Tuesday, 23 March 2010

আবিদ আজাদ, বয়রার ডেন এবং মৌল রুমাল :

উনিশ বছরের কবিতাগুলো


আমার সতেরো থেকে উনিশ বছরে লেখা কবিতাগুলো'র দিকে তাকালেই মনের গহিনতমো কোন থেকে প্রয়াত কবি আবিদ আজাদের প্রতি এক তিব্র ধুশ শালার গালাগাল উঠে আসে। কবিতাগুলো আমার বড় ধরনের সম্পন্ন ফেরার জায়গা হওয়াতে ধুশ শালাটাও প্রতিধ্বনিত হতে থাকে চাপা গোমরানো হতাশ হাহাকারে!

আমার উনিশ বছর বয়সে কবিতাগুলো প্রথমে ছাপেন আবিআ ওনার 'কবি' পত্রিকায়। তারপর সেগুলো জায়গা করে নেয় আমার 'মৌল রুমাল' গ্রন্থিকায়। গ্রন্থিকাটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা, ফন্ট সেটাপ করে প্রয়াত কবিবন্ধু আহমেদ মুজিব, প্রচ্ছদ পোট্রেট তুলেছিল প্রয়াত বন্ধু অর্থনীতিবিদ  কাফি বিল্লাহ।

চয়ন  খায়রুল হাবিব। ১৯৮৫। ফটো :  আইনুল হাবিব।

'কবি' পত্রিকাতে আমার প্রথম ছাপানো কবিতার সবগুলোই ৫ থেকে ১২ লাইনের। তারপর সেই একই পত্রিকাতে সেই উনিশেই ১০০ পংতি'রও বেশি  'মৌল জন্তুর ভাষা' কবিতা'টা প্রকাশের সময় আবিআ  লেখেনঃ

"আশির দশকের কবি খায়রুল হাবিবের অতি ছোট্ট এবং টুকরো টুকরো সুন্দর অসংলগ্নতা-স্নাত আত্ম-উন্মিলনী কিছু কবিতার সংগে ইতিমধ্যে যারা পরিচিত হয়েছেন- দীর্ঘ কবিতায় তারা নিশ্চয় এই তরুন কবিকে আস্টেপৃষ্ঠে অবলোকনের সুযোগ পাবেন।"

এটার পেছনে পরতের পর পরত কিছু কাহিনী আছে। আশির শুরুতে আবিদ আজাদের ছোট্ট 'শিল্পতরু প্রেস' ছিলো ঢাকেশ্বরি মন্দিরের উলটো পাশে। আমার আজিমপুর বাসা থেকে ১০ মিনিটের হাটা পথ। আজিমপূরের বন্ধু কচি ওরফে প্রেসের কবিতা সংগ্রহের লেখক আহমেদ মুজিব তখন শিল্পতরু প্রেসের ম্যানেজার। কচি ছিলো আমার দুই, তিন বছরের বড়। কচি, আমি সহ আজিমপূরের কিছু বন্ধু তখন ফুটবলের মাঠ থেকে রাত, দিনের তাস পিটানি, আড্ডাবাজি এবং কবিতার দিকে ঝুকেছি। কচি পরিচয় করিয়ে দেয় আবিদ আজাদের সাথে, আর সেখানে নিয়মিত আসা রিফাত চৌধুরী, কাজল শাহনেওয়াজের সাথে। শিল্পতরুতে তখন আরো আসতো বুলান্দ জাভির, পুলক হাসান, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারসহ সারা বাংলাদেশের তরুণ কবিরা। 

কিছু দিনের ভেতর রিফাত, কাজলের সাথে আমার খুব খাতির হয়ে যায়। রিফাত প্রতি দিন আজিমপুরে  আসতে থাকে।  কচি এবং স্থানীয় বন্ধুরা সহ আমরা আড্ডা দিতাম রাস্তার পাশে ব্যাড়াতে ছাওয়া জামাইর হোটেলে। পাশেই সাবেক রাস্ট্রপতি সায়েমের বাসা। কাজল তখন মকৃবির ছাত্র। খাতিরের পর থেকে ঢাকায় এলে কখনো আমার বাসায়, কখনো মোহসিন হলে মামার রুমে থাকতো। আমিও প্রায়ই মকৃবিতে যেতাম কাজলের কাছে। কখনো রিফাতের সাথে, কখনো যমজ বোনকে নিয়ে, কখনো ঢাবির প্রেমিকাকে নিয়ে। বোনকে পৌছে দিতাম ময়মনসিংহ জেলের জেইলার চাচাত ভাইর বাসাতে, প্রেমিকা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃ হবার সুবাদে উঠতো মকৃবির ছাত্রী নিবাসে। 

আমাদের এই আগুপিছুর প্রধান ব্যাপার ছিলো, ঘুম, খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় পড়া বাদে রাতদিন ২৪ ঘন্টা সাহিত্যের আলাপ। শুস্কমঞ্জরি বা গাজা সেবনও একটা নৈমিত্তিক  বিনোদনমূলক ভূমিকা রেখেছিলো। মকৃবিতে অবশ্য কাজলের সুবাদে ওনার গঞ্জিকা সার্কেলের বাইরেও অনেকের সাথে পরিচয় হয়, যার ভেতর বিশ্ববিদ্যালয় গন্ডি বেরোবার পরেও ঘনিষ্ঠতা বজায় থাকে কুদরতে মওলা, আতিক জামান ওরফে আতিক ভাইর সাথে। এই সার্কেলে আরেক নিয়মিত ছিলেন মুক্তা ভাই, মুরাদ ভাই এবং কবি নিয়ামত। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে মকৃবির এই সাহিত্য এবং গঞ্জিকা সার্কেলেও একটা প্রটোকল ছিল। এটা বুঝতে পারি কাজল মকৃবি থেকে ঢাকায় চলে আসার পর ঢাকাতে যখন সেখানের ছাত্র প্রয়াত অমিতাভ পালের সাথে পরিচয় হয়। কাজল, অমিত ছাত্রকালীন অবস্থাতে ঘনিষ্ট থাকলেও আশির যে ক বছর মকৃবিতে যেতাম, সেখানে কিম্বা ঢাকার যে শিল্পতরুতে কাজল আসতো, সেখানেও অমিতের সাথে দেখা হয় নাই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পর আমরা বিভিন্ন চাকুরিতে ঢুকে গেলে, তখন  মকৃবির যে সার্কেলটি গ্রিন রোডের এমবিএ হোস্টেলে মুরাদ ভাইর রুমে সমবেত হতো, সেখানে অমিতকে পাই। তখন এই সার্কেলটি শুস্ক মঞ্জরি ছেড়ে হার্ড ড্রাগে পর্যবসিত। আর আমি তখন গাজাও ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য তার বাইরেও শাহবাগের আড্ডাগুলোতে অমিতের সাথে দেখা হতে থাকে। আমি দেশ ছেড়ে চলে আসলেও কাজল সম্পাদিত 'ফৃ স্ট্রিট স্কুল' পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের গাটছড়া বজায় থাকে। পরে যখন ফেসবুকে 'জুলেখা সিরাপ মেটাভার্স' গ্রুপ হয়, অমিত সেখানে আমৃত্যু লেখালেখি পোস্ট করেছে।  

৯০র দিকে আবিদ আজাদের প্রেস ঢাকেশ্বরি থেকে কাঠাল বাগানে চলে এসেছে। ট্রেডল মেশিনের পাশে এসেছে ইয়া বড় অফসেট যন্ত্রপাতি। কচি কিছু দিন সেখানে ম্যানেজারি করে অন্য প্রেসে চলে গেছে।  আমি তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চাকুরি কাজে লাগিয়ে স্থায়ী ভাবে দেশ ছাড়ার ফিকির করছি। ইতিমধ্যে ১৯৮৮তে আমার বড় ভাই,  বাংলাদেশের প্রথম সুপারসনিক পাইলট ফ্লাইট লেফটেনেন্ট আইনুল হাবিব মিগ২১ ক্রাশে মারা যায়। কিছু দিনের ভেতর চারুকলার ছাত্রী, আমার যমজের কয়েক বার স্নায়বিক বিপর্যয় ঘটে এবং সিজোফ্রেনিয়ার প্রকোপ শুরু হয়। সবচেয়ে বড় বোন বাদে, অন্য দুই বড় বোন দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমাদের আজিমপূরের এক তলা বাসাটি খুব শিঘ্রি রুপান্তরিত হয় এলান পোর, 'ফলেন হাউস অফ দা আশারে'। 

বড় ভাইর মৃত্যু সংবাদের পর পর আমার সাথে বাসায় এসে সমবেদনা জানিয়ে যান অগ্রজ কবি মুহাম্মদ সামাদ এবং আবিদ আজাদ। আবিদ ভাই বাসায় এসেছিলেন কচিকে নিয়ে। উনি আমাকে কখনো ডাকতেন চয়ন, কখনো খায়রুল। ভাইর মৃত্যুর পর বাসায় এসে আমাকে বলেন, 'আপনি যে এ বাসাতে থাকেন আমি জানতাম না, আপনার কবিতা পড়ে মনে হতো, এ বাসাতেই হয়তো আপনি থাকেন।' আবিদ আজাদ নবাবগঞ্জ থাকাকালীন কয়েক বছর প্রতি দিন রিক্সায় আমাদের বাসা পার হতেন। আরো পার হতেন নির্মলেন্দু গূন। পথ থেকে দেখলে, আমরা যারা চিনতাম ওনাদের সালাম দিতাম।

আমার বড়  ভাইর মৃত্যু সংবাদে, আবিদ ভাই এলে আমি যেরকম থম মেরে ছিলাম, কিছু দিন পর সেরকম থম মেরে থাকতে দেখেছিলাম ওনাকে কিশোরগঞ্জের পৈতৃক নিবাসের রোয়াকে। ওনার স্ত্রী রানু, এক অস্ত্রপচারের গোলমালে মারা যান ময়মনসিংহ হাসপাতালে। ওনাদের ছেলে তখন কোলের শিশু। খবর পেয়ে কচি, রিফাত, আমি চলে যাই কিশোরগঞ্জ ওনার সাথে দেখা করতে। সকালের ট্রেন ধরে পৌছাতে পৌছাতে দুপর। রাস্তার ধারে এক পুকুরে গোসল করে, ওনার বাসার কাছাকাছি হতে দেখি লুঙ্গি, হাফ হাতা গেঞ্জি পরে টিন চালা বাসার রোয়াকে বসে আছেন চুপ করে। আমাদের দেখে অবাক হলেন। স্ত্রীর চিকিৎসার সময় ময়মনসিং মেডিকেলের ডাক্টারদের সাথে কবিতা বিষয়ে আলাপের কথা জানালেন। কিছুক্ষন ওনার সাথে এটা ওটা বলে, বিদায় নিয়ে আমরা মকৃবির দিকে চলে গেছিলাম।          

আজিমপুরে আমাদের নাম দেয়া 'বয়রার ডেন' ছিলো কাজল, রিফাত, আমাদের আরেক নিয়মিত গন্তব্য। বয়রা হলেন ছোটখাটো, কিন্তু দশাসই এক সাবেক মুক্তিযোদ্ধা প্লাস কাঠের কারিগর। তার বানানো তুমুল খোদাই কারুকাজসহ বিপুল পালঙ্কগুলো এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। সবাই বয়রা ডাকতো, কারণ সে কানে শোনে না, কথাও বলে বোবা, আড়ষ্ঠ ভাবে। এই মোটা লোকটা সব সময় দামি লুঙ্গি পরে থাকতো, কিন্তু ঊর্ধ্বাঙ্গ সব সময় অনাবৃত। আজিমপুরে চুড়িপট্টিতে বয়রার পৈতৃক বাসার লাগোয়া ছিল তার কারখানা। মাটির মেঝে, ব্যাড়ার ঘরের সে কারখানাই ছিলো বয়রার গাজা ব্যাবসার বৈঠকখানা। কাজল, রিফাত, আমার লেখায় এই বয়রার ডেন অনুষংগ, তুলনা, প্রতি তুলনা হিসেবে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। আমার কাছে বয়রার ডেনকে আমাদের আজিমপুরের দুই পাশে বাগান ওয়ালা বাংলো বাড়ির উঠানের অংশ মনে হতো। টেকনোক্রেটিক পরিবারের আবহে শেখানে একটা প্রলেতারিও রোমাঞ্চও কাজ করতো।

এই আবহতেই ১৯৮৪ বা ৮৫তে আবিদ আজাদ আমাদের সবার প্রতি দীর্ঘ কবিতা লিখবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। কাজল, রিফাত, কচি এবং আমাকে এক সাথে জানান যে একটি দীর্ঘ কবিতা দিয়ে একটি একক সংখ্যা করবেন। সে অনুযায়ী কিছুদিনের ভেতর আমি মৌল জন্তুর ভাষা লিখে ওনার হাতে দেই। উনি এক বসাতে পড়ে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেন। কয়েক দিন পর কচি জানায় যে কবিতাটাকে একক কবি সংখ্যা হিসেবে কম্পোজ করা হচ্ছে। পরে 'মৌল রুমাল' গ্রন্থিকার পরিচিতিতে যখন আবিদ আজাদ  'অসংলগ্নতাস্নাত আত্ম-উন্মিলনী'  টার্মটি ব্যাবহার করেন, তা এক অর্থে  ঢাকেশ্বরীতে শিল্পতরু প্রেসে কবি পত্রিকা ঘিরে জড়ো হওয়া তরুন কবিতা সম্মিলনির একটি যথার্থ শিরোনাম।
        
ধুশ শালার!আবিআ জান্তা আয়োজিত কবিতাকেন্দ্রে যোগ না দিলেত একজন মেজর কবির সত্যায়নের জোরে আমিও মেজর কবি হয়ে  যেতে পারতাম!ধুশ শালার!যাক, আমার কবিতা উনি যখন লিখে দেন নি তখন ওনার কর্মফলের দায়ভার নেয়াও অনর্থক!মেজর, টেজরের চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ধুশ, ধুশ, শালার, শালার!

প্রথম কবিতাগুলোকে আমি পরিনত অমিনাস পয়েন্ট হিশেবেই দেখি!নিত্যকার ব্যবহারিক সামগ্রির সাথে আত্মিক সংলগ্নতার ভারসাম্যই ছিল সেই অমিনাস পয়েন্টঃ সেখান থেকে দির্ঘ কবিতার বিস্তারে আমাকে কখনোই ছন্দ, উতপ্রেক্ষা, ভাষা, শব্দের ওপর ভর করতে হয় নি! সেই অমিনাস পয়েন্টেরই বিস্তার আমার ব্যক্তিগত 'দেহছন্দ' এবং 'ভাঙ্গা লিরিকের মোজাইক'।

বিলাতে স্থায়ী হবার প্রাথমিক সংগ্রাম ঠেকে ফরাসিনি প্যাট্রিসিয়ার সাথে পরিচয় সূত্রে সামাজিক, নান্দনিক যে সাইকেডেলিয়ার ভেতর আমি আজ অবধি বাঙলা সাহিত্যকে চর্চায় ধরে রেখেছি, তারই প্রযুক্তিগত রুপায়নকে এখন বলা হচ্ছে ওয়াইড ল্যাঙ্গুয়েঞ্জ বেসড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। কিন্তু আমার যাত্রাপথ আর্টিফিশিয়াল নয়, বরং জেমস জয়েস ইউলিসিস লিখতে যে মগ্ন চৈতন্য প্রবাহ/Esteem Of Self Consciousness প্রায়োগিক ভাবে ব্যাবহার করেছিল, সে রসায়নে জারিত। আইরিশ জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেটদের ডাবলিন ছেড়ে আসতে হয়েছিলো, ব্রিটিশ আরোপ এবং ক্যাথলিক আবদ্ধতা উত্রে আসতে। 

আমি বাংলাদেশ ছেড়েছিলাম পারিপার্স্বিকতায় সতির্থদের পাশাপাশি পুরো একটি প্রজন্মের মাদকগ্রস্থ অবস্থায়। কায়েমি স্বার্থ থেকে গণতন্ত্রহীনতা এবং সরকারি মদদে মাদক ছড়িয়ে প্রজন্মের প্রাণ শক্তি হরণের প্রক্রিয়া ঘটেছিলো একই সময়। সাথে যোগ হয়েছিলো পারিবারিক বিপর্যয়। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্গত নান্দনিক অস্তিত্ব ধারণ এবং মগ্ন চেতনার বিকাশে আমাকে যে অতি মাত্রায় সচেতন থাকতে হবে, দেশ বদলের সন্ধিক্ষনে তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। 

সে বুঝ থেকে 'মৌল জন্তুর ভাষা' লিখবার সময় যেরকম চিন্তা, হাতের কলম একত্র হয়ে রুপান্তরিত হতো যৌগিক ক্যানভাসে, পরে তাই বদলেছে চিন্তা, কম্পিউটার টাইপের দ্রুতলয় মিশ্রনে। এ সব কিছুর অবশ্য দৈহিক মূল্যও আছে। সেই আজিমপূরের বয়রার মত, কখন শ্রবন শক্তি হারাতে থাকি, তা আর বুঝতে পারি নাই। আবার শ্রবন শক্তি হারাবার সময়েও স্বরলিপি বুঝে ওঠার প্রক্রিয়াটা, সনেট বা ছোট গানের বিশ্বায়িত ছন্দ কম্বিনেশন আয়ত্ত করবার মন্ত্রগুপ্তি লুকিয়ে ছিলো আশির দশকে লেখা ছোট্ট, ছোট্ট সেই সম্পন্ন কাব্য সম্ভারে!  

এখানে তুলে দিলাম সেই প্রথম প্রহরের কয়েকটি কবিতাঃ

মৌল রুমালঃ

ঘরে কেউ নেই।জানালা দরোজা সব বন্ধ করে
পূর্ণিমা আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়...

সিধ্বান্ত বদলালাম। এই কবিতাটা দেই একেবারে শেষে!

বিজন সঙ্কেতঃ

বিষয়ান্তর যন্ত্রকাতরতায়
পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন ধীরে ধীরে ধীরাশ্রম
সংস্থাপনের ভয়ে তীব্র ছোটাছুটি
স্পর্শ-সুখের ভিতর বালু হয়ে যাওয়া
মগজে গুমরে কাদে প্রবল নেকড়ে নখ
নেকড়ে নেই জলপ্রপাত নেই
বেচে থাকা সুলভ কাগজের মতো নির্জন
প্রতিদিন নৌকা বাইচের মতো নিহত হয়ে যাব

ব্যক্তিত্বঃ

সকাল আটটার বাসস্ট্যান্ড-
অফিসগামি লোকজনের ভিড়ে দাড়িয়ে আছে
ক্ষয়াটে চেহারার পাগলাটে লোকটা
জট পাকানো চুল দাড়ি মোচ
গর্তে বসা চোয়াড়ে চোখ ভাটার আগুনে জ্বলছে
খালি গা হাটু গোটানো তেল-চিটচিটে-প্যান্ট
খোলা পোস্টাফিসের ফাক দিয়ে উকি দিচ্ছে
ভেজা-ভাদ্র-কুকুরের-জিহবার মতো তেড়ে ওঠা নুনুটা-
অপেক্ষা করছে কখন প্রেমিকা এসে
দাত জিব থুতু বুলিয়ে বেমালুম ভুলিয়ে দেবে
নিজের বাহির থেকে নিজের ভিতরকে স্মরণ

পাতাল সংলাপঃ

মাছ নয় মাংস, মাংসময় মাছ
দ্রুত উচ্চারন কর- জগতজননী প্রসিদ
যাহারা দীক্ষা লাভ করে তাহাদের দক্ষ বলা হয়
ভদ্রতা নির্নিত হবে
সুকৌশলে না এড়িয়ে মুন্ডুকাটা খাও
চেহারাচর্চা ঘর-সারিবধ্ব চেয়ার
মাঝখানে মঞ্চ শুধু জোড়ানো আর খোলা
কৌতুহল পরিব্রাজিত অনাবিস্কৃত প্রত্যন্ততায়
তড়িৎ প্রবহমান আঙ্গুল থেকে আঙ্গুল
পতংগ কিট।সংগায় করেছি ধারণ অপহরণের এন্টেনা
শেষমেষ একই শহরে এখন অনেক সুদূর
মানসের সন্ত্রাস মানসিকে খোজে
খুজে পেলে মন খারাপ, হারালেও মন খারাপ

মধ্যবিত্ত ম্যাডোনাঃ

বাচ্চা কোলে বসে আছো মধ্যবিত্ত ম্যাডোনা
দুধ শুকিয়ে বিরান বুক, ভেবেছ কি তুমি?
টাকা আসবে স্বর্গ থেকে? কত শুক্কুরবার এলো গেলো।
থলি থেকে সাদা-কালো কোন বিড়ালই বের হ'লোনা।
মরা উকুন খেতে-খেতে
বাচ্চা তোমার হাটা শিখলো এক্কেবারে আপ্না-আপনি

চাকর হ'লো তোমার বাচ্চা, শুলো গিয়ে মনিব-ফ্ল্যাটের বারান্দায়
বাতিল আসবাবপত্রের জঞ্জালে দেখতে পেল-
চোখ না ফোটা কয়েকটা বিড়ালছানা।
মা-বিড়ালটা একদিন কোথায় যেন গিয়েছে।
ভারি একটা ভাঙ্গা খাটের পায়া দিয়ে
বাচ্চা তোমার ছেচে দিল সবকটা বিড়ালছানার মাথা

মৌল রুমালঃ

ঘরে কেউ নেই।জানালা দরোজা সব বন্ধ করে
পূর্ণিমা আয়নার সামনে যেয়ে দাড়ায়
পোষাকগুলো খুলে রেখে কাপা-কাপা আলতো আঙ্গুলে
কুমির-বিস্ময় নিয়ে পূর্ণিমা ছুয়ে-ছুয়ে দেখে
যোনিগাত্রে গজানো প্রথম নরম লোম

প্রথম প্রকাশিত হয়  'কবি'তে ১৯৮৬/৮৭তে
'মৌল রুমাল' গ্রন্থিকাতে স্থান পায় ১৯৯১তে
সবগুলো লেখা ঢাকাতে


চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রথম লেখা ২৪/০৩/১০
পরিমার্যনা, ৬/০৯/২৫