Wednesday 11 November 2015

ইয়োরোপ, মৃত্যুদন্ড এবং কল্যানবোধক বিচ্চার

বিওর্ক অভিনিত 'ড্যান্সার ইন দা ডার্ক'এর ট্রেইলার

লো হোসনে আরা লো...

আমি বাংলাদেশ ত্যাগের আগ দিয়ে, ১৯৮৯সালে ঢাকাতে শহিদ বুদ্ধিজিবি সাংবাদিক নিজামুদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন রিমার হত্যাকান্ডে দোষি সাব্যাস্ত করে তার স্বামি মুনির হোসেন এবং মুনিরের প্রেমিকা হোসনে আরা খুকুকে নিম্ন আদালত মৃত্যুদন্ড দেয়।পরে উচ্চতর আদালতে আপিল করলে মুনিরের মৃত্যদন্ড বহাল থাকে, খুকু বেকসুর খালাস পান।সম্ভবত সামরিক সরকারের আংগুলি হেলনে ঐ হত্যা মামলা ঘিরে গনমাধ্যমগুলোতে বিবাহিতা খকুর চরিত্র হনন থেকে শুরু করে, আইনকে প্রভাবিত করবার এক কলঙ্কজনক ইয়েলো জার্নালিজমের প্রলয়কান্ড ঘটেছিল!বেশ কবছর আগে বিলাতে বসবাসকালে খুকুর সাজাপ্রাপ্তি এবং বেকসুর খালাস নিয়ে একটি উপকথা লিখি, 'লো হোসনে আরা লো, মুনির হোসেন হাতিয়ার ঢাল দো' নামে!সম্প্রতি উপকথাটি প্রকাশ করে নিউজবাংলাদেশ.কম।উপকথাটির পেছনে প্রবর্তনা হিশেবে কাজ করেছে 'মৃত্যুদন্ডরহিত' অঞ্চল EECতে বসবাস।সে আলোকেই বর্তমান নিবন্ধের অবতারনা!

নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ইংল্যান্ড ও গনতান্ত্রিক ফ্রান্স, দুখানে অনেক কাল থাকার সুবাদে, ভিন্ন দুই প্রশাষনে এই মৃত্যুদন্ড বা বিচারিক-হত্যাকান্ড বা ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বিরুদ্ধ্বে প্রায়োগিক বিতর্কগুলা হাতেকলমে, সরেজমিনে জানার সুজোগ হয়েছে।'মানবতা' এই আর্গুমেন্টের একটা অংশ, কিন্তু একমাত্র বা প্রধান আর্গুমেন্ট না। নাগরিকের প্রান সংহারে রাস্ট্রকে নিবৃত করবার মাধ্যমে, রাস্ট্রযন্ত্রের ক্ষ্মমতার উপর ব্যাক্তির অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। 'অমানবিক' সন্ত্রাসির ব্যাক্তিক অধিকারও সংরক্ষিত থাকছে, তার 'অমানবতা' নয়।

কেভিন স্পেসে, লরা লিনে অভিনিত 'লাইফ অফ ডেভিড গেইলের' ট্রেইলার

প্রটোকল ৬ এবং ১৩

মৃত্যুদন্ড রদে ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রধান দুটো অধ্যাদেশ হচ্ছে 'প্রটোকল ৬' এবং 'প্রটোকল ১৩'।এ দুটো অধ্যাদেশকে সামাজিক পটভুমিতে দেখলে বলা যায়ঃ
জন্মক্ষন থেকে ব্যাক্তির স্ফুরনকে রাস্ট্র বিনিয়োগ হিশেবে দেখেছে এবং দ্বিতিয়ত শিশুদের মনে গেথে দিচ্ছে যে রাস্ট্র তার প্রান-স্ফুরন, বিকাশের সহায়ক, কিন্তু প্রান হরনের মালিক নয়।সম্প্রতি ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে মৌলবাদি মুসলিমদের ব্যাপক প্রানঘাতি সন্ত্রাসে, ২০১১তে নরওয়ের দক্ষিনপন্থি এন্ডার্স ব্রেইভিকের হাতে অর্ধশতের বেশি শিশু হত্যার পরও কিন্তু মৃত্যুদন্ডের দাবি ইয়োরোপিয় কাউন্সিলে বেগবান হয় নাই।ইউরোপের বিভিন্ন মোড়বদলে রাজতন্ত্র, পুজিবাদি, ফ্যাসিবা্দি, মার্ক্সবাদি সব ধরনের রাস্ট্রকাঠামোতে ব্যাক্তি দুর্বলতমো সত্বায় পরিনত হয়েছিলো; আবার দুর্বলতমো সত্বার ভেতর তুলনামুলক দরিদ্ররা, নারিরা, কালো আফ্রিকানরা, রোমানি জিপ্সিরা, সমকামিরা যখন রাস্ট্রের মুখোমুখি হয়েছে তখন লঘুপাপে গুরুদন্ড পেয়েছে।

বিশ্বের অপরাপর রাজন্যদের মত ইয়োরোপের রাজারাও ছেলে সন্তান না হলে বেশুমার রানিকে নুন্যতমো অজুহাতে হত্যা করেছে।যেহেতু ক্যাথলিসিজম তালাক প্রথাকে সমর্থন করতো না, ইংল্যান্ডের অস্টম হেনরি তার নিস্পত্তি করেছিলো একের পর এক স্ত্রি হত্যা করে এবং পরিশেষে ক্যাথলিসিজম থেকে সরে এসে।প্রাচ্য, প্রতিচ্যে ইতিহাসের প্রদোষকাল থেকে সাধারন ও অভিজাত উভয় মহলে নারি গন্য হয়েছে লেনদেনের পন্য হিশেবে, দ্বিতিয় শ্রেনির সত্বা হিসেবে; চুড়ান্ত রাজতন্ত্রে নারিসহ যে কোন স্তরের প্রজার জান ও মালের আক্ষরিক মালিক বলতে রাজা বা রানি।রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে মার্ক্সবাদি ধারাতে যে 'প্রলেতারিও ডিক্টেটরশিপ'এর অনুশিলন বিভিন্ন দেশে সেখানেও প্রায়োগিক দন্ড, বিশেষ করে প্রানবধের প্রয়োগ হয়েছে প্রলেতারিয় শ্রেনির বিরুদ্ধ্বে বেশি।

ঘুরেফিরে EEC-অঞ্চলের শ্রমজিবিদের যাপনের মান, ব্যাক্তিক নিরাপত্তা অপরাপর উন্নত অঞ্চলগুলোর সমান বা বেশি।সিরিয়া সঙ্কটে সিরিয়ান শরনার্থিদের জানবাজি রেখে EECমুখি হওয়া তার প্রমান।বিভিন্নরকম অধিকারমুলক শিক্ষা বা এম্পাওয়ারমেন্টে শ্রমজিবিরা বুঝেছে যে রাস্ট্রযন্ত্রের সাথে তার ক্রমচলমান বিতর্কের জায়গাটাকে দুর্বল করে দিলে, ব্যাক্তি হিশেবে সে পুলিশের কাছে, সেনাবাহিনির কাছে, বিচারবিভাগের কাছে, আমলাতন্ত্রের কাছে জবাবদিহিতা পাবার অধিকারকে দুর্বল করে ফেলে।সত্বা বা এন্টিটি হিশাবে নিজের প্রানের মালিকানায় রাস্ট্রের হস্তক্ষেপের সুজোগ বন্ধ করে দিলে তার বিকাশের সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে।এই আর্গুমেন্টগুলা EECতে এখন আর ইউটোপিয়া নয়।

সোভিয়েত আমলের রাশিয়াতে ব্যাক্তির প্রানের ওপর কম্যুনিস্ট পার্টির অধিকারকে প্রশ্নাতিত পর্জায়ে নিয়ে আশা হয়; যার ফলে অনেক বিচার প্রহসনমুলক হলেও কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব তাতে সম্মতি দিলে সে দন্ড রাস্ট্রের চোখে বৈধ বলে পরিগনিত হয়।সোভিয়েত পরবর্তি রাশিয়াতে মৃত্যুদন্ড না দেয়ার ব্যাপারে মোরাটোরিয়াম বা অনির্দিষ্ট স্থগিতাদেশ আরোপ করা হয়েছে এবং পরোক্ষে মৃত্যুদন্ড রদের প্রক্রিয়াকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে যাবার পর, ওয়ারশ চুক্তির অনেক দেশ EECতে যোগ দেয়; তাদের সাথেও EECর পুরানা দেশগুলার 'মৃত্যুদন্ড/মানবতাবাদ/ব্যাক্তিসত্বার রাস্ট্রিয় মালিকানা' বিষয়ে প্রচুর তর্ক হয় সিকি শতাব্দি আগে।নতুন দেশগুলা যোগ দেবার সময় আর্থিক উন্নয়নের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয় ব্যাক্তির অধিকারগত সত্বাকে, যার সর্বোচ্চ গুনবাচকতা হচ্ছে নিজ-প্রানের-উপর-মালিকানা।

'চোখের বদলে চোখ' 

যিশু খ্রিস্টের জন্মের হাজার বছরেরও আগে, প্রাচিন মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলোনিও রাজা হাম্মুরাবি মানহানি, খাদ্যগ্রহন, দাসপ্রথা, শ্রমিকের করনিয়, চুরি, বানিজ্য, সম্পদ, দায়, বিয়ে, তালাক প্রভৃতি বিষয়ে যেসব আইন প্রবর্তন করে, কালের চাকা ধরে সেসব আইন গৃহিত হয় ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম আইন হিশাবে।হাম্মুরাবি-আইনের সার-সঙ্খেপ-বাগধারা দাড়ায় 'চোখের বদলে চোখ'!সে-আইন থেকে সরে গিয়ে EEC আনুষ্ঠানিকভাবে চার্চের পাদ্রিদের আধিপত্যকে খর্ব করে দিয়েছে।বর্তমানে dna,ফরেন্সিক প্রমানসাপেক্ষেতার ফলে আততায়িকে চাইলে সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করা যায়।তারপরও বিশ্বের বেশির ভাগ মৃত্যুদন্ড পরিস্থিতিজাত সাক্ষ্যপ্রসুত এবং তাতে আইনের অপপ্রয়োগের প্রবল সম্ভাবনা থাকে; অনেক সময় উদোকে বাচাতে বুদোকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।তার ওপর আছে বিচারিক প্রক্রিয়াতে ধর্মভেদ, শ্রেনিভেদ, লিংগভেদ, রাজনিতিভেদ, বিশ্বাসভেদ, মতভেদের প্রভাব।

মানুষ মানুষের প্রান নিতে পারে কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারে না।গৌতম তার নির্বান সোপানের একেবারে গোড়াতে বলেছিল, 'জিবহত্যা পাপ'; মার্ক্সবাদ শ্রমজিবিদের সমানাধিকারের কথা বলেছে; পুজিবাদ পুজির বিকাশে ব্যাক্তির উন্নয়নের কথা বলেছে ।কিন্তু শ্রিলঙ্কার বৌদ্ধ সঙ্খ্যাগুরুদের হাতে তামিল হিন্দুদের মারনযজ্ঞ্বে, বর্মাতে বৌদ্ধ সঙ্খ্যগুরুর হাতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকারচ্যুতিতে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত এবং মার্কিন তান্ডবে, সিরিয়াতে সব পক্ষ্যের হাতে নাগরিকের ব্যাপক প্রাননাশে আমরা দেখতে পাচ্ছি সবল, দুর্বল উভয় রাস্ট্রশক্তির হাতে ব্যাক্তি কতটুকু হুমকির মুখোমুখি।আর কয়েকটা রাস্ট্রের মিলিত সঙ্ঘ যদি ব্যাক্তির প্রানের মালিক হয়ে যায় তাহলে অধিকারবোধ বিকশিত হবার আগে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে! 

EEC নামের রাস্ট্রসঙ্ঘটি তার অংশিদারদের মুহুর্মুহু মনে করিয়ে দিচ্ছে ব্যাক্তির প্রানের উপর খবরদারি না করতে।এর ফলাফল হিশেবে রাস্ট্রপক্ষের 
যে-কোন জেরাতে দৈহিক, মানষিক নির্জাতন আইনত দন্ডনিয় এবং তা শুধু খাতাকলমে নয়, হাতেকলমে চর্চিত হচ্ছে!মৃত্যুদন্ড রদ করলেও, দুর্ঘটনা বা
হত্যাকান্ডের বিচারিক তদন্ত এবং দোষির শাস্তিবিধান এ চর্চার মুল প্রনোদনা বা কার্ডিনাল রুল।আর সে প্রনোদনার সাথে মানুষ হিশেবে দোষির পুনর্বাসনও জড়িত।চোখের বদলে চোখ উপড়ে নিতে, নিতে যে একটা সমাজ পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবে সে অন্ধচক্র নির্মুলই মৃত্যুদন্ড রদের মুল প্রবর্তনা।


চয়ন খায়রুল হাবিব
১১/১১/১৫
ব্রিটানি