Monday, 7 April 2025

।। আলতা এবং মায়ার গল্প।।

।।লুপ্ত, ভয়াল নেকড়ের ফিরে আসা এবং অমরতার দিকে আরেক ধাপ।।

যখন দুনিয়ার এদিক, ওদিক ভয়াবহ সব হানাহানি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে, বংশানু বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ফিরিয়ে এনেছে ১০,০০০ বছর আগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ডায়ার উলফ বা ভয়াল নেকড়ে।

ছেলে মাতিস জ্যোতি, আর আমার প্রিয় রূপকথা  এবং প্রিয় টিভি শোর একটি হচ্ছে জর্জ,আর, মার্টিনের গেম অফ থ্রোনস। সেখানে ওয়েস্টোরসের রাজা তার ছেলেমেয়েদের ছোটবেলায় একটা করে বাচ্চা ভয়াল নেকড়ে উপহার দিয়েছিলো, যারা কালক্রমে সে ছেলেমেয়েদের বন্ধু এবং রক্ষক হয়ে ওঠে।    


মাতিস যখন রূপকথার পাতা ডিঙ্গিয়ে, লুপ্ত ভয়াল নেকড়ের বাস্তব জন্ম নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের লিড আর্টিকেলটা পাঠালো, তখন আমি বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপে, গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতায় বাংলাদেশে বিপুল বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভকারীদের একাংশের বাটার দোকান লুটপাট দেখছিলাম। পড়ছিলাম যে সৌদি এরাবিয়া বেশ কিছু দেশের সাথে বাংলাদেশের জন্যও ওমরাহ ভিসা সাময়িক ভাবে স্থগিত করেছে। লুপ্ত নেকড়ের ফিরে আসায় আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, এ প্রযুক্তিতে কে বেশি অমর, অবিনশ্বর থাকবে, কে বেশি নশ্বর থাকবে?


আমি যখন বাংলাদেশের বিক্ষোভে দোকান, রেস্তোরা ভাংচুর, লুটপাটে মানুষের রুটি রুজিতে আঘাত হানায় নিন্দা জানালাম, তখন জুলেখা সিরাপ মেটভার্স গ্রুপের এডমিন কুদরৎ এলাহি গ্রুপ কভার মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি থেকে বদলে একটা ডায়ার উলফের ছবি দিলো এবং গবেষণাগারে লুপ্ত, ভয়াল নেকড়ে ফিরিয়ে আনা সঙ্ক্রান্ত টাইমের নিবন্ধটির লিঙ্ক দিলো। কুদরৎ মাদ্রাসায় প্রাথমিক পড়াশোনা করেছিলো, জাফর ইকবালের ভক্ত। 


যে গবেষণাগারে লুপ্ত নেকড়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, সেখানে যদি ইহুদি বিজ্ঞানী থাকে, তাহলে কি প্রযুক্তির এ সাফল্যকে ইহুদি চক্রান্ত বলা হবে? জাফর ইকবাল এটা নিয়ে লিখলে কি ইহুদিদের চর হয়ে যাবে? সৌদি আরবসহ বড় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো বিভিন্ন ভাবে পশ্চিমা প্রযুক্তি ব্যাবহার করে। ওরা যদি প্রিয় বেদুইনদের আবার ফিরিয়ে আনতে চায়? এডগার এলান পোর সেই বানরের থাবা গল্পের মত?


কল্পকাহিনীর জল্পনায় না থেকে, লুপ্ত ভয়াল নেকড়ে ফিরিয়ে আনার বাস্তব প্রক্রিয়াতে কি ঘটেছে দেখা যাক :

আমেরিকার জেনেটিক্স কোম্পানি Colossal Biosciences ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিলুপ্ত একটি প্রজাতিকে সফলভাবে জীবন্ত করে তুলেছে: ডায়ার উলফ। এরা প্রায় ১০,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিলো। জিনগত গবেষণা ও আধুনিক ক্লোনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা তিনটি ডায়ার উলফ জন্ম দিয়েছে—তাদের নাম রেমুস, রোমুলাস, ও খালিসি

এ তিনটি নেকড়ের মধ্যে রেমুস ও রোমুলাস ছয় মাস বয়সী পুরুষ, আর খালিসি তিন মাস বয়সী মেয়ে। এরা "Generation Zero" হিসেবে পরিচিত, এবং Colossal-এর গবেষণাগারে নিরাপদভাবে লালিত হচ্ছে।

গবেষকরা ১৩,০০০ বছর পুরোনো একটি দাঁত এবং ৭২,০০০ বছর পুরোনো একটি খুলির নমুনা থেকে প্রাচীন ডিএনএ সংগ্রহ করেন। এ ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ডায়ার উলফের জিনোম পুনর্গঠন করা হয় এবং ধূসর নেকড়ের জিনোমের সাথে তুলনা করে ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ জিনের পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়। এরপর, ধূসর নেকড়ের কোষে এই জিনগত পরিবর্তনগুলি সম্পাদনা করে ক্লোনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ভ্রূণ তৈরি করা হয়, যা গৃহপালিত কুকুরের গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তিনটি স্বাস্থ্যবান শাবকের জন্ম হয়।

রেমুস, রোমুলাস ও খালিসির জন্ম আমাদের কিছু অমোঘ প্রশ্নের মুখোমুখি করে —

  • আমরা কি অমরতার দিকে হাঁটছি?

  • নাকি আমরা আমাদের সীমারেখা মুছে ফেলছি?

  • জীবন কি কেবল কোড? আত্মা কি পুনরায় নির্মাণযোগ্য?

যদিও এ শাবকরা সম্পূর্ণরূপে ডায়ার উলফের গর্ভে জন্মায় নাই, তবে তাদের মধ্যে ডায়ার উলফের সাদা কোট এবং নেকড়ে-সদৃশ আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। তাদের একটি সুরক্ষিত ইকোলজিক্যাল রিজার্ভে রাখা হয়েছে, যেখানে তাদের জীববিজ্ঞান এবং আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ​

কিছু জীববিজ্ঞানী এ প্রকল্পের সাফল্য সম্পর্কে সতর্কতা প্রকাশ করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন যে এ প্রাণীগুলি প্রকৃতপক্ষে বিলুপ্ত প্রজাতির সত্যিকারের পুনরুজ্জীবন কিনা। তবে, কোলসাল বায়োসায়েন্সেসের এ অর্জন ডি-এক্সটিঙ্কশন প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে উলি ম্যামথের মতো অন্যান্য বিলুপ্ত প্রজাতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করছে।

এ প্রকল্প জীববিজ্ঞান এবং জিনগত প্রকৌশলে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা ভবিষ্যতে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ডায়ার উলফ বা ধবল, ভয়াল নেকড়ে যেহেতু আর বিলুপ্ত প্রাণী নয়, বিজ্ঞানের সম্ভাবনা থেকে বাস্তবতায় চলে এসেছে, তাকে নিয়ে কি আর কল্প কাহিনী লেখা হবে না? মানুষতো বিলুপ্ত নয়, কিন্তু মানুষ মানুষকে নিয়ে একের পর এক কল্পকাহিনী লিখে চলেছে। যে কাহিনীতে মানুষের এবং নেকড়ে একটি একক স্বত্বা, তাই মায়া এবং আলতার কাহিনী!

 


।। আলতা এবং মায়ার গল্প ।

ওরা দুই বোন। জন্ম নিয়েছিলো বিজ্ঞানের গর্ভে, কিন্তু তাদের মধ্যে লুকিয়ে লাখো বছরের পুরনো এক বন্য চিৎকারের প্রতিধ্বনি।

এক গভীর শীতের রাতে, বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, তার নেপাল সীমান্তের ওপারে এক গোপন জেনেটিক ল্যাবে আলো জ্বলে উঠেছিলো। বিজ্ঞানী ড. ইলিনা মোরেই আর তার সহকর্মী ড. রাজীব চৌধুরী একসাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরীক্ষাগারের কাচের জানালার পাশে। তারা অপেক্ষা করছিলেন—একটি নতুন কিছুর জন্য, এক নতুন অধ্যায়ের জন্য।

"তুমি নিশ্চিত, এলিয়েনার জরায়ু এ ভ্রূণগুলো নিতে পারবে?" রাজীব জিজ্ঞেস করেছিলো।

"তুমি জানো, এলিয়েনা একটা ধূসর, সাধারণ নেকড়ে। ওর দেহ-ঘড়ি মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু যে ভ্রূণগুলো আমরা ওর জরায়ুতে দিয়েছি, তা ডায়ার উলফের, বিশ হাজার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভয়াল নেকড়ে..." ইলিনার কণ্ঠে ছিল বিস্ময় আর ভয়, যেন মহাকালের দরজায় কড়া নাড়ছেন তাঁরা।


সবকিছু শুরু হয়েছিল ৭ বছর আগে। আলাস্কার বরফে জমে থাকা একটি প্রাচীন হাড় পাওয়া গিয়েছিল। তার ভেতরে এক চুলের থেকেও সূক্ষ্ম DNA-এর ছায়া ছিলো—ডায়ার উলফের ছায়া।

"আমরা কি ঈশ্বর হতে চাইছি?" রাজীব একদিন বলেছিলেন।

ইলিনা হেসে বলেছিলো, "না, ঈশ্বর না। আমরা তো সেই মানুষ, যে অতীতের হুঙ্কারগুলো পেরিয়ে কান্নাগুলো শুনতে চায়, সে কান্নাকে স্নেহের বরাভয় দিতে চায়। আমি জানি, তোমার প্রশ্ন হবে, কি হবে যদি হুঙ্কারগুলো আমাদের প্রযুক্তি গ্রাস করে নেয়?"

ওরা ডায়ার উলফের জিনোম পুরোপুরি পুনর্গঠন করেছিল, আংশিক ধূসর নেকড়ের DNA ব্যবহার করে ফাঁক গুলো পূরণ করে। তারপর কৃত্রিম নিষেক ঘটিয়ে ভ্রূণ তৈরি করে। এলিয়েনা নামের এক স্বাস্থ্যবান নেকড়েকে

মায়া ও আলতার জন্মের মুহূর্তে চারপাশ নিস্তব্ধ। এলিয়েনা চোখ মেলে দেখছিলো দুটি অদ্ভুত, অচেনা কিন্তু পরিচিত সন্তানের দিকে।

মায়া—ধবধবে সাদা শরীর, তীক্ষ্ণ চোখ, আর হালকা লালাভ লোমে মোড়া।
আলতা—কালো ছোপ ছোপ, কণ্ঠে যেন কোনো পুরনো গান গুনগুনায়।

ওরা বন্য, অথচ বনে জন্মায় নাই। ওদের কেউ কখনো শিকার করেনি, অথচ নখে লেগে আছে

হারানো সময়ের গন্ধ। ওরা কেউ কখনও বনে ঘুরেনি, অথচ চাহনিতে  প্রাচীন অরণ্যের ছায়া।


একদিন রাজীব প্রশ্ন করলো, "ওরা যদি সত্যিকারের ডায়ার উলফ না হয়? যদি শুধু দেখতে ডায়ার উলফ হয়, কিন্তু ভিতরে অন্য কিছু?"

ইলিনা উত্তর দিলো,
"তুমি আর আমি কি একেবারে 'আসল' মানুষ? আমরা তো প্রতিদিন পরিবর্তিত হই। জিন দিয়ে

তৈরি হওয়া মানে কি আত্মা তৈরি হওয়া?"

এক সন্ধ্যায়, মায়া ও আলতা, ওদের জন্য তৈরি হিমালয়ের কয়েক শ একর অভয়ারন্যে দাঁড়িয়ে

কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে চেয়ে ছিলো। ওরা হঠাৎ একসাথে ডেকে উঠলো—না নেকড়ের মতো,

না কুকুরের মতো। সে ডাকে ইতিহাস, তৃষ্ণা, ভয় আর ভালোবাসা।


গোটা বিশ্ব উত্তেজনায় ফেটে পড়লো। কিছু মানুষ বললো—"এরা বিজ্ঞানী না, ইশ্বর!"

আর কিছু মানুষ বললো—"এরা আগুন নিয়ে খেলা করছে। কাল কোনো ডায়নোসর আসবে,

পরশু নিয়ান্ডারথাল!"

একদিন এক সাংবাদিক ইলিনাকে জিজ্ঞেস করল,
"আপনারা কি অমরতা খুঁজছেন?"

কিছুক্ষন চুপ থেকে, ইলিনা বললেন,,
"আমরা শুধু সেসব কণ্ঠ শুনতে চাই যারা হারিয়ে গিয়েছিলো। যদি সেসব কণ্ঠ ফিরিয়ে আনা যায়,

তাহলে আমাদের নিজেদের কণ্ঠও হয়তো একদিন কেউ ফিরিয়ে আনবে।"

এক শীতের রাতে, মায়া আর আলতাকে পরিচিত অভয়ারণ্য থেকে বের করে, হিমালয়ের এক অপরিচিত বনাঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হলো। ওরা কিছুক্ষন থমকে দাঁড়িয়ে ছিলো। আলতা একবার পেছনে তাকালো, আর মায়া উদ্যাম গতিতে সামনে ছুটে চললো। দেখাদেখি আলতাও ছুটতে থাকলো।

পায়ের নিচে জমে থাকা তুষারের ওপর নতুন পায়ের চিহ্ন— সে চিহ্নে লুকিয়ে আছে অতীতের

ছায়া আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।


চয়ন খায়রুল হাবিব

৮/৪/২৫

ব্রিটানিন ফ্রান্স