Monday 20 February 2017

ফেব্রুয়ারির শরনার্থিসভা



ঘাস থেকে আকাশে শরতের বিশ্বায়নে শরণার্থীদের মেরুকরণে 
সিরিয়ান আফগান রোহিঙ্গাসহ যারা আসছে উন্নত যাপনের খোজে
সবার পেছনে একটা প্রকাশ্য এবং একটা গোপন রণাঙন''


ছেলের মা প্যাটি ধর্মাচারের মত শরনার্থিদের কল্যানে বিবিধভাবে কাজ করে।সিরিয়া, আফ্রিকার শরনার্থি নিয়ে বিভিন্ন সমিতির কাজেরও দিন, রাতের ঠিক নাই।ফ্রান্সের ভোটার পাব্লিক যত ইমিগ্রেন্ট ইস্যুতে ডান দিকে ঝুকে পড়ছে, তত এই শরনার্থি সেবকেরা আগামি নির্বাচনের আগে যতজনের কাগজপত্র ঠিক করে দেয়া যায়, তার সহায়তা দিতে মরিয়া ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সিরিয়ার শরনার্থিদের নিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে নান্দনিকতার সমস্ত শর্ত আদায় করে বাস্তবানুগ থেকে ভবিষ্যতবোধক কবিতা লিখেছি, ৬ বছর বয়সে ১৯৭১এ পাকিস্তানি মারনযজ্ঞের মুখে বাবামায়ের সাথে নিজের শরনার্থি হবার ঘটনা নিয়েও কবিতা লিখেছি।কবিতার ভেতর দিয়ে নিসন্দেহে অবচেতনের অন্ধকার ভিতিবোধটা পার হওয়া যায়।কিন্তু মুলধারার সমাজের চোখ ফেরানো নৈর্ব্যাক্তিকতার মুখে  শরনার্থিদের জন্য সরাসরি কাজ করাটা খুব কঠিন।

আমরা ফ্রান্সের যে পশ্চিম উপকুলে থাকি, সেখান অব্ধি যেসব শরনার্থি পৌছে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা অতিক্রম করে আশ্রয়, চিকিতসা, খোরপোস ভাতায় তারা মোটামোটি নিরাপদ।বেশির ভাগই আফ্রিকার।বাংলাদেশিদের কথা এই ভিড়ে অন্তত এদিকে শোনা যায় না।তবে এই ভিড়ে যে প্রচুর বাংলাদেশি মিশে আছে বোঝা যায়।প্যাটির কাছ থেকে এটা ওটা শুনি, টিভি, ইন্টারনেটে এটাওটা পড়ি।সাইপ্রাসে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে আসা বাংলাদেশের ছেলেগুলা যে পশ্চিম ইউরোপে ঢোকার জন্য তক্কে তক্কে থাকে তাও জানি।এখন প্যাটি বলছে ১৬ বছরের এক বাংলাদেশি ছেলেকে না কি ফরাসি পুলিশ হোটেলে রেখেছে, কাগজপত্র পরিক্ষা করছে ছেলেটি আসলেই ১৬ কি না?১৬ হলে ছেলেটি মাইনর প্রোটেকশান পাবে।এখন প্যাটি চাচ্ছে যে ছেলেটির সাথে আমি কথা বলি একটা মিটিং এ, ছেলেটি মেন্টালি আইসোলেটেড কি না বুঝতে ওদেরকে সহায়তা করি।আমি হাসতে, হাসতে বললাম, ছেলেটা গাজা খায় না কি জেনে নিতে, তাহলে কথাও হলো, গাজা সেবনও হলো।হাসতে, হাসতে এও জানালাম যে এদ্দুর এসে পড়ে যখন সরকারি খরচে হোটেলে থাকছে, তখন ওর জন্য দুশ্চিন্তিত না হওয়াই ভাল।

একটু পর মাতিসের দিকে চোখ গেল, নিরাপদে ঘরের কোনায় সোফায় এলিয়ে বই পড়ছে। ৩ বছর পর ১৬ হবে।তারপর ৭১ এ আমার বাবা, মায়ের চোখও মনে পড়লো।আমার ৬ বছর বয়সের মনে সেই অসহায় চোখজোড়া গেথে গিয়েছিল।আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, প্যাটি কোন ছেলেটির কথা বলছে।বাস স্টপেজে ছেলেটিকে দেখেছি।আমার নিজের ছেলে শুটকা।কিন্তু শরনার্থি ব্যাপারটা শুকনা, মোটার ব্যাপার না।বাস স্টপেজে ছেলেটির শুকনা ঠোট, শুকনা চোখ মনে পড়ছে।চুল অবশ্য ভাল করে ছাটা, জেল মাখানো।একটা অনিশ্চয়তা চোখে, মুখে।এই অনিশ্চয়তা আমি আমার ছেলে, মেয়ের চোখে কখনো দেখি নাই।কিছুদিন আগে বন্ধু তারিকের সাথে ওর ছেলে প্যারিসে এসেছিল।আমরা কি দাপটের সাথে প্যারিস ঘুরলাম।আমার সাথে ছিল মাতিস।নিশ্চয়তার ভেতরও ছেলেমেয়েরা দুক্ষ পায়, দুক্ষিত হয়, কিন্তু কথা বলার লোক পায়, কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করে।প্যাটি যেই কাজটি করছে, কাউকে পিটি না করে, প্যাট্রনাইজ না করে, তা করা কঠিন।

ভাষা আন্দোলনের মাসে দূর প্রতিচ্যে বিশ্ব শরনার্থিদের ভিড়ে মিশে যাওয়া একজন কিশোর বাঙ্গালির সাথে আমি কথা বলবো; কি নিয়ে বলবো? আসলে শুনবো।বাহাদুর ছেলতো বটেই সেসব ভামগুলোর তুলনায়, মা বাবা, শশুর, শাশুড়ির সাথে থেকে যেগুলো ফেসবুকে এখানে, ওখানে বারফট্টাই করে, বইমেলাতে কি কি সব কবিতা, গল্পের বই বের করে, যেগুলো ২০জন বন্ধুর গন্ডিও মানষিকভাবে অতিক্রম করতে পারে না।

মনে আছে ফ্রান্সের কিশোর দাবা চ্যাম্পিয়ান ফাহিমের কথা, বাবার সাথে যে ফ্রান্সে ঢুকেছিল অবৈধ অভিবাসি হিশেবে।কয়েক বছর আগে দাবা চ্যাম্পিয়ান হবার সুবাদে ফাহিমকে বাংলাদেশি সুধি মহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম নিজে রিপোর্টিং করে।সেবার আমার বন্ধুদের সাথে বাংলাদেশের দাবা লিজেন্ড, দাবা এসোসিয়েশানের সভাপতি নিয়াজের লেগে যায়, ফাহিমের খবরকে গুরুত্ব না দেয়ায়।নিয়াজ কিছুদিন আগে ওর ছেলের প্রিন্সটনে যাবার খবর দিয়েছে জাক করে।আমি হলেও জাক করতাম।নিজের ছেলেমেয়ে নিয়ে জাক করাটা অসাধারন কিছু নয়।কিন্তু রক্তমাংশে, সংস্কৃতিতে, ভাষায় কোন সম্পর্ক নেই এরকম কারো জন্য বিচলিত হওয়া এবং তার জন্য জান বাজি রেখে কাজ করাটা নিশ্চয় অসাধারন।

বাংলা ভাষার একটা বড় বাকবদল ঘটবে এই শরনার্থি ছেলেমেয়েদের অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে।একটা মনস্তাত্বিক বাকবদল ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে যার সাথে ঢাকা, কোলকাতার সংস্কৃতি, সাহিতের তেমন কোন সম্পর্ক নেই।আবার এই বাকবদলের আপাত সলজ্জতায়, দার্ঢতায় চরদখলের মারমুখো মরিয়া স্বভাবের সাথে নবান্নের যোগাযোগ যে আছে তা লেখা বাহুল্য।প্যাটিকে সালাম।

চয়ন খায়রুল হাবিব
একুশে ফেব্রুয়ারি/২০১৭
ব্রিটানি