Monday 22 March 2010

আশির স্নাইপারেরা ৩ঃ আহমেদ মুজিবের 'প্রেসের কবিতা'

প্রাগুক্তঃ

আমার বাবা আজিম্পুরের একই বাড়িতে আমৃত্যু থাকলেও, ঢাকাতে আমাকে স্কুল বদলের এক নাগরদোলাতে ফেলে দিয়েছিলেন।জমজ বোন কঙ্কনের সাথে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি আজিম্পুর লেডিস ক্লাবে, তারপর কয়েক বছর অগ্রনি বালিকা বিদ্যালয়ে, তারপর লিটেল এঞ্জেলস, তারপর আদমজি ক্যান্টনমেন্ট, শেষতক আজিম্পুরের ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে।প্রথমে ভদ্রমহিলা, তারপর বালিকা, তারপর দেবদুত, তারপর সামরিক শৃংখলা,তারপর পশ্চিমি বিতানেঃ ওয়েস্ট এন্ড স্কুল ছিল নৈরাজ্যবাদের রাজধানি; স্কুল'টাকে অলঙ্কৃত করেছে  মাহমুদুল হক, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এবং আলোচ্য আহমেদ মুজিব ওরফে কচি, আমার কয়েক বছর আগে!

ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের শিক্ষক মনিরুজ্জামান মিয়া ছিলেন কমিউনিস্ট, যোগদান করেছিলেন পিলখানার রাইফেল স্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে; বি, ডি'আর হত্যাকান্ডের আগে কিম্বা অনেক অনেক কাল আগে যেই বি, ডি, আর প্রধানের বৌকে সেপাইরা হত্যা করে, সেই প্রধানের বৌ নাকি মনিরুজ্জামান'কে বরখাস্থ করে।তারপর মনিরুজ্জামান গরিব হয়ে যায়।কে জানে এসবে মনিরুজ্জামানের হাত থাকতেও পারে।নাও পারে।কচি মনিরুজ্জামানের ভালবাসার ছাত্র ছিল।কচি অবস্য কমিউনিস্ট ছিল না।কচি ছিল মুখচোরা হেডোনিস্ট।কিন্তু কচির ভাই সবুজ ছিল কমিউনিস্ট।

কায়েসঃ

সব স্কুলে সবার সাথে মিশলেও কারো সাথেই আমার কোথাও বিশেষ বন্ধুত্ব হয় নাই।পাড়ার বন্ধু তারিক(সুজাত), আর কচি ওদের বন্ধুদের আমাকে দিয়ে দেয়!তারিকের দেয়া বন্ধুদের ভেতর আমার যাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় তাদের ভেতর ছিল আতিকুল হক চৌধুরির ছোট ছেলে কায়েস।

সেটা মেট্রিকের পরের সময় ১৯৮৩-৮৪।কায়েসদের বাসা এলিফেন্ট রোডের এরোপ্লেন মসজিদের কাছে।তারিক সার্কেলের আড্ডা জ়মত নিলখেত পুলিশ ফাড়ির উল্টোপাশে ফটিকের বাসাতে, কায়েসের চিলেকোঠার ঘরে।আর তারিকের আজিম্পুর কলোনির বাসাতে।এই সার্কেলে আমার দিনমান ঘোরাঘোরির বন্ধু ছিল কায়েস, ফটিক, মফিজ, অঞ্জন, মামুন, তারিকের ভাই আরিফ।।সবাই তারিকের ইউ ল্যাব স্কুলের।কায়েসের বড় ভাই কাইউম ভাই ছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম দিককার সংগঠক।ওনার প্রেম পর্বের কারনেই আমরা ওখানে যেতামই না!

কায়েস ছিল অত্যন্ত মেধাবি।অঞ্জন খুব এটাসেটা পড়তো।তারিক তখন থেকেই এই সংগঠন, সেই সংগঠন নিয়ে ব্যাস্ত।কিন্তু যখন যোগ দিত তখন পুরো প্রান নিয়েই উপস্থিত।গ্রুপটার সবাই খুব মেধাবি ছিল।এত গুলতানির পরেও একেকজনের ৬/৭টা লেটার!কায়েসত নির্ঘাত আমার ডাবল মেধাবি ছিল!আমার গ্যজদাত একটা, কায়েসের ছিল দু'টো গ্যাজদাত।হাসলে যে ওকে কি অদ্ভুত সুন্দর দেখাতো।

কায়েসের ওখানে গেলে প্রায়ই দেখতাম ওর বাবাকে।বোঝা যেতনা যে উনি ঐরকম খ্যাতিমান মানুষ।ঐ সময়টাতে আমরা এমনকি টেলিফোনেও একটা দিনও কথা বলিনি।কিন্তু ঠিক ক্লাশগুলো শেষ করেই কোন না কোন বাসাতে।কায়েসের বাসা ছিল একটা প্রিয় গন্তব্য।উচ্চ মাধ্যামিকের পর এই গ্রুপ'টার  যোগাযোগ হুট করে কমে যায়।আমি ঢাবি'তে অনেক নতুন বন্ধুর সাথে কেবল পাই তারিকের সংগ।অঞ্জন চলে যায় রাশিয়াতে।কায়েস' পড়াশোনা করবে বলে কাইয়ুম ভাইয়ের সাথে থাকতে এমেরিকাতে যায়।তারপর শুনি বছর না শেষ হতেই চলে আসে।গুম মেরে বসে থাকে।গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ নেয়।আমরা অনার্স শেষ করবার আগেই কায়েস আত্মহত্যা করে!আমার বন্ধুদের ভেতর আশির দশকের প্রথম আত্মহত্যা!

কচিকে ঘটনা'টা জানাই।

আমি তখন জিবন যাপন ভঙ্গি বদলে ফেলেছি।কারো বাসাতে আর যাই না।ঢা, বিতে ক্লাস করি কি করি না।সকাল বেলা নিলাকে বলি এই করবো, সেই করবো।ও রোকেয়া হলে ঢুকে গেলেই সব ভুলে যাই।কোথায় কি বস্তি'তে একসময়ের কচির দেয়া বন্ধুদের সাথে মদ, মাস্তিতে মজে যাই।রাত কাবার করে ভোর রাতে বাসাতে ফিরে জাগে অপরাধবোধ।ঘুমানোর আগে প্রতি রাতে নিলাকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠি লিখি।

তারিকের ইউল্যাব সার্কেল থেকে ছিটকে সরে যাবার পর, নিলা পর্জায়ে আমার সাহিত্যের যোগসুত্র হয়ে উঠে কচির বোবাত্ত্ব!ঐ নিশ্বব্দের বিদির্নতায় আমার নিজস্ব সাইকাডেলিয়া প্রকট হতে থাকেঃ
  
কচি, সবুজঃ

আজিমপুরে কৈশরেরর বন্ধুদের ভেতর আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট ছিলো সেলিম, হেনা কেমিকেলের মালিকের বাসার পাশের বাসাতে থাকতো।সেলিমদের বাসা, হেনা কেমিকেলের মালিকের বাসা, সাবেক রাস্ট্রপতি সায়েমের বাসা ছিলো রাস্তার একই পাশে।ক্লাস সিক্সে আমি, সেলিম একসাথে আদমজি স্কুলে পড়তাম।সেটা মাত্র এক বছর।আমি তার পর ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে, সেলিম ইউল্যাবে।মেট্রিক অব্দি সেলিমের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও, ও পরে মাস্তানির দিকে ঝুকে পড়ে এবং ওর সুশ্রি চেহারার পাশাপাশি অর্জন করে মাক্যু সেলিম নাম।আমি, সেলিম ফুটবল খেলতাম জাগন্ত ক্লাবে, অগ্রনির মাঠে। ফুটবল ক্লাবে আমার কয়েক বছরের বড় দুই ভাই কচি, সবুজের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়।কচি, সবুজ থাকতো আজিমপুর পিলখানারোড সংলগ্ন, খাদ্য মন্ত্রনালয়ের বড় গ্যারেজের পাশের কলোনি ভবনের একতলায়।ভবনটি ছিলো সাবেক রাস্ট্রপতি সায়েমের বাসার উলটো পাশে।আমরা খেলতাম অগ্রনি স্কুলের মাঠে। দুই ভাই-ই অত্যন্ত ভালো ফুটবল খেলোয়াড়।সবুজ কেরি কাটানোর ওস্তাদ, আর কচি ফ্লাইং কিকের!দুই ভাই-ই পাড়ার ভালো ছেলে আর বখাটে মাস্তান গ্রুপ দু'টোতেই জনপ্রিয়।দুই ভাই-ই কবিতা অন্ত প্রান!সবুজ কয়েকটা কবিতা লিখে এখানে, ওখানে প্রকাশ করেছিল সবুজ সরোজ নামে।কচি প্রথম থেকেই লিখত আহমেদ মুজিব নামে।সবুজ কবিতা লেখা চুকিয়ে দেয় উচ্চ মাধ্যমিকের পর পর, কিন্তু পুরোনো পাঠাভ্যাস বাড়িয়ে দেয় দশগুন; ভক্ত হয়ে ওঠে দ্বান্দিক বস্তুবাদের!

কচি উচ্চ মাধ্যমিকের আগেই বিয়ে  করে বসে আছে ওদের পেছনের কলোনি ভবনের রঞ্জনাকে।সেই সময় থেকেই না কি অল্প কিছু পরে ও চাকুরি নেয় কবি আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রেসে।কচি'র সাথে আবিদ ভাইর পরিচয় রিফাত চৌধুরি'র মাধ্যমে।রিফাতের সাথে কচির পরিচয় কিভাবে তার হদিস আমি কখনো বের করতে পারি নাই।নব্বি দশকের শুরুতে প্রকাশিত হয় এবং কবি মহলে আলোচিত হয় কচির একমাত্র কবিতা সংগ্রহ প্রেসের কবিতা।রোমে ২০১৩তে হার্ট এটাকে মৃত্যুর আগে কচি ও কচির কবিতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি ঠিক করি যে আমাদের সময়ের একজন কবিকে নিয়ে লিখলে তার যাপন যেরকম ছিলো, কোনরকম লুকাছাপা না করে সেরকম করেই লেখা উচিত।সেখান থেকে শুরু আশির স্নাইপারেরা।পরে কচির মৃত্যুর পর দু দফাতে লিখি দুটি এলিজি, জানুয়ারির এলিজি (২০১৩),  'প্রেসের কবিতা'র ঢাকা(২০১৭)।
 

ঢাকেশ্বরি মন্দিরে'র কাছাকাছি আবিদ আজাদের প্রেসে কচির খোজে যেতে যেতেই পরিচয় হয় কাজল শাহনেওয়াজের সাথে।কচির কাছে অবস্য  সে সময়কার আরো তরুন কবিরা আসতো।এর ভেতর ঢাকায় এলেই  ওর সাথে দেখা করত কিশোয়ার ইবনে দেলোয়ার।কিন্তু কারো সাথেই কচিকে তেমন দুর্দান্ত আলাপে মত্ত হতে দেখা  যেত না।গাজা, মদেও ওর  কোনোই আগ্রহ ছিলনা।এখানে, সেখানে যে তিন তাসের আড্ডায় আমি, কচি  মশগুল থাকতাম তাও কিছুদিন পরেই আমরা দুজনেই ছেড়ে দেই।কবিতা ছাড়া, কচির রঞ্জনাময় জিবন ছিলঃ

'এ-ভ্রমন আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া!'

ঐ চরন'টার মতোই  এক সহজ দার্শনিকতার ভেতর ডুবে গিয়েছিল কচি।ওর প্যাশনগুলো খুবই ধারালো আবার সাদা-কালো।একবার  আজিম্পুর, হাজারিবাগ গ্যাং ফাইটে স্থির হ'লো হাজারিবাগের যে কাউকে আজিম্পুর রোডে পাওয়া যাবে, তাকেই পুচিয়ে দিতে হবে।এই পোচাপোচিতে দেখলাম কচি হঠাট অন্যান্য খুচরাদের কচি ভাই হয়ে গেল এবং রিক্সা থামিয়ে হাজারি বাগের কয়েকটা লুঙ্গি পাট্টিকে পোচানোর নেতৃত্ব দিয়ে ফেললো।কিন্তু এর পরের পাইকার পর্যায়ে উন্নয়নের জন্য যেসব ঠিকাদারিগুলো করতে হয় সেগুলোতেও আবার ওর অনিহা।সুতরাং যেই কে সেইঃ 'চামেলি হাতের নিম্ন মানের মানুষ!'

রঞ্জনার বাইরে কচির আসক্তি ছিল ডাইলে।আমি দেশ ছাড়া পর্যন্ত ওর লেনদেনগুলোর হিশাব ছিল ডাইল নির্ভর।বৌয়ের সাথেও সম্পর্ক  টালমাতাল!আবিদ ভাই প্রেস কাঠাল বাগানে নিলে, ওখান থেকে কচি অন্য আরেক বড় প্রেসে চাকুরি নেয়।বলা মুশকিল রঞ্জনা, ডাইল, কবিতা কোন'টা ওর কাছে বেশি প্রিয় ছিল।সমিকরনে যোগ হ'লো রাজকুমারির মতো উজ্জ্বল কন্যা মমো!রঞ্জনা স্বিধ্যান্ত নিল মমোকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যাবার।এরপর আর বোঝা গেল না, ওরা আদৌ  বিবাহিত  না কি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।কচি নিজে হয়ে গেল ওর কবিতা সংগ্রহ 'প্রেসের কবিতা'র চরিত্র'!

খুব একটা পড়াশোনা না করলেও হয়ত দ্বান্দিক বস্তুবাদ নিয়ে সবুজের অতি পঠন, সবুজ বলতে না চাইলেও টেলিপ্যাথি মারফত কচির মগজে চলে গিয়েছিল!মানে সরকারি ভুর্তুকি বিষ চেখে চেখে দিন কাবার করলেও ও'তো আর অন্ধ ছিলনা! ট্রাকে পিষে মানুষ মারার কৌশল বের করা প্রতিবেশিদের মাথা থেকে ঝাকিয়ে বের করতে গিয়ে আরো লাখো তরুন প্রানের মতোই কচির ভেতরেও একটা  সময়-স্বয়ংক্রিয় দ্বান্দিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল।আমি ছিলাম কবিতার কেন্দ্রনিবিড়তায় আবার মিছিলের কেন্দ্রছুট প্রবনতায়।কিন্তু আমি কচি নই।কচিও আমি না।ইঞ্জিন, চেসিস আলাদা।দম নিতে,  নান্দনিক হাড়গোড়ের জয়েন্ট জুতসই রাখতে  প্রায়ই যে গ্যারেজে যাই তার তেল, মবিলেও পেলাম ঘাপলাঃ

আবিদ ভাই'র কবিতা কেন্দ্রে যোগদানের সুবাদে কাঠাল বাগান শিল্পতরু পরিনত শুল্কতরুতে!একটা দম আটকানো অবস্থা!আমরা কেউ আর তেমন আবিদ ভাই'র সাথে দেখা করি না।কচির জন্য অপেক্ষা করি প্রেসের বাইরে লুকিয়ে, যাতে হুট করে আবিদ ভাইর চোখে না পড়ে যাই! কাজল, রিফাত, আমি আমাদের আড্ডাগুলো ছড়িয়ে দিলেও কচি আটকে গেল ঐ রঞ্জনা-আছে-রঞ্জনা-নাই; প্রেসের-চাকুরি-আছে-প্রেসের- চাকুরি-নাই-কিন্তু-ডাইল-সবসময়-আছে-সমিকরনের-গাবতলি-ঘেরজালে!

আমাদের কারো অবস্থাই যে কচির চেয়ে খুব একটা উন্নত তা নয়।আমি আটকে আছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামের এক হত কুতসিত প্রতিষ্ঠানে।সেখানে আমার রঞ্জনা'র নাম নিলা ।কিন্তু গন্তব্যকে সেই নিলামুখি না করে আমি নিজেকে ভাবতে শুরু করে দেই আশির আত্মিক শহিদান হিশেবে।কায়েসের কথা মনে পড়ে কি পড়ে না!শহিদান মিছিলে এসে সংগ দেয় কাজল, অপু এবং আরো উত্তমর্নেরা!এ-বস্তিতে, সে-বস্তিতে খুজে বের করি রিফাত'কে, তার পর বিভিন্ন অনুপানে চলতে থাকে হায় হোসেন, হায় হোসেন মাতম!

অপু শোনায় ওর বড় মামা বেলাল চৌধুরি'র কাহিনি, নাটক পাড়ার কিচ্ছা!কাজল বলে লিটেল ম্যাগাজিনের কথা।কখনো দৌড়াচ্ছি চিলের পিছে, কখনো দৌড়াচ্ছি বাদুরের পিছে।কখনো এই রাস্তায়, ঐ রাস্তায় কফিলের সাথে দেখা।কফিল কিছুই খায়না ! অপুর মুখে নাটক পাড়ার কচি কচি মেয়েদের কথা শুনে নাটক করতে ইচ্ছা করে! যে-নিলার সাথে আশনাই শ্রেনি সংগ্রামে তার কমিটমেন্ট দেখে বিপ্লব করতে ইচ্ছা করে।মিছিলে গিয়েও কান্নি মেরে বেরিয়ে যাই, চলে যাই কখনো কাজলের  ক্যাম্পাসে ব্রক্ষপুত্রের তিরে, কখনো কফিলের কাছে জাহাঙ্গির নগরে!ওরাও আসে আমার আজিম্পুরের বাসাতে।রাত কাটায়, মশারির ভিতর হুট করে লাফ দিয়ে বলেঃ একটা কবিতা আসলো!সকালে নাস্তার টেবিলে কাজল'কে আম্মা বলেঃ আমিও কবিতা লিখতাম!কাজল মিটমিটায় হাসে!কচি জিন্দেগিতে আমাদের বাসার ভেতর ঢুকে নাই।কিন্তু বারান্দার সামনে দাড়িয়ে আম্মা'র সাথে খুব অন্তরংগভাবে কথা বলতো।

বিয়েত করে ফেলেছিল; বাচ্চাও পয়দা করেছিল; কিন্তু বসত শব্দটার সাথে মনে হয় তেমন পরিচয় ঘটে নাই!ওর বাবা অবসর নেবার আগে, আগে যখন আজিম্পুরের পাট চুকায়, মোহাম্মদপুরে বাড়ি তুলছে তখনো ইট, কাঠ, কংক্রিট, কামলার তদারকি করতো সবুজ।বাড়ি তৈরি হবার পর ওখানে গেলে দেখতাম অনেক ঘর থাকা স্বত্ত্বেও আমাকে নিয়ে খালি ব্যাল্কনিতে চলে আসে।ওর কবিতা পড়লেই আমার মনে হয়, ব্যাল্কনিতে গিয়ে দাড়াই!

কে এক মাখনা ভাই বস্তিতে এসে রিফাতের বন্ধু হবার জন্য ক্ষেপে যায়; রাজ্যের যত নাটক পাড়ার কথা, টি, ভি পাড়ার কথা শুনাতে চায়।কচি বলে, সেজন্যত অপুই আছে, ও তারানার সাথে নায়ক হয়েছে!তখন মাখনা মিডিয়ার কথা বলে!কচি বলেঃ সে জন্যত মুস্তফা ভাই আছে!সবকিছু একটা করে হলেই কচি তুষ্ট! কচি খেয়াল করে যে এইসব লোকের কোনই রঞ্জনা নাই!আমার চেয়েও বেশি খেয়াল করে কচি!ও বলেঃ গাবতলি'র বাস ধরতে হবে!

বাসায় ফেরার পথে কখনো  কখনো দেখি ইডেনের উলটো পাশে তারিকদের কলোনি ভবনের সামনে তাসলিমা নাসিরিন'কে।টি,এস, সি'র সামনে তারিক বলেঃ দেখ ঝামেলা, বই বের করতে চায়! তাসলিমা কচির নামও নিসচিত জানে না।অথচ কচি প্রেসে কাজ করে!অথচ তাসিলিমা বই বের করতে চায়!কচি ঢাকা ছাড়বার আগেও তাসলিমা-ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও, এটুকু বুঝছিল ছিল যে একটা উচ্ছেদমত ঘটছে।এক সময় নখ কাটাও ছেড়ে দিয়েছিল।কোনটা যে ক্ষিপ্ততা, কোনটা প্রক্ষিপ্ত তার একটা তালগোল পাকাতে থাকে ওর ভিতর।কবিতায় দেখতাম যেখানে বিস্ময়বোধকতায় বাক্য শেষ হচ্ছে, সেখানে ও দিত দাড়িচিন্ন। এটাও বলে দিচ্ছে যে ওর যুক্তিবোধ সাহিত্যের নান্দনিক পরম্পরা থেকেও আসছে না।আসছে পদার্থের ভিতরের অধ্যাত্ম থেকে।টোটাল।ভাংলে তা আরো জ্বলজ্বলে, আরো শক্তিমান।

আজিম্পুর গ্রামে তারিক, কচি দু'জনেই আমার প্রতি সহানুভুতিশিল ছিল।
তারিক আমার কবিতা পৌছে দিত এর তার কাছে।আবিদ আজাদের কাছে আমার কবিতা পৌছে দিত কচি।কবিতার দুতিয়ালি করতে করতে কচি আবিদ ভাইর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমার কবিতাকৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পালাবদলের সুত্রপাত হয়।তখন আমার বয়স উনিশ!১৯৮৫ থেকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র।জান্তা শাষনের আশির্বাদে ক্লাস শুরু হতে হতে আরো এক বছর।কচির সুত্রে আবিদ ভাই; আবিদ ভাই'র সুত্রে ঘনিষ্ঠতা কবি মুস্তফা আনোয়ারের সাথে।

কচির মাধ্যমে কাজল, রিফাতের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলেও আজিম্পুরের জামাইর হোটেল, বয়রার ঘর থেকে কাজলের ক্যম্পাস ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রক্ষপুত্র নদিতিরের রাতাকাবারি আড্ডাগূ্লো থেকে কচি দুরে সরে যায়।অবস্য ওর 'প্রেসের কবিতা' বের করবার সময় আমাকে মলাটের লেখাটা লিখবার অধিকার দিয়ে সম্মানিত করেছিল।এই সম্মানের ফলাফল হিশাবে আগের থেকে বুঝে যাওয়া একটা পর্জবেক্ষন আরো দৃড় হয়ঃ তা হচ্ছে যে আবিদ ভাইর ঢাকেশ্বরি  এবং কাঠালবাগান দুই পর্বেই নিয়মিত যাতায়াতকারি আব্দুল মান্নান সৈয়দ আমাকে একেবারেই কখনোই পছন্দ করে উঠতে পারেন নাই।'প্রেসের কবিতা'র ফ্ল্যাপ মান্নান সৈয়দকে দিয়ে লিখিয়ে নেবার পরামর্শ কচিকে দিয়েছিল আবিদ ভাই।কচি তা অগ্রাহ্য করে আমাকে দিয়ে লেখায়; এতে আবিদ আজাদ কিছু মনে না করলেও মান্নান সৈয়দ তা ব্যাক্তিগতভাবে নেয়, আমার নাম না নিয়ে, 'এই ইয়ে, এই ইয়ে...' করতে থাকে।

এই যে তারিকের সাথে কচির ঘনিষ্ঠতা হ'লোনা কিম্বা যাদের সাথে দেখা হবার'ই কথা না তাদের সাথে একটা আলুথালু, অন্যমনস্ক, নিবিড়তা; এগুলোও ওর কবিতায় যে অনিবার্জতার ঝোক তার সুত্রচিন্ন, সুরতহাল, ময়না তদন্ত করতে বেশ সহায়ক হয়ে উঠে।একটা ব্যপার লক্ষনিয়ঃ যে ঢাকাতে কচিসহ অনেক স্পর্শকাতর, সৃজনশিল নিজ নিবাসে প্রবাসি, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ৭৫ পরবর্তি একের পর এক আরোপিত সামাজিক আবদ্ধতায়, তারিকের নান্দনিক, রাজনৈতিক অঙ্গিকার ছিল সেই আবদ্ধতা থেকে মুক্তির রাজপথ তৈরি করা।

আগে বলেছি প্রায় কৈশরে কচির বিয়ে করে বাবা হয়ে যাওয়া এবং গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যস্ততা!কচির বৌ রঞ্জনাও ছিল আমাদের পাড়ার বন্ধু।কিন্তু একসাথে ফুটবলা খেলা, মোমবাতি জ্বালিয়ে কলোনির সিড়িবারান্দায় রাতভর তিনতাস পিটানি আর কবিতা পত্তনির বন্ধুকে দুরে সরিয়ে দেবার জন্য রঞ্জনার ওপর আমার একটা রাগও ছিল অনেক দিন।তবে সুন্দরি মেয়েদের সামনে রাগ, বিতরাগ ধরে রাখাও মুস্কিল!এই বেলাতে মনে পড়লো কচির বড় ভাই সবুজের সাথে তুই তোকারি হলেও, কচির সাথে সম্বোধন বরাবরই ছিল তুমিসুচক!আবিদ ভাই'র প্রেসে ম্যানেজারির কারনেও কচি ওনার সামনে আমার, কাজলের যে অনানুষ্ঠানিক কথপোকথন ছিল তাতে তাল মেলাতে চাইতনা!এটা রিফাতের মধ্যেও ছিল।রিফাত, আবিদ ভাই'র প্রেসের ম্যানেজারি ছেড়ে দেবার পরেই কচি সেই কাজ'টা পায়।

প্রেসের কবিতাঃ

প্রেস টেকনোলজি মুজিব আর মুজিবের কবিতার মধ্যে স্বচ্ছতোয়া আয়না হয়ে উঠেছেঃ বিজ্ঞ্বান বা মেশিন টুলস এ-কবিতাগুলো লেখেনি বরং কবিতার সংগলিপ্সা মেশিন'কে সংবেদনশিল চলকে রুপান্তরিত করেছে।অনুষঙ্গের জড়ত্ব ভাংগতে ভাষার যে জ্যান্ত জৈবিকতা দরকার তাতেও মুজিব সফল।মানুষ তার স্বভাবজাত মমত্ব দিয়ে যতই যন্ত্রকাতরতা প্রকাশ করুক যন্ত্রের নিজস্ব অভিধানে কাতরতা দির্নতা জাতিয় ভাবাবেগের অবকাশ নেই!ফলে মুজিবের অনুকরনে যদি অন্য কেউ যন্ত্রানুষঙ্গে মেতে উঠতে চায় তাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে আত্ম নিয়োজিত না হলে এ-অনুষঙ্গের প্রাবল্য কবিতাকে অনিবার্য জড়ত্বের দিকে ঠেলে দেবে!

মননশিলতার অভাবহেতু টেকনোক্রেটিক বহিরঙ্গে যদি কবিতা জারিত হয় তাহলে আগামিকালের প্রাগ্রসর তথ্যসমৃধ্ব পাঠকের কাছে আজকের উজ্জ্বল কবিতা হয়ে উঠবে অবসোলিট!শুধু টেকনোলজির ক্ষেত্রে নয় নাগরিক অনুষঙ্গের বেলায়ও একই বিচার প্রযোজ্য!বাংলা ভাষাতে ষাটের, সত্তরের, আশির এবং এখনো অনেকেই নগরায়নের অনুকারকতায় সংক্রামিত; কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞ্বানসম্মত করে তুলতে পারেননি অর্থাৎ টেকনিক ব্যবহার করেছেন বৈজ্ঞানিক অভিসন্ধিতসাকে এড়িয়ে।নিজের লেখাতে এবং অন্যকে পাঠে এদের তৈরি হয়েছে কেন্দ্রনিবিড় ধর্মানুষংগ যা একধরনের হস্তমৈথুনও বটে; যার থেকে উত্তরনের আয়ুধ অধ্যাত্ম নির্মিত বৈজ্ঞ্বানিক দৃষ্টিকোন!'প্রেসের কবিতা'য় যে যাত্রার শুরু তা কচি কেন চালিয়ে যেতে চায়নি তার উত্তর একটাইঃ সে যাত্রার গন্তব্য যাত্রা শুরুর আগেই নির্ধারিত, স্বপ্নদ্রষ্ট!

এই যাত্রাগুলো ভয়ঙ্করঃ তাপ ছড়াচ্ছে, আচ পাওয় যাচ্চে, ফুল্কি জ্বালানো পাথরের ফসিলগুলোও দেখা যাচ্ছে; দাবাগ্নিতে জ্বলে, পুড়ে সব ছাই হয়ে যাচ্ছে; তার মধ্যে কয়েকটা সম্পন্ন কবিতা নিয়ে দাড়িয়ে আছে ক্রশবিদ্ধ্ব, প্রলম্বিত এক স্মিতহাসি!এত শক্তি এই বজ্রপাতের; এটা মন্থনের ভেতর সমুদ্র, পোষা শুশুক-শব্দের সওয়ারি শাখের খোল হাতে উভচর এক রাজকুমার; এত সুন্দর এই কবিতাগুলো!সুন্দর শব্দটার সমস্ত নান্দনিকতা' আদায় করেও একটুকুও ধস্তাধস্তির চিন্ন নাই; কোথাও কোন আশ, ছোক্লা, ছোবড়ার চিন্ন নাই!প্রিস্টিন।সেরেন্ডিপিটি!হারাকিরি!সবকিছু খুলে দেখায়!

কচি এখানে কায়েস!কায়েস এখানে আবুল হাসান!রঞ্জনা এখানে সুরাইয়া খানম!হননের এবং বার বার পুনর্জন্মের  গৌতমি-চক্কর!সবচেয়ে বেশি দ্রষ্টব্য এটাই যে আবিদ আজাদের 'কবি' পত্রিকাতে আশির দশকের যে দঙ্গলটা একত্রিত হয়েছিল এবং পরে যারা লিখেছে বিভিন্ন সময় কাজল শাহনেওয়াজের 'ফৃ' তে, তাদের যৌথনন্দনের চিন্নায়ন সুত্রগুলো অর্থাৎ দেহছন্দে মিলানো ভাঙ্গা লিরিকের মোজাইক'ই হয়ে উঠেছে কচির কবিতার মুল মেরুদন্ডঃ

'এ ভ্রমন আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া'

কচির বিস্তারঃ প্রেমের কবিতাঃ

লোডসেডিঙ্গের ভিতর ফুটে উঠেছে আমার ব্যাক্তিগত বিদ্যুতের প্রেমমুখ।
বহুদিন লক্ষ্য করেছি, গোপন চাপ ও তাপে
আলোহীন আমার বুকে একটুকরা কয়লা শুধু হীরা হ'তে চলেছে।

কালো একজোড়া জুতার কালিকে পেয়েছিলাম সেদিন।
পেয়েছিলাম আমার নিঃসংগ পকেটে থাকা ঠিকানাময় কাগজগুলোর নিচে ঐসব অন্ধকার মুহুর্ত।
আর সড়কে কালো মাটির স্তুপ'কে ঘুমন্ত ঝোপ ভেবে
পেয়েছিলাম সারারাত বণ্য ফুল ফোটার সুতীব্র ভাবনা।

কিন্তু জানা, কোনদিন, সামান্যভাবে, তোমাকে পাবো না আমি
গাছের মন থেকে, ধীরে ধীরে, তোমাকে লক্ষ্য করে পেয়ারাফুল ঝরে।

আহমেদ মুজিব
১৯৯৫

প্রেসের কবিতার বাইরেঃ

মনে রাখা ভালো যে আমরা কেউ চেতনার শুধ্ব স্তরে বাস করি না।শুধ্বতা বস্তুত চেতনাকে খন্ডবিখন্ড বিভাজিত করার অসৃজনশিল প্রয়াস যার চাপে বারবার বিচ্ছেদ ঘটেছে প্রানস্পন্দন ও মতবাদেরঃ

'সর্বসাধন সিধ্ব হয়, তারা ভাবে মানুষ গুরু নিষ্ঠাবান'!

চয়ন খায়রুল হাবিব
২২/০৩/২০১০
ব্রিটানি

উদ্ধৃতি ব্যাবহার করা হয়েছে আহমেদ মুজিব, আবুল হাসান, আবিদ আজাদের কবিতা ও লালনের গান থেকে।চখাহা।