।।পাচটি প্রেমের সনেট।।
১
আনমনে আলতো হাত গালে দিয়ে রাখো।
নিজের আদরের পরশ নিজের সাথে মাখো।
রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে পাস্তেরনাকের লারা
রাজু ভাস্কর্যের পাশে মিছিলের ঘামে দিশাহারা,
তোমাকে কি আমরা মূর্তিমান শরতকাল ডাকবো?
কিন্তু সব ঋতু ছুটে এসে তোমার হাতে হাত ধরতে চায়!
এমনই সে এলোমেলো, এবড়োখেবড়ো ছোটাছুটি,
শাহবাগ মোড়ে ফুলের দোকানে সমস্ত ফুলের রেণু গলে গলে
কাঞ্চনজঙ্ঘা জ্বলে জলে ডাকাতিয়াকে শোনায় বেহুলার ভাসান।
মরনকে ম্লান করে বেজে ওঠে গহীন এক সহমর্মিতার আজান।
তোমার আদরকে আমরা কোন নরমের সাথে তুলনা করবো?
সবাই আরেকটু বাড়তি বেতন চাইছে তোমার আদর পেতে।
অলৌকিক হলো লৌকিক, দুর্বিপাক ঘুরে ঘুরে ঘূর্ণিপাকের ঘুঙ্গুরে,
আদরের অনন্ত লাইন ছড়ালো নতুন নতুন ফুলেল নামের ইজারায়!
২
হাত কাঁপছে তোমার, কিন্তু কণ্ঠস্বর সুদূরে সুস্থির।
কয়েকটা পাকা বরুই গাছ থেকে পড়ে তোমার অপেক্ষায়
বদলালো সাগরের ফ্যানায় ফ্যানায় ঝলমলে পোখরাজ।
সবাই ধেয়ে এলো তোমাকে পিছে ফেলে। বরুই মেলালো অস্পষ্টতায়।
স্পষ্ট সুরে গাইলে, তোরা যে যা বলিস ভাই,
গাছপাকা বরুই আমদের চাই। এবার পোখরাজের খাঁজকাটা দ্যুতি
সাগুরে দলকল্মির দোলনায় দুলে মাছকুমারীর আঁশ-শ্যাওলা চুলে,
একই সাথে গোপন এবং প্রকাশ্য আদরের কোলাহল।
মাছকুমার তোমাকে ভালোবাসা জানাতে আবছায়ায় মিলালে।
নোঙ্গর করা সাম্পানগুলো অকস্মাৎ আলোর গতিতে উড়ালে।
দেহ-ছন্দের থির থির চঞ্চলতা নিজেকে আদরের কত্থকে নেচে
পুরোটা বরুই বাগান সমেত বরুইর আচারের বয়মে ঢুকলে।
শুরু হলো রূপকথা নগরে রূপক-ভাঙ্গা ঝাকুনির চমক।
বয়ম খুলে আমরা সবাই তোমার আদরে ভাগ বসাচ্ছি!
৩
এপ্রিল সাঁঝে, টি-এস-সি'তে গোধূলি বেলায়,
টিয়ারা ফেরে বাসায়, গথিক মন্দির চুড়ায়।
পরিত্যক্ত সুইমিং পুলের ধারে,
রমনা-লেকে রমণের বিশেষ স্নান সেরে।
পালকে পালক ঘষে, খুঁজে কোমল একটি স্থান,
পান রাঙ্গানো ঠোটে ঠোট, অনুভবে পরিত্রাণ।
নরম পালক বুলায়ে বুলায়ে একে অপরকে,
ঘনিষ্ঠতায় জড়ায়ে থাকে দিনের শেষ অঙ্কে।
কেউ ঝাঁকায় ডানা, কেউ ফুলায় পাখনা,
বাসনার ভাষা হারায় লাল মরিচের ডুলায়।
সবুজ তুলার বলে ফাঁপানো গভীর আকর্ষণে,
দাবদাহ জুড়ায় পরাবাস্তব জ্যামিতির কোণে।
কিট-কিটি-কুট, টুই-টুই-টুই, চিড়ু-চিড়ু-চিড়,
টিয়াদের বেসামাল ইজতেমায় কে যে কাকে ছুঁই!
৪
কত নদী পাশে বসে আমরা বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি,
কয়েকটা নুড়ি পাথরে, কাদা-মাখা মার্বেল সিঁড়িতে,
সারা রাত একটার পর আরেকটা স্বচ্ছ পর্দায়,
দিনকে আড়াল করে কিছুটা মসলিনের খেলায়,
গোড়ালি ছোঁয়া পূর্ণিমার পাগলুটে অন্যমনস্কতায়,
পেছনে ফেলে আসা কপাল ছোঁয়া হাওয়াদের ধাওয়ায়,
এতো এতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাষ্ট্রীয় মত্ততায়,
অথচ মনে মনে সকলে সন্তর্পণে মাতাল ঋত্বিক,
দিগ্বিদিক অকারণ উল্লাসে একটু দীপকে, একটু দাদরায়,
একটু বন্দিশে, একটু ঠাটে বেদে নৌকার ছলাৎ ছলাৎ,
ভাঙ্গা লিরিকে কুপোকাত ভাঙ্গা বয়ানে, কবরস্থানে, শ্মশানে,
বাগানে, ঝর্ণাধারায়, নাচঘরে ঘুমঘোরে, কোনো এক ভোরে,
গোপন বর্ষায় ভিজে ভিজে, পশলা পশলা অকস্মাৎ,
নতুন গ্যালাক্সিতে নতুন আদর জন্ম নেয় চয়নের গানে।
৫
ব্রক্ষপুত্রের বুকে এক মাঝি প্রেমিক যুগলকে বলেছিলো : সঠিক নারীর অভাবে এই নদ বানজলে আমাদের ভাষায়। আপনি কি কুমারী বলির দিকে ইঙ্গিত করছেন? প্রেমিকা মাঝিকে এ-প্রশ্ন সুধাতে, মাঝি বলে: এই যে সোহাগ, মহব্বত আপনেরা একে অপরকে দিচ্ছেন তাতে এই নদ খুশি মহাখুশি প্রেমিকা : আপনার বয়স কত? মাঝি : সত্তরের কম নয়, প্রথম বড় যুদ্ধের কালে জন্ম পোকি : পেষিত এখনো বেশ পোক্ত মাঝি : শক্তের আর কি আছে?বউটা চলে গেল। বেহেস্ত নসিব হোক।নাত নাতকুরে সংসার ভরন্ত। পোড়ানি বাড়লে ব্রক্ষপুত্রে আসি আমার মত এই নদেরও বৌ প্রবাসী
চয়ন খায়রুল হাবিব
৬/০৪/২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স
**'নতুন আদরের জন্ম' সনেট পান্ডুলিপি থেকে।
Painting : Henry Matisse