Friday 19 March 2010

তাশের দেশেঃ রবীন্দ্র ভাবনায়, রবীন্দ্র নাট্যশালায়


পূর্বকথনঃ

কয়েক বছর আগে লন্ডনে  দেখেছিলাম চৈনিক তরুণ হাই চিঙ্গয়ের পরিচালনায় Foundation for Indian Performing Arts(FFIPA) প্রযোজনা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কুশীলবদের সমাবেশে রবীন্দ্রনাথের তাশের দেশ অপেরাটির একটি বিশ্বস্ত মঞ্চায়ন।


পশ্চিম লন্ডনের প্রাচ্যকলা বিদ্যালয়ের ব্রুনেই গ্যলারির মঞ্চ ছোট হওয়ায় একক ও দ্বৈত নাচগুলো দেখানো হয়েছিল মঞ্চে আর দলীয় পরিবেশনাগুলো দেখানো হল আগে ধারণ করা ভিডিওতে, পর্দায়। সূত্রধরের ভুমিকায় হাই চিং নিজে দিলেন ইংরেজি ধারাভাষ্য।

বীরপুরুষ ধরনের এক রাজকুমার অজানাকে জয় করতে বেরিয়েছে। তাসগুলো হচ্ছে বর্ণাশ্রমের, শ্রেণিভেদের, অচলায়তনের প্রতীক। রাজকুমারের জংলিপনা ধূলিস্মাৎ করে দেবে হরতন, ইস্কাপন, রুইতনের জরদগব শৃঙ্খলা!

FFIPA প্রজোযনা'র একই সপ্তাহে এক আন্তর্জাতিক অনুবাদ ওয়ার্কশপে শুনতে হয়েছিল তাসের দেশে কবিগুরু যে ব্রটিশ রাজের পরোক্ষ সমালোচনা করেছিলেন তারই নাক উঁচু ভৌতিক প্রতিধ্বনি। বক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বক্তব্যগুলো হজম, বদহজমের সময় হজমির শক্তি সুধার মত মনে পড়ছিল আজিমপুরে বাসার কাছে থাকা উর্দু সাহিত্যের অনুবাদক জাফর আলমের কথা; মনে পড়ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘সেবা’ অনুবাদগুলো গোগ্রাসে গিলতে, গিলতে শৈশব থেকে বিশ্বজনীন যৌবনে আছড়ে পড়বার অদম্য বাসনার কথা!

যুক্তি ভাঙবার কেজো কৌশলঃ

এক যুগেরও আগে আমি ইংরেজি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম সোয়িঙ্কাকে। অনুবাদটির অনানুষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন দু’জন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবে মাত্র গড়ে ওঠা নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি সৈয়দ জামিল আহমেদ ও ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ নিয়াজ জামান।অনানুষ্ঠানিক এ-কারণে যে আমি ওনাদের সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু অনেককে ঠেলে শুধু যে কাজটি এ-দুজন অনুমোদন করেছিলেন তাই নয়, বড় মাপের এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে নাটকটির মঞ্চায়নের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। মঞ্চায়নে আমার সবচেয়ে বড় খুঁটি ছিল পাভেল (আবুল কালাম আজাদ), অপু চৌধুরী, আহমেদ হোসেইন ও মিজানুর রহমান।

অনুবাদ হচ্ছে একটি আমদানিজাত যুক্তি প্রক্রিয়া। সে-যুক্তির সাথে একমত হলে ভাল। কিন্তু বিরোধ থাকলেও তাকে কীভাবে প্রকাশ এবং যোগাযোগ যোগ্য ভাষায় রূপান্তর করা যায় তা নিয়ে সোয়িঙ্কা অনুবাদ থেকে মঞ্চায়ন পর্যন্ত জামিল ভাইর সাথে দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তখন যে আলোচনাগুলো হয়েছিল, এখন বুঝি যে ঐগুলোই ছিল সুতীব্র ওয়ান টু ওয়ান ওয়ার্কশপ।

জামিল ভাই আমাকে একের পর এক কেজো-কৌশল বাতলে দিচ্ছিলেন। কৌশলগুলোর মোদ্দা কথা হচ্ছে সংলাপের পেছনের সংলাপগুলো খোড়া; ভেতরে ঢুকবার আগে বাইরের উঠোন, দরজা, জানালা মাপামাপি; কোন দেশটা থেকে শব্দগুলা আসছে তা জেনে সেই দেশটার ভূত, ভবিষ্যত, সংস্কার, কু-সংস্কার জানা। এই জানাগুলো একই সাথে যুক্তি ভাঙবার বর্শা এবং ঢাল!

আর সে-বর্শা ও ঢালে ভর করে সাজ সাজ রবে আমি সোয়িঙ্কার যুক্তিগুলোকে ধরিয়ে দিচ্ছিলাম নাগরিকের অপু, আরণ্যকের পাভেল, পদাতিকের মিজান ভাই, লোকনাট্য দলের মনি, ঢাকা থিয়েটারের পাখিসহ সে-সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অন্যান্য নাট্যকর্মীদের মগজে ও জিহবায়।

জামিল আহমেদের এক প্রধান দীক্ষাগুরু NSD-র অধ্যক্ষ ইব্রাহিম আল কাজি। আর এ তো স্বতসিদ্ধভাবে ধরেই নেয়া যায় যে আল কাজি সাহেব পুরো ভারতের নাট্যধারাগুলোর সাত নরি হার বানাবার সময় রবীন্দ্র নাট্য-ভাবনাকে অন্যদের চেয়ে দুই বা তিনটি বেশি নরি দিয়েছিলেন। জামিল ভাই আমাকে রাজা নাটকটি করবার ইচ্ছার কথা বার বার বলতেন। করেছিলেন কিনা জানা হয় নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে শুনেছি পাভেল রাজা করেছে। বেশ ভেঙেচুরে করেছে। কারো এ-ভাঙাচোরা ভাল লাগে নি। কারো ভালো লেগেছে। সে-প্রসঙ্গ আরেক দিন।

জামিল ভাইর কাছ থেকে মঞ্চায়নযোগ্য অনুবাদের খুটিনাটি জানবার আগ থেকে এ-অব্দি বার বার পড়ি, বার বার ভাবি রবিন্দ্রনাথের নিজের করা ইংরেজি থেকে বাংলা রূপান্তর আর বাংলা থেকে ইংরেজি ভাষান্তর নিয়ে তার নিজের ভাবনাগুলো। গীতাঞ্জলির অনুবাদক ইংরেজি ভাষার তখনকার ডাকাবুকো ব্যটসম্যান পাউন্ড, ইয়েটসকে সরাসরি বোল্ড আউট করেছিলেন। কিন্তু সেই একই রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবীর নিজের করা ভাষান্তর রেড অলিয়েন্ডার নিয়ে বিব্রত বোধ করেছিলেন।

তাসের দেশ-এর পটভূমিকায় যেমন বর্ণাশ্রম আর উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল, সোয়িঙ্কার লেখার পেছনে তেমনি উপনিবেশী হীনম্মন্যতার সাথে গোত্র আর ধর্মভেদের অভিশাপ। সোয়িঙ্কার যুক্তি বুঝতেই আমাকে প্রথমবার তাসের দেশ-এর যুক্তি ভাঙবার কৌশলগুলো আয়ত্ব করতে হইয়েছিল।




দ্বিভাষী সাহিত্যের আলুনিঃ

বিদেশি একটি যুক্তিকে ভেঙে নিজের যুক্তিবোধের আওতায় নিয়ে আসবার যে-পদ্ধতি, সেই একই রীতি কি নিজের কাজের ভাষান্তরেও ব্যবহার করা যাবে? অন্যের যুক্তি-পদ্ধতিতে ঢুকতে হলে সবচেয়ে আন্তরিক আয়াসেও কি রক্ষণাত্মক নুনের ছোঁয়াচ থাকে? নিজের কাজ নিজে নিজে অনুবাদ করবার সময় এই রক্ষণাত্মক আলুনির মাত্রা কি বাড়ে না কমে?

আন্তর্জাতিক তথ্য মাধ্যমে অনুবাদকের কাজ করবার সময় দেখেছি তথ্যের অনুবাদে ক্ষমতাকাঠামোর অদৃশ্য নুন, তেল, ঝাল মিশিয়ে কী করে তা বিদেশি শ্রবণ যন্ত্রগুলোর কাছে হয়ে ওঠে মোহন বাশির সুর! কী করে তা বিরোধী যুক্তিকে নিয়ে আসে আপোশ ও বশ্যতায়।

তথ্য মাধ্যমগুলো যে বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর প্রচার মাধ্যম তা বুঝতে আমাদের প্রচণ্ড মেধাবী হবার দরকার নেই। কিন্তু তথ্যকে যে দর্শনের ছাকুনিতে ফেলে দানবীও শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়;আর সে দানবকে রুখতে হলে ক্ষমতাকাঠামোর দৈনন্দিন ঝাড়াই, মাড়াইতে পেরেশান মানুষের যে তথ্য পাবার এবং তাকে ভাঙবার বিকল্প দরকার তা বুঝেই কি রবীন্দ্রনাথ, স্যামুয়েল বেকেট, ওলে সোয়িঙ্কা তাদের সৃজনশীল সময়ের বিপুল এক সময় দ্বিভাষী সাহিত্য চর্চায় নিয়োগ করেছেন?







তাসের দেশের দর্শনঃ
তাসের দেশে অপেরাটি রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন ল্যুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর ছায়া অবলম্বনে। অপেরাটির মূল লক্ষ্য ছিল সনাতনী প্রথা আর ব্রটিশ রাজের সমালোচনা।

বিভিন্ন লেখালেখি খোড়াখোড়ি করলে দেখা যাবে শিশুদের নিরীহতাকে রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড শক্তির উৎস মনে করতেন। এই নিরীহ শক্তি যে দেব ও দানব কোনোটারই তোয়াক্কা করে না, সে-ধারণার সাথে ভ্রমণের বাসনাকে বাস্তবতায় রূপ দিতে পারলে যোগ হবে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার দুরন্ত অধ্যাত্ম: এই দর্শনই কাজ করেছিল তাসের দেশের নির্মাণ পরিকল্পনায়। সংলাপ, নাচ, গান, বাজনা ঐ দর্শনেরই বাহন।

মূল বিষয় বেশ মামুলি ধরনের ছেলেমানুষী: বীরপুরুষ ধরনের এক রাজকুমার অজানাকে জয় করতে বেরিয়েছে। তাসগুলো হচ্ছে বর্ণাশ্রমের, শ্রেণিভেদের, অচলায়তনের প্রতীক। রাজকুমারের জংলিপনা ধূলিস্মাৎ করে দেবে হরতন, ইস্কাপন, রুইতনের জরদগব শৃঙ্খলা!

মঞ্চায়নের সূত্রচিহ্নঃ

তাসের দেশ লেখা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া গায়ক শান্তিদেব ঘোষের বরাতে জানা যায় কবির ছেলের বউ ও নাচের শিল্পী প্রতিমা দেবী একটি নাচ-নাটকের কথা ভাবছিলেন। প্রতিমা শান্তিকে তার করা খসড়াটি শ্বশুরকে দেখাতে বলেন। প্রতিমা চেয়েছিলেন শ্বশুর মশাই ওর খসড়াটি ঠিকঠাক করে দেবে। তিন দিন বাদে রবীন্দ্রনাথ এক্কেবারে নতুন এক অপেরা লিখে হাজির। ওটাই তাসের দেশ-এর প্রথম পাণ্ডুলিপি।

১৯৩৮-এ শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিনকে সামনে রেখে তাসের দেশ ঘিরে শুরু হয় আক্ষরিক অর্থে হুলুস্থুল কাণ্ডকারখানা!রবীন্দ্রনাথ এতে জুড়লেন আরো চারটি নাচের দৃশ্য, আর ৮টি নতুন গান!একের পর এক দৃশ্য আর নতুন গান জুড়ে দেবার সময় শান্তিদেব, প্রতিমা বসু, নন্দলাল কি কোনো প্রশ্ন তুলেছিলেন?এঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গুরুদেব। এঁরা কি ভালোবেসে শেষবেলায় গুরুর ছেলেমানুষীকে মেনে নিয়েছিলেন? প্রতিমার ধারণার সাথে কবি যোগ করলেন ১৮৯৮তে লেখা ছোট গল্প ‘একটি আষাঢে গল্প’ এবং তার কবিতা ‘বাণিজ্য বসতে লক্ষী’।

তাসের দেশ প্রকল্পে উত্তেজিত কবি সে-সময় শুরু করা চণ্ডালিকা পাশে সরিয়ে রাখলেন। পুরুষ চরিত্র নিলেন মেয়েদের, আর নারী চরিত্রের রূপায়ণে নিলেন ছেলেদের। সময়টা এমন তখন যে মেয়েদের মঞ্চে অভিনয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ অচলায়তনের পট বদলাবে রাজার হাতে নয়, রানির হাতে!





শিল্প নির্দেশনাঃ

প্রতিমা দেবী ভারতীয় ধ্রুপদ নাচের পাশাপাশি ইউরোপীও আধুনিক নাচে পারদর্শী ছিলেন। তাসের দেশ-এর প্রথম মঞ্চায়নে তিনি মণিপুরি কত্থকের সাথে মেশালেন পশ্চিমী ব্যালের ভঙ্গি। পরে তার হাত ধরে যোগ হল কেরালার কথাকলি আর শ্রীলঙ্কার কান্ডি ভঙ্গি।

সে-সময়কার সঙ্গীতভবনের প্রধান রমা দেবী বাজনদার আর গাইয়েদের নেতৃত্ব দেন। রবীন্দ্রনাথের ভাই দিনেন্দ্রনাথ লেখেন গানগুলোর স্বরলিপি। চারুকলার প্রধান নন্দলাল বসু করেন মঞ্চসজ্জা । বালি ও জাভার মেয়েদের পোশাকের ঢঙে তাসের দেশবাসীদের পোশাক বানান প্রতিমা। আর রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনটি পর্যন্ত রাজকুমারের পাট করতেন শান্তিদেব: এক বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে এসেছিল যে শিশুটি সে তার আটাশি বছর কাটিয়েছিল বোলপুরের ঐ আশ্রমে।

প্রতিমা, শান্তিরা রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় যেভাবে করেছিলেন তার প্রতি আক্ষরিকভাবে বিশ্বস্ত থেকে ২০০৮-এ চীনা পরিচালক কুশীলব ধরে এনেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে: কোলকাতা থেকে এসেছেন নৃত্যশিল্পী য়্যশ মুখার্জি, বালি থেকে নি মাদে পুজাওয়াতি, কেরালার শ্রীকান্ত সুব্রাহ্মণ্যম,আমার ঢাকা শহরের শাহাদাত হোসেইন।

খুঁটিনাটি ইতিহাসঃ
এখন যা কোলকাতার এলিট সিনেমা এক সময় তা ছিল “মদন থিয়েটার”। ১৯৩৩-এ এখানেই প্রথম তাসের দেশ মঞ্চস্থ হয়। পুরো প্রযোজনাটি ছিল ৭৫ মিনিটের। এর পর ওপেরাটি বোম্বে সফরে গেলে আরো নাচের দৃশ্য যোগ হয়। ১৯৩৮-এ শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিনকে সামনে রেখে তাসের দেশ ঘিরে শুরু হয় আক্ষরিক অর্থে হুলুস্থুল কাণ্ডকারখানা!রবীন্দ্রনাথ এতে জুড়লেন আরো চারটি নাচের দৃশ্য, আর ৮টি নতুন গান!এতে কি প্রযোজনাটি খোলতাই পেল, নাকি ভারাক্রান্ত হল? এক বিচারে হ্যাঁ। আরেক বিচারে না!

একের পর এক দৃশ্য আর নতুন গান জুড়ে দেবার সময় শান্তিদেব, প্রতিমা বসু, নন্দলাল কি কোনো প্রশ্ন তুলেছিলেন? এ-ব্যাপারে কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই। এঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গুরুদেব। এঁরা কি ভালোবেসে শেষবেলায় গুরুর ছেলেমানুষীকে মেনে নিয়েছিলেন?

এ-প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে তাসের দেশ ঘিরে রবীন্দ্রনাথের অস্থিরতার আরেকটি অর্থ আমি দাঁড় করাতে চাই। রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর অন্তরঙ্গ কুশীলবদের প্রাণ যে-পাষাণে পিষ্ট হচ্ছিল তখনো তা হচ্ছে “পরাধীনতা”। সমস্ত উৎসব আয়োজনের ভেতর মহৎপ্রাণ ঐ বিশাল মানুষটি আর তাঁর কীর্তিমান অনুচরেরা কড়ায় গণ্ডায় বুঝেছিল যে ভারত তখনো পরাধীন। ঢাকার বস্তি বালকের শহীদ মিনার গড়ার আনন্দ থেকেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ কেন শেষ বেলায় তাসের দেশ-এ আরো গান, আরো নাচ জুড়েছিলেন। এ-সময় লেখা অন্যান্য কবিতার পরিমিতি মনে পড়িয়ে দেয় আত্ম-সম্পাদনায় তাঁর পারদর্শিতা।




কারিগরি পযার্লোচনাঃ

যে কোনো মঞ্চায়নের মূল লক্ষ হচ্ছে দর্শকের সাথে কুশীলবের সরাসরি যোগাযোগ। যোগাযোগটা হচ্ছে ধরে নিয়েই বাণিজ্যিক থিয়েটারের মালিকেরা তখনকার কোলকাতা থেকে বোম্বে তক তাসের দেশ দেখিয়েছিলেন। এটা রবীন্দ্রপ্রীতি থেকে নয়।

হাই চিঙ্গের মঞ্চভাষ্য বিশস্ত হলেও দর্শকের সাথে যোগাযোগের যে তাৎক্ষণিকতা তাতে আমার ধারণা সফল নয়। মঞ্চভাষ্যের সাথে ভিডিও ভাষ্যের মিশেল আমার কাছে মনে হয়েছে কখনো প্রাথমিক স্তরের একাডেমিক কাজ, কখনো প্রক্ষিপ্ত। যদিও ভিডিও ভাষ্যেও রবীন্দ্রনাথের সাথে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় নি। কিন্ত কাজটা কি ওপেরা নাকি মিউজিক্যাল, নাকি মিক্স মিডিয়া ইন্সটলেশান তা বোঝা মুশকিল। প্রাচ্যকলার ডাইরেক্টার তাঁর বক্তব্যে ইউ-টিউবের দোহাই পেড়ে এই ফিউশনকে জায়েজের চেষ্টা করেছিলেন। আমার মনে পড়ছিল পিটার ব্রুকের ১২ ঘণ্টার মহাভারতা মঞ্চ প্রযোজনাটির কথা। ওখানে ব্রুক এক লহমার জন্যেও মঞ্চে অন্য কোনো মাধ্যমের অনুপ্রবেশ ঘটান নি।

দুই মাধ্যমের মিশেলে হাই চিং প্রযোজনা চমৎকারিত্বের দাবিদার, কিন্তু বড় মাপের মঞ্চ প্রযোজনার নিক্তি পাল্লায় ছোট মাপের বাটখারার ভাগিদার।

প্রাককথনঃ

সপ্তাহের শুরু গড়ায় সপ্তাহের শেষে। লুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড ভেঙে গড়া তাসের দেশের রাজনীতি হাড়ে হাড়ে বুঝি সাহিত্য অনুবাদের ওয়ার্কশপের আড়ালে প্রচারমাধ্যমের ভেল্কিবাজিতে। বুঝি, কিছু কিছু দূরত্ব আছে যেগুলো মৌলিক। শত সহাবস্থানেও সে-দূরত্ব ঘোচে না। এ-দূরত্বের গা সওয়া মেলবন্ধনের আলঙ্কারিক নামই কি “অনুবাদ”? মনে পড়ে যায় ইংরেজের সাথে মধুচন্দ্রিমা সাঙ্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ জালিওনয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর নাইটহুড খেতাব ফেরত দিয়ে। কিন্ত আরেক ইংরেজপুত্র লিওনার্ড এল্মহার্স্ট ১৯২৫ শালে শান্তিনিকেতনের অনুপ্রেরণায় গড়েছিলেন যে ডার্লিংটন হল তা এখনো অনূদিত অক্ষরগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে কালের সীমান্ত পেরিয়ে অনূদিত অনুভবের দেশে।

লন্ডন মে ২০০৮
চয়ন খায়রুল হাবিব

স্বত্ত্বঃ লেখক
লেখকের প্রকাশিতব্য  'রবীন্দ্র ভাবনায় , রবীন্দ্র নাট্যশালায়' এর অংশবিশষ।
লন্ডনে এবং বাংলাদেশে আইনি আনুষ্ঠানিকতায় স্বত্ত্ব সংরক্ষিত।
অনলাইন বা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা যাবে না।