কিম্বা কেতলি, পাশবাতি ও জ্যোতি'র মোজেজা!
পুরানো কেতলি আমার খুব ভাল লাগে।এখান সেখান থেকে কিনেও ফেলতাম।দেশ বদলে ব্রিটানিতে আসার সময় লন্ডনের এক গ্যারেজ ভাড়া করে অনেক কিছুর সাথে বহু বছর ধরে কেনা কেতলিগুলা রাখলাম যে মেয়ের মা পরে পৌছায় দিবে।গ্যারেজটার তালা ভেঙ্গে কে বা কাহারা কেতলিগুলা নিয়ে গেল।তারপর থেকে দেখি, কিনি না।
কেতলি আর চা এর বিবিধ বিচিত্রতা নিয়েতো Choyon's Tea House নামে একটা আলাদা ব্লগই বানায় ফেলছিলাম।পুশকিন নিয়ে একবার উদ্বেলিত হয়েছিলাম সনেট নিয়ে খোড়াখুড়ির সময়, আরেকবার এই কেতলি এবং চা নিয়ে হুজ্জতির সময়।রাশিয়ান লেখকেরা, বিশেষ করে পুশকিনের চা এবং তাদের ঐতিহ্যবাহি কেতলি অর্থাৎ সামোভার ঘিরে যেই বর্ননা, তার নান্দনিকতা টিকে থাকবে যতদিন স্তন্যপায়ি মানুষ বিশ্বচরাচরে টিকে থাকবে!
আমার লেখা ও নির্দেশিত অপেরাধর্মি নাটক 'জুলেখা ট্রিলজি'র ইউসুফ চরিত্রের জুনাইদ যে ভাল আলোক পরিকল্পক এটা বুঝে আমার মাথায় প্রথম যেটা আসে, তা হলো, ওহ আলোটা জানে মানে টেক্সটা ভালো ধরতে পারবে।জুলেখা ট্রিলজির যে 'জুলেখার জেরা পর্ব' আমার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয়েছে তাতে জুনায়েদ ছাড়া, জুলেখা রুপি পারভিন পারু,বয়ানকারি শিশির রহমান যাতে আলোক প্রক্ষেপন ভালোমত ধরতে পারে, দৃশ্যায়ন এবং সংলাপ যাতে মিলেমিশে যেতে পারে তা নিয়ে আমি বেশ সাবধানি ছিলাম।বাংলাদেশে মঞ্চে কারিগরি মহড়ার সুযোগ খুব কম।এই ঘাটতিটুকু মাথায় নিয়ে কুশিলবদের প্রতি আমি টেক্সটে গুরুত্ব দিতে, টেক্সট প্রয়োগে আপোষহিন হতে জোর দেই।আলো আমার কাছে টেক্সট, টেক্সট আমার কাছে আলো।কিন্তু এগুলার ভেতর অপচয়টা কোথায়?অপচয়টা আসলে একটা আপেক্ষিক চিন্তা!কিভাবে?
ছেলে, যাকে জ্যোতিমনি ডাকি, ১৪ বছর আগে জন্মের প্রথম সপ্তাহ ( তার আগে হাসপাতালে মায়ের বিছানার পাশে আলাদা কটে) থেকে আলাদা ঘরে।তো জ্যোতিমনির ঘরটায় আমি বিভিন্ন মাপের ল্যাম্পের আর ডিমারের ব্যাবস্থা করি।ঘুমানোর সময়ও একটা আবছায়া প্রচ্ছন্ন পাশবাতি সবচেয়ে নিচের ডিমার পয়েন্টে জ্বালানো থাকতো।একটু গেরস্থালি প্লাস ঘরকন্যার পড়াশোনা করে নিলে এসবে বেশি খরচ হয় না।কিন্তু পড়াশোনায় তো আর শিশুমনের পুরাটা বোঝা যায় না।ছেলের মা প্যাটি আবার ধর্মাচারির মত সাইকোলজি ব্যাকগ্রাউন্ডের।আমার আলো মাপামাপি শিশু পরিচর্যাতে প্যাটির বেশ সায় ছিলো।জ্যোতিমনি যখন আধোবুলি থেকে পুরা বাক্য বলতে শুরু করলো, তখন এই আলোর বিচিত্রতায় রিএকশান কি আমাকে মাঝে মাঝে বলতো।একবার বল্লো, আলো আধারিতে আমাকে ইয়া বড় লাগে, মানে ছায়াগুলা, এটাতে ওর ভয়ও লাগে, মজাও লাগে।আমি ভাবলাম, খাইসে, এইটাতো সাইকোলজি ধর্মাবলম্বিকে জানাইলে আলো নিয়ে খেলা পুরা বন্ধ।আমি সুধালাম সেই ছোট্ট কুশিলব জ্যোতিমনিকে, ডার্লিং বয় তাইলে কি শুভরাত্রি বলে পুরা অন্ধকার করে দিব ?জ্যোতিমনি খুব সজোরে 'না' বল্লো এবং ঐ আলো মাপামাপির খেলা চলতেই থাকলো!তো এইখানেই বা অপচয়টা কি?
আরেকটু বলি?আমি তিনটা দেশে সম্যক যাপন জিবন কাটালাম।বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকে আশি অব্দি যারা লবন পানির ডিমারে আলোর কাজ করেছে, তারা বুঝবে life immitates art, art immitates life এর প্রকৃত অর্থ।আবার যারা যুক্ত্ররাজ্য থেকে ফ্রান্সে এসে বসবাস করতে পারছে, তারা শুধু এই জ্বালানি বা আলো ব্যাবহারের তারতম্য দিয়ে বুঝবে যে ইংল্যান্ড আসলে একটা সাজানো গুছানো তৃতিয় বিশ্বের দেশ।এখনো লন্ডনের এমন সব মহল্লা আছে যেখানে ইন্টারনেট চলে শামুক গতিতে বিদ্যুতের সঙ্কুলানের কারনে।ইংল্যান্ডে ঠিকঠাকমতো সব ঘরে বিচিত্র পাশবাতি জ্বালাতে হলে আপনাকে মোটামোটি ভাল আয় করতে হবে, কিম্বা প্রচুর বাচ্চা দেখায় ট্যাক্স বেনিফিট, সোশাল বেনিফিট নিতে হবে।ইংল্যান্ডের আনবিক বোমা, সাবমেরিন আছে কিন্তু আনবিক প্রযুক্তির শান্তিকালিন জ্বালানি ব্যাবহার নাই।এখন আছে কি না জানি না।থাকলেও তা সার্বজনিন কি না আমার জানা নাই।আমি যখন ছিলাম, তখন ছিল না, সেটাও বেশি দিন আগের কথা না।যাক, ফ্রান্স অনেক দিন ধরে আনবিক প্রযুক্তিকে সার্বজনিন জ্বালানির কাজে ব্যাবহার করে।ফলে ইন্টারনেট স্পিডসহ, গ্রামাঞ্চলেও রাস্তাঘাটে আলো অনেক বেশি।ব্রেক্সিটে কি বিলাতিদের ভেতর এই অন্ধকার দিকটাই উঠে আসলো?আবার বিলাতি বাংগালির শঠতা, মিথ্যাচার, স্নবারি নিয়ে গোলাম মুর্শিদ যা সব লিখেছেন, তার পিছনেও কি এই কম আলো?তবে ব্রিটিশের সাথে বাংগালির চা খাওয়ার অভিজাত্যে মিল আছে।ঐ যে বাংগালি শহুরে মধ্যবিত্তের বাড়িতে বা গ্রামে একটু অবস্থাপন্ন বাড়িতে ট্রেতে করে কেতলি, পাশে সুন্দর পোর্সেলিনের পেয়ালায় দুধ চা, পিরিচে ঝকঝকে চামচ!
বাক্লাভা সহযোগে ইস্তাম্বুলি চা পান |
ব্রিটিশ শ্রমজিবি শ্রেনির মানুষ চা খায় বড় মগে।ভারতিয় অভিবাসিদের যারা প্রথমে বিলাতে এসেছিল রেল বা ডক শ্রমিক হিশেবে, বাড়তি আয়ের জন্য তারা যখন তান্দুরি হাউস খোলা শুরু করলো এবং হাতে কাচা পাউন্ড পেলো, তারা কিন্তু অভ্যাসের দিক থেকে শ্রমজিবিদের ঐ বড় মগে চা খাওয়াই আয়ত্ত করে নিলো।এখন অবস্য বৃটিশ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তও সেই বড় মগেই চা খায়, তবে সবসময় না।যখন বিশেষ কেতা দিয়ে চা পরিবেশন করা হয় তাকে বলা হয় সালোন বা স্যালন টি সার্ভিং।সেটা পরিবেশন করা হয় বিশেষ টি কেক, জ্যাম দেয়া স্কোন, শশার স্লাইস দেয়া স্যান্ডউইচ সাথে।এর ভেতর আবার ব্রেকফাস্ট টি, হাই টি, নুন টি, ইভনিং টি এর সময়ের রকমফেরে কেতার ও সাথের খাবারের অদলবদল হয়।সালোন টি এর আদর্শ সময় দুপুরের খাবার ও রাতের খাবারের মাঝখানে সন্ধ্যা শুরু হয় হয় এরকম সময়।
মেফেয়ারে শ্যাম্পেইন বিক্রির ব্যাবসার ম্যানেজারি করবার সময় এই ব্যাপারগুলো আমাকে খুব খেয়াল রাখতে হতো।আবার তিন প্রজন্ম ব্রিটেনে থেকেও দুই প্রজন্ম রেস্টুরেন্ট চালায়ও অনেক উপমহাদেশিয় পরিবার কাপ/পেয়ালা/মগ শব্দের ভেতর যে কেতাকানুনের দুরস্ততা ও দুস্তরতা আছে সেটা শিখে উঠে নাই।গোলাম মুর্শিদ যে 'বিলাতে বাঙালি' লিখেছে তা ঐ কেতাকানুন না জানা বা কেতাকানুনের ভান করা বাঙ্গালির বয়ান।আমি কি মেফেয়ারে প্রথম এই কাপ ও মগের দুস্তরতা ও দুরস্ততা শিখলাম?না কি ব্রিটিশ রাজকিয় বিমান বাহিনিতে কাজ করা বাবার কাছে শিখলাম?না কি স্নাতোকোত্তর প্রথম দাদুরি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ থেকে শিখলাম?একটু খুটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে বাংলাদেশের, মুর্শিদাবাদের অভিজাত কেতাকানুনগুলো এসেছে অটোমান বা তুর্কি সাম্রাজ্য থেকে ভায়া দিল্লি।এটা দিল্লি, ইস্তাম্বুলে কিছুদিন থাকলে বোঝা যায়।আমরা বাঙ্গালিরা ব্রিটিশের আগে থেকে বলি পেয়ালা, পরে চায়ের পেয়ালা।তুর্কিদের হাতলওয়ালা কাচের পেয়ালার জায়গায় ব্রিটিশের সুত্রে আমরা পেলাম চিনাদের বানানো পোর্সেলিনের কাপ।
বিড়ালের কাজ ইদুর মারা।কেতলির আসল কাজ চা গরম রাখা।এখানে কেতাদুরস্থতা যোগ হতে পারে, তার সাথে ভান ভনিতাও যোগ হতে পারে।সে কেতাদুরস্থতা যত প্লাস্টিকের মত হবে, তার থেকে আসা ভানভনিতাও তত প্লাস্টিক, কস্মেটিক হবে।ব্রিটিশ লেবার যেরকম বড় মগে চা খায়, রাজস্থানের ছাদপিটানি কর্মজিবিনিও সেরকম বড় মগে চা খায়।সারাদিনের বেধড়ক ধকলের মাঝেমাঝে বড় মগের চায়ের চুমুক প্রানসঞ্জিবনিসম।আমার কেতাদুরস্থভাবে ইস্তাম্বুলিও ঘরানার, ব্রিটিশ ঘরানার, রাশিয়ান ঘরানার চাও ভাল লাগে, আবার বড় মগের চাও ভাল লাগে।শিত রাত্রে যখন লেখার ঘোরে লম্বা লম্বা টাইপে মজে যাই, তখন ভাল লাগে বড় মগে চা।
পুশকিন কি বড় মগে না কি পেয়ালায় চা খেত?ইতিহাস এবং পুশকিনের কালো চুল সাক্ষ্য দেয় যে তার মায়ের দিকের প্রপিতামহ রুশ অভিজাত জেনারেল আব্রাম পেত্রোভিচ গানিবাল ছিলো আফ্রিকার একজন কালো দাশ, যাকে ছেলেবেলায় আফ্রিকার ঘানা থেকে অপহরন করে তুরস্কের দাশবাজারে বিক্রি করা হয়েছিল এবং সেখান থেকে কেউ কিনে এনে রুশ সম্রাট পিটারকে উপহার দেয়।পিটার আব্রামকে নিজের দেবোত্তর সন্তান হিশেবে গ্রহন করে এবং সেভাবে বড় করে।আব্রামের পুর্বপুরুষ ঘানাতে চা পান করতো কি করতো না তা জানা যায় না।আব্রাম এবং পুশকিন যে অভিজাত কেতা বজায় রেখে চা পান করতো তা লেখা বাহুল্য।আবার পুশকিনের লেখার বিপুল জমিন বলে দেয় যে রাশিয়ার সেসময়কার সামন্ত সমাজের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ছিলেন এই কবি।সে সমাজের উচু ও নিচু উভয়তলায় চা খাওয়ার যে সমঝদারিত্ব তা ধরেছিলেন কাব্যধর্মি উপন্যাস 'ইউজিন, ওনেগিনে'।
ফ্রান্সের সাথে এই চা খাওয়ার তুলনাটা চলে না।এরা চা খায়, তবে মুলত কফিখোর।আবার আমি যেই বাংগাল দুধ দেয়া চায়ে অভ্যস্থ তা এখন আর ঢাকাই বেশির ভাগ বাসায় মেলে না, রাস্তার চায়ের দোকানগুলাতেও না বললে দুধ ছাড়া কড়া লিকার চা।আবার দুধ ইন্ডাস্ট্রির ঠিকুজি কুলুজির এহেন দুরবস্থা যে বাংলাদেশে সাহস করে দুধ দিতে বলাটাও হয়ে উঠেনা।ভারতে অবস্য এখনো দিল্লি থেকে হিমাচল ঘন দুধ দিয়ে বানানো চায়ের পরিবেশনের চল বজায় আছে।যাক ভাই, ফ্রান্সের ব্রিটানিতে আসার পর পাশবাতির আলোর রকমারির দিকে তাকায়ে, একবারও ল্যাপটপ ক্রাশ না করে, বাঙ্গাল চলে বাপ, ব্যাটায় চা পান করতে করতে তিনটা প্রকাশিত কবিতা সংগ্রহ, একটা নাট্য ট্রিলজির প্রথম দুই প্রকাশিত পর্ব এবং একটা ভদ্রসম্মত সাইজের প্রকাশিত প্রবন্ধ সংগ্রহ শেষ করলাম।এইটা কি আলোর অপচয়?
আমার আম্মার কবিতাকেন্দ্রিক লুলাবাই মনে পড়লে আম্মার সৌখিন মনের পরিচয় পাই।যুদ্ধবিদ্ধস্থ একটা দেশের বিমান সংস্থার স্বল্প আয়ের একজন মোটরযান প্রকৌশলি, যে কি না ছয় ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালাতে গিয়ে সেই সস্তার সত্তর দশকেও হিমসিম, তার পক্ষ্যেতো আর ওয়াজিবির বাইরে সৌখিনতার অবকাশ ছিলো না।নরম আলো বিশেষ করে হারিকেন, মোমবাতির আলোর সাথে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা কমবেশি সবাই পরিচিত।শবেবরাতে এবং রোজার মাসের সাতাশ রোজার দিন আম্মা আমাদের জমজ ভাইবোনকে কিছু খরচ দিতো প্রচুর মোমবাতি কিনতে।আমরা ভাইবোন ঢাকার আজিম্পুরের একতলা বাড়িটার প্রত্যাকটা জানালার কার্নিশে, বারান্দার প্রতিটা খুপরিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বাড়িটাকে করে তুলতাম আলোর জাহাজ, আর তার মাঝে দাড়িয়ে একের পর এক তারাবাতি জ্বলাতাম!তা নিয়ে লিখেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত 'আমার ওকাম্পো' কবিতা সিরিজে।পাশবাতির সৌখিনতা, বিচিত্র দেশে বিচিত্র কেতলির নয়নাভিরাম রুপে বিমোহিত হবার বিজ আমার ভিতরে বুনে দিয়েছিল, ছেলে জ্যোতিমনির নাম যার থেকে ধার করেছি, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সেই কিশোরি নববিবাহিত মেয়েটি যার নাম ছিলো জাহানারা বেগম, জ্যোতি।
চয়ন খায়রুল হাবিব
৬/১০/১৭
ব্রিটানি