Monday 4 July 2016

গুলাশান-হত্যাযজ্ঞ্বে 'প্রথম আলোর' রাখাল-বালকি আচরন!



জিম্মি হত্যাযজ্ঞের তথ্য 'প্রথম আলো' যেভাবে পরিবেশন করেছে, তা বিশ্বাস করা যায় কি?মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিনের শাষনামলে পত্রিকাটি যে সেনা-গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্য এক তরফাভাবে পরিবেশন করে আসছিলো তা সম্প্রতি প্রকাশ্যে স্বিকার করেছে এর প্রকাশক!
আমরা দেখতে পাচ্ছি জন্মলগ্ন থেকে পত্রিকাটির কর্মকর্তারা বিভিন্ন ফোরামে কথিত প্রাগ্রসরতার আড়ালে, কখনো বা আড়ালের তোয়াক্কা না করে অবস্থান নিচ্ছে মৌলবাদি ধর্মভিত্তিক রাজনিতির পক্ষ্যে; পত্রিকাটির সহদর প্রকাশনা 'প্রথমা' তাদের বাংলা কবিতার সঞ্চালনে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের পর দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবির স্থান দিচ্ছে হেফাজতে ইসলামের রুপকার ফরহাদ মাজহারকে।এহেনো বিভেদমুলক অবস্থানের কারনে আমরা আর বুঝতে পারিনা, গুলশান-মারনযজ্ঞ্বের পর পত্রিকাটির সম্পাদকিয়, উপসম্পাদকিয় যা বলছে সেটা ঠিক, না কি তাকে খন্ডন করে অপর সুত্রগুলো যা বলছে তা ঠিক!'প্রথম আলো' বলছে, গুলশানে জঙ্গিদের হাতে নিহত 'প্রথম আলো'র মালিক লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন একজন বির; কারন জংগিরা ওনাকে অন্যদের মত কলেমা পড়তে বললে উনি তা পড়েন; তখন জঙ্গিরা তাকে বেরিয়ে যেতে বল্লেও উনি বন্ধু আবিন্তা কবির ও তানুশি জাইনকে ফেলে চলে আসতে রাজি হন নাই এবং বন্ধুদের সাথে পরে তাকেও হত্যা করে পিশাচসম আততায়িরা!অন্যদিকে ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে কয়েকটি সুত্র 'প্রথম আলো'কে খন্ডন করে বলছে যে ফারাজ 'হিরো' নন, বরং জঙ্গিদের একজন; ইশরাত আখন্দ এবং অপর দুজন বন্ধু ওনাকে চিনে ফেলার কারনে তাদেরকে হত্যা করা হয়, আর ফারাজ অন্য আততায়িদের সাথে পরে কমান্ডোদের হাতে নিহত হন!


আবিন্তা কবির ও ফারাজ হোসেন 
কার দাবি ধোপে টিকবে, সেটা বিবেচনার আগে দেখা দরকার কোন প্রেক্ষাপটে আমরা হার্ড-ফ্যাক্ট এবং 
ধারনাজাত-তথ্যের(স্পেকুলেশান)পার্থক্য বুঝতে পারছি না!এটা অজ্ঞতা থেকে হলে আমাদের জন্য ভালো, কারন তা জ্ঞ্বান ও সাংবাদিকতার দক্ষতা বাড়লে আর থাকবে না।কিন্তু জ্ঞ্বানপাপিরা যদি তাদের আনুগত্য দেখানোর স্বার্থে এরকম করে থাকে তাহলে আমাদের জন্য সমুহ বিপদ!

'প্রথম আ্লো' যখন থেকে ফারাজকে প্রাধান্য দিয়ে একের পর এক খবর পরিবেশন করছিলো, তখন নিরাপত্তা বেস্টনি পার হয়ে তাদের হাতে কি করে প্রামান্য-হার্ড-ফ্যাক্ট পৌছালো তা আমার বোধগম্য নয়।প্রামান্যতার অভাবই যে ফারাজের ভুমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তা বলাই বাহুল্য!'প্রথম আলো'র কর্মকর্তারা তখন গুলশানের ঘটনা প্রবাহ থেকে সরে গিয়ে মালিক লতিফুর রহমানের বাসাতে কি ঘটছে, ফারাজের সাথে কবে তাদের অল্প একটু দেখা হয়েছিল, তার মায়ের সাথে তাদের দেখা হবার কথা ইত্যাদি সাত কাহনের বুনটে একটি আন্তর্জাতিক ঘটনাকে গেয়ো-বুলেটিনের পর্জায়ে নামিয়ে আনে!ফারাজকে হিরো থেকে জঙ্গিতে নামিয়ে আনা পোর্টালগুলো একটা উপকার করেছে বৈ; তারা হেচকা টানে অপরাপর পত্রিকাগুলো্র সাথে 'প্রথম আলোকে' গুলশানোর ঘটনাপ্রবাহে ফিরিয়ে আনে এবং নিহত অপর দেশি, বিদেশি নাগরিকদের ভারসাম্যযুক্ত পরিচিতির ব্যাপারে সচেতন করে তোলে।







ইশরাত আখন্দ

সম্প্রতি ফ্রান্সের রাজধানিতে তরুনদের নাচের ক্লাবে ইসলামি জঙ্গিদের হামলাতে যেসব তরুন, তরুনি নিহত হয়, তাদের ভেতর অনেকে খ্যাতিমান ও ধনাড্য ব্যাক্তিদের সন্তান!বাটাক্লান ক্লাব জঙ্গি আক্রান্ত, এ-খবর প্রকাশের পর পর টুইটার, ফেসবুক তোলপাড় করে উদ্গ্রিব অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের খোজ নিতে থাকে।খোজ নেবার ব্যাকুলতা সত্বেও অভিবাবক এবং আক্রান্ত তরুনদের বন্ধুরা ধারনাজাত-তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে।আবার মুলধারার পত্রিকাগুলোও, নিহতদের কে কোন বনেদি বাড়ির ছেলেমেয়ে এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করে নাই।অভিভাবক, পত্র-পত্রিকা সুত্র হিশেবে পুলিশি ভাষ্যের ওপর পুরোপুরি আস্থা দেখায় ফ্রান্সের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসি ঘটনাপ্রবাহে।এটা অনুশিলিত সেন্স-অফ-প্রপোর্শান বা পরিমিতির ব্যাপার।আমাদের জনপ্রতিনিধিগন ও নিরাপত্তা বাহিনি তথ্যের ব্যাপারে এতটা অনুদার, স্বেচ্ছাচারি এবং পক্ষপাতদুষ্ট যে পরিমিতির জন্য যে পারস্পরিক মানদন্ড দরকার তা এখনো তৈরি হয়ে উঠে নাই।

ন'জন ইটালিয় নাগরিক 
গুলশান হত্যাকান্ডে কমান্ডোদের অভিযানের পরপর পুলিশি কথনে জঙ্গিদের আকাশ, বিকাশ, ডন ইত্যাকার নামকরনের কারনে শুধু যে সিটিজেন সাংবাদিকতা হঠাত করে সক্রিয় হয়ে ওঠে তাও নয়!মৌলবাদি জঙ্গিদের হাতে কয়েক বছর ধরে একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাাশক, শিক্ষক, মৌলবি, পুরোহিত হত্যা; প্রতিক্রিয়াতে সরকারের নিস্ক্রিয়তাও সামাজিক নেটওয়ার্কে সিটিজেন সাংবাদিকতাকে মন্দের ভালো পর্জায়ের বিকল্প করে তুলেছে।

'প্রথম আলো'সহ মুলধারার আরো অনেক পত্রিকা কাটতি সত্বেও যে আস্থাভাজন হতে পারে নাই, তার বড় প্রমান শাহবাগ আন্দোলনের সময় চাদের বুকে সাইদির ছবি জাতিয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার উস্কানি এবং প্রতিরোধ দুই'ই এসেছিলো অনলাইন মাধ্যম থেকে!পুজির বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে তথ্য প্রবাহের যে জায়গাটিকে স্বচ্ছ করবার জন্য বেসরকারি মালিকানায় সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ছেড়ে দেয়া হলো, দেখা গেলো সে-জায়গাটির বাটোয়ারাতে মুল হিস্যাদার হচ্ছে সামন্তবাদি কিছু পরিবার!বসুন্ধরা গ্রুপের কর্নধারের ছেলে যখন খুনের মামলাতে অভিযুক্ত হলো তখন আমরা দেখলাম 'কালের কন্ঠের' অগ্রাধিকার কোথায়!সাগর-রুনি হত্যা থেকেও আমরা তথ্য মাধ্যমের সামন্ত-প্রবনতার সামনে অসহায় হয়ে পড়ি!এরপর কাছাকাছি সময়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তনু হত্যায় সেনাসদস্যদের নাম সন্দেহভাজন হিসেবে ছড়িয়ে পড়া এবং তদন্তে বিভিন্ন টালবাহানা; চিটাগাঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রি খুনের পর পুলিশের পরস্পর বিরোধি বক্তব্যে আমরা যখন আস্থাহিনতার চুড়ান্তে পৌছেছি; সে-আস্থাহিনতার ফোকর গলে মৌলবাদি খুনেরা যখন গুলাশানে আঘাত হানলো; তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনির সাহসি লোকবলের পাশাপাশি দরকারি সরঞ্জামের অপ্রতুলতায় আমাদের যে-বিমুড়তা; নিহতদের একজন ফারাজ হোসেন মৃত্যুর আগে বিরত্বপুর্ন ভুমিকা রেখেছে এটা জেনে আমাদের সে-বিমুড়তা কিছুটা হলেও কেটে উঠবার কথা!কিন্তু আমরা যখন একের পর এক সম্পাদকিয়তে জানতে পারি যে ফারাজ ঐ পত্রিকাটির মালিকের নাতি, তখন আমাদের সেন্স-অফ-প্রপোর্শান দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং সে-দ্বিধা রুচি-সঙ্কটে গড়ায়!



যারা 'প্রথম আলোকে' খন্ডন করে ফারাজকে জঙ্গি বলতে চাইছে, তারা ওপরের ফুটেজের পাশে ফারাজের স্থির ছবি দিয়ে প্রচার করছে।অভিজোগকারিরা বলছে যে 'প্রথম আলো' তথ্য প্রবাহকে ভিন্ন খাতে নিচ্ছে পারিবারিক সুনামের স্বার্থে!'পারিবারিক সুনামের স্বার্থ' কার নাই তা আমার বোধগম্য নয়!বিশেষ করে যেসব পরিবার তরুন সন্তান হারায়, তাদের মর্মবেদনার তলানি ছোয়া, যার না গেছে সে বুঝবে না!তনুর বাবা মায়ের হাতে বড় পত্রিকা থাকলে তারাও হয়ত অন্য সামন্ত পরিবারের মত আচরন করতো!কিন্তু আমরা যেটা জানছি যে সমাজের নিচুতলার কর্মজিবি তনুদের হাতে কোন 'প্রথম আলো' নেই!উপরন্ত মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিনের সময় সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে 'প্রথম আলো' যেভাবে তথ্য পরিবেশন করেছিল, তা থেকে প্রমানিত যে তথ্যকে কায়েমি স্বার্থের খাতে বদলে দেয়ার ক্ষ্মতা তাদের আছে এবং সাময়িকভাবে জনমতামতকে প্রভাবিত করবার ক্ষ্মতাও তাদের আছে।কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে 'প্রথম আলোর' প্রকাশক এবং ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম টেলিভিশনে বলেন যে কেয়ারটেকার সরকারের আমলে গোয়েন্দাদের দেয়া খবর একতরফাভাবে প্রকাশ করা ছিল, 'সম্পাদকিয় ভুল'!গুলশান হত্যাযজ্ঞ্ব ঘটবার ৪৮ ঘন্টা না পেরোতে, মালিকের নাতির মৃত্যু সংবাদকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং সমস্ত প্রচারনাকে, সমস্ত কর্মকর্তাকে সে খাতে নিয়োজিত করা কি 'সম্পাদকিয় ভুল' নয়?আর সমস্ত কর্মকর্তা যদি তাদের পেষাদারি সততা শিকাতে তুলে নিমকহালালি প্রবনতায় আগ বাড়িয়ে এহেনো প্রচারনায় মেতে ওঠে, তা রোধ করাটাওতো সম্পাদকেরই কর্তব্য!কে কাকে কর্তব্য স্মরন করাচ্ছে, করাবে আজকের বাংলাদেশে, আজকের বাংগালি সংস্কৃতির ওপর যেখানে প্রবলভাবে আত্মপরিচয় সঙ্কট চাপানো হয়েছে!

স্বঘোষিত, পরিবারতন্ত্র লেহি, বিভ্রান্তি ছড়ানো কথিত জাতিয় পত্রিকাগুলোর দ্বারস্থ না হয়ে আজকে আমাদের প্রত্যেক বাঙ্গালির ভিতরের মানুষটাকে খুজে বের করবার বড়ই দরকার।প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি জাত, ধর্ম, বর্ন, জাতিয়তা নির্বিশেষে হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার!

গুলশান হত্যাযজ্ঞ্বে নিহতদের স্বজনদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই!

নিহতদের নাম ও জাতিয়তাঃ
  • Cristian Rossi, Italian
  • Marco Tondat, Italian
  • Nadia Benedetti, Italian
  • Adele Puglisi, Italian
  • Simona Monti, Italian
  • Claudia Maria D'Antona, Italian
  • Vincenzo D'Allestro, Italian
  • Maria Rivoli, Italian
  • Claudio Cappelli, Italian
  • Hideki Hashimoto, Japanese
  • Nobuhiro Kurosaki, Japanese
  • Koyo Ogasawara, Japanese
  • Makoto Okamura, Japanese
  • Yuko Sakai, Japanese
  • Rui Shimodaira, Japanese
  • Hiroshi Tanaka, Japanese
  • Faraaz Ayaaz Hossain, Bangladeshi
  • Ishrat Akhond, Bangladeshi
  • Rabiul Karim, Bangladeshi
  • Salauddin Khan, Bangladeshi
  • Saiful Islam, Bangladeshi
  • Abinta Kabir, American
  • Tarishi Jain, Indian

চয়ন খায়রুল হাবিব
৪/০৭/১৬
ব্রিটানি

পরিমার্জনাঃ ৬/০৭/১৬