অস্থির করে তুলছে, যা একের পর এক প্রতিকৃতি এবং আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেও তাকে সুস্থির করতে পারে নি।


কোলাজ।দীপা হক।

মানুষের প্রাচীনতম ভয়ের নাম মৃত্যুভয়, যাকে ঘিরে আমাদের ওপর চাপানো হয় দৈবের শাসন। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছি, দীপার যাত্রা শুরুর চিত্রকলায় এবং শেষ দিকের আত্মপ্রতিকৃতির একটিতেও কোনোভাবে পারলৌকিক প্রতীক আসে নি। একটি কোলাজে পাচ্ছি একজন সম্পূর্ণ নগ্ন নারী, আরেকজন স্বল্প বসনে আবেদনময়ি ভঙ্গির নারী, দীপার দুটি আত্মপ্রতিকৃতি এবং একেবারে নিচে একটি লোকজ মুখোশ।

সেই আশির দশকের শেষ প্রান্তে আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী নাট্যকার সোয়িঙ্কার নাটক অনুবাদ, নির্দেশনার সময় থেকে আজতক আমার মনে প্রশ্ন জেগে আছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজ মুখোশগুলো কি আড়াল, না কি অবচেতনের সেতু?

অভিব্যাক্তিজাত বিভিন্ন শিল্পের লেনাদেনা থেকে যে বহুসচল দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়, তার অভাবে আমাদের কথিত প্রগতিবাদীদের দেখার ব্যাপারটা যে কতটুকু একমাত্রিক, তা বোঝা যায় ১৯৮৬সালের প্রদর্শনীর পর দীপার কাজগুলোকে কেউ কেউ ‘প্রতিবাদী’ বলে সরলীকৃত করায়। মাঝখানে বহু বছর ঢাকার শিল্পরসিকেরা তার কাজ দেখতে পায় নি, ফলে বিষয়, শৈলী, নন্দনতত্ত্ব, প্রথা, দর্শন, শিল্প-চিন্তা নিয়ে তার নিরীক্ষাগুলোকে চড়াদাগে একটি ব্র্যাকেটে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। ক্যাটালগে লেখা ‘অন্বেষণের’ অহেতুক জটিল তকমাতে তাকে আমরা ভুল বুঝতেই থাকতাম।


দীপা পাথরকে পাথরের মত দেখাতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছিলেন। একই সাথে দেহকে, দেহের নগ্নতাকে দেহের মত দেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান ন্যুডগুলোর বিনির্মান করে গেছেন নিজস্ব দেহ ভাষায় পৌঁছোতে। ১৯৮৬ প্রদর্শনীর ক্যাটালগ এবং ১৯৯৯তে মৃত্যুর আগের বছরের রেট্রোতে লেখা ‘আমার কথা’ মেলালে বোঝা যায় যে নিজের সবচেয়ে দক্ষ কাজগুলোকেও দীপা আক্ষেপের বিরামচিহ্ন ভেবেছেন এবং দেহের উদ্ভাসন মেলে ধরতে না পেরে কোলাজের আশ্রয় নেয়াকে শৈল্পিক অপূর্ণতা  ভেবেছেন।


মাতিস, নাচ।

দীপা হক, নাচ।

যে কোনো রাজনৈতিক একমাত্রিকতার একমাত্র কারণ পুরুষতন্ত্র, আর দুই বাংলায় তা প্রগতিবাদ এবং শিল্প সমালোচনায়, চারুকলার শিক্ষায় প্রবলভাবে ছায়া ফেলেছে। দীপা যাদের কাছে শিখেছেন, যাদের সাথে পড়াশোনা করেছেন, তাদের বেশির ভাগ পুরুষ হওয়া সত্বেও ‘ঢাকা পেইন্টার্সের’ পুরুষ শিল্পীদের ভেতরেও নারীবাদী প্রবর্তনা সঞ্চারিত হয়েছে। দীপা যে আত্মপ্রতিকৃতি দেখিয়েছেন তা একজন নারীর প্রতিকৃতি, যে নগ্ন দেহগুলো এঁকেছেন তাতে নারী এবং পুরুষ উভয়ে আছে। নারীবাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজে নারী তার নিজস্ব পরিচয়ে বেঁচে থাকবে। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে সমাজ নারীর যে নিম্নতর অবস্থান তৈরি করে তাকে অসাম্যের শিকারে পরিণত করে, একজন নারীবাদী তত্ব এবং বাস্তবতায় তা নিয়ে সচেতন থেকে তা থেকে উত্তরণে সক্রিয় থাকে। 


দীপা হকের মৃত্যুর আগের বছর, তার শেষ প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত বইতে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের একটি পর্যবেক্ষণমূলক বক্তব্য আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে। সৈয়দ মঞ্জুরুল লিখেছিলেন,  

‘‘নারীর একটি বড় অবস্থান আছে দীপার কাজে। আমি অবশ্য তার কাজকে একজন শিল্পীর কাজ হিসেবেই দেখি, মহিলা পুরুষ বিভাজনে, বিশেষ করে শিল্প, সাহিত্যে আমার আপত্তি আছে। কিন্তু দীপা যেহেতু নারীর নিম্নবর্গিও অবস্থান নিয়ে সচেতন, তাকে বদলে দিতেও সচেষ্ট, সে জন্য তার কাজে নারীর চিন্তাটি সমুন্নত, তার অবস্থানটি সুচিহ্নিত। এই নারী মোটেও প্রান্তিক নয় শেষ পর্যন্ত, বরং শিল্পের শক্তি ও সাহস পরিপূর্ণ আছে বলে,  পুরুষের অবস্থানকেও ছাড়িয়ে যায় সে,  বলা যায় পুরুষের অপূর্ণতাকেও পূর্ণ করে সে।’’


সৈয়দ মঞ্জুরের ওপরের মন্তব্যর সাথে আমি  সূক্ষ্ম এবং চড়াদাগে দ্বিমত পোষন করি। ‘’পুরুষের অপূর্ণতাকেও পূর্ণ করে’, ব্যাপারটা কি? ওয়াযকারীরা নিয়মিত বলে যে পুরুষ হচ্ছে বাইরের টিউব, নারী হচ্ছে ভেতরের টায়ার, এটা ঠিক না থাকলে চাকা ঠিক ভাবে চলবে না। কিন্তু নারী আসলে কোনো টায়ার নয়। সৈয়দ মঞ্জুরুল দীর্ঘকাল ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে শেকস্পিয়ার পড়িয়েছেন, আমার পাঠে ওপরের মন্তব্যটি তিনি লেডি ম্যাকব্যাথ প্রসঙ্গেও করতে পারতেন ‘শিল্প’ শব্দটি বাদ দিয়ে। লেডি ম্যকব্যাথের চরিত্রায়ন নিয়ে নারীবাদীরা প্রশ্ন তুলে এসেছে অনেক দিন যাবত। শিল্পকলা আমাদের সমাজেরই অংশ, সৈয়দ মঞ্জুরুল আপত্তি করুন আর নাই করুন, শিল্পক্ষেত্রেও সামাজিক ব্যাধির মত ‘মহিলা পুরুষ বিভাজন’ সঙ্ক্রমিত, বলা যায় আরো প্রবল ভাবে সঙ্ক্রমিত। 


লুইস বুর্জোয়ার মত বিরাট মাপের ভাস্কর ফ্রান্স ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্থায়ীভাবে এমেরিকাতে বসবাস শুরু করেছিলেন ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপের শিল্পক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাবল্যে। শক্তিশালী ফরাসি ভাস্কর ক্যামি ক্লদেলের বেশির ভাগ কাজই হারিয়ে গেছে তার মানসিক ভারসাম্য হারাবার সূত্রে। অথচ ক্যামির বড় ভাই পল ক্লদেল ফরাসি ভাষার বড় কবি এবং একজন জাদরেল আমলা ছিলেন। একই সময় ক্যামির শিক্ষক রদ্যার একটি কাজও হারিয়ে যায় নি। পূর্ব, পশ্চিম উভয় বলয়ে পুরুষ শিল্পীরা যত শিঘ্রি রেট্রো করতে পারে, নারী শিল্পীদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। বাংলাদেশের প্রথিতযশা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর স্ত্রীগন চারুকলায় তাদের সহছাত্রী হয়েও সাংসারিক বাস্তবতায় নিজেদের শিল্পস্বত্বা বিকাশের সুযোগ পেয়েছেন খুব কম। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম কথিত ‘পুরুষের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করবার’ ভার নারী শিল্পীদের ওপর বর্তালে লিঙ্গ বৈষম্য-জনিত ভয়াবহ অবস্থানটি পার হতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যাবে, সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে তা নিসন্দেহে বলা যায়।


নারীবাদসহ, যৌনায়নের জায়গাটি কিভাবে দীপা নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন? বরোদাতে, এমেরিকাতে প্রশিক্ষিত হবার পরও দীপা ন্যুড বা নগ্নতা নিয়ে দ্বিধার ভেতরে পড়েছিলেন, তার সাথে নিজের মত করে বোঝাপড়া করে একটি মীমাংসায় পৌছাতে চেয়েছিলেন, তা তার কাজের চেয়েও বেশি বোঝা যায়, নিজের যাত্রাপথ নিয়ে তার লেখায়। 


দীপা যখন ভারতের বরোদায় পড়াশোনা করছেন, তখন সেখানে চিত্রকলার শিক্ষক জি, এম, শেখ ও ভুপেন খাকার। দীপা লিখেছিলেন, ‘’বারোদাতে আমি এম, এ করেছি। সেখানে চিত্রাঙ্কন বিভাগের প্রধান জি, এম শেখ এবং ভুপেন খাকার ন্যারেটিভ পেইন্টিংএর একটা জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। এই রীতিটিকে আমার বেশ অনুকূল মনে হয়েছিলো, যদিও বলতে বাঁধা নেই , আমি এই ধারার ভেতরের মানুষ ছিলাম না।’


খাকারের বেশির ভাগ আঁকাআঁকি  হচ্ছে আত্মজৈবনিক এবং নগ্ন পুরুষদের, সেখানে সমকামিতার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। জি, এম, শেখের আরেক পরিচয় হচ্ছে কবি, বরোদাতে চিত্রকলা বিভাগের ভার পাবার পর খাকারকে শিক্ষকতার নিমন্ত্রণ জানান।


খাকারের মাপ কেবল একজন খাকারই ছুতে পারে। আশির দশকে লন্ডন, বার্লিন, আমস্টারডাম, টোকিওতে গ্যালারি মালিকেরা খাকারের কাজ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছে। শিল্পের অনুশীলনে খাকার পুরোপুরি স্বশিক্ষিত। খুব কাছে গিয়েও দীপা খাকার, জি, এম, শেখের আত্মজৈবনিকতার গভীরে যেতে পারলেন না। একই ‘বারোদা গ্রুপে’ খাকারের পাশে আত্মজৈবনিকতার পত্তনি ঘটিয়ে নলিনী মালানী আর পিছে ফিরে তাকান নাই। এই আক্ষেপটুকু দীপা যেভাবে তার লেখাতে উজাড় করেছেন, তা আমাদের পিছুটানগুলোর টেস্টামেন্ট হয়ে থাকবে।


দীপা যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দোরগোড়ায়, তখন ১৯৯৮সালে ওনার দুশো কাজ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনী হয়। সে উপলক্ষে প্রকাশিত বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেখাটি লিখেছিলেন দীপা নিজে ‘আমার কথা’ শিরোনামে। এক জায়গাতে দীপা লিখেছেন, 

 ‘’ড্রয়িং এর ভেতরেই আমাকে খুঁজে পেয়েছি আমি। এসব ড্রয়িঙে কিছু ন্যুড ছিল। তা দেখে কাউকে কাউকে ভ্রু কোঁচকাতে দেখেছি মনে পড়ে। আমাদের সমাজে নগ্ন মানব দেহের যথাযথ প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিধিনিষেধ আছে। এই বিধিনিষেধ এড়িয়ে যেতে শিল্পীদের স্টাইলাইজেশানের শরণাপন্ন হতে হয়। না হলেই ভালো হতো। স্রষ্ঠার সকল সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহকে আমি সবচেয়ে বেশী নান্দনিক গুণসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করি। সমসাময়িক যে দুজন শিল্পীর মানব দেহের উপস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করেছে তারা হলেন আর, বি, কিতাই আর লুসিয়ান ফ্রয়েড।’’ 

কেউ আসলে কারো জগতে ঢুকতে পারে না। যা পারে তা হলো নিজের জগতকে আন্তরিকভাবে মূর্ত করে তুলতে। দীপা যাকে ‘মানব দেহের যথাযথ প্রতিকৃতি’ বলছে, অমৃতা শেরগিল, ফ্রিদা কাহলো, লুসিয়ান ফ্রয়েড, ভুপেন খাকারের কাছে  তা প্রথমত নিজের দেহ। নিজের শরীর উন্মোচন করতে করতে তারা অন্য মডেলের শরীর উন্মোচন করেন। খাকারের, ফ্রিদার, লুসিয়ানের, অমৃতার ন্যারেটিভ এসেছে আশেপাশের অনুষঙ্গ থেকে, কল্পনা থেকে নয়। দীপা যে অন্বেষার কথা বলেছিলেন তা কল্পনাকে অর্গল-মুক্ত করবার বাসনা। 



শিল্প স্বয়ম্ভু নয়, ভুঁইফোড় নয়। দাদা, পরাবাস্তব, ইম্প্রেশনিজম, সুরিয়ালিজম, কিউবিজম, বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট সবগুলো শিল্প আন্দোলন ঘটেছে কবিতার বাতাবরণে। সুরিয়ালিজম, কিউবিজম শব্দগুলো তৈরি করেছে ফরাসি কবি গিয়ম আপোলিনেয়ার। নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর তাদের বিপুল অধ্যায় কাটিয়েছে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ঢাকাতে এসে খুঁজে বের করেছেন শামসুদ্দীন আবুল কালামদের। বরোদার চিত্রকলা বিভাগের প্রধান জি, এম, শেখ তার আত্মজৈবনিক কবিতা এবং চিত্রকলাকে পারস্পরিক করে তুলতে যে ভুপেন খাকারকে চিত্রকলার শিক্ষক হিশেবে নিয়োগ দিলেন, তা অনেকে ধরতে পারেন নি।


চিত্রকলা নিয়ে খাকারের আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। খাকার ও শেখের যোগাযোগ কবিতা ও শিল্পের যোগাযোগ। উত্তীর্ণ কবিতা যেভাবে উত্তীর্ণ শিল্প, উত্তীর্ণ শিল্প সেরকম উত্তীর্ণ কবিতার সমান্তর। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান তাদের চিত্রনাট্যের শক্তি  নিয়েছে সাহিত্য থেকে। মঙ্গলকাব্য, যাকে অবলম্বন করে তখনকার শাসক গোষ্ঠী জনতার কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছে, তা মূলত সাহিত্য। 


সাহিত্যকে হালনাগাদ বা নবায়ন করে নেবার একটা দায় সব জন্রের শিল্পীদের ওপর বর্তায়। । বাংলাদেশে শিল্পচর্চাকারীদের সাথে সাহিত্যের যোগাযোগ কমে গেছে। সমাজ থেকে শিল্পের এগিয়ে থাকবার কথা। এ দূরত্বের ফলে মাল্টাই জনরা মিডিয়াম খুলছে না, যার প্রভাবে টেলি নাটক, ফিল্ম, ক্যামেরা সবই দুর্বল থেকে দুলতর হচ্ছে। ডেয়ারিংটা নাই। সাহিত্য যে নান্দনিকতার শতশ্চক্ষু দিতে পারে তার সমকালীন নবায়ন নাই। আমরা উপন্যাস, নাটকের ক্যানভাসে শিল্পীদের বৃত্তান্ত পেয়েছি, কিন্তু শিল্পীদের ক্যানভাসে সাহিত্যকে এখনো পাই নি। যতটুকু পেয়েছি তা সংবাদের শুন্যতা পুরন করা ইন্সটলেশান, শিল্পের দৃষ্টিকোন সেখানে শূন্য। 

 

স্বাধীনতা উত্তর ধ্বংশস্তুপ, ১৯৭৫এ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নারকীয় হত্যা, আশির দশকের টানা সামরিক শাসন যে কোন সৃজনশীল মানসকে অবদমিত ট্রমার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অবদমন কাটিয়ে দীপা ও তার সাহযাত্রীরা তাদের শিল্পভাষাকে পোস্টার সংলাপে পর্যবসিত করেন নি। হয়তো খেয়াল করেছিলেন যে অনেক সমকালীন কবি, নাট্যকার কথিত, আবৃতিযোগ্য দ্রোহের কবিতা এড়িয়ে, কলাকৈবল্যবাদি না হয়েও, নান্দনিকতার সমস্ত শর্ত আদায় করে সাহিত্যকে আরো বেশি যোগাযোগ সফল করে তুলছে। আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখন ইয়োকো ওনোদের ইন্সটলেশান এবং আর্ট পার্ফর্মেন্সের হাতছানি।


রেখা এবং রঙের বর্ণীলতাকে কোন দিকে নেবেন, এ দ্বিধার সীমাসরহদ্দে দীপা প্রচুর আত্মপ্রতিকৃতি, লতা, পাতা এঁকেছেন। নিজের তাগিদে, বন্ধুদের সাথে পারস্পরিকভাবে পরাবাস্তবতা, প্রকাশবাদ নিয়ে খোড়াখোড়ি করেছেন। পঞ্চাশের পর শিল্পের তত্ব ও ব্যাবহারিকতা নিয়ে এতো ব্যস্ত শিল্পী আমরা খুব কম পেয়েছি।


দীপার সব কাজই নয়নাভিরাম। একটি অসম্পূর্ণ যাত্রাপথের বিরাম চিহ্নের মত সেগুলো আমাদের অনেকের মনে গেঁথে থাকবে। এ অসম্পূর্ণতা ঠিক ব্যর্থতা নয়, বরং সম্ভাবনার বীজ বপনের পর ফসল দেখে যেতে না পারার অসম্পূর্ণতা।  আমার দৃঢ় বিশ্বাস দীপা যে লেখাটি রেখে গেছে, তাতে অন্যরা এ বিরাম চিহ্নগুলো পেরিয়ে উদ্দাম মূর্ততায়, নগ্ন চঞ্চলতায় লক্ষ্যভেদী হতে পারে

আমার দেখায়, বোঝায় দীপা এবং তার কাজগুলো সর্বতোভাবে সুদূরের প্রয়াসী। তারুণ্যে উদ্ভাসিত মুখের আত্মপ্রতিকৃতির পাশাপাশি ক্যান্সারে কোঁচকানো প্রতিকৃতিতে লিখেছেন,  ‘I decided, I want to live!’


ধারাবাহিক  আত্মপ্রতিকৃতির কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘’আত্মপ্রতিকৃতির জন্য আমি কিছুটা সময় আলাদা কোরে রাখি। এর কারণ আত্মরতি নয়, কারণ আমিই আমার একমাত্র মডেল যাকে সবসময় হাতের কাছে পাওয়া যায়। ম্যাসেকটমি আর কেমোথেরাপির ধ্বংশলীলার পর, আমার আমূল পালটে যাওয়া জীবন এবং তার আবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে, আমি এভাবেই সহনীয় আর অর্থবহ করে তুলতে পারি। আমার শিল্পী সত্বার যাত্রা শুরু হলো যখন, তখন আমি এক ঘনকৃশ্ন যবনিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।’’


আত্মপ্রতিকৃতির অনুশীলন।দীপা হক।১৯৮৯।

দীপার মৃত্যু পূর্বকালীন প্রতিকৃতিগুলোর দিকে পর পর নির্নিমেষে তাকিয়ে, ১৯৯২ সালে লন্ডন সেন্ট জন্স উডের সাতচি গ্যালারিতে দেখা ডামিয়ান হার্স্টের একটি অভিনব কাজের কথা মনে পড়েছে, যার শিরোনাম, ‘একজন জীবিত মানুষের মনে মৃত্যুর শরীরী অসম্ভাব্যতা/The Physical Impossibility of Death in the Mind of Someone Living’। এখানে 1991 সালে ইংরেজ শিল্পী ডেমিয়েন হার্স্ট, একটা গ্লাস-প্যানেল ডিসপ্লে কেসে ফর্মালডিহাইডে ভেজানো একটি বিশাল হাঙ্গর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আমার মনে পড়ে যায়, আয়নার সামনে দাঁড়ানো পিকাসোর সেই আধা শেভ করা মুখের প্রতিকৃতি। পিকাসো শেভ করছি্লেন, এসময় বন্ধু কবি আপোলিনেয়ারের মৃত্যু সংবাদ শুনে পিকাসোর চোখ, মুখ বেদনায় কুচকে যায়, শেভ শেষ না করে পিকাসো আয়নায় দেখা নিজের মুখটি সাথে সাথে স্কেচ বইতে তুলে রাখেন, নিজেকে মনে রাখার জন্য নয়, বন্ধু বিয়োগে খাটি দুক্ষের রেশটিকে ধরে রাখতে। 


দীপা ছিলেন জীবনভর উল্লাসপ্রবন, উদযাপন প্রিয়। জীবনের দর্পণেই দেখেছেন নিজের যবনিকা। দুক্ষ এবং ভয়ের মিশ্রণে কোন আবেগের পরিমাণ বেশী তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সহযাত্রী কাজী রকিবের স্ত্রী মাসুদা কাজী থেকে আমরা জানতে পারছি, ''দীপা’পার সময়ে এই চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল অনেক কষ্টের। এই কষ্টের মধ্যেও দীপা’পা বিভিন্ন রকমের বই খুঁজে খুঁজে পড়ত। ক্যানসারের কত ধরনের উন্নত চিকিৎসার গবেষণা চলছে, এই সব বই পড়ে পড়ে ও আমাদের শোনাত। আমার খুব মনে পড়ে—দীপা’পা আমাদের দুজনকে ওর দুই পাশে বিছানায় আমাদের দুই হাত চেপে ধরে বসে থাকত।''


আমরা নিজের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাই, সুতরাং নিজেকে স্বচ্ছভাবে মেলে ধরেই অন্যের সাথে সবচেয়ে ভালো সেতু তৈরি করতে পারি। প্রণোদনার দিক থেকে দীপা খাকার, নলিনী, আমাদের অপরিচয়ের স্পর্শ-মাখা গল্পকার মুস্তফা আনোয়ারকে ধারণ করেছিলেন। আত্মপ্রতিকৃতিগুলো বলে দেয়, নিজ দেহের ক্যানভাসে আকাঙ্ক্ষার বিচূর্ণতাও অনুভব করেছিলেন।    

 

দীপা হক তার দ্বিধার সাথে, কোথায় পৌছাতে চেয়েছিলেন তার বৈশ্বিক পরম্পরাটুকু তুলে ধরেছিলেন লেখাতে। আমরা জানতে পারছি, শিল্পী রশীদ চৌধুরীও নিজের একাকিত্বের সময় প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন, যেগুলো এখনো প্রকাশিত  হয় নি। দীপার লেখা, সম্পাদনা বলে দিচ্ছে দক্ষতার পাশাপাশি ভাবনার নবায়নে, পড়াশোনা এবং লেখালেখির গুরুত্ব অপরিসীম।


এ লেখালেখি গল্পকার, কবি হবার জন্য নয়, কিন্তু সাহিত্যের জন্রেগুলো যে গল্প, কবিতা চরিত্রায়নের দৃষ্টিকোণ তৈরি করে, ক্যানভাসের নান্দনিকতায় এবং ভেজা তুলির আগায় তা সঞ্চারিত করবার জন্যই জরুরি। শিল্পীর জন্য এ লেখালেখি ভাবনার কাদামাটিকে ভেজা অবস্থায় কুমারের চাকায় আনবার মতো। এ চাকার ঘূর্ণি শিল্পীর জন্য জিয়নকাঠি। উল্টাপাল্টা কাদামাটি দিয়ে ইচ্ছেমত চাকা ঘুরালে, কাঙ্ক্ষিত মাটির পাত্রটি যে পাওয়া যাবে না, দীপা তা বুঝেছিলেন। নগ্ন মূর্তিকে তিনি পূজার বিগ্রহ ভাবেন নি,  নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে তার আরাধ্য নগ্নতাকে দেখতে চেয়েছিলেন এবং সে নগ্নতার নন্দন-চাঞ্চল্য আজলা ভরে পান করতে চেয়েছিলেন! 


চয়ন খায়রুল হাবিব

২৯/১২/২৩

ব্রিটানি, ফ্রান্স


দীপা হক। ১/৭/১৯৫৩ - ৪/০১/১৯৯।

Copyright declaration : Except one painting by Mattise, all other artworks here are the works of late Bangladeshi artist Deepa Haq.

Text copyright : Choyon Khairul Habib.