Friday, 28 February 2025

মানুষ কেন পড়ে?

একজন আলোকচিত্রীর কি  এবং কিভাবে পড়া উচিত?



মানুষ পড়ে পরিশীলিত হতে, আনন্দ পেতে, দৃষ্টিভঙ্গি বাড়াতে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং বাস্তবতা থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে।

জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় মানব শিশু অসম্পূর্ণভাবে জন্মায়। অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই হাঁটতে-দৌড়াতে পারে, কিন্তু মানব শিশু ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। প্রথমে মৌলিক বেঁচে থাকার দক্ষতা গড়ে তোলে, তারপর শেখার ক্ষমতা অর্জন করে, এবং অবশেষে ভাষা ও পড়ার দক্ষতা আসে। এটি মানুষের বিবর্তনের অংশ।

একজন শিশুকে পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলার পেছনে মা, বাবা ও শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ছোটবেলায় শোনানো রূপকথার গল্প ও শয্যাগাথা (bedtime stories) শিশুর কল্পনাশক্তি গঠনে সাহায্য করে এবং পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে।

পাঠের পরম্পরা


Illustration by Louis Figuier in Vies des savants illustres, depuis l'antiquité jusqu'au dix-neuvième siècle from 1866, representing the author's imagining of what the assault against Hypatia might have looked like

হাইপেশিয়ার হত্যাকাণ্ড

চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক নারী গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক হাইপেশিয়া বসবাস করতেন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের আলেকজান্দ্রিয়াতে, যা বর্তমানে মিশরে। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শনে অগাধ জ্ঞান রাখতেন এবং তার পাঠশালা ছিলো মুক্ত-চিন্তার কেন্দ্র। কিন্তু তার এই মুক্তচিন্তা, যুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা, এবং ছাত্রদের স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখানো তাকে নব্য খ্রীস্টানদের  শত্রুতে পরিণত করে।

খ্রিস্টান মৌলবাদীরা তখন জ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং বিজ্ঞানকে ধর্মবিরোধী হিসেবে দেখছিলো। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে একদল খ্রিস্টান উগ্রপন্থী হাইপেশিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা তাকে নগ্ন করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং হত্যা করার আগে নির্যাতন চালায়।

হাইপেশিয়ার  নির্মম পরিণতি পড়ার গুরুত্বকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে—শিক্ষা, যুক্তিবাদ এবং মুক্ত-চিন্তা সবসময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। সত্যিকার পাঠক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এসব বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন।

ঠাকুরবাড়ির হোম টিউটরিং : বিকল্প পাঠের মডেল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার ভাইবোনেরা কখনো প্রথাগত বিদ্যালয়ে পড়েননি। ঠাকুরবাড়ির শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো একেবারে ভিন্ন। শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হতো বাড়িতে, এবং তাদের পড়ানোর পদ্ধতি ছিলো উন্মুক্ত, সংলাপভিত্তিক, এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল।

এ শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাপ্তাহিক পাঠসভা। রবীন্দ্রনাথ এবং তার ভাইবোনেরা সপ্তাহে একদিন তাদের মায়ের সামনে বসে শিখে আসা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতেন। এতে তাদের চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়তো।

এছাড়া, ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা নিয়মিত বই পড়তেন এবং তা নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা করতেন। ব্যবসায়িক পরিবার হয়েও তারা পড়াশোনাকে জীবনের প্রধান বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

গরিব নজরুলের পাঠ-পরিশীলন

আসানসোলে  চা-রুটির দোকানে কাজ করার সময় কিশোর নজরুলের সাথে আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র পরিচয় হয়। নজরুলের কবিতা ও ছড়া দেখে রফিজউল্লাহ তাকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা করেন। এখানে নজরুল চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনাবিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

শিরাজ সাঁই ও লালনের সম্পর্ক

বাউল সাধক লালন ফকির এক অর্থে ছিলেন স্বশিক্ষিত, কিন্তু তার চিন্তার জগতে শিরাজ সাঁই-এর বড় প্রভাব ছিল। শিরাজ সাঁই ছিলেন একজন সুফি সাধক, এবং তিনি লালনকে জীবনের গভীর দর্শনের পাঠ দিয়েছিলেন।

লালন ছিলেন মৌখিক ঐতিহ্যের বাহক। তিনি বই পড়তেন না, বরং গুরুজনদের কাছ থেকে শেখার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতেন। তার গানের মধ্যে আছে দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, মানবতাবাদ, এবং আত্মঅনুসন্ধানের শিক্ষা। মুখে মুখে ঘোরা লালনের গানে প্রভাবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং মার্কিন বিট কবি এলেন গিনসবার্গ। লালন, শিরাজ সাঁইর সম্পর্ক পাঠ, পুঁথি-পাঠকে জীবন-পাঠে রুপান্তর করে। আমরা যে যে কারণে পাঠ করি, তার পুরো নির্যাস পাওয়া যাবে লালনের গানে।

লালন, শিরাজ সাঁই প্রসঙ্গে রোমানি জনগোষ্ঠী বা জিপসিদের  লিখিত পাঠ ছাড়া জ্ঞান সংরক্ষনের প্রক্রিয়া উল্লেখ্য। রোমানি (Gypsy) জনগোষ্ঠীর ভেতর লিখিত পাঠের প্রচলন নেই। তারা ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গল্প, গান ও প্রতীকী চিহ্নের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে থাকে। নাচ, সঙ্গীত, ও পারফর্মিং আর্টস হচ্ছে তাদের "পাঠের" মাধ্যম। এটি প্রমাণ করে যে, পাঠ কেবল বইয়ের মাধ্যমে নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

বেগম রোকেয়া : নারীর পাঠ-বিপ্লব

বেগম রোকেয়া বিশ্বাস করতেন, নারী-মুক্তির একমাত্র উপায় হলো শিক্ষা। তার সময়ে মুসলিম নারীদের পড়াশোনার অধিকার ছিলো না। তিনি প্রথমে নিজের দাদার কাছ থেকে বাংলা ও উর্দু শেখেন, পরে গোপনে ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয় পড়েন। যখন দেখলেন যে, মুসলিম নারীদের পড়াশোনা করার অনুমতি নেই, তখন তিনি নিজের উদ্যোগে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

তার লেখা সুলতানার স্বপ্ন নারীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যেখানে নারীরা শিক্ষিত হয়ে সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বেগম রোকেয়া নারীদের শুধু পড়তে উৎসাহিত করেননি, বরং যুক্তিবাদী চিন্তা ও আত্মনির্ভরতার পাঠও দিয়েছিলেন।

বিশ্ব ইতিহাসে আমরা উল্লেখ করতে পারি, সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের পরম্পরা। সক্রেটিস প্লেটোকে, প্লেটো অ্যারিস্টটলকে, এবং অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে শিক্ষা দেন। আকবরের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে তার শিক্ষক বায়রাম খানের ভূমিকা ছিল অসামান্য। দর্শনে হানা আরেন্ট-এর বিকাশে তার শিক্ষক হাইডেগারের প্রভাব ছিল সুগভীর।

একজন আলোকচিত্রীর কি এবং কিভাবে পড়া উচিত?

আলোকচিত্র শুধুমাত্র দৃশ্যের প্রতিফলন নয়, বরং এটি দৃষ্টিভঙ্গি, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়। একজন আলোকচিত্রী কীভাবে দুনিয়াকে দেখবেন, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়কে ধরবেন, কীভাবে আলো ও ছায়ার খেলায় ছবি তুলবেন—এসব তার পড়াশোনার ওপর নির্ভর করে। শুধুমাত্র আলোকচিত্র সম্পর্কিত বই পড়লেই ভালো ফটোগ্রাফি সম্ভব নয়, বরং ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, এমনকি বিজ্ঞানের বইও তার চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়।

লুই মাল ও ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’: অদৃশ্য ক্যামেরার ধারণা

ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা লুই মাল ভারত নিয়ে তার বিখ্যাত তথ্যচিত্র Fantom India তৈরির আগে শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ করেননি, বরং মাসের পর মাস ভারতীয় সমাজের ভেতরে ডুবে গিয়েছিলেন। তিনি সাধারণ ভারতীয়দের মতো জীবনযাপন করেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের জীবনযাত্রা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেন।

এ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি "অদৃশ্য ক্যামেরা" ধারণার জন্ম দেন। তিনি বুঝতে পারেন, ক্যামেরা দৃশ্যমান থাকলে মানুষ স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। তাই তিনি ক্যামেরাকে নিজের চোখের সম্প্রসারণের মতো ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে দর্শক বিষয়কে সরাসরি পড়তে পারেন, যেন ক্যামেরা আর চোখের মধ্যে কোনো বাধা না থাকে।

একজন আলোকচিত্রীর জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—ক্যামেরার মাধ্যমে বিষয়কে কেবল ছবি তোলার বস্তু হিসেবে নয়, বরং জীবনের গল্প হিসেবে পাঠ।

পিকাসো ও ডোরা মার : গের্নিকা এবং পাঠের নতুন উপলব্ধি


Picasso and Dora Maar on the left corner.

Guernica কেবল একটি চিত্রকর্ম নয়, এটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক চিরস্থায়ী প্রতিবাদ। এটি তৈরির পেছনে পিকাসোর প্রেমিকা ও আলোকচিত্রী ডোরা মার-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ডোরা মার পিকাসোকে বলেন, “যুদ্ধের নির্মমতা বোঝাতে রঙ নয়, বরং কালো-সাদা আলোকচিত্রের মতো দেখো।” কারণ বাস্তবে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ কোনো উজ্জ্বল রঙে ধরা পড়ে না—তা ধূসর, ছায়াযুক্ত, এবং ভয়াবহ শূন্যতায় পূর্ণ।

এই পরামর্শ পিকাসোর শুধু শিল্পীসত্তা নয়, বরং তার পড়ার অভ্যাসও বদলে দেয়। তিনি দাদাবাদ (Dadaism), পরাবাস্তবতা (Surrealism), এবং কিউবিজম (Cubism) নিয়ে আরো গভীরভাবে পড়তে শুরু করেন। এর পাশাপাশি, তিনি ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং জানতে পারেন কিভাবে পাঠ প্রচারণার হাতিয়ার হতে পারে।

এ সময়ে, দাদাবাদীরা (Dadaists) যুদ্ধবিরোধী চিন্তাধারা ছড়ানোর জন্য সাহিত্য ও শিল্পকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। পরাবাস্তববাদীরা(Surrealists) বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন, আর কিউবিস্টরা (Cubists) জগতকে নতুনভাবে দেখার জন্য ভিজ্যুয়াল ভাষা গড়ে তুলেছিলেন।

এ আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে পাঠ গণমাধ্যমে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

পাঠের ইতিহাস : 
অভিজাতদের একচেটিয়া সম্পদ থেকে জনসাধারণের হাতে

প্রাচীন যুগে পড়াশোনা ছিলো অভিজাত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর একচেটিয়া সম্পদ। গ্রিস ও রোমে কেবল রাজপরিবার, অভিজাত ও ধর্মযাজকেরা পড়তে পারতেন। মধ্যযুগে চার্চ ও মসজিদ ছিলো শিক্ষার কেন্দ্র, কিন্তু সাধারণ জনগণের জন্য পাঠের সুযোগ ছিল সীমিত।

পড়াশোনা গণমানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে মূলত প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কারের পর (১৪৫০-এর দশকে গুটেনবার্গ)। এটি প্রথমবারের মতো বইকে সস্তা ও সহজলভ্য করে তোলে।

পাঠের গণতন্ত্রায়ন : বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তন

**প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার (১৫১৭): মার্টিন লুথার জনগণের ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন, যা সাধারণ মানুষের জন্য ধর্মগ্রন্থ পাঠকে সহজ করে তোলে।

**ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯): শিক্ষা ও পাঠকে জনগণের অধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়।

**শিল্পবিপ্লব (১৮-১৯ শতক): শ্রমজীবী মানুষের শিক্ষার জন্য পাঠশালা তৈরি হয়।

**রুশ বিপ্লব (১৯১৭): শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা ও পাঠচর্চার ব্যবস্থা করা হয়।

পাঠের রাজনীতি : প্রচারণা, পুরুষতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রণ

যখন পাঠ অভিজাতদের একচেটিয়া সম্পদ ছিলো, তখন সমাজের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীগুলো পাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছি্লো। কিন্তু যখন পাঠ গণমানুষের হাতের নাগালে এলো, তখন এটি প্রচার ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করলো।

১. প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে পাঠ

নাজি জার্মানি : হিটলার পাঠ ও শিক্ষাকে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে ব্যবহার করে জনমত নিয়ন্ত্রণ করেছিলো।

সোভিয়েত রাশিয়া : কমিউনিস্ট মতাদর্শ ছড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট বই বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো।

উপনিবেশবাদ : ব্রিটিশরা ভারতীয়দের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ রেখে উপনিবেশের প্রতি অনুগত রাখতে চে্যেছিলো।

২. পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পাঠের নিয়ন্ত্রণ

প্রাচীন ও মধ্যযুগে নারীদের জন্য পড়াশোনা নিষিদ্ধ ছিলো। এমনকি ১৮-১৯ শতকে যখন সাধারণ মানুষ পড়তে শিখছিলো, তখনো নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা কঠিন ছিলো। গ্রিস ও রোমে নারীদের শিক্ষার সুযোগ ছিলো না। মধ্যযুগে ইউরোপের চার্চ নারীদের পাঠ নিষিদ্ধ করেছিলো। উনিশ শতকের ভারতে বিধবা ও অবিবাহিত নারীদের জন্য পাঠ গ্রহণকে অপরাধ মনে করা হতো।

সমতা, নারীবাদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পাঠচর্চা

শুধু নির্দিষ্ট মতবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয়। কিন্তু যদি আমরা বিচিত্র ও ভারসাম্যপূর্ণ পাঠ গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের চিন্তার জগৎ বিস্তৃত হবে, যা সমাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব তৈরি করবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস পড়লে বোঝা যায় কিভাবে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে। মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব পড়লে বোঝা যায় বিভিন্ন শ্রেণি ও লিঙ্গ কীভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে।

লিঙ্গ ভারসাম্য ও নারীবাদী পাঠের জায়গা থেকে সিমন দ্য বোভোয়ারের The Second Sex নারীদের অধিকার ও সমাজের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে। ভার্জিনিয়া উলফের A Room of One’s Own নারীদের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন দেখায় নারীর ক্ষমতায়ন কেমন হতে পারে।

৩. বহুমাত্রিক সমাজ, ধর্মিও এবং ধ্রুপদ সাহিত্য

ধর্মীয় ও দার্শনিক গ্রন্থ পড়লে বিভিন্ন সংস্কৃতির চিন্তাধারা বোঝা যায়। ক্লাসিক সাহিত্য ও মহাকাব্য মানব সভ্যতার ইতিহাস ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। এগুলো পড়লে শুধু ভাষার সৌন্দর্য বোঝা যায় না, বরং চিন্তার গভীরতাও বাড়ে।

হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ বীরত্ব ও ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। মহাভারত ও রামায়ণ রাজনীতি ও নৈতিকতার জটিলতা বোঝায়। দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ আত্মজিজ্ঞাসার পথ দেখায়। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো মানব প্রকৃতির গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে।

পাঠ শুধু তথ্য আহরণের জন্য নয়, বরং বিশ্বকে বোঝার জন্য। কিন্তু পাঠ যদি একপেশে হয়, তবে তা প্রোপাগান্ডায় পরিণত হয়। সবিশেষে বিচিত্র, বহুসচল পাঠ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করবে, সমাজে সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে, এবং ব্যক্তিগতভাবে আরও পরিপূর্ণ করবে।


চয়ন খায়রুল হাবিব 

৩/০১/২৫

ব্রিটানি, ফ্রান্স