Wednesday, 15 October 2025

গায়ত্রী স্পিভাকের অথেনটিক সাধু দর্শন!


Gayatry Chakravarty Spivak in Dhaka to attend Lalon festival.

এই লেখাটার পুরাটাই পলিটিকালি বেঠিক। বেঠিকের রসটা নৃতত্বের খটমটসহ ভালো বুঝতো আমার প্রয়াত অনুজ বন্ধু মাহবুব পিয়াল। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার পিয়াল ডারহামে নৃবিজ্ঞানে পি,এইচ,ডি করে আই,ইউ,বির সোশাল সাইন্সের ডিন হয়ে বিদেশের হোটেলে মরার আগে লোকগান নিয়ে এমন সব কাজ শুরু করেছিলো যে আমার বিশ্বাস হুট করে না মরলে আলাউদ্দিন খান, সচিন দেবের পর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার তৃতীয় এবং জাহাঙ্গীরনগরের প্রথম রিয়েল স্কলারের নামটা পেতো।

ব্রিটিশ আমলের মেট্রিক পাশ দেখতে গ্রাম ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। কুষ্টিয়াতে সার্কিট হাউস, গেস্ট হাউস, রিসোর্ট, মায় টেলি সেলসের লোকদের জন্য যে কয়েকটা এয়ার কন্ডিশন রুম সব দখল। জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পুলিশের এসপি কয়েক শ প্রোটকল আয়োজনের পাশাপাশি 'সাবল্টার্ন' টার্মটার আগা-মাথা বুঝার চেষ্টা করতেসে। গায়ত্রীর অবস্থা একেবারে ধ্বজভঙ্গ,  এখন ওনার ৮৩ বছর বয়স। তাকে নিয়ে এক সময় পড়াশোনা করা ফরহাদ মজহার, ফরিদা আখতারেরও বয়সের ভারে মাথা আউলায়ে গেসে। 

পৃথিবীর সর্বোত্তম সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের কারিশমা দিয়েও ওনার এমেরিকান, কলকাত্তাই এক্সেন্টের বাঙলা কারো বোঝা সম্ভব না। সবাই ভান করবে যে বুঝসে, আর সেই বুঝা নিয়া ওনার বলা ওহির ওপর আলোচনা করবে ফারুকীর ইউজুয়াল সাস্পেক্ট দঙ্গল। যদি গায়ত্রী এসবে রাজি হয়। লালন মেলাতে গায়ত্রী টেসে না গেলে হয়।

ফারুকী যেই বান্দা, ওনার সাইক নিয়ে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পেরেছি, উনি তামাসা করে ঢাকাই ভাষাতে যাকে বলে মজা নেন। আশি ঊর্ধ্ব একজনকে ক্লাব ক্লাসে চড়ায়ে লালন মেলার হুজ্জতিতে নিয়ে অথেনটিক সব ছবি তুলবেন, ফেসবুকে পোস্ট দিবেন, সংস্কৃতি, পররাষ্ট্রনীতির দুই পাখি যে এক ঢিলে কুপোকাত হলো তার ঘোষণা দিবেন। সব মিলায়ে কয়েক কোটি টাকার খরচ, তার উপরে আর কয়েক লাখ দিয়ে এয়ার এম্বুল্যান্সও রেখে দেয়া হলো।

আশির পর আমাদের দেহযন্ত্র, মাথার অনেক কিছু গড়বড় হয়ে যায়। অনেকে আলঝাইমার বা স্মৃতিভ্রংশতায় পতিত হয়ে এক পর্যায়ে কোথায় কি করতে হয় আউলায়ে ফেলে। অনেক আপাত ভদ্রলোক পুরাপুরি ছোটলোক বনে গিয়ে নেড়ি কুত্তার মত ঘেউ ঘেউ করে। আবার অনেক নেড়ি কুকুরের মত লোক সন্তের আচরণ করে। ট্রাম্পের আগের মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের পুরাপুরি এই অবস্থা নয়া হলেও কাছাকাছি চলে আসছিলো। ক্লিন্ট ইস্ট-উড এই অবস্থা বুঝতে পেরে ৭/২৪ সুশ্রুসা এবং সঙ্গ  পেতে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেছে। কোভিডের সময় মারা গেলেন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মৃত্যুর পর পর দেখি বেশ কয়েক জন ওনার ৫ ভাগের এক ভাগ বয়সী পোস্ট করে বসে আছেন, উনি কি ভালও ছিলেন, প্রায়ই ফোন করে ব্যক্তিগত কথা অকপটে বলে যেতেন। মানে বিশ্বব্যাপী কপালকুণ্ডলা ক্লাস। 

এখন দেখা যাক, আমাদের আলোচ্য ক্ষেপী গায়ত্রীর নাট, বলটু আশির কোঠায় পৌঁছানোর সময় কি পরিস্থিতিতে আছে?   

২০১৮ সালের মে মাসে, স্পিভাক নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে (NYU) একটি যৌথ চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠিটি ছিল স্পিভাকের সহকর্মী আভিতাল রোনেল-কে সমর্থন জানাতে, যাকে NYU-র এক গ্র্যাজুয়েট ছাত্র নিমরোদ রাইটম্যান যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন। স্পিভাক ও অন্যান্য স্বাক্ষরকারীরা মামলাটিকে রোনেলের জন্য একটি “আইনি দুঃস্বপ্ন” বলে অভিহিত করেন এবং রাইটম্যানের বিরুদ্ধে “বিদ্বেষমূলক প্রচারণা” চালানোর অভিযোগ আনেন। চিঠিতে আরও বলা হয়, রোনেলের গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক অবদানের কারণে তাকে ক্ষমা করা উচিত। অনেক স্বাক্ষরকারী উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে নারীবাদী হাতিয়ার, যেমন Title IX আইন, নারীবাদীদের আক্রমণে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ চিঠির প্রধান স্বাক্ষরকারী ছিলেন জুডিথ বাটলার; পরে তিনি চিঠির কিছু দিক নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত NYU রোনেলকে যৌন হয়রানির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এবং এক বছরের জন্য তাকে বরখাস্ত করে।

২০২৪ সালের মে মাসে, স্পিভাক আরেকটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। নয়াদিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে আলোচনার সময়, দলিত গবেষক ছাত্র অংশুল কুমার তাকে প্রশ্ন করলে, স্পিভাক বারবার তার উচ্চারণ শুধরে দেন। এ ঘটনা নিয়ে অংশুল কুমার এক দলিত ব্লগে লেখেন যে তিনি অপমানিত ও হেয় বোধ করেছেন। পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে স্পিভাক মন্তব্য করেন যে অংশুল কুমার নিজেকে “দলিত” হিসেবে পরিচয় দেননি। এ প্রসঙ্গে দলিত পণ্ডিত অনিল-কুমার পেয়াপ্পিলি বিজয়ন বলেন, ছাত্রের প্রতিক্রিয়া হলো “প্রতি-আক্রমণের কৌশল”—যে “গঠনমূলক সহিংসতা” উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী চিন্তাধারার ভিতের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, এবং যেখান থেকে স্পিভাকের মতো উচ্চবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা নিরাপদে অবস্থান করছেন।''

দলিত পণ্ডিত অনিল-কুমার পেয়াপ্পিলি বিজয়নের খটমট ভাষা দেখেন। এসব ভাষা বলে দেয় কেন সেলিম আল দীন, আবদুল্লাহ আল মামুন নাটক লিখতে পেরেছেন, কিন্তু নাটকের এত কিছু জেনেও সৈয়দ জামিল আহমেদ একটি নাটকও লিখতে পারেন নাই। একাডেমিক স্কলারের মত বাক্সবন্দী মগজ দুনিয়াতে আর কোনো কিছু নাই। এরা যত পড়ে, যত জানে তত একটা বাক্সে, আরেকটা বাক্স ঢুকতে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে। 

সাহিত্যিকের মগজ একেবারে উলটা, সে প্রথমত বাক্সটা তৈরি হতে দেয় না। এই বাক্সবন্দি লেখার জন্য আমার কখনো এডওয়ার্ড সাইদ, চমস্কিদের কোনো বয়ান ভালো লাগে নাই। তবে কয়েক কোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক শ কোটি স্নাতকোত্তর আছে, যাদের কাছে বাক্সবন্দীত্বের ভাষা হচ্ছে যাপনের চিচিং ফাঁক, মানে ভ্রান্তিবিলাসি চিচিং ফাঁক। 'রাষ্ট্রচিন্তা' ক্লাসের ছেলেমেয়েদের হাতে আমাদের অবস্থা দেখেন।

গায়ত্রীর জেনারেশানে গায়ত্রীর প্রেমে কাতর বিনয় মজুমদারও এই বাক্সবন্দী বা এরেস্টেড মানসিকতার ভাষাতে অনেক কবিতা লিখেছেন এবং দাবি করেছেন যে এই বাক্সবন্দীতে উপনীত হয়েছেন সচেতনভাবে জীবনানন্দকে অনুকরণ করতে গিয়ে। বিনয় এরকম ভ্রান্তিবিলাসে চলে গেছিলেন, যে গায়ত্রীর সাথে জীবনে দেখা, কথা হয় নাই, তাকে নিয়ে অজস্র কল্পিত কবিতা লিখেছেন। 

বিনয়ের সাথে গায়ত্রীর দেখা হলে কি হতো? অনুমান করি, নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশুল কুমারের সাথে যা হয়েছে, তাই হতো। গণিত নিয়ে লেখা বিনয়ের বই স্কুল পাঠ্য, কিন্তু উচ্চ বর্ণের গরিমায় ডুবে যাওয়া গায়ত্রীর পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব হতো না যর বিনয় মজুমদার নিম্নবর্ণের হিন্দু। সোজা কথা ছোটলোক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক জাতপাত নিয়ে ছোঁয়াচ করেন এবং খটমট ভাষায় লিখে বলেন একেবারে উলটো কথা।

আমার পাঠে, দেখায়, মেশায় পশ্চিম বঙ্গের নাট্যকার বাদল সরকার গায়ত্রী ধরণের লোকদের এবং একাডেমিকদের এসব ভণ্ডামি খুব ভালো বুঝেছিলেন। আর্কিটেক্ট হিসেবে অনেক আয়ের পর, উনি বুড়ো বয়সে নাটক নিয়ে পড়ে-শুনে নাটক লিখতে শুরু করেন, অভিনয় করতে শুরু করেন। ওনার নাটকের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো গায়ত্রীদের চিন্তাভাবনার যে বাক্স-বন্দিত্ব এসেছে হাজার বছরের বর্ণবাদ থেকে এবং যার পঙ্কিলতায় এমন কি পশ্চিম বঙ্গের কমিউনিজমও কমিউনাল হয়ে গেছে, তার মূলে আঘাত। 

বাদল সরকার নাটকে যা করেছেন, উপন্যাসের পটভূমিতে তা করেছেন মহাশ্বেতা দেবী। গায়ত্রী মহাশ্বেতাকে নিয়ে লিখেছেন, সেখানে অংশুল কুমারের মত ভুল শোধরাতে বসেন নাই। তবে এমেরিকাতে থাকতে থাকতে বুঝেছিলেন যে আদিবাসীদের নিয়ে মহাশ্বেতার জগত পশ্চিমের একাডেমিয়া খাবে ভালো। তবে যে দুর্বোধ্য গদ্যে মহাশ্বেতাকে আলোচনা করেছেন, তাতে ওনার পাঠকেরা মহাশ্বেতা কতটুকু পাবে, তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। 

গায়ত্রীর ভাষার জটিলতা নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, সমালোচক টেরি ইগলটন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন—

''যদি উপনিবেশিক সমাজগুলো স্পিভাকের ভাষায় “বারবার ব্যাহত হওয়া, সময়কে ছিঁড়ে ফেলার এমন এক পুনরাবৃত্তি, যা আর জোড়া লাগানো যায় না”—এর ভেতর দিয়ে যায়, তবে তার নিজের লেখাও অনেকটা সেই রকম—অতিরিক্ত ভরাট, অতি-সংকেত-পূর্ণ ও জটিল। স্পিভাক নিজেই তার লেখার এই ভাঙাচোরা কাঠামোকে ব্যাখ্যা করেন প্রচলিত একাডেমিক বা সমালোচনামূলক ধারা থেকে বিদ্রোহী এক প্রস্থান হিসেবে। কিন্তু এই অস্পষ্টতা, ভারী জার্গন, পাঠককে ধরে নেওয়া যে তিনি বুঝবেনই, আর না বুঝলেও তাতে লেখকের বিশেষ কিছু আসে যায় না—এসব আসলে এক প্রকার একাডেমিক গোষ্ঠীর আড়ম্বর।

নব্বই দশকে যখন প্রথম বিলাতে আসি, ইংরেজ ভাষীদের ভেতর বাঙলা সাহিত্যে দিকপাল উইলিয়াম রাদিচের কাছে যেতাম। একেবারেই গরিবি অবস্থা আমার, লম্বাটে ঘোড়ামুখো শালপ্রাংশু রাদিচের পাশে আমার সিড়িঙ্গে ছয় ফুটি অবয়ব মিলায়ে আমার কাছে মনে হতো ফ্যাগিন এবং অলিভার টুইস্ট। রাদিচে কি বুঝেছিলেন, কে জানে, স্নেহ-বশত আমাকে কয়েক বাঃর একাডেমিক সেমিনারে নিয়ে গেছেন, আর তার কয়েকটাতে গায়ত্রী মুগ্ধ জটিল, বিপ্লবীদের সাথে কথা হয়েছে। একবার শুনলাম এরকম একজন মাঝ-বয়সী একাডেমিক, বাংলাদেশি নারী তসলিমা নাসরিনের কড়া বিরোধিতা করছেন। পরে অবশ্য এরা ট্র্যাক বদলেছিলো। 

রাদিচে আমাকে সোয়াসে পি,এইচ,ডির আমন্ত্রণ জানালে, এদের সাথে কয়েক বছর মিশতে হবে, এই আতঙ্কে সে দিকে পা না বাড়িয়ে বাসন, কোসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। লন্ডন ভিত্তিক এক ইন্টেরিওর ডিজাইন ম্যাগের এডিটর হিসেবে কন্যা এলিসের লেখালেখি যখন পড়ি, তখন মনে হয় গায়ত্রীর জটিল লেখালেখি নয়া পড়েও একজন তার জীবনের নিশানা ঠিক করে নিতে পারে। 

মহাশ্বেতা দেবীর কাজ নিয়ে লেখার পাশাপাশি গায়ত্রী  আলজেরীয়, ফরাসি দার্শনিক দেরিদা, কঙ্গোর ফরাসি ভাষী কবি এইমে সেজারের অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে। বইয়ের  দোকানে কয়েক পৃষ্ঠা উলটে সেগুলো পুরো পড়তে, সংগ্রহ করতে ইচ্ছে করে নাই। যার লেখালেখি অনেক বিজ্ঞের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে, আমার মতো অজ্ঞের পড়তে ইচ্ছে করে নাই, তাকে ক্লাব ক্লাসে চড়িয়ে বিভিন্ন লালন মেলাতে নিয়ে যাবার বহু ফারুকী আছে। ফারুকী বুঝুক, না বুঝুক ঢাকাতে গায়ত্রী, গ্রামসির ককটেল বুজুর্গ অনেকে আছেন। 

গায়ত্রীর "Can the Subaltern Speak?" (1988), রচনাটি নব্বই দশকের শুরুতে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলো রাদিচের পরিচয় করিয়ে দেয়া দঙ্গলটি। কোথায় য্যানো গায়ত্রীর লেখা এবং পুরো দংগলটিকে মেকি মনে হয়েছিলো। মাঝ নব্বইতে যখন সাইকোলজি পড়ুয়া ফরাসিনী প্যাট্রিসিয়ার সাথে দেখা হলো, ফিলসফি ব্যাপারটা ফরাসি স্কুল, কলেজে কিভাবে পড়ানো হয়, জানতে পারলাম। মূলত জগতকে সহজভাবে বুঝতে সেখানে বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন কালের দার্শনিকের লেখা স্কুলে, কলেজে পড়ানো হয়। প্যাটির কাছ থেকে পাওয়া ইংরেজ, নিউরোলজিস্ট অলিভার স্যাক্সের লেখা খুব ভালো লেগে গেলো। দেখলাম এই লোক নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকারদের প্রিয় লেখক, মনস্তত্ব, সমাজতত্বের জটিল জারগনকে কি সহজে ভেঙ্গে দিয়েছেন। 

গায়ত্রীর সেই একটা রচনা পড়ে তার দিক থেকে যে ঠিক মুখ ফিরায়ে নিলাম, তা নয়। অলিভার স্যাক্সের নিউরোলজি দেখার প্রক্রিয়া ভেঙ্গে যেরকম পিটার ব্রুক নাটক করেছে, সে জায়গা থেকে গায়ত্রী এবং বিনয়কে নিয়ে কিছু লেখা ব্লগে প্রকাশ করেছিলাম। 

আমার কাছে রান্না করতে এবং কোন ওয়াইন কি খাবারের সাথে যায়, তা চেখে বুঝতে ভালো লাগে। এসব নিয়ে আমার পেশাগত কোর্স আছে। ওয়াইনে একটা টার্ম আছে কর্কিং। যেখানে অনেক ভিন্টেজ ওয়াইনের কর্ক গুড়ো হয়ে ওয়াইনে মিশে যায়। তা তখন পান করা ঠিক নয়। এটা হতে পারে কর্কের মান খারাপ হবার জন্য। আবার হতে পারে, যে ওয়াইন ভিন্টেজের উপযুক্ত নয়, বেহুদা তাকে বছরের পর বছর রেখে দেয়া হয়েছে। 

গায়ত্রীর লেখা আমি যদ্দুর পড়েছি, তাতে আমার এই কর্কিং মনে পড়েছে। এটা শুধু ওনার লেখালেখি নয়। এই কর্কিং ভিন্টেজের এক বিপুল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে, দুনিয়া জুড়ে, যা বলে যে এটা অংশুল কুমারদের নিয়ে লেখা, কিন্তু যা অংশুল কুমারদের হেয় করে। আবার এই একই লেখাকে সন্ত্রাসবাদী এবং সন্ত্রাসবাদের শিকার দুজনে ব্যাবহার করতে পারবে নিজেদের পক্ষের বলে। এই দ্বিচারিতা ভয়ঙ্কর। 

ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী ফাবিয়ান বার্নার্ড শ দের প্রতিষ্ঠিত নিউ স্টেটসম্যান-এ স্টিফেন হাও অভিযোগ করেছিলেন—

“স্পিভাক এতটাই বিভ্রান্তিকর-ভাবে বৈচিত্র্যময়, এত ভিন্ন ভিন্ন ধারণা একসাথে জুড়ে দেন অথচ কোনো মিল বা সামঞ্জস্য করেন না, যে কোনো বিষয়ে তাঁর একটি সুসংগত অবস্থান নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব।”

নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪সালে দলিত গবেষক অংশুল কুমারকে গায়ত্রীর অপদস্থ করবার ঘটনাটিকে পিছিয়ে আমরা চলে  যাই ১৯৮৬ সালে বিহার, পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তে ঝাড়খণ্ডের একটি গ্রামে। এখানে কিছু দিন গায়ত্রী ভুমীহীন, নিরক্ষর, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কাজের ধরণ ছিলো NGO কাঠামো-ভিত্তিক। তার নিজের বয়ানে, এ কাজের মাধ্যমে তিনি ব্যাবহারিক কাজের সাথে উঁচু মানের তত্বের পার্থক্য বুঝতে চাইছিলেন। আমার পর্যবেক্ষণে বলে, তিনি তা বুঝতে পারেন নাই। এর দু বছর পর তিনি প্রকাশ করেন, "Can the Subaltern Speak?"। 

ফিলিস্তিনি এমেরিকান এডওয়ার্ড সাইদ গায়ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশ্ব জুড়ে NGO মহলে ওনার হাঁক ডাক। ফেসবুকে 'জুলেখা সিরাপ মেটাভার্স' গ্রুপে একটি লম্বা লেখাতে তৃণা রাব্বানি গায়ত্রী স্পিভাকের ছবির পাশে সেঁটেছেন মৃত্যদন্ডে দণ্ডিত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি, কুমিল্লা সামরিক নিবাসে ধর্ষণ এবং হত্যাকন্ডের শিকার সোহাগী জাহান তনু এবং ডাকসুতে নব নির্বাচিত মুক্তিযুদ্ধ সচিব তাসনিম জুমার ছবি। তৃণার দীর্ঘ লেখাটির শিরোনাম,  'বিধিবাম এবং বানরের পিঠা ভাগ : জামাত কোথায় আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মত'। পড়ে নাট-শেলে যা বুঝেছি, তৃণা বলতে চাইছেন, গায়ত্রী এবং ওনার স্বাগতিকদের কেউ মিন্নি, তনু, জুমার প্রতিনিধিত্ব করে না।      

কিছু সংস্কৃতিতে পেঁচার ডাককে সতর্কবার্তা হিসেবে ধরা হয়, আবার কিছু সংস্কৃতিতে তা আত্মিক সুরক্ষার প্রতীক মনে করা হয়। কোথাও কোথাও ইতিহাসে পেঁচাকে মৃত্যু বা মৃত্যুর পরের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ আধ্যাত্মিক ধারণায় পেঁচা আসলে মৃত্যুর প্রতীক নয়, বরং পরিবর্তন ও রূপান্তরের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।

লালন কিন্তু আমাদের বাঙালিদের একজন আবশ্যিক পেঁচক। আমার বিশ্বাস মৃত্যুর ওপার থেকে লালন যেরকম, তার প্রকৃত অনুসারীরাও বুঝতে পারবে, কে আসল পেঁচা, কে নকল পেঁচা।  


চয়ন খায়রুল হাবিব

১৬/১০/২৫

ব্রিটানি, ফ্রান্স