Tuesday 20 February 2024

লাল ঘোড়ার চক্কর, চক্কর!

আসলে কিন্তু তেমন বেশি বই প্রকাশিত হচ্ছে না!

বিউটি বোর্ডিং। ২০১০।

অনেকে বলে, আরে সবাই দেখি লেখক, সবাই দেখি বই বের করছে! আদতে আমার তা মনে হয় নি।

আপনার বাসার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন। অনেক কিছুর ভেতর বইয়ের তাক নেই। কারো বাসায় থাকলেও নতুন বই সেখানে কম বা নেই। যে কয়েকটা নতুন বই, তা  কোনো বন্ধুর মোড়ক উন্মোচনে পাওয়া বা কাজের জায়গা থেকে পাওয়া। কাজের জায়গাগুলোতে বই উপহার আর চোখে পড়ে না, ক্রেস্ট দেয়া হয়। আর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলেমেয়ের পাঠ্য বই। আপনার বইপত্র পড়বার অভ্যাস নেই, বা চলে গেছে, ছেলেমেয়েও সে অভ্যাস পায় নি। স্কুল, কোচিং সেন্টার, বাসা সেই টেকস্ট, টেকস্ট, টেকস্ট, আর টেকস্ট বইয়ের বাইরে টেক্সটিং।

বই প্রকাশ অন্য সব সরবরাহের মত চাহিদা ভিত্তিক। আপনার আশেপাশে তার নিয়মিত চাহিদা নেই বলে, সারা বছর তার তোড়জোড় না করে সাকুল্যে এক একুশে মেলাতে যখন অনেক বই বেরোয়, তখন আপনাদের মনে হয়, আরে সবাই লেখক হয়ে যাচ্ছে। হলে কিন্তু খুব ভালো। পড়ার এবং নিয়মিত প্রকাশের চাহিদা বাড়বে।

বই মেলার বাইরে বইয়ের নিয়মিত চাহিদা, যোগান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বইয়ের দোকানের পাশাপাশি বড় ভূমিকা রাখে স্থানীয় পাঠাগারগুলো। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঠাগার সংখ্যা একেবারেই বাড়ে নি। ধর্মীয় বইয়ের চাহিদা, যোগান বেড়েছে,  সেই অনুপাতে কমে গেছে স্থানীয় সাহিত্যের যোগান। কিন্তু সাহিত্য পাঠের চাহিদা যে কমেছে তা সত্য নয়। পাঠাগারের সংখ্যা বাড়লে দুটাই পাশাপাশি বাড়তে পারতো। স্থানীয় লেখকদের ভেতরেও বিচিত্র পাঠ সীমিত, কাকে চিনি, কার বইয়ের কথা বললে লাভ হবে এসব প্রবণতায়। সারা দুনিয়াতে লেখক, প্রকাশকেরা পাঠাগার সম্প্রসারণে জড়িত, বাংলাদেশে লেখকদের ভেতর এ ব্যাপারে অনীহা।  আমাদের প্রজন্মের শক্তিমান উপন্যাসিক রাশিদা সুলতানা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। রাশিদা যেরকম নতুন বইপত্র সংগ্রহ করেন, সেরকম নতুন পাঠাগার হলো কি না খোজ রাখেন এবং সেখানে বইপত্র পৌছে দেন। 

ব্যতিক্রম দিয়ে চাহিদা, যোগানে ভারসাম্য হয় না। লেখকদের ভেতর অন্তর্মুখী প্রবণতা চাহিদা, যোগানে যে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাঠকের নিয়মিত চাহিদা পূরণে বইয়ের দোকানগুলোতে পশ্চিম বঙ্গের সমকালীন সাহিত্যের যোগানের ভিড়ে। বাংলাদেশের চাহিদার ওপর চলছে পশ্চিম বঙ্গের প্রকাশনা জগত। সম্প্রতি বেইলি রোডে যে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের মালিক পক্ষের  হাই রাইস নির্মাণের কারণে সাগর পাবলিশার্সের শো রুম বন্ধ হবার পথে তাও দ্রষ্টব্য। নিউমার্কেটে বন্ধ হয়ে গেলো ৫০ বছরের পুরনো জিনাত বুক স্টোর। আশির দশকে জিনাতের নিয়মিত যাতায়াতকারী হিসেবে জানি পশ্চিম বঙ্গের প্রকাশনা এবং বিশ্ব প্রকাশনার ক্ষেত্রে জিনাতের মালিক যে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তার কিয়দংশ দেন নি স্থানীয় সমকালীন প্রকাশনার প্রতি। এখনো যা চলছে তা হলো পুরনো প্রতিষ্ঠিত, ব্যাপক পরিচিত লেখকদের সমগ্র পরিবেশনা। বাতিঘর, পাঠক সমাবেশ পরিবেশনায় গুনগত মান অর্জন করমেও, এখানেও স্থানীয় সমকালীন নবায়িত সাহিত্যের পরিবেশনা শূন্য। 

পৌষে বই মেলাতে যে কিছু নতুন বই বের হয়, বৈশাখ না আসতে আসতে তার রেশ মিলিয়ে যায়, নতুন বইগুলোর ঠাই হয় না বইয়ের দোকানের তাকে। ফলে দৃষ্টিকোণের নবায়নও ঘটে না। এদিক থেকে ধর্মিও বইয়ের পরিবেশকরা এগিয়ে থাকেন, কারণ যখনই তাড়া একজন নতুন প্রচারকারীর সন্ধান পান, তার বইপত্র প্রমোট করতে থাকেন।         

একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আগে ঢাকার পাড়াগুলো থেকে বন্ধুরা মিলে, ক্লাবগুলো, সাংস্কৃতিক সঙ্ঘগুলো এর তার থেকে চাঁদা নিয়ে একুশে সঙ্কলন বের করতো। এতে লেখা ছাপাতো পাড়ার ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি সব।

এসব সঙ্কলন থেকে বেরিয়ে আসতো তরতাজা, তরুণ কোরক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলো থেকেও বের হতো এরকম সংকলন। এখনো হয়তো হয়, কম। তরুণদের লেখালেখি, প্রকাশনা খুবই কম। মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ পুরোপুরি বুড়োদের দখলে। তাও বা মন্দ কি। বুড়ো, বুড়িরা সলতে ধরে রাখলে হয়তো প্রদীপ জ্বালাতে আবার তরুণদের সমাগম হবে। কিন্তু বুড়োবুড়িরা সব মঞ্চ দখল করে রাখলে খুব বিপদ।

আমার সতেরো বছরের কবিতাগুলো ছাপিয়েছিলেন প্রয়াত কবি আবিদ আজাদ তার 'কবি' পত্রিকায় ১৯৮৪, ৮৫ সালের দিকে। অবশ্য ওনার সাথে দেখা হতে হতে আমার বয়স ১৯/২০। শুরু করেছিলাম ১৭ বছরে লেখা কবিতাগুলো দিয়ে। আজিমপুর থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উল্টো-পাশে ওনার 'শিল্পতরু' প্রেসে যেতাম সতীর্থ বন্ধু আহমেদ মুজিব, আমি। সেখানে আমার দেখা হয় রিফাত চৌধুরী, কাজল শাহনেওয়াজ, কিশোয়ার ইবনে দিলওয়ার, বুলান্দ জাভির, পুলক হাসান, রাজু আলাউদ্দিনসহ অনেকের সাথে। ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় রিফাত এবং কাজলের সাথে। রিফাত আসতো পুরান ঢাকা থেকে, কাজল আসতো ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কিশোয়ার সেই সিলেট থেকে। আমার কবিতাগুলো ছিলো খুব ছোটো, আবিদ ভাই বলতেন, 'অসংলগ্নতা-স্নাত আত্ম উন্মীলন'। 

অন্যরা সবাই মোটামোটি মাঝারি লম্বা কবিতা লিখতো, কোনটা সরল, কোনটা খটোমটো। আমরা দিন রাত কবিতা, সর্বোপরি সাহিত্য নিয়ে কথা বলেই যেতাম। সবচেয়ে বেশি কথা হতো কাজল, রিফাত, মুজিব এবং আমার। এদের ভেতর কাজল, রিফাত নিয়মিত আজিমপুরে আসতো, আমাদের বাসার সামনে রাস্তার এক পাইস হোটেলে আড্ডা মারতাম। আমাদের লক্ষ্য ছিলো অনেকগুলো, বাংলা কবিতাকে পরোক্ষ প্রতীকের বাইরে নিয়ে আসা, সহজ করে ফেলা, যার ফলশ্রুতিতে আশির শেষে একসময় কাজলের কয়েন শব্দ হয় 'খোলামিল', আমার একটা কয়েন শব্দবন্ধ দাঁড়ায় 'ভাঙ্গা লিরিক'। 

মাঝ আশিতে আমাদের শুরুর দিকে একদিন আবিদ আজাদ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, ''রিয়েল দীর্ঘ কবিতা দেন, 'কবি'র একটা সংখ্যাতে শুধু একটা দীর্ঘ কবিতা ছাপাবো।'' কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখলাম কেউ দেয় কি না। আবিদ ভাইকেও জিজ্ঞেস করলাম, কেউ দিয়েছে কি না। উনি জানালেন যে কেউ দেয় নি। সে সময় কয়েক দিন ধরে লেখা আমার প্রথম দীর্ঘ কবিতা 'মৌল জন্তুর ভাষা' ওনাকে দিলাম, উনি শুধু সে কবিতাটি দিয়ে একটি 'কবি' সংখ্যা করলেন। আমার প্রথম অনুবাদ নাটক সোয়িঙ্কার 'রক্তবীজও' উনি ছাপিয়েছিলেন। 

সেই ৯০তে বাসার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেয়েছি গুণদা হেটে যাচ্ছেন, ওনাকে দাঁড় করিয়ে বাসা থেকে এনে সুলভ কাগজে লেখা ১০ স্তবকের 'সম্পর্ক সংহিতা' দিয়ে বলেছি, পুরোটা একসাথে ছাপাতে হবে। উনি তা পুরো ছাপিয়েছেন 'বাংলা বাজার' পত্রিকায়। 

আজকের সতেরো বছরের বা উনিশ বছরের চয়নদের অনেকে হয়তো কবিতা লিখছে। আবার অনেকে অন্যের লেখা কপি/পেস্ট করে সামাজিক মাধ্যমে ছাড়ছে। অনেকের একটা করে বই আছে। কিন্তু মঞ্চগুলোতে সেই বুড়োদের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে টিকে থাকতে পারলে টিকছে বা ধাক্কাধাক্কিটা নিতে চাচ্ছে না। কেই বা নিতে চায়। নন্দনতত্ত্ব যখন রফিক আজাদের ভাষায় বলে, ''আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ। ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।'', তখনো তা ধাক্কাধাক্কির ব্যাপার নয়। মব, হাটুরে মার থেকে সাহিত্য আসে না। সাহিত্যের জন্য ধ্যানস্থ পরিবেশ জরুরি। 

রফিক আজাদ ছিলেন আবিদ আজাদ সহ আরো অনেকের কাছে নমস্য। আবিদ আজাদ প্রথমে ছদ্মনাম নিয়েছিলেন সুমন সরকার। পরে নিজের ডাকনামের সাথে রফিক আজাদের আজাদ যোগ করেন। আবিদ আজাদের ঘনিষ্ঠতা বন্ধু ছিলেন শিহাব সরকার। আবিদ আজাদ যখন সামরিক জান্তা আয়োজিত কবিতা সভায় যোগ দেন, ওনাদের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যায়। আমাদের সাথেও আবিদ ভাইর দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের প্রাণের ভেতরে থেকে যায় আবিদ আজাদের 'ঘাসের ঘটনা', 'বনতরুদের মর্ম'।

আজকের আজিমপুরের একজন সতেরো বছরের কিশোর একের পর এক হাই রাইজ দেখবে, সেই পুকুর, মাঠগুলো ভরাট হয়ে গেছে। আমাদের কয়েক প্রজন্ম আগের শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সৈয়দ হকদের পুরো ঘোরাঘোরি ছিলো আরমানিটোলা, মাহুতটূলি, বিউটি বোর্ডিং এলাকায়। শহর বদলায়, কবিতাও বদলায়। বড় বড় শহরগুলোতে বিভিন্ন সময়ের প্রতিষ্ঠিত, অপ্রতিষ্ঠিত কবিদের লেখা অনবরত রিপ্রিন্ট হতে থাকে। আমাদের বড় কবিদের বেশির ভাগ লেখাগুলো তাদের জীবনাবসানের পর আউট অফ প্রিন্ট। কারো কারো শ্রেষ্ঠ কবিতা সঙ্কলন পাওয়া যায়, তাও খুঁজেপেতে যোগাড় করতে হয়। আর বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় ঘুরেফিরে কিছু জীবনী উপহার হিসেবে দেয়া হয়, সেগুলোকেই দেখা যায় দোকানে পিরামিড করে রাখতে। কবিতার ছন্দকে বলা হয় নাচের ছন্দ, গদ্য সেখানে দাবার চাল। একটি নগর থেকে কবিতার পরম্পরা হারিয়ে যাওয়া মানে, নাচের ছন্দের জায়গাতে দাবার চাল জাঁকিয়ে বসা।

আরো প্রকাশনা, আরো লেখক,  লেখিকা আসাটা ভালো। কিন্তু এই তোড়ে তরুণ সাহিত্য এখন দুর্লভ। চ্যালেঞ্জ নাই, শুধু সাবধানী হিসেবি পদক্ষেপ। আমার পরিচিত অনেকে দেশে এবং ডিয়াস্পোরাতে স্মৃতিকথা লিখে প্রকাশ করছেন। এটাও দরকারি প্রকাশনা। আমার এই পরিচিতদের বয়স ষাটের কোঠায় বাঁ ষাট পেরোনো। ছেলে মেয়েকে বড় করে, জীবনের একটা স্থিতিতে এসে এরা যা প্রকাশ করছে তাকে বলা যায় গেজেটিয়ার লেখালেখি। অর্থাৎ আগের জমানার ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কর্মকর্তারা অবসর গ্রহণের পর যেসব লেখালেখি করতো সেরকম। একটি জনপদের ইতিহাস জানতে এরকম লেখাগুলো দরকারি। 

ব্রিটিশ গেজেটিয়ারদের লেখাতে স্থানীয় সাধারন্যের কথা যত জানা যেতো, আমাদের পরিচিতিদের স্মৃতিকথায় তা সেরকমভাবে জানা যায় না। এদের প্রবণতা অনেকটা আলফ্রেড হিচককের মত। হিচকক শুধু যে নিজের জীবনচরিতে লন্ডনের শ্রমজীবি পাড়ায় জন্ম, বেড়ে ওঠা লুকিয়েছিলেন তাই নয়, অন্য জীবনিকারদেরও তা লুকাতে বাধ্য করেছিলেন। আমার পরিচিতদের স্মৃতিকথা কেমন হবে তার আভাষ পাওয়া যায় তাদের সামাজিক নেটওয়ার্কের পোস্টে, যা ভরা থাকে কখন কোথায় কোন সচিব, পদবীধারীর সাথে দেখা হলো তার ফিরিস্তিতে। 

মজার ব্যাপার, আমার প্রিয় কবি শামসুর রাহমান ৫০ বছর বয়সে, 'স্মৃতির শহর' নামে একটি বই প্রকাশ করেন, ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের শিশু সাহিত্য বিতান প্রকাশনার মাধ্যমে। বইটির বর্তমান প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন। একটি বইয়ের কপিরাইট লেখক বা তার ওয়ারিশদের হাতে থাকে লেখকের মৃত্যুর পর ৬০ বছর। আশা করি শামসুর রাহমানের ওয়ারিশেরা তার বইয়ের বিক্রয় রয়্যালটি পাচ্ছেন। 

শামসুর রাহমানের 'স্মৃতির শহর' সত্তর দশকের শেষে প্রকাশিত হলেও, উনি যে শহরে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছিলেন, পঞ্চাশ থেকে সত্তরে তা আমূল না বদলালেও, নতুন ঢাকাতে সম্প্রসারিত হয়েছে মধ্যবিত্তের প্রাণকেন্দ্রগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রমনা, আজিমপুর, ধানমন্ডি, এলিফেন্ট রোডে ছড়ীয়ে পড়েছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। শামসুর রাহমান যে লাল ঘোড়ার সওয়ারিদের সাথে তরুণী প্রতিবেশী বা আত্মীয়াদের ইলোপের কথা শুনতেন এবং লিখতেন, তারা অপসৃত হয়েছে নতুন ঢাকায় রেসকোর্স উঠিয়ে দেয়ার সাথে। শামসুর রাহমানের আপন বোনের মেয়ে লিনা আপা আমার সেজো বোন রুবির ঘনিষ্ঠতা বান্ধবী। সামাজিক নেটওয়ার্কে জুলেখা সিরাপ মেটাভার্স গ্রুপে সামিনা আহসান একদিন প্রশ্ন তুলেছিলো, কেউ শামসুর রাহমানের লাল ঘোড়ার অর্থটা জানে কি না। অনেকে বলছিলো যে এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। রুবি তখন এগিয়ে এসে জানালো যে লাল ঘোড়ার সওয়ারি পুরান ঢাকার বাস্তবতা এবং শামসুর রাহমানের নিজের পরিবারে এরকম  সওয়ারির সাথে ইলোপ হওয়া আত্মীয়া ছিলো, যাদের ওরা শুধু দেখতো ইদের সময়। আরেকজন তখন জানলো যে এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো।

প্রকাশিত কথা নিয়ে কেউ বলে, বাহ, আবার কেউ বলে এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো। শামসুর রাহমানের সবচেয়ে গতিশীল কবিতাগুলোর একটি এই মাতোয়ালা রাইতে এভাবে আমাদের অগোচরে চলে গেছে। গত বছর, এ বছর আলোচিত বইগুলো দেখলেও আমরা দেখবো, সেই এসব নিয়ে কথা না বলা ভালো ধরনের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সবাই সেসব নিয়ে কথা বলতে চাইছে। বিশেষ করে নারীরা যখন নারীদের অভিজ্ঞতার জায়গাটিকে দাম্পত্য, শিশু পালনের জায়গা থেকে সরিয়ে এনে ব্যক্তিক অভিমত দিচ্ছে, তা নিয়ে দুয়ো দুয়ো হচ্ছে আর কখনো তা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। 

ধরা যাক, আমাদের হাতে এলো সেই লাল ঘোড়ার সওয়ারিদের সাথে ইলোপ হওয়া রমণীদের ডায়রি। তাদের কেউ বেচে আছেন জীবনের শেষ বেলাতে এবং নাতি, নাতনিদের সামাজিক লোকচক্ষুর রাঙ্গানোতে জীবৎকালে আর তার ডায়রি প্রকাশিত হলো না। কিম্বা নাতি, নাতনিরা রসস্থ হয়ে নানি, দাদিকে জীবৎকালে সেই ডায়রি প্রকাশে রাজি করিয়ে ফেল্লো! অমিতাভ বচ্চন অভিনীত গুলাবো সিতাবোতে দেখা যাবে লাখনৌ শহরে অমিতাভ অভিনীত হাড় কিপটা ঘরজামাই, বুড়ো মির্জার চেয়ে ১৭ বছরের বড় বুড়ি ফাতিমা বেগম তার তরুণ কালের প্রেমিককে খুঁজে বের করে মির্জাকে ফেলে ইলোপ করেছে। রুপালি পর্দায় যা ঘটে তার অনেকটাই ঘটে গেছে আমাদের ঢাকা শহরে পর্দার আড়ালে। আমাদের রক্ষণশীলতার মুখে সেসব ইতিহাস আউট অফ প্রিন্ট! 

লাল ঘোড়ার সওয়ারিরাও নাই, আমাদের তরুণ সাহিত্যের নবায়নও নাই। 'জুলেখা সিরাপ মেটাভার্সে' যাদের বইপত্র শেয়ার করলাম তাদের গড় বয়স পঞ্চাশের ওপর। 'তুলট', 'তরঙ্গ' ওয়েবজাইনে যাদের লেখা পড়ি তাদের গড় বয়স চল্লিশ। তাজা রক্তের অভাবে বাংলা সাহিত্য কি ফসিলে পরিণত হচ্ছে? একুশে মেলা কি ফসিলের মেলাতে পর্যবসিত হচ্ছে? ক্লিশে হলেও বলতে ইচ্ছে করছে, ''পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা। আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।'' 


চয়ন খায়রুল হাবিব 

২০/০২/২৪

ব্রিটানি, ফ্রান্স


Cover photo from 'Choyon Khairul Habib at Beauty Boarding' by Nasir Ali Mamun.