Monday 24 July 2023

ওপেনহাইমার সিনেমা : প্রমিথিউস থেকে গীতা কথনে :

আমি স্বয়ং মৃত্যু এবং প্রলয়ের  অবতার। 

শ্রীকৃষ্ণ-রূপি ভিষ্ণু, ভগবত গীতা 

মেঘলা এনভেলাপ 

ফ্রান্সে থাকবার সবচেয়ে ভালো দিকগুলোর একটি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোর সদ্য সদ্য দেখতে পাবার সুযোগ। সিনেমাগুলো যাতে স্ব স্ব ভাষায় দেখা যায় তার জন্য বিশেষ দিন নির্ধারিত থাকে। আমাদের ছোট্ট শহরের মাঝখানে এরকম একটি সিনেমা হল আছে। আবার শহরের প্রান্তে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের মালিকানাধীন একটি বিশাল সিনেপ্লেক্স আছে, যাতে এ সপ্তাহে এক সাথে মুক্তি পেলো 'ওপেনহাইমার', 'বারবি' এবং 'ইন্ডিয়ানা জোন্সের' সাম্প্রতিক ছবি।

সাধারণত মূল ভাষায়, বিশেষ করে ইংলিশে দেখাবার দিন সিনেমা হলে হাতে গোনা, খুব কম লোক থাকে। এবার 'ওপেনহাইমার' ইংলিশে দেখাবার জন্য নির্ধারিত দিন ছিলো রোববার, সময় দুপুর। গেলো রোববার অর্থাৎ ২৩শে জুন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিলো মুষলধারে। রোববারে ছোট শহরগুলোতে  প্রান্তে যাবার বাসের সংখ্যাও কম। ছেলে মাতিস গরমের ছুটি কাটাচ্ছে আমাদের সাথে। মাতিসের মা প্যাটি আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে যে 'ওপেনহাইমার' সিনেমাটি আমরা ইংলিশে দেখবো। ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, কাপড় ভিজিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে দেখি সিনেমাটি ইংলিশে দেখবার জন্য বিপুল লাইন, বিভিন্ন বয়সের দর্শকে বিশাল হলঘর কানায় কানায় ভর্তি।

বুঝলাম যে 'বারবি', 'ইন্ডিয়ানা জোন্সের' পর্দা কাঁপানো চমকপ্রদ কাহিনীর পাশে ফরাসিদের জন্য  ওপেনহাইমারের জীবনী বংশ পরম্পরায় জানা ও বোঝা সবসময়ের মত জরুরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মত ফ্যাসিবাদ মুক্ত জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানের বুদ্ধিজীবীরাও যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ, ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ নিয়মিত করে যাচ্ছে, যার ধারাবাহিকতায় নির্মিত ক্রিস্টোফার নোলানের 'ওপেনহাইমার'।

বিভীষিকার পরিসংখ্যান 

উপনিবেশিক কারণে সব মহাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্ববাসী সবখানে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে এ -যুদ্ধের শিকার হয়। 

১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তৎকালীন বিশ্বে সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্র এ-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়; মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। এ-মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ খুব দ্রুত একটি সামগ্রিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সামরিক ও বেসামরিক সম্পদের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য না করে তাদের পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োগ করে। এছাড়া বেসামরিক জনগণের উপর চালানো নির্বিচার গণহত্যা, হলোকস্ট (হিটলার কর্তৃক ইহুদীদের উপর চালানো গণহত্যা), পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় এ যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। 

জার্মান আগ্রাসন প্রতিহত করতে সোভিয়েত ইউনিয়নে এক কোটির বেশি সামরিক, বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ দূর বাংলাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি তিরিশ লাখের বেশি লোক দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়। হিটলারের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী জার্মানির তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে ছিলো শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদের ওপর, যার প্রায়োগিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় জার্মানি এবং অধিকৃত ইয়োরোপে সংগঠিত-ভাবে ইহুদি নিধন, যা ইতিহাসে 'হলোকস্ট' নামে অভিহিত। হলোকস্টে বিভিন্ন শ্রম-শিবিরে জেনোসাইডে, গুলি করে, গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল, যা ছিলো ইয়োরোপের মোট ইহুদি জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ।

ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমাটি পরিসংখ্যানের ভারমুক্ত হলেও, ওপেনহাইমারের অর্জন, বিসর্জন যে এক বিভিষিকাময় মহাযুদ্ধের শোকাবহতায় জর্জরিত তা বোঝা যায় প্রতিটি দৃশ্যে, অনবদ্য অভিনয় এবং লক্ষ্যভেদী সংলাপে।

এমেরিকান প্রমিথিউস 

ওপেনহাইমার সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে, ২০০৫ সালে প্রকাশিত ''এমেরিকান প্রমিথিউস : দ্য ট্রায়াম্প এন্ড ট্র্যাজেডি অফ জে, রবার্ট, ওপেনহেইমার/ American Prometheus: The Triumph and Tragedy of J. Robert Oppenheimer'' বই অবলম্বনে। বইটির যৌথ লেখক যথাক্রমে ইতিহাসবিদ মার্টিন জে, শারউইন এবং কলামিস্ট, সাংবাদিক কে, বার্ড। ৭২১ পৃষ্ঠার বইটির গবেষণা থেকে প্রকাশনা পর্যায়ে আসতে লেখা, সম্পাদনা, পরিমার্জনায় শারউইন ও বার্ডের লেগেছে ২৫ বছর। সে বছরের সেরা জীবনী গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশনাটি পুলিটজার পুরস্কার পেয়েছিল।

পারমাণবিক বোমার জনক বলে অভিহিত ওপেনহাইমারের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে গোড়ামিমুক্ত এক সংস্কৃতিবান ইহুদি পরিবারে। আঠারো শতকে ওপেনহাইমারের বাবা জুলিয়াস যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলো কিশোর অভিবাসী হিসেবে। তার পর কঠোর পরিশ্রম করে জুলিয়াস হয়ে ওঠে সফল কাপড় ব্যবসায়ী। মা এলা'ও জার্মানি থেকে অভিবাসী হিসেবে এসেছিলো। পরিবারটির ম্যানহাটান এপার্টমেন্টে তেলচিত্র সংগ্রহের ভেতর পিকাসো, ভ্যান গগের মৌলিক কাজও পাওয়া যাবে। ওপেনহাইমার এবং ছোট ভাই ফ্র্যাঙ্ক দুজনেই পদার্থবিদ। ওপেনহাইমার হয়ে ওঠে আইনস্টাইনের সমকক্ষ এবং নিউ মেক্সিকোর লস আলামস মরুভূমিতে গোপন পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ গবেষণাগারে তাকে পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। 

বাচ্চাদের স্কুল , বিজ্ঞানীদের পারিবারিক আবাসস্থল, সৈনিকদের ব্যারাকসহ লস আলামসে তৈরি করা হয় এক স্বনির্ভর আবাসিক শহর। লস আলামসে আসবার আগে ও পরে ওপেনহাইমারের ছাত্র জীবন, প্রেম, রাজনৈতিক চিন্তার পাশাপাশি সহ-বিজ্ঞানী, সেনাকর্তা, আমলাদের সাথে তার মত বিনিময়, কাজের প্রক্রিয়া ঘিরে গড়ে উঠেছে নোলানের তিন ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের ওপেনহাইমার আখ্যান, যার পরিণতিতে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলা হয়। এর পর অক্ষশক্তির এশিয়ান সহযোগী জাপান আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধ্বের পর আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন উপনিবেশ তাদের ইয়োরোপীয় প্রভু দেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পায়। 

আইনস্টাইন, ওপেনহাইমার, ১৯৪৭ 

আইনাস্টাইনের ছায়া 

নোলানের সিনেমায় আইনস্টাইন মুখ্য চরিত্র না হলেও, অল্প সময়ের কিছু দৃশ্যে তার সাথে অনুজ ওপেনহাইমারের কথোপকথনকে অন্য দৃশ্যের যোগসূত্র হিসেবে টেনে নেয়া হয়েছে। একই ভাবে জাপানের ওপর আণবিক অস্ত্র প্রয়োগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারি প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকেও দেখানো হয়েছে অত্যন্ত ছোট একটি দৃশ্যে, যেখানে ট্রুম্যান জাপানে বোমা নিক্ষেপের পরের ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে ওপেনহাইমারের অনুশোচনায় সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করছে।

লস আলামসে পারমাণবিক বোমার গবেষণায় আইনস্টাইনের কোনো ভূমিকা নেই। আইনস্টাইনের তখন জীবনের শেষ বেলা। ওপেনহাইমার আইনস্টাইনের লেখালেখি, গবেষণা ৩২ বছর ধরে জানলেও, তাদের ব্যক্তিগত সখ্যতা গড়ে ওঠে আইনস্টাইনের শেষ ১২ বছর। ওপেনহাইমার তার লেখাতে আইনস্টাইনকে বর্তমান সভ্যতার সেরা পদার্থবিদ ও দার্শনিকের স্বীকৃতি দিয়েছিল। আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক দিকে আগ্রহী, অন্যদিকে ওপেনহাইমার এবং তার সহকর্মি পদার্থবিদেরা তত্বের সাথে প্রায়োগিক দিকেও সক্রিয়ভাবে উৎসাহী ছিলো। ৫০ দশকে প্রকাশিত বিভিন্ন ফটোতে আইনস্টাইনের সাথে ওপেনহাইমারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বোঝা যায়, যে বন্ধুত্বের ডাইনামিজম শক্তিশালী-ভাবে উঠে এসেছে বই এবং সিনেমাতে। ১৯৬৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বার, অর্থাৎ আমার জন্মের পরের দিন ওপেনহাইমার প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দফতরে এক ভাষণে আইনস্টাইনের সাথে তার সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছিল।  

মহাযুদ্ধ্বের পরে যে 'ট্রুম্যান ডকট্রিনকে' ভিত্তি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়, তার যূপকাষ্ঠে ওপেনহাইমারও বলি হয়। কমিউনিস্ট সমব্যথী এবং সোভিয়েত গোয়েন্দা সন্দেহে তাকে আমলাতান্ত্রিক জেরায় পর্যদুস্ত করে ফেলা হয়, কয়েক দিন ব্যাপী যে জেরাকেও সিনেমাটিতে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক অর্থে 'ওপেনহাইমার' সিনেমার মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি, বিশ্বের আঞ্চলিক প্রভাব বলয় বদলে যাওয়া, শীতল যুদ্ধের পটভূমিতে ব্যাক্তি-জীবনের এক ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। যে ব্যাক্তির উদ্ভাবিত অস্ত্র  এ-যাবত ব্যাবহার করা হয়েছে দু'বার এবং যার পরিণতিতে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আড়াই লাখ লোক নিহত হয়েছে।

জিন ট্যাটলক, ওপেনহাইমারের প্রেমিকা
প্রেমিকার টানাপোড়েন এবং সেক্স দৃশ্যে গীতা পাঠ 

ওপেনহাইমার সংস্কৃতসহ বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলো। সিনেমার একটি দৃশ্যে তরুণ অধ্যাপক ওপেনহাইমার-রুপি অভিনেতা কিলিয়ান মারফির সাথে কমিউনিস্ট প্রেমিকা জিন ট্যাটলক-রুপি ফ্লোরেন্স পিউ সঙ্গম শেষে বইয়ের তাক থেকে একটা বই নিয়ে আসে। বইটি 'ভগবত গীতা' এবং একটা পৃষ্ঠা উলটে জিন, ওপেনহাইমারকে পড়তে বলে। ওপেনহাইমার ইংরেজিতে এবং সংস্কৃতে পাঠ করে, 'আমি স্বয়ং মৃত্যু এবং প্রলয়ের অবতার।' 'ভগবত গীতা' থেকে পাঠ এবং সঙ্গম একসাথে দেখানো হয়।

ওপরে উল্লেখিত 'ভগবত গীতার' উক্তিটি সর্বজনীন, সর্বকালীন। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন যখন তার আত্মীয়দের শ্ত্রু গণ্য করে নিধন করতে দ্বিধাগ্রস্ত, যুদ্ধরথের সারথি কৃষ্ণ তখন তার বহু অবতারের সর্বোচ্চ স্বরূপ ভিষ্ণুরুপ ধারণ করে এবং বলে যে জন্মৃ, মৃত্যু সব তার হাতে,আত্মা অবিনশ্বর, সবই মায়া। এর পর অর্জুন তার শত্রুদের প্রবল বিক্রমে নিধন করে। 

কৃষ্ণের পরামর্শ কিন্তু গান্ধী শোনে নি, এখানে  সুভাষ বসুর সাথে তার বিরোধ বাধে এবং গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংসার পথে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু এবং সফল হয়। কৃষ্ণের পরামর্শের মূলে ছিলো, লক্ষ্যের সিদ্ধি অর্জনে যে কোনো উপায় ঠিক আছে। গান্ধী দর্শনের মূলে ছিলো, উপায় লক্ষ্যের মতই এবং লক্ষ্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাসিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার সাথে গান্ধী কোনো সমঝোতা করতে চায় নি। রক্তপাতের পথ ধরে আসা বলশেভিক বিপ্লব এবং এক দলিয় কমিউনিস্ট শাসন এক শতক না ঘুরতেই রাশিয়া সহ অন্যান্য সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল।   

প্রশ্ন জাগতে পারে, ওপেনহাইমারের সংস্কৃত ব্যুৎপত্তি অন্যভাবে দেখানো যেতো কি না? আমরা অনেক সময় কি হতে পারতো, কি হয় নাই তার ব্যাস্ততায় কি হয়েছে তার দৃষ্টিকোণ ঘুলিয়ে ফেলি। 

'হিন্দুস্তান টাইমসে' প্রকাশিত জিন ট্যাটলকরুপি ফ্লোরেন্স পিউ।
ধারণকৃত অরিজিনাল দৃশ্যে ফ্লোরেন্স পিউ, কিলিয়ান মার্ফি সম্পুর্ন নগ্ন। 
 দর্শকদের কাছে গ্রহনযোগ্য করতে  ভারতীয় সেন্সর বোর্ড 
ফ্লোরেন্স পিউর নগ্ন দেহে কালো পোষাক লেপে দিয়েছে।
এতে কোনো কোনো ভারতীয় টুইটে বলেছে, 
এ জন্য সেন্সর বোর্ডকে বিশেষ প্রযুক্তি পুরস্কার দেয়া উচিৎ।

সিনেমাটি সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ দর্শক দেখেছে,  সিনেমাটির সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষতা নিয়ে ভারতীয় সমালোচকেরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কিন্তু বাদ সেধেছে বিজেপির কেন্দ্রীয় তথ্য  কমিশনার অনুরাগ ঠাকুর। সেন্সর বোর্ডের দিকে অঙ্গুলি উঁচিয়ে অনুরাগ ঠাকুর বলছে, পবিত্র গ্রন্থের উক্তি কিভাবে একটা সঙ্গম দৃশ্যে দেখানো হলো এবং তা সেন্সর বোর্ড পাশ করে দিলো?

একজন বিজ্ঞানীর জীবন দেখাতে কেনো  সেক্স দৃশ্য দেখাতে হবে, সে প্রশ্নের উত্তরে নোলান বলেছে,

''আমার মনে হয়েছে, জিন ট্যাটলকের সাথে ওপেনহাইমারের সম্পর্ক বোঝানোটা এই আখ্যানে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তা একেবারে ভেতর থেকে অন্তরঙ্গভাবে দেখাতে হবে, কোনোভাবে না এড়িয়ে বুঝতে হবে কিভাবে তারা দুজন এতো গভীরভাবে কাছাকাছি এসেছিলো। এটার জন্য ওপেনহাইমার, জিনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোতে তাদের সাথে থাকা দরকার বলে ভেবেছি, কারণ ওপেনহাইমারের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, এই সম্পর্ক তার ভবিষ্যৎ এবং নিয়তিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল।'' "It felt very important to understand their relationship and to really see inside it and understand what made it tick without being coy or allusive about it, but to try to be intimate, to try and be in there with him and fully understand the relationship that was so important to him." Nolan said that the relationship between the two "had enormous ramifications for his later life and his ultimate fate."
জিন ট্যাটলকরূপি ফ্লোরেন্স পিউ

জিন ট্যাটলক : ছোট্ট একটি তীব্র যাপন

'এমেরিকান প্রমিথিউস' গ্রন্থে,  ওপেনহাইমারের লিখিত ভাষ্যে আমরা পাচ্ছি,  

''১৯৩৬ সালের বসন্তে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির একজন প্রখ্যাত অধ্যাপকের মেয়ে জিন ট্যাটলকের সাথে আমার পরিচয় হয়;  শরৎকালে, তার সাথে ডেটিং  শুরু করি এবং আমরা একে অপরের কাছাকাছি হলাম। নিজেদেরকে এনগেজড মনে করার জন্য, দুবার বিয়ের প্রস্তাব করেছিলাম। ১৯৩৯ এবং ১৯৪৪ সালে তার মৃত্যুর মধ্যে আমি তাকে খুব কমই দেখেছি। জিন আমাকে তার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ সম্পর্কে বলেছিল, কখনো সে পার্টিতে সক্রিয়, কখনো নিষ্ক্রিয় ছিলো এবং সে যা চাইছিল পার্টি তা দিতে পেরেছিলো বলে মনে হয় না। আমি বিশ্বাস করি না যে তার স্বার্থ সত্যিই রাজনৈতিক ছিল। জিন এই দেশ, মানুষ এবং এর জীবনকে ভালোবাসতো। আমার এ ধারণা দেওয়া উচিত নয় যে সম্পূর্ণরূপে জিন ট্যাটলকের কারণে আমি বামপন্থী বন্ধু তৈরি করেছি, বা এমন অঙ্গীকারগুলোর জন্য সহানুভূতি অনুভব করেছি। আমি এখনও স্পেনের রিপাবলিকান আদর্শ  এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগঠনের প্রতি অনুগত। আমি নতুন সাহচর্য,  নতুন অনুভূতি পছন্দ করি এবং সেই সময়ে অনুভব করেছি যে আমি আমার সময় এবং দেশের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছি।''

সিনেমাতে জিন ট্যাটলকের সাথে ওপেনহাইমারের দেখা হওয়া, প্রবল প্রেম দেখানো হয়েছে। জিনের আত্মহত্যার সংবাদে ওপেনহাইমারের ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্যে তার ওপর জিনের প্রভাব বোঝা যায়। তার স্ত্রী কিটি খামার বাড়িতে খোলা আকাশের নিচে মুষড়ে পড়া ওপেনহাইমারকে খুঁজে পায় এবং তার মুখে জিনের আত্মহত্যার খবর জানতে পায়।

জিন ট্যাটলকের সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র জীবন, কমিউনিস্ট বিশ্বাস, সমকামিতার বিড়ম্বনা এবং ক্লিনিকাল ডিপ্রেশান নিয়ে আলাদা একটি ছবি হতে পারে। আত্মহত্যার সময় জিনের বয়স ২৯। সে সময় জিন একজন পেশাদার মনস্তত্ববিদ। জিনের সাথে ওপেনহাইমারের দেখা হয় বার্কলিতে তার বাড়িওয়ালীর পার্টিতে। তখন ওপেনহাইমার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, আর জিন স্ট্যানফোর্ডে চিকিৎসা বিদ্যার স্নাতক পর্বের ছাত্রী। ওপেনহাইমারের বাড়িওয়ালী ও জিন দুজনেই মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা, সে সুবাদে জিনের সে বাড়িতে আসা। দেখা হবার পর ওপেনহাইমার দুবার জিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, দুবারই জিন প্রত্যাখ্যান করে। 

ওপেনহাইমার তার পর জিন থেকে সরে কিটির সাথে ঘনিষ্ঠ হয় এবং কিটিকে বিয়ে করে। জিন বিবাহিত ওপেনহাইমারের সাথে কয়েক বার দেখা করে এবং তারা অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। ওপেনহাইমার জানিয়ে দেয় যে সে আর দেখা করতে চাচ্ছে না। কয়েকটি দৃশ্যে জিনের সাথে ওপেনহাইমারের এই  টানাপড়েন দেখানো হয়েছে কবিতার বুনটে, প্যাশনেট সংলাপে, যৌনায়িত দৃশ্যে। 

সিনেমার বাইরে আমরা জানতে পাই, জিনের বাবা হলো সে সময়ের খ্যাতিমান ফিলোলজি শিক্ষক, চসার বিশেষজ্ঞ, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন পেরি ট্যাটলক। মা মার্জারি ছিলো গৃহবধূ।জিনের নিজস্ব ভাষ্য থেকে বোঝা যায় যে নিজের সমকামী প্রবণতা নিয়ে সে বিড়ম্বনায় ভুগছিলো। সে সময়ের মার্কিন সমাজে সমকামিতাকে মানসিক রোগ হিসেবে দেখা হতো এবং এধরনের বিশ্বাস মনস্তাত্ত্বিকদেরও সাংস্কৃতিক-ভাবে সংক্রমিত করেছিল। বোঝা যায় যে পেশাদারি জগতে এবং বৃহত্তর সমাজে নিজের যৌন প্রবনতার কোনো সমর্থন না পাওয়াতেও জিনের ডিপ্রেশান বাড়তে থাকে। জিনের বাড়িতে বেড়াতে এসে, কোনো সাড়া না পেয়ে তার বাবা দরজা ভেঙ্গে বাসায় ঢোকে এবং বাথরুমে টাবে মেয়েকে ডুবন্ত অবস্থায় পায়। হাসপাতালে নেবার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ময়না তদন্তে তার শরীরে ক্লোরাল হাইড্রেট পাওয়া যায় এবং মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে রায় দেয়া হয়।

জিনের ছোট ভাই হিউ'ও একজন চিকিৎসক ছিলো। ছোট ভাইসহ আরো অনেকের সন্দেহ যে জিনের মৃত্যুতে মার্কিন গোয়েন্দা দফতরের হাত আছে। ১৯৭৫ সালে মার্কিন সিনেট গোয়েন্দা দফতরেগুলোর বাড়াবাড়ি এবং তাদের গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহতদের ব্যাপারে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে এ সন্দেহ আরো বাড়ে। ওপেনহাইমারের জীবনীগ্রন্থ  'এমেরিকান প্রমিথিউসের' ২৫৩ পৃষ্ঠায় এই ঘটনা, লস আলামসের সাথে জড়িত গুপ্তচরদের প্রতি সন্দেহর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

আগে লিখেছি, জিন ট্যাটলককে নিয়ে আলাদা একটি ছবি হতে পারে। 'ওপেনহাইমার' সিনেমাতে নিসন্দেহে নোলান এ-চরিত্রটির প্রটি দর্শকের আগ্রহ উস্কে দিয়েছে, ভারত বা অন্য কোথাও কোনো সরলীকৃত প্রতিক্রিয়াতে যার প্রতি অবিচার করা হয়। 

                                           ওপেনহাইমার, ভগবত গীতা উদ্ধৃততি

সাদা-কালো রংধনু

পৃথিবীর সবচেয়ে নারকিয় সামগ্রিক, সম্মিলিত হত্যাযজ্ঞগুলোর একটি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই মারণযজ্ঞের থিয়েটারে ওপেনহাইমার এক পক্ষের হাতে সবচেয়ে মারাত্মক সমরাস্ত্রটি তুলে দিচ্ছে। আবার ফ্যাসিবাদি জার্মানিও পদার্থবিদ্যার সামরিক গবেষণায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। নোলানের সিনেমায় যদি নারী, পুরুষের মিলন দৃশ্যে কুরুক্ষেত্রের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমান্তরাল তুলনা দৃশ্যায়িত করা হয় তাতে আমি কোনো অপরাধ দেখি না। 

সঙ্গম বা মিলন দৃশ্যকে এখানে চিরায়ত সৃষ্টির পক্ষ্যের দৃশ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভিষ্ণু একই সাথে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের পরমেশ্বর। ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জনতার ধর্মিও অনুভূতিতে আঘাতের নামে যেসব সাম্প্রদায়িক, হিংসাত্মক রক্তপাত ঘটানো হচ্ছে, সেখান থেকে নান্দনিকতাকে যেভাবে কাটাছেড়া করবার উস্কানি দেয়া হচ্ছে তাতে আমাদের আশঙ্কিত হবার আছে। সাম্প্রদায়িক মারণাস্ত্র আণবিক মারণাস্ত্রের চেয়ে কম বিপদজনক নয়।

আমাদের দেখতে হবে যে নোলান তার সিনেমাটি যে বই অবলম্বনে নির্মান করেছে, তার শিরোনাম 'এমেরিকান প্রমিথিউস'। দেবতা প্রমিথিউস দেবালয় থেকে আগুন চুরি করে এনে মানুষকে তার ব্যাবহার শিখিয়ে দিয়েছিলো জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সভ্যতা হিসেবে । এতে ক্ষেপে গিয়ে দেবরাজ জিউস প্রমিথিউসকে পাহাড় চুড়ায় শেকলবন্দী করে রাখে, তার সাথে শাস্তি হিসেবে যোগ হয় যে একটি ইগল প্রমিথিউসের যকৃত খেয়ে ফেলবে, আবার প্রতিদিন প্রমিথিউসের দেহে  নুতন একটা যকৃত তৈরি হবে, আবার ইগল এসে প্রমিথিউসের যকৃত খেয়ে নেবে। অবশেষে বীর হেরাক্লেস প্রমিথিউসকে এই অনিশেষিত নারকীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে।

পারমাণবিক শক্তি শান্তিকালীন জ্বালানি হিসেবে ব্যাবহার করা যায়, মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করা যায়। রোগ সনাক্তকরণেও পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হচ্ছে। মানুষের তৈরি মহাপরাক্রমশালী এ-শক্তি ব্যাবহার করে মানুষ আত্মঘাতী হবে না কি নিজেকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নেবে, তার সময় টিক টিক করছে দ্বিতীয় ব্বিশ্বযুদ্ধত্তোর প্রত্যেকটি প্রজন্মের ধমনিতে! আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কুরুক্ষেত্র থেকে আজকের দুনিয়াতে আর্জিত লৌকিক, পারলৌকিক জ্ঞান ও গীতার সঙ্গীতরথে চড়ে আমরা কোন পথে যাবো।

মহাভারত, ইলিয়াড এবং অন্যান্য পুরাণ-কথনের পথ ধরে 'ওপেনহাইমার' বই এবং সিনেমা উভয়ই আমাদের জানায় যে ধ্বংসের মহাকাব্য মানুষ বিভিন্ন অজুহাতে বার বার মঞ্চায়িত করছে। তার বিপরিতে  সৃষ্টির মহাকাব্যের সম্ভার আমাদের আরো আরো বাড়াতে হবে!

সিনেমা হল থেকে মাতিস, প্যাটি, আমি বেরিয়ে আসি। বিকেলের আকাশ তখনো মেঘলা, বৃষ্টি ঝরছে অঝর ধারায়! ছয় ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা পুত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি, বেড়ে উঠছে সেই মহাদেশে, যেখানে এই কয়েক প্রজন্ম আগে একদল রক্তপিপাসু,বর্বর সভ্যতার দাবি করে নিরীহ মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো বিভিন্ন তত্বের ওপর ভর করে। হৃদয়ে ধারণ করা সেই দেশের কথা ভাবি যেখানে এখনো বাঙালিদের জেনোসাইডকে একদল লোক সঠিক রাজনীতি ভাবে। আকাশের মাটির কাছে নেমে আসা দেখি, ভিজতে ভিজতে বাস স্টপেজের দিকে আগাই!      


চয়ন খায়রুল হাবিব 

২৫/০৭/২৩

ব্রিটানি, ফ্রান্স