।।বোতামের লড়াই।। মাছিদের প্রভু।। ক্ষুধার খেলা।। রাজকীয় যুদ্ধ।।
ব্যাটেল রয়াল ছবির দৃশ্য |
প্রাককথন
ঢাকায় বিভিন্ন কলেজের ভেতর ধাওয়া, পালটা ধাওয়া, ব্যাপক ভাংচুর, লুটতরাজ নিয়ে ছেলে মাতিস জ্যোতির সাথে কথা বলছিলাম। মাতিস ওর পড়া কিশোর উপন্যাসগুলোর কথা পাড়লো। যেগুলো ওকে আমরা কিনে দিয়েছিলাম, যেগুলো অবলম্বনে আমরা এক সাথে ফিল্মও দেখেছি। ঢাকার বিশাল বই মেলার কথা মাতিস জানে। ওখানে কিশোর উপন্যাস কি রকম বিক্রি হয় জানতে চাইলো। জানালাম যে অন্যান্য বইপত্র খুব কম বিক্রি হয়, তবে জাফর ইকবালের বই প্রচুর বিক্রি হয়। ইদানিংকার আন্দোলনকারীরা কি পটভূমিতে ওনাকে বয়কট করেছে, তা জানালাম।
মাতিসের মন্তব্য হলো, এটা তো এক্সট্রিম সেন্সর, লেখককে নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা যে এভাবে লিখতে হবে। সেবা প্রকাশনীর প্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেনের নামও এলো। সারা বাংলাদেশে কিশোর, কিশোরীদের কাছে কত রকম স্পাই থ্রিলার, ক্লাসিকস পৌঁছে দিয়েছেন। মাতিসকে ঢাকায় বেড়ে ওঠা, অকাল প্রয়াত খান মোহাম্মদ ফারাবির কথা জানালাম।
তার পর এলো সেই অমোঘ পরিণতির কথা, বাংলাদেশিদের যে সাহিত্য পাঠের অভ্যাস মারাত্মক কমেছে, শুধু টেক্সটবুক আর ধর্মগ্রন্থ জেনে বেশির ভাগ লোকজন জীবন পার করে দিচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্করা তাদের জায়গাগুলো দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি দিয়ে এভাবে সঙ্ক্রমিত করেছে, যে কিশোর, কিশোরীরা তাদের থেকে কোনো দৃষ্টান্ত পাচ্ছে না, তাও এলো। সমাজের সবচেয়ে বেশি যারা বিদেশি মুদ্রা আয় করে, যাদের ওপর পুরো সামাজিক জৌলুসটা দাঁড়িয়ে আছে, গার্মেন্টসের সেই নারী কর্মিদের প্রতি অবহেলা, অসম্মানের প্রশ্নটাও এলো। এতো কিছু বৈষম্য দেখে, বৈষম্য বিরোধিতার স্লোগান দিয়ে, একটা রিজিমের পতন ঘটিয়ে যে এড্রেনালিন কিক তৈরি হয়েছে, তাকে শান্ত করবার মত কানেক্টিভ নেতৃত্বও নাই। সব দল চাইছে এই কিশোরদের দিয়ে অরাজগতার বিস্তার ঘটিয়ে নিজেদের দণ্ডমুণ্ডের উপযুক্ত কর্তা বলে গছিয়ে দিতে।
প্রথমে বাবা, মাদের পাঠাভ্যাস নষ্ট হয়েছে। নিজেরা দৃষ্টিকোণ হারিয়ে বাক্সবন্দী হয়ে, কেবল খাওয়া, আড্ডা, ধর্মের ধুয়া এবং আত্মসর্বস্বতা। সাথে সাথে নষ্ট হয়েছে ছেলেমেয়েদের পাঠাভ্যাস। কিন্তু তাদের মনের ক্ষুধা থেকে গেছে। বড়রা তাদের ক্ষমতার হাতিয়ার করেছে শিশুদের এই মনের ক্ষুধাকে, তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের বাক্সগুলো।
একজন কিশোর, তরুণ কিভাবে ডিফেন্ড করে ১৯৭১এর গণহত্যাকারিদের, ধর্ষকদের। কিভাবে বলে যে আমরা এসবে ছিলাম না, এসবের পর আমাদের অভ্যুদয়। আবার এসবে যারা ছিলো তাদের সহযোগী হয়ে যায়। শিশু, কিশোরদের উপন্যাস থেকে মানস গঠনের কত রসদ পাওয়া যায়। আপাত দৃষ্টিতে তাদের কোনটাকে মনে হবে নৃশংস, কিন্তু তা নৃশংসতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখাচ্ছে। মাতিস জ্যোতির সাথে কথা বলতে যে ৪টি কিশোর উপন্যাসের কথা উঠে এসেছিলো, তাদের সারমর্ম নিচে দেয়া হলো।
লা গের দে বুতো/বোতামের লড়াই
লা গের দে বুতো (La Guerre des boutons) বা বোতামের লড়াই ফরাসি লেখক লুই পেরগো (Louis Pergaud)-এর লেখা একটি কিশোর উপন্যাস। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে এবং তখন থেকে এটি সাহিত্যে কিশোরদের দুষ্টুমি ও গ্রামীণ জীবনের চিত্রায়নের জন্য বিখ্যাত।
উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুটি গ্রাম। এ দুটি গ্রামের কিশোররা একে অপরের বিরুদ্ধে স্থায়ী এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারা মূলত খেলার ছলে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে, যার মূলে রয়েছে তাদের শত্রুতাপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
এ যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় লাঠি, পাথর, এবং বিভিন্ন রকমের ফাঁদ। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তাদের যুদ্ধের "ট্রফি" বা বিজয়সূচক পদক হল প্রতিপক্ষের পোশাকের বোতাম ছিঁড়ে নেওয়া। বোতাম ছিঁড়ে নেওয়া মানে শত্রুকে লজ্জিত করা এবং তার পরাজয় নিশ্চিত করা।
উপন্যাসটি কিশোরদের দুষ্টুমি, বন্ধুত্ব, শত্রুতা, এবং তাদের নৈতিকতা শেখার যাত্রার গল্প। এতে হাস্যরস, দুঃসাহসিক কাহিনী এবং সে সময়ের গ্রামীণ ফরাসি জীবনের একটি বাস্তব চিত্রায়ন পাওয়া যায়।
এ গল্পটি কেবল শিশুদের খেলা নয়; এটি মূলত একটি রূপক। এটি সমাজের যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক নৈতিকতার প্রতিফলন।
উপন্যাসটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এটি বেশ কয়েকবার চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে, যা এর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
মাছিদের প্রভু/ দ্য লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ
লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ (The Lord of the Flies), বা মাছিদের প্রভু উইলিয়াম গোল্ডিং (William Golding) রচিত একটি বিশ্বখ্যাত উপন্যাস,( ১৯৫৪)। গল্পের শুরুতে যুদ্ধকালীন সময়ে একটি বিমানে থাকা একদল স্কুলপড়ুয়া ছেলে দুর্ঘটনায় এক নির্জন দ্বীপে আটকা পড়ে। প্রাপ্তবয়স্কদের অনুপস্থিতিতে তারা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে এবং নিজেদের নিয়ম-কানুন তৈরি করে। শুরুতে তারা একত্রিত হয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করে। রালফ নামের এক ছেলে নেতা নির্বাচিত হয়, এবং সভ্যতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা শুরু হয়।
তবে, ধীরে ধীরে এই চেষ্টা ভেঙে যায়। জ্যাক নামে আরেকটি ছেলে ক্ষমতার লোভে রালফের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তার নিজের একটি দল গঠন করে। এই দলের মধ্যে ক্রমে সহিংসতা, হিংস্রতা এবং বর্বরতা বেড়ে যায়। তারা শিকার করা এবং নিজেদের আদিম প্রবৃত্তি প্রকাশে বেশি মনোযোগ দেয়। বিভেদ ও সংঘর্ষের এক পর্যায়ে, সহিংসতা এতটা বাড়ে যে এটি কয়েকজনের মৃত্যু ঘটায়। দ্বীপে তাদের নির্মম আচরণ প্রতিফলিত করে কীভাবে সভ্যতার নিয়ম ছাড়া মানুস পশুত্বে নেমে যেতে পারে। এ গল্পে মানব প্রকৃতির অন্ধকার দিক, ক্ষমতার লোভ, সভ্যতার প্রভাব এবং পশুত্ব, শিশুদের নিষ্পাপ, নিরিহতার অবক্ষয় তুলে ধরা হয়েছে।
ক্ষুধার খেলা/ দ্য হাঙ্গার গেমস
দ্য হাঙ্গার গেমস (The Hunger Games), সুজান কলিন্স (Suzanne Collins) রচিত একটি বিশ্বখ্যাত ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, যা ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একই নামের একটি জনপ্রিয় ত্রয়ী উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। উপন্যাসটি ভবিষ্যতের একটি অত্যাচারী সমাজে টিকে থাকার লড়াই এবং মানবতার আশা ও বীরত্বের কাহিনী। ক্ষমতা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে টিকে থাকার লড়াই, মানবতার আশা এবং আত্মত্যাগ। সামাজিক বৈষম্য এবং শ্রেণিবিন্যাস ঘিরে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় কিশোর চরিত্ররা বিবর্তিত হয়েছে।
গল্পটি ভবিষ্যতের উত্তর আমেরিকা, যা তখন প্যানেম নামে পরিচিত, এই সমাজে সংঘটিত। প্যানেম একটি অত্যাচারী সরকার দ্বারা শাসিত হয়, যার রাজধানী ক্যাপিটাল এবং ১২টি দরিদ্র জেলা। ক্ষমতা প্রদর্শন এবং জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য প্রতি বছর "হাঙ্গার গেমস" নামক একটি নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ প্রতিযোগিতায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে (যাদের ট্রিবিউট বলা হয়) বেছে নেওয়া হয়। মোট ২৪ জন প্রতিযোগীকে একটি বিশাল অঙ্গনে পাঠানো হয়, যেখানে তাদের একে অপরকে হত্যা করতে হয় যতক্ষণ না একজন জীবিত থাকে। এটি ক্যাপিটালের বিনোদনের জন্য এবং জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য প্রচারিত হয়।
গল্পের নায়িকা ক্যাটনিস এভারডিন, ১২ নম্বর জেলার এক সাহসী মেয়ে। তার ছোট বোন প্রাইমকে যখন হাঙ্গার গেমসের জন্য নির্বাচিত করা হয়, তখন ক্যাটনিস স্বেচ্ছায় তার বোনের পরিবর্তে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। তার সঙ্গী হয় পীটা মেলার্ক, যে ক্যাটনিসের প্রতি গোপনে ভালোবাসা পোষণ করে।
খেলা চলাকালীন, ক্যাটনিস তার বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, এবং মানবিক গুণাবলীর মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে। সে পীটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং তাদের মধ্যে একটি কৌশলগত জোট গড়ে ওঠে। তারা একসঙ্গে খেলা শেষ করার একটি কৌশল খুঁজে বের করে, যা ক্যাপিটালের নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে।
শেষে, ক্যাটনিস এবং পীটা উভয়েই বিজয়ী হয়, তবে এটি ক্যাপিটালের ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের বিদ্রোহী আচরণ ভবিষ্যতে একটি বৃহৎ বিদ্রোহের সূচনা করে।
রাজকীয় যুদ্ধ/ব্যাটেল রয়াল
ব্যাটেল রয়্যাল (Battle Royale), জাপানি লেখক কোশুন তাকামি (Koushun Takami)-এর লেখা একটি বিখ্যাত ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে এবং বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয় এর চরম সহিংসতা, গভীর মানবিক সঙ্কট এবং রাজনৈতিক প্রতীকবাদের জন্য। গল্পের পটভূমি একটি বিকল্প জাপান, যেখানে দেশটি একটি সর্বাধুনিক স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দ্বারা শাসিত। সরকার জনগণের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য ভয়াবহ এক প্রোগ্রাম চালু করে, যা "ব্যাটল রয়্যাল" নামে পরিচিত।
এই প্রোগ্রামের অধীনে, প্রতি বছর একটি স্কুলের পুরো একটি ক্লাসকে এলোমেলোভাবে বেছে নেওয়া হয় এবং তাদের একটি দূরবর্তী দ্বীপে পাঠানো হয়। এখানে তাদের বাধ্য করা হয় একে অপরকে হত্যা করতে, যতক্ষণ না মাত্র একজন জীবিত থাকে। গল্পের মূল চরিত্র, শুয়া নানাহারা, একজন সাধারণ ছাত্র, যিনি হঠাৎ এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তার সঙ্গে আছেন তার বন্ধু নোরিকো নাকাগাওয়া এবং রহস্যময় সহপাঠী শোগো কাওয়াদা, যিনি আগের কোনো একটি ব্যাটল রয়্যালে বেঁচে গিয়েছিলেন। শুয়া ও তার সঙ্গীরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে, কিন্তু সহপাঠীদের মধ্যকার বিশ্বাসঘাতকতা, ভয়, এবং সহিংসতার কারণে তাদের জীবনে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
ব্যাটল রয়্যাল উপন্যাসটি তরুণ প্রজন্মের জন্য এক গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে : চরম পরিস্থিতিতে কিভাবে মানুষ তার নৈতিকতা এবং মানবিকতা বজায় রাখতে পারে।
বাংলাদেশ ২০২৪
সোহরোয়ার্দী কলেজ, মাহবুব মোল্লা কলেজের ছাত্রদের লড়াইর পর লুটপাট। ২৫শে নভেম্বার, ২০২৪।ছবি : জীবন আহমেদ। |
২০২৪এও একটা চরম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো। একটা দল মানুষকে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে দেবে না, নির্বাচনে জুয়াচুরি করছে তো করছেই। গুম, লুট, স্বজনপ্রীতি, অবিচার ছাড়া কিছুই নেই। ইলিয়াস আলী, সাগর, রুনি, তনু, ত্বকি ধরে নাম বলা শুরু করলে শেষ করা যাবে না। আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির মত কতজনকে ফাঁসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আবার আরেকটা দল বলে যাচ্ছে পাকিস্তান খুব গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট, ১৯৭১এ এটা করা ঠিক হয় নাই, ওটা না করলেও চলতো। তারা ৩০ লাখকে হত্যা অস্বীকার বলে যে তিন লাখ হত্যা করা হয়েছিলো, য্যানো তিন লাখ হত্যা ঠিক আছে। তার পর আছে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল বদরদের হাতে দুই থেকে চার লাখ বাঙালি নারীর ধর্ষণ। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার সরাসরি তদন্তের এই ফলাফলও এটাও একটা দল অস্বীকার করে। এই অস্বীকারকারী দল ২০২৪ এর গণ অভ্যুত্থানের সুযোগে রাষ্ট্র ক্ষমতা চায়, নিদেন পক্ষে আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল হতে চায়।
একটা দলের দায় অস্বীকার, আরেকটা দলের নিজেদের ধারাবাহিকতাকে কাল্ট বানিয়ে ফেলা, এর ভেতর বড় হওয়া প্রজন্মগুলোর কাছে জাফর ইকবালের মত কিশোর উপন্যাসিক বেশি নেই। ২০২৪এর এক পর্যায়ে রাজাকার শব্দটি যখন ট্যাবু ভেঙ্গে স্লোগান হয়ে গেলো, তখন জাফর ইকবাল তাঁর কঠোর সমালোচনা করলেন, আন্দোলনকারীদের সাথে দূরত্ব তৈরি করলেন। তিনি আন্দোলনের মর্মে যে একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অপসারণ, তা বুঝতে চাইলেন না। আন্দোলনকারীরা ক্ষেপে গেলো। রকমারি ডটকম সহ কয়েকটি বই বিক্রির পোর্টাল ঘোষণা দিলো যে তাড়া আর জাফর ইকবালের বই বিক্রি করবে না। আমরা কি সত্যি সত্যি জানি রকমারি, ডট, কম, ঐতিহ্য প্রকাশনী আসলে আকারা চালায়? মুক্তিযুদ্ধে যার বাবা শহীদ হয়েছে, সেরকম একজন জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাসিককে কিছু মন্তব্যের জন্য তড়িঘড়ি বলি দেবার আয়োজন কেন হলো?
ব্রিটিশ কিশোর উপন্যাসিকেরা আমাদের এক দল তাত্ত্বিকের কাছে উপনিবেশিক। তাহলে সুভাষ যে জাপানের দিকে হেলেছিলো তাদের কিশোর উপন্যাসিকেরা কি উপনিবেশ-বিরোধী? মহত সাহিত্য তার সমসাময়িক রাজনীতির বাক্স থেকে বেরিয়ে একটি সার্বজনীন কম্পাস তৈরি করে। এমেরিকান মার্ক টোয়েনের কিশোর উপন্যাসের নায়কদের আজকের পটভূমিতে অনেক নেতিবাচক-ভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। যত পাঠ হবে, তত ব্যাখ্যার পরিধি, নিজের স্বতন্ত্র উন্মোচনের পরিচর বাড়তে থাকে। স্বৈরতন্ত্র উৎপাটন জরুরি। তার সাথে ভবিষ্যৎ-বোধক মানবিকতার উন্মোচনও জরুরি।
নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪, টি, এস,সি বাম থেকে ড. শাহনাজ পারভীন, মনীরা পারভীন, হাশেম খান, চয়ন খায়রুল হাবিব, রশীদ আমিন, সুজন মাহবুব |
২০২৪এ মার্চ থেকে মধ্য আগস্ট আমি বাংলাদেশে ছিলাম। মে মাসে ঘোর দাবদাহের ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক মিলন কেন্দ্রের পরিত্যাও সুমিং পুল সাইডে কিউরেট করেছি ৬ দি ব্যাপী মিশ্রকলার প্রদর্শনী 'নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪'। তার পর নড়াইলে ঘুরে বেড়িয়েছি চিত্রা নদীর তীরে। জুলাই কোটা বিরোধী আন্দোলন কাছাকাছি দেখতে দেখতে, আগস্টের কারফিউ, হত্যাযজ্ঞের পর ৫ই আগস্ট উল্লসিত জনতার সাথে ঢুকে পড়েছি গণভবনে। আসার আগে ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় দেখে এলাম ঝাঁক ঝাঁক তরুণ, তরুণী দেয়াল ভরিয়ে তুলছে স্বাপ্নিক গ্রাফিটির । কুমিল্লাতে সে গ্রাফিটি ভিত্তিক প্রথম প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখলাম, গণ-গ্রাফিটির জোয়ার এবং অদৃশ্য ক্যামেরা!
কোথায় য্যানো আবার তাল ভঙ্গ হলো। ১৯৭১এর পরাজিত শক্তি চলে এলো প্রকাশ্য মঞ্চে। ২০২৪এর পরাজিত আড়াল থেকে লেলিয়ে দিলো তাদের গুপ্ত লাঠিয়ালদের। ধর্মবাদি জঙ্গিরা যে কোনো অজুহাতে আক্রমন করতে থাকলো বাক-বিচিত্রতার স্পৃহা। পুনর্গঠনের বদলে কায়েমি স্বার্থ আশ্রয় নিলো সন্ত্রাসের। সাধরণ মানুষ আবার জিম্মি হলো।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ : আশির দশক আমার কলেজ জীবন
শিল্পমেলা, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা, ১৯৮৪। লেখক বসে, সর্ব ডানে। |
১৯৯০তে প্রথম বিলাতে এসে কয়েক মাস থেকে ফিরে যখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান বন্দর কর্মি হিসেবে জিয়াতে যোগ দিলাম, তখন এয়ারপোর্টে যেতাম আজিমপুর থেকে ঢাকা কলেজ রিক্সায়, সেখান থেকে টেম্পোতে ফার্মগেট, তাঁর পোঁর বাস। পুরো পথই ফাকা লাগতো। আশির দশকের নীরবতার তেমন অদলবদল হয় নাই। উত্তরা মাইলের পর মেইল ফাকা। তবে তখন থেকে ঢাকায় গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠছে। শ্রমিক তরুণীদের ঢল দেখা যাচ্ছে আজিমপুর মোড়, সৈনিক ক্লাবের রেল ক্রসিঙে।
সিটি কলেজে পড়লেও আমি আড্ডা দিতাম ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে। আমার দিনমানের কয়েকজন দোস্ত কায়েস, অঞ্জন ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়টো। ইউল্যাবে মামুন এসে জগ দিতো। পাড়ার বন্ধু অপু, যার সাথে আমি ঢাকা কলেজের এক ইয়ার সিনিয়ার জামাল ভাইর সাথে আমাদের বাসায় একসাথে পড়েছি, সেই অপু ছিলো ঢাকা কলেজের বাণিজ্য বিভাগে। সিটি কলেজ থেকে ভালো ফলাফল নিয়ে আমি ঢাবিতে গেলেও সেখানে আমার কোনো বন্ধু ছিলো না।
ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে কিছু আড্ডা মেরে, বাস্কেটবল খেলে বাসায় চলে যেতাম। বিকালের দিকে আবার কায়েস এলিফেন্ট রোডের বাসার চিলেকোঠায় আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে নাকে তুলা গুজে একাউন্টিং, আর ফাকে ফাকে কাব্য চর্চা। কায়েসের বাবা হচ্ছেন প্রয়াত খ্যাতিমান নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরী। ওনারা একান্নবর্তিভাবে ঐ বাসাতে থাকতেন। এ ছাড়া আড্ডা মারতাম এলিফেন্ট রোড পেট্রল পাম্পের উলটো পাশে মফিজের বাসায়, কিম্বা ইউনিভার্সিটি স্টাফ কোয়ার্টারে ফটিকের বাসা, কিম্বা আজিমপুর কলোনিতে তারিক, আরিফদের বাসাতে। কায়েস, অঞ্জনরা প্রচুর কোচিং এ যেতো। সেসব কোচিং এর ইংলিশ, বাংলা নোটস আমাকে দিয়ে দিতো, সেগুলো পড়ে আবার ঠিকঠাক করে দিতো মেট্রিকে স্ট্যান্ড করা মেহেন্দি-গঞ্জের জামাল ভাই।
ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে অনেকে জানতো যে আমি সিটি কলেজের। ধরুন, এই যে কিছুদিন পর পর সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ হাড্ডাহাড্ডি লেগে যাচ্ছে, একে অন্যকে মেরে ফেলতে চাইছে, আমার সময়টাকে টাইম মেশিনে করে এখনকার সময়ে নিয়ে এলে আমাদের ঐ বন্ধুদের দঙ্গলের সবাই থমকে যেতাম। আমি গুলতানি, ক্রিকেট ফুটবল, একাউন্টিং, কাব্য চর্চা ইত্যাদির ফাকে গাজা টানতে আজিমপুরের চুড়িহাট্টা, বাবুপুরা বস্তিতেও যেতাম। আরো অনেকে আসতো যাদের অনেকে এখন আলোচিত চিত্র নির্মাতা, গল্পকার। বস্তি থেকে বের হচ্ছি, দেখতে পেলাম জীবন আমার বোন খ্যাত গল্পকার মাহমুদুল হক রিক্সাতে বসে আছেন গলির মুখে। বস্তির প্রধান গঞ্জিকা বিক্রেতা বুড়ির ছেলে গিয়ে ওনাকে পুরিয়া দিয়ে আসছে।
আমি ইউনিভার্সিটিতে যাবার আগেই যমজ বোন কঙ্কণ ঢাবি চারুকলার ছাত্রী। ওদের সময় মেট্রিকের পর ভর্তি পরীক্ষায় টিকে ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হতো। কঙ্কণের সূত্রে ওর ব্যাচমেটদের অনেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এখন চারুকলা এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের এদিক ওদিক গেলে হঠাৎ যেরকম ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ মনে হয়, আশির দশকে পুরো ঢাকা এরকম ছিলো। সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত ঢাকা ইউনির মোড়গুলোও এখন গুলিস্তান, নবাবপুরের মতো।
সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ কলেবরে বড় হয়েছে। ভবনগুলোর গায়ে মাছির মত সেটে আছে এয়ার কুলার। কিন্তু হৃদয় নয়া থাকলে আর এয়ার কুলার হৃদয় জুড়াবে কার
সেই একই কথা পুরান ঢাকার কবি নজরুল, সোহরোয়ার্দী কলেজ, মাহবুব মোল্লা কলেজ নিয়ে। ২০২৪এর জুলাই, অগাস্ট যাত্রাবাড়ী, সদরঘাট ছিলো অভ্যুত্থানের হট স্পট। এখন এই কলেজের ছেলেরা একে অন্যের ভবন মাটিতে গুড়িয়ে দিতে চায়। একে অন্যকে মব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সামগ্রী লুটপাট করছে। কিছুদিন আগেও এরা স্বপ্ন দেখেছে। আর এখন কাদের পুতুল হয়ে গেলো পুতুল নাচ থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে বার বার বেরিয়ে আসে। আমরাও এসেছিলাম পুরো আশির দশক জুড়ে। সামনেও কিছু নাই, পেছনেও কিছু নাই, ইতিহাস যা আছে তাকে অস্বীকার করবার উস্কানিতে সবকিছু ভেঙ্গে ফেলার এক মরিয়া প্রবণতা। ইতিহাসকে কাল্ট বানিয়ে যারা স্বার্থসিদ্ধি করেছে, তাদের প্রতি অনাস্থা, যারা ধর্মের কথা বলছে তাদের খোলসও উন্মোচিত।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে, গুহার আধারে, বিধাতা অনুসারীদের লুকোচুরির মুখে, নতুন প্রভাত-পাখির গান ছাড়া সত্যিই আর কোনো কিছু শোনার নাই!
চয়ন খায়রুল হাবিব
২৬/১১/২৪
ব্রিটানি, ফ্রান্স