Sunday 28 October 2012

ব্রেশট বনাম সার্ত্রে: মঞ্চনাটকের দায়মুক্তি:

'বাংলা ভাষাপ্রমিতের নোম্যান্সল্যান্ড' প্রবন্ধ সংগ্রহে লেখাটি গ্রন্থবদ্ধ, ২০১৫

পুর্বকথনঃ
আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো পর্বটা আমার কেটেছে মহাঅস্বস্তিতে।রায়ট গিয়ারে পুলিশ, জামাতি শিক্ষক দেখলে  যে অনুভূতি হ’তো তার  একটা নাম পেতে আমার অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল।আত্মিক সমস্ত উল্লাস দিয়ে আমি আর আমার বহু বন্ধু ঐ  অনুভূতির বিরুদ্ধে নিরন্তর ধস্তাধস্তি চালিয়ে যেতাম কখনো নাট্যমঞ্চে, কখনো সাহিত্যে, কখনো সরাসরি রাস্তার মিছিলে।যা পল সার্ত্রের La Nausea রচনাটির শিরনামটি এই অনুভূতিকে ধারণ করেছে।

স্বৈরতন্ত্রী যে কোন সমাজে ব্যক্তি তার অজান্তেই এ-অনুভূতির শিকার হতে পারে।একদল শিক্ষক ও বুধ্বিজিবি ঐ অনুভূতিকে আন্দোলনের নামে, শ্রেণি সংগ্রামের নামে ত্যাগের মূল্য বলে জায়েজ করতে চাইবে; আরেক দল শিল্পী ঐ একই বোধকে মুখরোচক ভাঁড়ামি দিয়ে মঞ্চায়ন করে গা-সওয়া করে তুলতে চাইবে।কিন্তু ঐ শিক্ষকেরা, শিল্পীরা কখনোই স্বীকার করতে চাইবেনা যে এটা একটা অসুস্থতা; এরা এটাও অস্বীকার করবে যে  শিল্প, সাহিত্যের, দর্শনের রুগ্নতার মুলে এই অসুস্থতা।

সার্ত্রে, চে গেভারা, সিমোন দ্যা বুভোয়া!

এক্ষনকার লেখবার ভাষা:
বাংলা ভাষাভাষী গোষ্ঠীর এক অংশ দীর্ঘদিন কম্যুনিস্ট শাসনাধীন থেকেছে।আরেক অংশ কখনো জবাবদিহিতাবিহীন গণতন্ত্র, কখনো সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের এবং মৌলবাদের কুহেলিকায় আচ্ছন্ন।এই ভাষাভাষী গোষ্ঠী  নান্দিগ্রাম, লোগাং, খাগড়াছড়ি ইত্যকার শব্দগুলোর প্রায়োগিক ব্যঞ্জনার কল্যাণে নিজেদের প্লেটোর রিপাবলিকের অনুগত ছাত্র হবার লক্ষণগুলো প্রকট করে তুলেছে।যে রিপাবলিকে সক্রেটিসদের হবি হচ্ছে হেমলকের রস পান!ব্যক্তির বিনাশ করতে করতে এই জনগোষ্ঠীটি য্যানো নিজেকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে।

প্রাণ দেয় উলুখড়ে:

সার্ত্রে তার “সাহিত্য কি”  রচনাতে ঘোষণা করেছিলেন , “কারো পক্ষ্যে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবা সম্ভব নয় যে ইহুদীবাদ-বিরোধিতাকে প্রশংসা করে মহত উপন্যাস রচনা সম্ভব।”

ইহুদীবাদ বিরোধিতায় হিটলার থেকে শুরু করে আজকের লাদেনিয় বুদ্ধিজীবী কোটি অর্বুদ অক্ষর বিষোদগারের কথামালাশরিফ রচনা করলেও তাদের প্রচারণা, তত্ত্ব, রুশদি বিরোধী ফতোয়া কোনটাই দুই নোবেল বিজয়ী উপন্যাসিক মিশরের নগিব মেহফুজ আর তুরস্কের অরহান পামুককে ইহুদিদের বিরুধ্বে একটি বাক্য লিখতেও উৎসাহিত করেনি।অথচ এদের দেশের রাজনীতির বিশাল একটি অংশ মুসলিম মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে।পামূক , মেহফুজ , সার্ত্রের মতই জানেন যে আজ যে ইহুদির বিনাশ চায় , কাল সে পান থেকে চুন খসার অজুহাতে আমারই বিনাশ চাইবে।

সার্ত্রের অনুসরণে থিওডোর আদোর্নো বলেছিলেন, “ জিনোভিয়েভ, বুখারিনকে হত্যা করবার উছিলাতে যে মস্কো বিচারের প্রহসন, তারপর স্টালিনকে নিয়ে মহৎ সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়।” সার্ত্রে অনুপ্রাণিত আদোর্নো এই তীব্র বানবাক্য ছুড়ে মেরেছিলেন ব্রেখটের “জননী সাহসিকা’ নাটকের মঞ্চায়নের সমালোচনা করে।

“জননী সাহসিকা” নাটকটাতে পার্টি লাইন প্রমাণ করতে ব্রেশট সামাজিক বাস্তবতা যার একচেটিয়া দাবিদার বলে ও নিজেকে দাবি করত; সে-বাস্তবতাকে এবং তা-থেকে তৈরি সমস্যাগুলো ও ইচ্ছেমত অদলবদল করে ফেলে।যেটুকু নিলে পার্টি লাইন বহাল থাকবে ঠিক তট্টূকু; বাদবাকি সব ইতিহাসের আস্তাকুড়ে!

সার্ত্রে অনুসারীরা ব্রেশটের ওপর বিরাগভাজন হলেও সার্ত্রে নিজে কিন্তু ব্রেশটকে নিয়ে কখনো কটুকাটব্য করে নি।আর মস্কো প্রহসনের সাথে মিলিয়ে “সন্ত জোয়ান” গ্যলিলি গ্যলিলিও”নাটকের লেখককে মিলিয়ে ফেলতে আমার লেখক স্বত্বা কোথায় য্যানো কুণ্ঠিত বোধ করে।সার্ত্রে মনে হয় জানতেন যে মাও কুর্তাধারী শিশুসুলভ ঐ লেখক তার নাটককে মার্ক্সবাদী তত্ত্বের বাহন করে তুললেও একই লেখক “এমিল ও তার গোয়েন্দা বাহিনী’র মত শিশু সাহিত্যের রূপকার।এটা ঠিক ঠাণ্ডা মাথার হিটলারি বা স্তালিনিও খুনেদের সাথে মেলেনা।তবে শেষ জীবনে ব্রেশট এমন কিছু স্ববিরোধী কাজ করেছিলেন যা তার সমালোচকদের মোক্ষ আক্রমণের রসদ যুগিয়েছিল।

থিওডোর নিজেও ব্রেশটের মতই জার্মান।জন্মও ব্রেশটের কাছাকাছি সময়।অর্থাৎ প্রজন্মগত কোন পার্থক্য নেই।কিন্তু ব্রেশটের বৈরিতা এরা কিন্তু পুঁজিবাদের সমর্থনের জায়গা থেকে করত না।এদের মঞ্চটার নাম ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল।এরা নিজেদের দাবি করত নিও-মার্ক্সবাদী বলে।এরা কিন্তু শিল্পী , সাহিত্যিক নয়।সমাজতাত্ত্বিক।এরা সার্ত্রেকে কাছে টেনে নেবার কারণ; সার্ত্রে ষাটের দশকে বল্লেনঃ 'আমি মার্ক্সের প্রথম দিককার লেখাগুলোকে অনেক মানবিক বলে মানে করি।'সার্ত্রে কিন্তু বলে নি যে আমি মার্ক্সের পরের দিককার লেখাগুলোকে অমানবিক মনে করি।সার্ত্রে মূলত তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের” সাথে দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল।এতে  প্যরিসের মস্কো লাইনের লোকেরা সার্ত্রের ওপর খড়গহস্ত হোল আর থিওডোরের মত লোকেরা যারা হয়ত নিছক ব্রেশটের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত তারা ভাবল , ওহ আমাদের শিবিরে একজনকে পাওয়া গেছে।তার
ওপর সার্ত্রে প্রথম নোবেল প্রত্যাখ্যানকারী সাহিত্যিক।এমনি বলে কথা!দলে ভিড়ানো চাইই চাই!সার্ত্রেকে ভর করে এরা ব্রেশটকে বলে বসল ঃ দাড়ের ময়না।

ব্রেশটের নাটকে আবার বিস্তারিতভাবে যাবার আগে দেখা যাক দার্শনিক, নাট্যকার, উপন্যাসিক সার্ত্রের    নিজের জায়গাটা।

সত্য সন্ধানী সন্ত:

১৯৬৪ তে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে  সার্ত্রে বলেছিল: “সব লেখকেরই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবার সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।তা যত সম্মানজনক উপায়েই হোক না কেন।”

এ-কথাটা কিন্তু তার সময়ের পাস্তেরনাক, সোলঝেনিতসিন, রাসেল বলে নি।আবার সার্ত্রেকে গুলাগেও পাঠানো হয়নি!মার্ক্সবাদী না হয়েও সম্পদ বিতরণে যে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতন্ত্র তার লক্ষ্য তা তার কাজকামে অত্যন্ত পরিস্কার।প্রকাশ্যে ও ঘোষণা দিল যে ফ্রান্সের আলজেরিয়া দখলদারি কোন বিবেকবান ফরাসির বরদাস্ত করা ঠিক না।রাসেলের সাথে ও ভিয়েতনামে ফরাসি-মার্কিন নিধনযজ্ঞের বিরুধ্বে ট্রাইব্যুনাল গঠন করল।সঙ্গিনী সিমনের সাথে অতিথি হল ফিদেল আর চে’র।ফিদেলের চেয়ে চে’কে বেশি পছন্দ হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে দিনের পর দিন চে’র সাথে আড্ডায়।সি, আই, এ চে’কে হত্যার পর সার্ত্রে বলেছিল, “ চে শুধু একজন বুধ্বিজিবিই নয়; আমাদের সময়ের সবচেয়ে পুর্নাংগ মানুষ।। ...চে’র গল্পই আমাদের পৃথিবীর গল্প।”কিন্তু স্টালিনকে সার্ত্রে কখনোই গ্রহণ করে নি।গ্রহণ করেনি “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকেও”।
এখানেই সার্ত্রের সাথে ব্রেশটের বিরোধ।

আর মিলের যায়গাতে সার্ত্রে ব্রেশটের চেয়ে অনেক বেশি শ্রেণীচ্যুত। “সৎ মানুষের সন্ধানে” নাটকে ব্রেখট পতিতাকে সৎ মানুশ হিশাবে দেখাচ্ছে।কিন্তু ঐ সাধারণ মানুশ যখন ১৯৫৩র ১৭ই জুন পূর্ব জার্মানির সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়লো তখন ব্রেশট শুধু সরকারকে সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত নয়; ও চাইছে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক এসে “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”রক্ষা করুক।আর সেভাবে শ্রমিক রাজ রক্ষায় যত প্রতিক্রিয়াশীলের বিনাশ হোক তাতে ব্রেশটের কিছুই যায় আসে না।এ-তথ্য অন্যের বয়ানে নয়।খোদ ব্রেশটের জবানিতে।ঐ জুনে কতজন ক্ষুধার্ত জার্মানকে পূর্ব জার্মান সরকার হত্যা করেছিল তার হদিশ মেলা ভার।এই ব্রেশটকে আমি চিনি না। এই ব্রেশটকে আমি বুঝি না।

এমন নয় যে ব্রেশটের অন্য কোন উপায় ছিলনা।আমেরিকাতে থাকবার বদৌলতে , আর কপিরাইটের গুনে ব্রেশটের অস্ট্রিয়ান একাউন্টে কোটি, কোটি ডলার।ওর অস্ট্রিয়ার পাসপোর্টও ছিল।জুন অভ্যুথানকারিদের পাশে দাঁড়ালে অস্ট্রিয়ার সরকার ওর হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারতো।যে সুবিধা পাস্তেরনাকের, সোলঝিনিতসিনের ছিল না।সম্ভাব্য সব বর্বরতায় ঐ অভ্যুত্থান দমনের পর , মৃত্যুর কিছুদিন আগে ব্রেশট ওর অবস্থান বদলেছিল; লিখেছিল “বুকোভারের শোকগাথা” নামের কবিতা।

সার্ত্রে তার সৎ মানুষের খোজ পেয়ে গেছে বাস্তিল কারাগারে।ওখানে গিয়ে সার্ত্রে তীর্থযাত্রীর মত দেখা করছে সমাজের সবচেয়েনিচের তলাকার এক মাদকাসক্ত, দাগি , সমকামী চোরের সাথে ।সার্ত্রে ঘোষণা করল জা জেনে নামে এই চোরের কাছ থেকেই ফ্রান্স যদি কিছু শেখবার থাকে , শিখতে পারবে।আর ঐ চোরই হয়ে উঠল সার্ত্রের সিরাজ সাই।বুধ্বিজিবিমহলে সিঁধ কেটে জা জেনেকে ঢূকিয়ে দিয়ে সার্ত্রে ১৯৬৮ তে ছাত্রদের সাথে রাস্তায় নামলো সরকারের বিরুদ্ধ্বে প্রতিবাদে।গ্রেপ্তারও হ’লো।দ্যাগল নিজে হস্তক্ষেপ করে সার্ত্রেকে কারাগার থেকে বের করেছিলো পুলিশ বাহিনীকে এ বলে ভতসনা করে যে: ভল্টেয়ারকেত আমরা গ্রেপ্তার করতে পারি না।

এপিক থিয়েটার:

বের্টল্ড ইউজিন ফ্রেড্রিখ ব্রেশট।জন্ম ১৮৯৮তে।বিশ বছরের শুরু থেকেই মার্ক্সবাদে দীক্ষিত।কিন্তু কখনো কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়নি।ঐ বিশের শুরুতেই মেডিকাল স্কুলে পড়বার সময় থিয়েটারের হাতেখড়ি।কবিতা, নাটক লেখবার পাশাপাশি নাটকের প্রায়োগিক মঞ্চায়ন নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছে।নাটকে ব্রেশটের মৌলিক অবদান হচ্ছে এপিক থিয়েটার ফর্ম।এখানে দর্শকদের আহ্বান জানানো হয় সংলাপের সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিজের ভাবনার জায়গাতে পৌছুতে।কৌশলগতভাবে একে বলা হয় এলিয়েনেশান বা বিজ়ুক্তিকরন।নাটকে চরিত্রায়নে অভিনয়কে নিরুৎসাহিত করা হয়।বদলে চরিত্ররা একটি দ্বন্দময় বিশয়ে তার্কিক একটা পরিস্থিতি উপস্থাপন করে।এলিয়েশনে দর্শককে যেখানে যেতে উৎসাহিত করা হচ্ছে, মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ব্রেশটের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সাথে মেলে না।তত্ত্বে যাই থাকুক ,প্রয়োগে মার্ক্সবাদী দলগুলোতে সবকিছুই আগে থেকেস নির্ধারিত; যাকে আম জনতার কাছে হাজির করা হয় পার্ট লাইন বলে।দল জনতার সাথে অভিভাবকসুলভ আচরণ করে।

কিন্তু ব্রেশট দর্শককে আম জনতা মনে করে না।কুশীলবদেরও মনে করেনা পার্টির পাইওনিয়ার বা কমসোমল সভ্য।কিন্তু “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” তার মগজপ্রিয় ধারনা।আর এই ধারনাকে শিল্পের ওপর প্রাধান্য দিতে গিয়েই নিজের থিয়েটারের এক অর্থে বারোটা বাজিয়েছিল ব্রেশট।

হিটলারের তাড়া খেয়ে একের পর এক দেশ বদলে ব্রেশটকে ঠাই নিতে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।হিটলারি জমানার আগে ব্রেশটের শিল্প ধারনা ছিল দাদাবাদে প্রভাবিত।ত্রিস্তান জারার ঐ আন্দোলনের মুল সুর যুদ্ধ বিরোধী।দাদাদের শিল্প চর্চা এমনকি শিল্পেরও বিরোধী।অর্থাৎ যা কিছু আগে হয়ে আছে তার সব বাতিল।ব্রেশট কখনোই দাদাবাদি ছিলনা।কিন্তু যা কিছু আগে হয়ে গেছে তার সব বাতিল; এটা তার প্রাণে ধরেছিল।তবে মার্ক্সবাদী দীক্ষা থেকেই নতুন যা কিছুই তাকে অবশ্যই শ্রমিকরাজ কায়েমে কাজে লাগাতে হবে।দায় বলে কথা।

হিটলারের তাড়া খেতে খেতে ও লিখল গ্যলিলিও, জননী সাহসিকা, সৎ মানুষের সন্ধানে, ককেশিও চক সার্কেল, আর্তুরো উই।এর মধ্যে সৎ মানুষের সন্ধানে আগের “সন্ত জোয়ানের” বিনির্মাণ।জোয়ানের কুমারী প্রতীকের কীর্তি ম্লান করতেই য্যনো পতিতাকে বানানো হ’লো কেন্দ্রীয় চরিত্র।গ্যলিলিও , জোয়ান যেখানে সুনির্দিষ্ট ও সার্বভৌম, সেখানে সৎ মানুষের সন্ধানে, আর্তুরো উই  ইতিহাসে, শ্রেণি দ্বন্দ্বে একাকার, চরিত্রগুলো সম্পাদিত সমাজ বাস্তবতায় বিমূর্ত।দর্শক এখানে আমোদিত, ভাবিত নয়।

বার্লিনে ফিরে বিশাল এন্সাম্বলে শুধু যে চরিত্রদের নির্দেশনা দিতে শুরু করলো তাই নয়, দর্শকদেরও নির্দেশনা দিতে শুরু করলো ব্রেশট।একই এন্সাম্বল গর্কির “মা”  মঞ্চায়ন করলো পার্টি লাইনের ধ্বজা উড়িয়ে।ব্রেশটের বিজ়ুক্তিকরন এক্কেবারে উধাও।বার্লিনে ফেরবার পর থেকে ব্রেশট পার্টির সভ্য না হয়েও অত্যন্ত বিশ্বস্ত।আর এ-বিশ্বস্ততার বলি হ’ল তার নিজের এপিক থিয়েটার।

কি পাপের স্খালন করতে ব্রেখট তার এলিয়েনেশানকে বিসর্জন দিয়েছিল?পলপটি কমিউনিস্টরা কি তাকে বুঝিয়েছিল যে মধ্যবিত্তের জন্মরিন এভাবেই শোধ দিতে হবে।কি মর্মান্তিক!

হিটলারের ছায়ায় বানানো আর্তুরো উই এক মাস্তানের কাহিনী।এর মঞ্চায়নে ব্রেখট ধার করলো চার্লি চ্যাপলিনের কৌশল।চ্যাপলিন মত তার মঞ্চায়নেও হিটলারি চরিত্র এক ভাঁড়।বোঝবার উপায় নেই যে সর্বকালের নৃশংশতমো মারণযজ্ঞের  হোতা হচ্ছে হিটলার।রবার্তো বেনিনি বা পোলান্সকি যা পেরেছে চ্যাপলিনকে অনুসরণ করতে গিয়ে তাতে ব্যর্থ হ’লো ব্রেশট।কিন্তু ঐ দায়বধ্বতা যে ও সহজে নেয় নি তার প্রমাণ মেলে এক দর্শনার্থীকে বলা ওর কথায়: ''থিয়েটার করি মজা লাগে বলে।এ-থেকে সমাজের বদল হবে কি হবে না , ভাবি না।'' ব্রেশটকে ঘিরে ততদিনে বার্লিনার এন্সাম্বল বিশ্বের সবচেয়ে বড় থিয়েটার প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।

ব্রেশটের স্ববিরোধী নিঃস্পৃহতা কি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আদর্শায়িত আরশির ফাটল ধরতে পেরে সৃজনশীল মননের চাপা দীর্ঘশ্বাস?সার্ত্রের Morts Sans Sepulture  নাটকে এক চরিত্রের প্রশ্ন: ''কাউকে পিটাতে পিটাতে শরীরের ভেতর হাড়গোড় ভেঙ্গে দিয়ে বিধ্বস্ত শরীরটার সামনে নির্যাতনকারী যদি নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দেয় জীবনের আর কি অর্থ থাকতে পারে?''

চয়ন খায়রুল হাবিব
লন্ডন জুন/২০০৮