Thursday, 27 February 2025

নাটক : মাংসের স্বপ্ন, হাড়ের খেলা

।।জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষ সিরিজ অবলম্বনে।।

স্নায়বিক এবং হৃদপিণ্ডের দুর্বলতায় ভুগলে এ নাটকটি পড়া এবং দেখা থেকে বিরত থাকবার অনুরোধ।লেখক।


এখানে ১৯৪৩/৪৪ বাংলার মন্বন্তর ভিত্তিক জয়নুল আবেদিনের "দুর্ভিক্ষ সিরিজ"-এ ক্ষুৎপীড়িতের সংগ্রাম, পাশবিক বিকারগ্রস্থতা, উন্মত্ততার সঙ্গে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণজাগরণ ও গণহত্যার প্রসঙ্গ যুক্ত করেছি, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে মানুষ অপর জীবন্ত মানুষের মাংস খেতে উদ্যত, লাশ থেকে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে, কুকুর মেরে খাচ্ছে, গণ- কবরে গিয়ে লুকোচ্ছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলছে।
৫ আগস্ট জনতার সাথে গণভবনে ঢুকি। এক পর্যায়ে এক করিডোরের আধারির ভেতর, বিকট ঠাসাঠাসির ভেতর গ্যাসের গন্ধ নাকে আসে। সাথে চার পাশে চিৎকার, 'পাইপ লিক, গ্যাস পাইপ লিক"। ওখানে পায়ে পিষে লোকজন মরে যাবার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু হয় নাই। কারণ, প্রচণ্ড সংক্ষুব্ধ জনতা ওখানে কেউ কাউকে মারতে যায় নাই। জনতাকে ইঁদুর, বিড়ালের মত যারা মারতে চেয়েছিলো তাদের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে গিয়েছিলো। সেই গ্যাস-লিকের গন্ধ আমার মনে থেকে যাবে স্থায়ী ট্রমার মত। 'মাংসের খেলা, হাড়ের স্বপ্ন' নাটকটি আমি লিখতে শুরু করি আগস্টের মাঝামাঝি দেশ থেকে ফিরে। 'নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৫'এর কিউরেটিং বিষয় হিসেবে ঠিক করেছি, ৪৩/৪৭/৭১। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষ সিরিজ ভিত্তিক অন্যদের কাজ। ৪৭এর দেশভাগ ভিত্তিক হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' ভিত্তিক কাজ এবং ১৯৭১ ভিত্তিক কাজ। আলাদা করে আমার নাটকের শিরোনাম দেই নাই। অল্প অল্প করে লিখছিলাম। গত রাতে অর্থাৎ ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে নিচের অঙ্ক এবং দৃশ্যগুলো লেখার সময় শিরোনামটি মাথায় আসে। সেই গ্যাস লিকের গন্ধের কথা, সেই চিৎকারের কথা মনে পড়লে শেখ হাসিনার প্রতি আমার মন উঠে যায়। উনি কোনো দুর্ভিক্ষে পড়েন নাই, ক্ষমতায় টেকার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে পশুর মত হত্যা করতে চেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে যে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং আদেশবলে তাদের কেউ কেউ তা অন্ধের মত পালন করে, তা উনি বুঝেছিলেন প্রথমত ১৯৭১এ পাকিস্তানি বাহিনীর জেনোসাইডের বরাতে, আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর হাতে নিজের পরিবারের মর্মন্তুদ পরিণতির সুবাদে। ২০২৪এর জুলাই, আগস্টে বাংলাদেশের অধিবাসীদের সে একই পরিণতিতে ঠেলে দিতে উনি দ্বিধা করেন নাই। সাবেক সেনা প্রধান ইকবাল করিম ভুঁইয়া সেনাবাহিনীর প্রতি নিরস্ত্র জনতাকে গুলি না করতে আহবান না জানালে এবং বর্তমান সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান, সে আহবানে সাড়া না দিলে, পরিস্থিতি আরো জঘন্যতার দিকে এগোতো।
এ দৃশ্যগুলোতে ক্ষুধা, ক্লান্তি, অসহ্য ব্যথা, এবং মানবদেহের চূড়ান্ত দুর্বলতা অনুভব করা যায়। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া শরীরের নিষ্ঠুর অবস্থা, পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই, এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকার ফুটে ওঠে। এখানে 'মাংসের স্বপ্ন, হাড়ের খেলা" নাটকটির তিনটি অঙ্ক পরিবেশিত হলো। চয়ন খায়রুল হাবিব ২৭/০২/২৫ ব্রিটানি, ফ্রান্স




অঙ্ক ৬ : হাড়ের খেলা (The Game of Bones)

দৃশ্য ১: দেহের যন্ত্রণা

একদল মানুষ—রমিজ, হাজেরা, মনোয়ারা, গফুর, এবং রহিম—একটি শূন্য মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। শরীরগুলো এতটাই শুকিয়ে গেছে যে হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। গফুর হাঁটু গেড়ে বসে, কাঁপতে কাঁপতে পেট চেপে ধরে, যেন এক ফোঁটা শক্তি খুঁজে পেতে চায়।

গফুর (দাঁতে দাঁত চেপে, পেট ঘষতে ঘষতে): খিদা... পেটের ভেতর শূন্য! মাটির গন্ধও খাইতে ইচ্ছা করে... কই পামু কিছু?

হাজেরা (নিস্তেজ গলায়, মাথা ঝুলিয়ে): জিহ্বাটা শুকায়ে কাঠ... শরীরের রস নাই... (জিহ্বা বের করে মাটি চাটতে চায়)

মনোয়ারা (নিজের পেটের চামড়া টেনে ধরে, যেটা হাড়ের সাথে লেগে গেছে): এই দেহ তো মরার আগেই কঙ্কাল হইয়া গেছে... গায়ে কিচ্ছু নাই, তাও বুকের ভেতর জ্বলে!

দৃশ্য ২: মাংসের লড়াই

রহিম দূরে একটা আধামরা কুকুর দেখে। কুকুরটাও দুর্বল, মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। রহিম হঠাৎ সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কুকুরের গলা চেপে ধরে। বাকিরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।

রহিম (আবছা কণ্ঠে, ঘাড়ের শিরা টান টান করে): এটা... এটা খাইতে হইবো...!

রমিজ (দৌড়ে এসে রহিমের হাত সরাতে চায়): তুই কুকুর মারবি? মানষের মতো থাক তোর!

রহিম (গর্জে উঠে, চোখ লাল করে): মানুষ? খিদার সময় মানুষ বলে কিছু নাই! খাবার আছে আর নাই!

বাকি সবাই রহিমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কুকুরটাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। কুকুর ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায়। গফুর তার নখ দিয়ে মাংস চিরে নিয়ে চিবাতে থাকে। হাজেরা কুকুরের হাড্ডি কামড়ে ধরে, দাঁত দিয়ে চেপে ধরে চুষতে থাকে।

দৃশ্য ৩: আত্মগ্লানি ও উন্মাদনা 

(রমিজ একটু দূরে বসে থাকে, শিউরে উঠে। শরীর কাঁপতে থাকে, মাথা ধরে বসে থাকে। চারপাশে সবাই জানোয়ারের মতো খাবার ছিঁড়ে খাচ্ছে। সে পাগলের মতো হেসে ওঠে।)

রমিজ (চোখ বড় বড় করে, হাসতে হাসতে কাঁদতে থাকে): আমরা মানুষ ছিলাম তো...? না কি জন্ম থেকেই জানোয়ার ছিলাম...?

মনোয়ারা (রক্তমাখা হাত নিয়ে, চিবোতে চিবোতে): মানুষ? আর মানষের মতো থাকতে দিলে তো! (হাসতে হাসতে কাশতে শুরু করে

হঠাৎ, রহিম হালকা বমি করে, কুকুরের মাংস মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। সেও নিজের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে, তৎক্ষণাৎ থুতু ফেলতে চায়, কিন্তু মুখে পানি নেই। গলা শুকিয়ে গেছে।

দৃশ্য ৪: পাগলামির চূড়ান্ত অবস্থা

বাতাস ভারী হয়ে গেছে। চারপাশে মরা মানুষের শরীর। কেউ কেউ তাদের হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে নেয়ার জন্য হামাগুড়ি দিয়ে আসছে। মনোয়ারা তাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে ওঠে, তারপর চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। রমিজ দাঁড়িয়ে গিয়ে কাপড় খুলে ফেলে উলঙ্গ হয়ে নাচতে থাকে। বাকিরা তাকিয়ে থাকে।

রমিজ (পাগলের মতো নাচতে নাচতে): খিদা! খিদা! খিদা আমাদের রাজা! আর আমগো গা’তে মাংস নাই, তাই আমরা পোশাকও পরমু না!

হাজেরা (উলঙ্গ রমিজের দিকে তাকিয়ে, বিকৃত হাসি দিয়ে): তোর শরীরে কিছু নাই, কিন্তু তোকে ছিঁড়ে খাইতে পারি তো...

হাজেরা হঠাৎ রমিজের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার গলা চেপে ধরে কামড় দেয়। রমিজ চিৎকার করতে থাকে, বাকিরা হাসতে থাকে।

দৃশ্য ৫: রক্ত ও মৃত্যু

(রমিজ ছটফট করতে করতে পড়ে যায়। তার ঘাড় থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বাকিরা শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার শরীরের মাংস টেনে ছিঁড়ে খেতে শুরু করে।)

গফুর (রমিজের শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে): কুকুরের চাইতে মানুষ বেশিই নরম!

শাহজাহান লাফিয়ে উঠে, তার চোখ দিয়ে রক্তের মতো পানি পড়ছে। তার নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে সে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। তারপর হাসতে হাসতে নিজের হাতের চামড়া কামড়ে নেয়। বাকিরা চেয়ে থাকে।

দৃশ্য ৬-১০: নীরবতার রাজত্ব

পরের দৃশ্যগুলোতে ধীরে ধীরে সব চরিত্র নিস্তেজ হয়ে যায়। কেউ কামড় খেয়ে মারা যায়, কেউ খিদায় মরে, কেউ নিজের মাংস খেয়ে পাগল হয়ে যায়। একসময় পুরো জায়গাটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়, শুধু বাতাসে শকুনের ডানা ঝাপটার শব্দ শোনা যায়। একদল কাক এসে মৃতদেহের ওপর বসে, ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খায়। শূন্য মাঠের ওপর ধুলো উড়তে থাকে।

একটি কাক ফাঁকা চোখ নিয়ে মৃতদেহের ওপর বসে। দূরে, শুকিয়ে যাওয়া গঙ্গার চরে একটি গরু হেঁটে যায়, তার পাঁজর বের হয়ে গেছে। আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পৃথিবী ঠিক আগের মতোই চলছে, কিন্তু এই মানুষগুলো আর নেই।

এবারের অধ্যায়ে মানুষের মধ্যে থাকা পশুত্ব, খিদের চরম রূপ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতির চূড়ান্ত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। শারীরিক ও অবচেতন দুঃস্বপ্নের স্তরে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য আর থাকবে না।। ক্ষুধার জন্য মানুষ কীভাবে একে অপরকে শিকার করে, সেই ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

অঙ্ক ৭: "মাংসের গন্ধ" (The Scent of Flesh)


দৃশ্য ১: লাশের ভেতর শ্বাস নেওয়া


একটা পরিত্যক্ত গুদামঘর। জানালাগুলো ভাঙা, মেঝেতে শুকনো মাটি। কোণায় একগাদা মৃতদেহ—কিছু আধামরা, কিছু পুরোপুরি নিথর। শবগুলোর ভেতরেই জীবিতরা গা ঢাকা দিয়ে আছে, কারণ বাইরে সৈন্য আর দাঙ্গাবাজরা হত্যা করছে যাকেই পাচ্ছে। কদর, আয়েশা, ছবরু, ফরিদা, আর হাশেম মরে যাওয়া শরীরের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে।


কদর (ফিসফিসিয়ে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এমন কণ্ঠে): মরা লাশের গন্ধ নাক দিয়া ঢুকে গেল... উগলানো আসতেছে।


ফরিদা (চোখ বন্ধ করে, কানের কাছে হাত রেখে): শব্দ কইরো না... বাহিরে যদি টের পায়...


আয়েশা (শুকনো ঠোঁট চাটে, চুপচাপ): মরার মাংস পচতেছে... কবে জানি আমরা গন্ধ হইয়া যাই।


দৃশ্য ২: মরার সাথে কথা বলা


ছবরু তার পাশের মরা লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটার চোয়াল হা হয়ে আছে, যেন কিছু বলতে চাচ্ছে। ছবরু ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মৃতের চোয়ালটা বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তখনই লোকটার শরীর থেকে একটা পোকা বেরিয়ে আসে। ছবরু এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়, কিন্তু তার চোখে ভয় নেই। বরং সে হাসে।


ছবরু (মরা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে): তোর ভাগ্য ভালো রে... আর খিদা লাগব না।


হাশেম (ধীরে ধীরে বলে, যেন মন্ত্র উচ্চারণ করছে): মরলে খিদা লাগে না... মরলে ব্যথা লাগে না... মরলে আর কিছু চাওন লাগে না।


সবার চোখের সামনে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। তারা নিজেদের মৃত্যু কল্পনা করে, যেন সেটাই মুক্তি। কিন্তু ক্ষুধা তাদের সে সুযোগ দিচ্ছে না। তারা এখনো শ্বাস নিচ্ছে, তারা এখনো বেঁচে আছে। আর তাই, তারা কষ্ট পাচ্ছে।


দৃশ্য ৩: খিদের চেয়েও বড় ভয়


গুদামের বাইরে হঠাৎ গোলমালের শব্দ হয়। দাঙ্গাবাজদের পায়ের আওয়াজ। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে। হাশেম আর ফরিদা মরার ভান করে পড়ে থাকে। কদর কেঁপে উঠে, আয়েশা তার মুখ চেপে ধরে। ধুলো উড়তে থাকে, পায়ের শব্দ থেমে যায়।


একটা কণ্ঠ (বাইরে থেকে চেঁচিয়ে): এখানে কেউ লুকাইছে?


আরেকজন (হাসতে হাসতে): সব যদি মরা থাকে, তাইলে ভিতরে ঢুইকা দেখার দরকার কী?


বাইরের লোকগুলো চলে যায়। কিন্তু ভিতরের মানুষগুলোর মনে একটা উপলব্ধি হয়—মৃত্যুর ভয় তাদের আছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় হচ্ছে বেঁচে থাকার অভিশাপ। এখানে পড়ে থাকলে মরতে হবে না, হয়তো, কিন্তু বাঁচতেও হবে না। তাদের দেহগুলো আরও নিঃশেষিত হয়ে পড়ে।


দৃশ্য ৪: মাংসের স্বপ্ন


(রাত গভীর হয়। ফরিদা ঘুমের মধ্যে কিছু বিড়বিড় করে। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু সে কাঁপছে, ঘামছে। বাকিরা চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যেন স্বপ্নে কিছু দেখছে।)


ফরিদা (স্বপ্নের মধ্যে, হাসিমুখে): মা... ভাত রাইন্ধা আনলা? এক থালা, গরম গরম... মাছের ঝোল আছে?


(সবার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সেই স্বপ্নের কথা শুনেই তাদের ক্ষুধা আরও বেড়ে যায়। কদর একবার গলা খাঁকারি দেয়, তারপর ধীরে ধীরে ফরিদার দিকে এগিয়ে যায়। তার হাত ফরিদার শুকনো বাহুর দিকে বাড়ে, যেন সে মাংসের উষ্ণতা অনুভব করতে চায়। হঠাৎ ফরিদার চোখ খুলে যায়, আর কদরের হাত থেমে যায়।)


ফরিদা (ভয়ার্ত চোখে): তুই কি করতেছিস...?


কেউ কিছু বলে না, কিন্তু সবার চোখে একই প্রশ্ন—মানুষ যখন পশুর চেয়েও নিচে নেমে যায়, তখন সে কী খাবে? আর কতদূর যাবে?


দৃশ্য ৫: প্রথম কামড়


পরদিন সকাল। আয়েশা এক কোণায় চুপ করে বসে থাকে। তার সামনে একটা শুকনো কাঁটা, মরা মুরগির একটা পালক পরে আছে। তার মুখ শুকিয়ে গেছে। হঠাৎ, সে নিজের হাতের দিকে তাকায়। সে তার নিজের চামড়ার নিচে থাকা শিরাগুলোর নীল রং দেখতে পায়। সে ধীরে ধীরে নিজের হাতের মাংস কামড়ে ধরে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠে। বাকিরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।


কদর (চোখ বড় বড় করে): তুই... নিজের হাত কামড়াইলি?


আয়েশা (ঠোঁট দিয়ে নিজের হাতের ক্ষত চুষতে চুষতে): আমি তো নিজের... কাউরে কষ্ট দেই নাই।


(একটা থমথমে নীরবতা নামে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই সবার মাথার ভেতর একটা ভয়ংকর চিন্তা জাগে—যদি নিজেদেরই খেয়ে ফেলা যায়? যদি বেঁচে থাকার জন্য এটাই একমাত্র রাস্তা হয়? এই চিন্তা ভয়ানক, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী। মনের মধ্যে কামড় বসায় ক্ষুধা, বাস্তবে নয়, এখনো নয়।


দৃশ্য ৬-১০: শেষ ধাপ


(ধীরে ধীরে এই ভয়ানক ধারণা তাদের গ্রাস করে। একে একে অনেকে আর নিজেকে সংযত করতে পারে না। একজন অজ্ঞান হলে, অন্যরা ধীরে ধীরে তার শরীরের দিকে তাকায়। শেষ দৃশ্যে শুধু নীরবতা, মাঝে মাঝে রক্তের টুপটাপ শব্দ। আর দূরে, একদল কাক জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। যেন তারা জানে, এই গুদামের মানুষগুলো আর মানুষ নেই। তারা এখন শুধুই ক্ষুধার শিকার। এবং শিকারীরা নিজেরাই

অঙ্ক ৮ : গণকবরের নিচে (Beneath the Mass Graves)


এই অধ্যায়ের ভিত্তি :


এই অধ্যায় জয়নুল আবেদিনের "গণকবর" বিষয়ক চিত্রগুলোর উপর নির্মিত, যেখানে একসাথে অনেকগুলো মরদেহ ফেলে রাখা হয়েছে, তারা মানুষ কিনা তাও বোঝা যায় না, শুধু হাড়, খুলি, এবং নিঃশেষিত শরীর। এই অধ্যায় একইসঙ্গে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ও ২০২৪-এর গণহত্যাকে সংযুক্ত করবে, দেখাবে কীভাবে শাসকের নির্মমতা ও মানুষের ক্ষুধা একইসঙ্গে এক ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে।


এই অধ্যায়ে মানুষের চরম হতাশা, মনস্তাত্ত্বিক ভাঙন, শেষ বিকারগ্রস্ততা ও বেঁচে থাকার ভয়ংকর লড়াই দেখানো হয়েছে।


দৃশ্য ১ : পচা মাটির গন্ধ


একটি পরিত্যক্ত মাঠ, যেখানে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে অর্ধপচা হাত, পাঁজরের হাড়। কয়েকজন দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষ সেখানে লুকিয়ে আছে—আসমা, রাজু, করিম, হাফিজা, এবং মঞ্জু। তাদের শরীর শুকিয়ে কাঠ, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। তারা এখানে লুকিয়ে আছে কারণ সামরিক বাহিনী শহরে গণহত্যা চালাচ্ছে, এবং তারা জানে, যদি ধরা পড়ে, তাদেরও এই গণকবরে ঠেলে ফেলা হবে।


আসমা (নাক চেপে ধরে): মাটির নিচ থাইকা গন্ধ বাইর হইতেছে...


রাজু (চোখ বন্ধ করে, মুখ শুকিয়ে গেছে): গন্ধ না... আহার...


করিম (হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে, কাতর স্বরে): যদি পঁচা মাংসও পাওয়া যাইতো, খাইতাম...


সবাই চুপ হয়ে যায়। মৃত্যুর গন্ধই এখন তাদের কাছে খাবারের গন্ধ হয়ে গেছে। তাদের মানবতা শেষ হয়ে আসছে। মাটির নিচে চাপা পড়া মরদেহগুলো যেন তাদের নাম ধরে ডাকছে। "এসো, আমরাই তোমাদের শেষ ভরসা।''


দৃশ্য ২ :


একদল কাক, একদল মানুষ (একটা কাক এসে বসে একটা পাঁজরের হাড়ের উপর। তার ঠোঁটে একটা মাংসের টুকরা। মঞ্জু তাকিয়ে থাকে কাকটার দিকে, হঠাৎ হাসে। বাকিরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।)


মঞ্জু (ফিসফিস করে): ওই কাকের ভাগ্য ভালো রে... মানুষের মাংস পাইতেছে...


হাফিজা (চোখ বড় বড় করে, ধরা গলায়): আমরাও তো মানুষ...


মঞ্জু (নির্লিপ্ত স্বরে): আগে আছিলাম...


মঞ্জু ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে কাকটাকে ধরতে চায়। কাক তাড়াতাড়ি উড়ে যায়, তার ঠোঁটে ঝুলতে থাকা মাংসের টুকরাটা নিচে পড়ে যায়। রাজু, করিম, আর আসমা একসাথে ছুটে যায় সেই টুকরার দিকে, যেন ওটাই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু হাফিজা পেছন থেকে চিৎকার করে উঠে।


হাফিজা: এটা মানুষের মাংস!


(তারা থেমে যায়, কিন্তু তখনই রাজু পাগলের মতো সেই টুকরাটা তুলে মুখে পুরে দেয়। বাকিরা ভয়ে চেয়ে থাকে, আর রাজু নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। সে জানে সে কী খাচ্ছে, তবুও থামতে পারে না। কারণ ক্ষুধা কোনো নীতি মানে না।)


দৃশ্য ৩: যারা লাশ সরায় (দূরে একটা ট্রাকের শব্দ। সামরিক বাহিনী আরও গণহত্যা চালিয়ে মরদেহ ফেলতে আসছে। সবাই দ্রুত মাটির নিচে লুকিয়ে পড়ে, নিজেদের মৃত সাজিয়ে ফেলে।)


সৈনিক ১ (গলা চেপে ধরে): এতগুলা লাশ তো জায়গা নিচ্ছে!


সৈনিক ২ (হাসতে হাসতে): তয় কি? পোড়ায়া দেই?


সৈনিকরা সিদ্ধান্ত নেয় এখানে আগুন ধরাবে। লুকিয়ে থাকা জীবিতরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, কারণ তারা জানে, এই আগুনে তারা নিজেরাই পুড়ে যাবে। কিন্তু চিৎকার করার শক্তিও তাদের নেই। তারা চোখ বুজে থাকে, প্রার্থনা করে, যেন আগুন তাদের ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই তারা মরে যায়।


দৃশ্য ৪: আগুন জ্বলছে, মানুষ পুড়ছে


সৈন্যরা লাশের উপর আগুন ধরিয়ে দেয়। ধোঁয়া উড়তে থাকে। রাজু নিজের পায়ের নিচে তাপে মাটি গলতে দেখে, আর চিৎকার করতে চায়, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে গেছে। সে শুধু ফিসফিস করে বলে—


রাজু: মা...


কেউ তাকে শুনতে পায় না। চারপাশে শুধু আগুনের শব্দ। মানুষের চামড়া পোড়ার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আসমা আর করিম একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে, যেন একসাথে মরবে। কিন্তু হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামে, আর আগুন নিভে যায়। তারা জানে, তারা মরেনি। এখনো মরেনি। কিন্তু হয়তো মরাই ভালো ছিল।


দৃশ্য ৫: গণকবরে নেমে যাওয়া


সৈন্যরা চলে যায়, কিন্তু তারা বুঝতে পারে, এই জায়গায় আর থাকা যাবে না। তাদের পালাতে হবে। কিন্তু কোথায়? চারপাশে শুধু মৃত্যু। মঞ্জু একটা মরদেহের পাশে বসে থাকে, হাত দিয়ে একটা কঙ্কালের মুখ ছুঁয়ে দেখে। সে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে—


মঞ্জু: আমরাও যাই...


বাকিরা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তাদের সামনে দুটি পথ—এক, তারা এখানে থেকে না খেতে পেয়ে মরে যাবে। দুই, তারা মরদেহের সাথে মিশে যাবে, আর বেঁচে থাকার জন্য যে কোনো কিছু করবে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়। ধীরে ধীরে, তারা নিজেরাই গণকবরের মধ্যে নেমে যেতে থাকে। মাটি তাদের গিলে ফেলে। তাদের চিৎকার হয় না, কান্না হয় না। কারণ এখন আর কিছুই অবাক করে না। সব স্বাভাবিক। সব নিঃশেষ।


চয়ন খায়রুল হাবিব

আগস্ট, ২০২৪-ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ব্রিটানি, ফ্রান্স


'মাংসের স্বপ্ন, হাড়ের খেলা' নাটকের অংশ।