বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত। রাজা রবি ভার্মার 'শকুন্তলা' তেলচিত্র এবং 'রাং রাসিয়া' চলচ্চিত্রের ক্রিটক সহ।
শকুন্তলা আজকাল
দৃশ্য ৩
অন্ধকার, সংকীর্ণতা, নেশার কুয়াশা ও স্বপ্নের বিভ্রমের অনুভূতি |
রাজদরবারের অলিন্দ। আলো অল্প, দেয়ালে ছায়ারা লম্বা হয়ে পড়ে, শকুন্তলা দাঁড়িয়ে—অস্থির, বিষণ্ণ। তার কণ্ঠস্বর ধীর, কিন্তু তীক্ষ্ণ। যেন সে ফিসফিসিয়ে বলছে, আবার গর্জনও করছে।
শকুন্তলা:
আমি এসেছি, রাজা!
তুই কি মনে রাখিস?
একদিন তুই প্রতিজ্ঞা করেছিলি,
আমার হাত ধরেছিলি, আমার চোখে চেয়েছিলি—
আজ তুই কোথায়?
এই দরবারে গন্ধ নেই,
কেবল বাষ্প, ধোঁয়া,
পিছনের গলির পচা জল,
আর মন্ত্রীদের ফিসফাস!
"রাজা এখানে নেই!"
"রাজা নেমে গেছে নীচের অন্ধকারে!"
"রাজাকে খুঁজতে হলে নামতে হবে কানাগলির শেষে,
সেই গর্তে, যেখানে আলো পৌঁছায় না!"
আমি কি নেমে যাবো?
আমি কি নামতে পারবো?
(আলো নিভে যায়, শকুন্তলা অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। বস্তির নেশার গলি – নরকের প্রথম স্তর। আলো ভারী, তীব্র লাল, ধোঁয়ায় ঢাকা চারপাশ। শকুন্তলা হাঁটে, পথ যেন সংকীর্ণ হতে হতে তাকে গিলে ফেলতে চায়। গলি সরু—কেবল একটা শরীর ঢোকার জায়গা। তার কণ্ঠ দ্রুত হয়ে ওঠে, যেন শ্বাস নিতে পারছে না।)
শকুন্তলা:
এ কেমন গলি?
এ কেমন দেয়াল?
এ কেমন ঘর, যেখানে জানালা নেই?
এ কেমন পথ, যেখানে আলো ঢোকে না?
দেয়ালে হাত রাখি—
এটা ইট? না মাংস?
শরীরগুলো পড়ে আছে,
কেউ নড়ছে না, কেউ জানে না আমি এসেছি!
"রাজা? রাজা?"
নিঃশ্বাস টেনে নিই—
বাতাস নয়,
পচা আফিম, পোড়া হেরোইন,
বদহজম হওয়া স্বপ্নের গন্ধ।
ওই কোণায় একজন বসে আছে,
নিমজ্জিত, স্নায়ুহীন,
সে কি মানুষ? না ছায়া?
তার চুল জট পাকানো,
তার আঙুলগুলো কুঁকড়ে গেছে ধোঁয়ায়!
আমি জিজ্ঞেস করি,
"রাজা? দুষ্মন্ত?"
কেউ উত্তর দেয় না।
শুধু অন্ধকার হাসে।
শুধু এক ভাঙা কণ্ঠ বলে—
"সে এখানে নেই!"
"সে ওপরে উঠে গেছে, উঁচু বিল্ডিং-এর পেন্টহাউসে!"
(শকুন্তলা থমকে দাঁড়ায়। তার কণ্ঠ বদলে যায়—তীক্ষ্ণ থেকে স্থির, ধোঁয়ার চেয়েও হালকা।)
শকুন্তলা:
রাজা!
তুই নরকের নিচের স্তর ছেড়ে
স্বর্গের দিকে উঠলি?
নাকি এই নরকই উঁচুতে উঠে গেছে?
(আলো ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, দৃশ্যান্তর।কর্পোরেট ক্লাবের পেন্টহাউস – নরকের শেষ স্তর।আলো ঝলমলে—কিন্তু নিস্তেজ, কৃত্রিম, শীতল। বিশাল কাচের জানালা, শকুন্তলা যেন মহাকাশে ভাসছে। আগের দৃশ্যের আঁধার এখানে নেই, কিন্তু ভয় আরও গভীর।)
শকুন্তলা:
এ কোথায় এলাম?
নেশা এখানে ভিন্ন,
কিন্তু বিষ এক!
নীচে মাটি, ধুলো, ঘামের গন্ধ ছিল,
এখানে শুধু এয়ার ফ্রেশনার,
বিলাসী হুইস্কির ধোঁয়া,
সাদা কোকেনের ছিটেফোঁটা!
রাজা!
তুই কি এখানে বসে আছিস?
তুই কি স্বপ্ন দেখছিস, নাকি স্বপ্ন বিক্রি করছিস?
সামনে কাচের জানালা,
তার ওপাশে শুধু আলো, শুধু আকাশ,
রাজা সেখানে দাঁড়িয়ে—
সে যেন মোমের তৈরি,
তার চোখের তারা নিভে গেছে,
তার আঙুল কাচের টেবিলে নীরবভাবে পড়ে আছে!
"দুষ্মন্ত!"
সে তাকায়, কিন্তু চেনে না!
সে শোনে, কিন্তু বোঝে না!
তার ঠোঁটে এক ব্যঙ্গের হাসি,
তার চারপাশে সঙ্গীরা—
নেতিয়ে পড়া গলায় এক অদ্ভুত গানের সুর।
আমি কি ভুল করলাম?
আমি কি নিচে থাকা নরক ছেড়ে আরও গভীর এক গহ্বরে এলাম?
"সে এখানে আছে, কিন্তু নেই!"
"সে আকাশে উড়ছে, কিন্তু নিচে পড়ে আছে!"
আমি পেছনে হাঁটি, জানালার দিকে তাকাই।
নিচে দেখি—
ঢাকার সেই বস্তির গলি,
তাদের পচা বাতাস, তাদের অন্ধকার,
তারা অন্তত সত্য ছিল!
এখানে?
এখানে সত্য বলে কিছু নেই!
(শকুন্তলা থমকে দাঁড়ায়, তার কণ্ঠ স্তিমিত। হালকা ফিসফিস।)
শকুন্তলা:
মেনকা, মা, তুমি ঠিক বলেছিলে।
পৃথিবীর পুরুষ ভালোবাসতে জানে না!
সে শুধু খুঁজতে জানে,
নিজেকে ভুলতে জানে,
নেশার গর্তে, অথবা আলোয় ভেসে থাকা পেন্টহাউসে!
সুলতান হাতির পিঠে চড়ে
স্বপ্নের মেয়েকে খুঁজতে গিয়েছিল,
সে সাগর আর আকাশ সেলাই করছিল!
আর দুষ্মন্ত?
সে কেবল নেশার কুয়াশায় নিজেকে খুলে দিচ্ছে,
নিজেকে হারিয়ে ফেলছে!
(আলো ধীরে কমতে থাকে। শকুন্তলা পেছনে হাঁটে। পেন্টহাউসের আলো নিভে যায়, নীচের বস্তির আঁধার দেখা যায়—কিন্তু এবার সেটা ভয়ঙ্কর নয়, বাস্তব। শকুন্তলা নিঃশ্বাস নেয়, শেষ লাইন বলে।)
শকুন্তলা:
রাজা, তুই ছিলি নরকের প্রথম স্তরে,
এখন তুই নরকের শেষ স্তরেও পৌঁছে গেছিস!
আমি ফিরে যাবো!
আমি তোকে আর খুঁজবো না!
(আলো সম্পূর্ণ নিভে যায়।
(আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, মেনকা দাঁড়িয়ে থাকে, যেন উত্তরের অপেক্ষায়।)
মেনকা :
আমি ছাত্রছাত্রীদের আরেকটা এসাইন্টমেন্ট দিয়েছিলাম, রাজা রবি ভার্মার আকা শকুন্তলাকে কিভাবে দেখা যায়? আর রবি ভার্মাকে নিয়ে তৈরি ‘রাং রাসিয়া’ সিনেমাতে শিল্পী ও মডেলের সম্পর্ক কিভাবে দেখা যায়?
(মৃদু হেসে):
"রাজা রবি ভার্মার শকুন্তলা নিয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদের পর্যবেক্ষণগুলো বেশ মজাদার। কেউ কেউ লিখেছো, ছবিটি ‘সুন্দর’, কারও মতে এটি একান্তই শিল্পীর কল্পনা। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলো— এই শকুন্তলা কি সত্যিকারের সেই শকুন্তলা, নাকি ইউরোপীয় শিল্পরীতির প্রতিফলন?"
(একটু থামেন, যেন ছাত্রছাত্রীরা কিছু বলছে। তিনি মাথা নেড়ে শোনার ভঙ্গি করেন।)
মেনকা :
"একজন বললেন, ‘শিল্প তো শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, তাই না?’ ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি কার দ্বারা প্রভাবিত, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। রবি ভার্মার সময় ভারতে ইউরোপীয় শিল্পশৈলীর গভীর প্রভাব ছিল। তার শকুন্তলা কি প্রকৃতপক্ষে এক বনবাসিনী, নাকি ইউরোপীয় সৌন্দর্যের ছাপে গড়া এক আদর্শ রমণী?"
ওদের কয়েকজন জানালো যে ওরা নিজেরাও মডেলিং করো, এবং সেখানে ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক, ভঙ্গি সব ঠিক হয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। তাহলে কি রাজা রবি ভার্মার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো? তার সময়কার অভিজাতরা যেভাবে ইয়রোপিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করে নিচ্ছিলো, শেখানে থেকে তিনি শকুন্তলাকে দেখেছিলেন।
(একটু থামেন, তারপর বোর্ডের দিকে ইঙ্গিত করেন)
মেনকা :
শকুন্তলার ছবিতে আমরা দেখি স্নিগ্ধ, কুণ্ঠিত এক নারী— তার দৃষ্টি মাটির দিকে, তার শরীরের রেখায় এক ধরনের কোমলতা। কিন্তু প্রকৃত শকুন্তলা কি এমনই ছিলেন? কুষাণ রাজাদের মুদ্রায়, প্রাচীন ভাস্কর্যে যে নারীমূর্তি দেখা যায়, তার সঙ্গে কি এ মিল খুঁজে পাওয়া যায়?"
রঙ রসিয়া সিনেমার কথা এলো বারবার। অনেকের মতে, সিনেমাটি দেখিয়েছে রবি ভার্মার লড়াই— একজন শিল্পী কীভাবে সমাজের রক্তচক্ষু সহ্য করে নিজের কাজ করে গেছেন। কিন্তু আমি জানতে চাই, সে লড়াইটি কাদের বিরুদ্ধে ছিলো? কেবল নীতিপুলিশদের বিরুদ্ধে, নাকি তার নিজের শিল্পভাবনারও একটি সীমানা ছি্লো?"
(একটু থামেন, যেন ছাত্রছাত্রীরা ভাবছে।)
সিনেমাটি কি দেখায়, তার মডেল সুগন্ধার কণ্ঠস্বর ছিলো? তার সম্মতির জায়গাটি কোথায়? এক শিল্পীর দৃষ্টিতে যে নারী হয়ে ওঠে নিখুঁত রূপের প্রতীক, সে নারীর নিজের অভিজ্ঞতা কি আমরা জানতে পারি?"
মেনকা :
তোমরা কি লক্ষ্য করেছো, দুষ্মন্ত যখন প্রথম শকুন্তলাকে দেখলেন, তখন তার কী প্রতিক্রিয়া হয়? তিনি বিমোহিত হলেন, আকর্ষিত হলেন, এবং শকুন্তলাকে নিজের মতো করে ভাবতে শুরু করলেন।"
(একটু থামেন, তারপর গভীর স্বরে বলেন।) আমরা কি এখানে রবি ভার্মার দৃষ্টির প্রতিফলন দেখতে পাই? তিনিও কি শকুন্তলাকে তার নিজস্ব দৃষ্টিতে নির্মাণ করেন নি?"
(একটু থামেন, তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন ।)
শোনেন ভাইসব, আপাগন, যখন লেকচারার ছিলাম, তখন ছিলাম ছাত্রদের বয়সের কাছাকাছি। এখন আমার ছাত্রদের সাথে তিন জেনারেশান বয়সের পার্থক্য। এটাকে গ্যাপ না করে, সেতু বানানো কঠিন। আমি এই কঠিনটুকু পেরিয়েছি ওদের খেলায় অংশ নিয়ে। আমার প্রিয় ছাত্রী নীলিমাকে বেশি নাম্বার দিতে দিতে এমনই আশকারা দিয়েছি যে, এসাইন্টমেন্টের শিরোনাম দিয়েছে, রাং রাসিয়ার মাল। ওর এসাইন্টমেন্টটা সঙ্খেপে পড়ে শোনাই। শুনলে মনে হবে ললিপপ। একটু দম নিয়ে নেন। এবার একটু টানা একাডেমিক সংলাপ। অনেক ললিপপ দরকার হবে।
নীলিমার এসাইন্টমেন্ট পড়ছি। শিরোনাম ‘রাং রাসিয়ার মাল’।
ম্যাডাম আমাদের এসাইনমেন্ট দেবার পর এক সাথে গ্রুপ স্টাডি করছি, সায়মা বলে উঠলো, তুইতো রঙ রসিয়ার মাল, যেই দিকেই যাইবি সবাই টালমাতাল। সায়মা রঙ রাসিয়ার মাল কথাটা এতো অকপটে, অনায়াসে বললো, তার সাথে মিলায়ে আমি কালিদাসের আলঙ্কারিক শকুনতলাকে দেখতে চাইলাম। ফোকাস ঝাপসা হয়ে গেলো। বনকে মনে হলো রিসোর্ট।
দুষ্মন্ত যেমন শকুন্তলার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের কল্পনার নারীতে পরিণত করলেন, রবি ভার্মাও তেমনই করেছেন। কিন্তু তখনকার সমাজের চোখে, ‘নারীর আবেদন’ কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তিনি দেবী। দুষ্মন্ত, ভিয়াসা দেব, কালিদাস, রাং রসিয়ার নির্মাতা সবার কাছেই শকুন্তলা মাল, কিন্তু সায়মার মত অকপটে তা বলছে না।
রবি ভার্মার আঁকা সরস্বতী বা লক্ষ্মী প্রশংসিত হয়েছে, কিন্তু যখন তিনি সাধারণ নারীকে চিত্রিত করলেন, তখনই তিনি বিতর্কের মুখে পড়লেন। এবার আমি আরেকটি প্রশ্ন তুলতে চাই। শুধু রাজা রবি ভার্মাই কি শকুন্তলাকে নতুন করে কল্পনা করেছেন? নাকি এর আগেও তার রূপান্তর ঘটেছে?
মহাভারতে শকুন্তলা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়। কিন্তু কালিদাস যখন ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ লিখলেন, তখন তার চরিত্র পেল এক নতুন মাত্রা— এক অপেক্ষমাণ, কোমল হৃদয়ের নারী, যিনি দুষ্মন্তের স্বীকৃতির আশায় পথ চেয়ে বসে থাকবেন। সায়মা, আমার বন্ধুদের বুলিতে যেটা মাল, কালিদাসের কলমে যা শাশ্বত তা রাবি ভার্মার তুলিতে তা আবেদন, তখনকার ইয়রোপিয় আবেদন, যার সাথে এখনের আবেদন মিলছে না। Nobody calling the spades as spades!
নীলিমা আরো লিখেছে, তাহলে কি কালিদাসও সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী এক নতুন শকুন্তলাকে নির্মাণ করলেন? রাজার কৃপা পেতে হলে যাদের বনবাস থেকে নগরে আসতে হবে। সেই যে লক্ষিন্দরের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে বেহুলাকে ইন্দ্রের সভায় নাচতে হয়েছিলো।
মহাভারত কি বিজয়ীদের দৃষ্টিতে পরাজিত নারীদের গল্প বলে? শকুন্তলা কি তখন একজন শক্তিশালী নারী ছিলেন, না কি কেবল প্রেমের প্রতীক্ষায় থাকা এক সৌন্দর্যময় প্রতিমা হয়ে উঠলেন?"
শিল্প সময়ের সঙ্গে বদলায়, কিন্তু কিছু প্রশ্ন চিরকাল থেকে যায়। রাজা রবি ভার্মার শকুন্তলা, কালিদাসের শকুন্তলা, মহাভারতের শকুন্তলা— তাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যিকারের কে? আর আমরা কীভাবে আমাদের চোখ দিয়ে শকুন্তলাকে দেখবো?
(একটু থামেন, গভীরভাবে শোনার ভঙ্গি করেন, তারপর ধীরে ধীরে বলেন,
নীলিমা শেষে এসে লিখেছে, তাহলে কি শকুন্তলা আজও আমাদের শিল্পীদের দৃষ্টিতে বন্দি? নাকি এবার আমরা নিজেদের মতো করে তার গল্প নতুনভাবে বলবো?
আর যে সায়মাকে কোট করে, নীলিমা শিরোনাম দিয়েছে, সে সায়মা টান মেরেছে শকুন্তলাকে নিয়ে যারা যেসময় লিখেছে, তাদের ভাষা নিয়ে। ওর প্রথম প্রশ্ন, কালিদাস, ভিয়াসা সবাই লিখেছে তখনকার অভিজাতদের ভাষা সংস্কৃতে, যে ভাষা বিশিষ্ট হতে হতে সাধারণ্য থেকে হারিয়ে গেছে। শকুনতলা কোন ভাষায় কথা বলতো? বনের বন্ধুদের সাথে কোন ভাষায় খেলতো? যাকে জনক বলছে, সে কন্ব মুনি তাকে সংস্কৃত শেখাতে পারে। আবার মনসাকে যেভাবে শিব সাধারণের পুজা পেতে দেয় নাই, সেভাবে চাঁদ সদাগরের আনুগত্যের উসিলায়, অন্ত্যজ মনসাকে জাতে ওঠাতে, যেরকম বেহুলা, লক্ষিন্দরের পাঁচালি, সেরকম শকুনতলা এবং দুষ্মন্তের একটা পার্শ্ব কাহিনী বোনা হয়েছে, যা লেখা হয়েছে দুষ্মন্তের ভাষায়, আর এতিম শকুনতলাকে বলা হয়েছে স্বর্গের অপ্সরার মেয়ে, কারণ তার গর্ভজাত ছেলে ভরত ভবিষ্যতে ভারত বর্ষ শাসন করবে। ভরতের মত পরিত্যাক্ত সন্তান, তাদের সূত্রেই হয়তো আদিবাসি ভাষাগুলো অভিজাত সংস্কৃতের সাথে জায়গা করে নিতে নিতে সংস্কৃতকে কোনঠাসা করে ফেলে। এরকমটা হয়েছিলো রোমান সাম্রাজ্যে ল্যাটিনের ক্ষেত্রে।
বুঝতে পারছিলাম না নীলিমাকে না কি সায়মাকে বেশি নাম্বার দেবো। সায়মাকেই বেশি দিলাম। শেষে এসে হেচকা টানে লিখেছে, আমাদের বাংলা ভাষাও এ ধরণের একটা সঙ্কটে পড়েছে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা ফারুকী পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া লোক জন নিয়ে, পথের ভাষায় নাটক লিখেছেন, পথের খিস্তি সহ। কিন্তু ঐ ভাষা কি উনি উপদেষ্টাদের বৈঠকে, অধ্যাপক ইউনুসের সাথে ব্যাবহার করতে পারছেন? এখানে সঙ্কট আরো গভীর। সংস্কৃত ছিলো আরোপিত ভাষা, শকুনতলাদের ভাষা ছিলো আহরিত, স্থানীয় স্বতোতসারিত। সে ভাষাগুলোর মিশেলে যে স্থানীয় সাধারন্যের ভাষা পালি তৈরি হয়, তাও কাল প্রবাহে হারিয়ে গেছে। বাংলা প্রমিতের চলমানতা, বাংলা আঞ্চলিকের চলমানতা কোনটাই আরোপিত নয়। লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের জনপ্রিয়তা তা প্রমান করে। তাহলে কি আম্মাদের মিডিয়া, বিনোদনের লোকজন এক ধরনের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক সিজোফ্রেনিয়াতে ভুগছেন। কিম্বা বিভিন্ন হীনমনত্যা এবং কৃত্রিম পরিচয়ের সঙ্কট চাপিয়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক স্কিজোফ্রেনিয়াতে ঠেলে দেয়া হচ্ছে?
ওপরের এটুকু পড়ে, সায়মাকে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট মার্ক দিয়ে দিলাম।
এর পর আমি জানালাম, সে নতুন গল্পের নতুন নাম দরকার হবে। শ্রোতা, দর্শক তাকে গ্রহণ করলে ভালো, না হলে বক্স অফিস ফ্লপ। একটা ছেলে বলে উঠলো, নাম হতে পারে, ‘শকুন্তলা আজকাল’, অন্তমিলে ‘রাং রাসিয়ার মাল’।
(মেনকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, অধ্যাপিকা একা মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যান।)
চয়ন খায়রুল হাবিব
জানুয়ারি/মার্চ, ২০২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স