Sunday 5 March 2023

গফরগাঁও ডেটলাইন : নকশী কাঁথার মাঠে, স্লোপ আর্টে

স্লোপ আর্ট ম্যুরাল, শিল্পী রুহুল আমিন কাজল।ধামাইল, গফরগাঁও, এশিয়ান হাইওয়ে।
ফটো, লেখক।

গৌরচন্দ্রিকা  

''কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো,
ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো!''*
'মৈমনসিংহ গীতিকার' সংগ্রাহক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের কথায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজ সঙ্গীত সংগ্রহ করতে জসীমউদ্দীন গফরগাঁওয়ে এসেছিলেন৷ সেখানে কবি তার সাহিত্যচর্চার অন্যতম সঙ্গী খ্যাতনামা সাহিত্যিক মৌলভী শেখ আবদুল জব্বারের বনগাঁও গ্রামের বাড়িতে ওঠেন৷ এখানে অবস্থানকালে বনগাঁও গ্রামে জমির ধান কাটা নিয়ে একদিন বড় ধরনের এক দাঙ্গা (স্থানীয় ভাষায় কাইজ্জা) হয়৷ সেই দাঙ্গায় গফরগাঁওয়ের লাঠিয়াল দলের নেতৃত্ব দেন শিলাসী গ্রামের হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের, কালো রঙের যুবক রূপা৷ পল্লীকবি সে-দাঙ্গায় দেখতে পান গ্রামাঞ্চলে জমি দখলের নারকীয়, জীবন্ত মঞ্চে নেতৃত্বদানকারী রূপার তেজোদীপ্ত, ভয়ঙ্কর বীরত্ব৷ ওই দাঙ্গাই 'নকশী কাঁথার' মাঠ মহাকাব্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে৷

গফরগাঁওয়ে স্বাগতম।শিল্পী রা, কাজলের সাথে।ফটো, ইব্রাহিম।

পাগারিয়া-শিলা ধরে ব্রক্ষপুত্র-গাঁথায়
''আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে |''*
'নকশী কাঁথার মাঠ'  ১৯২৯সালে প্রকাশিত হবার ৯৪ বছর পর ২০২৩ সালে ফাল্গুনের এক বিকেলে, ডেনমার্ক নিবাসী শিল্পী অগ্রজ রুহুল আমিন কাজলের সাথে এসে বসলাম গফরগাঁও মশাখালী ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শির্নকায়া শিলা নদী তীরে। একটু দূরে দ্বারকানাথ মিত্রের দাহমন্দীরের বট গজানো ভগ্নস্তুপ, যার জন্মৃ, ১২৫০ বাংলা সালের কার্তিকে, মৃত্যু ১৩২৬সালের চৈত্রে।

পাগারিয়া-শিলা নদী ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নে প্রবহমান সুতিয়া নদী থেকে বের হয়ে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলাতে মশাখালী ছুঁয়ে নিগাইর ইউনিয়নের ত্রিমোহনী পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে পুনরায় সুতিয়া নদীতে পড়েছে। প্রবাহপথে নদীটি সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে বাড়েরা নামে, ভাবখালি ইউনিয়ন এবং ত্রিশাল উপজেলার সীমানা পর্যন্ত পাগারিয়া নদী নামে এবং গফরগাঁও উপজেলায় শিলা নদী নামে পরিচিত। সুতিয়া নদীটি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে বের হয়ে এসেছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের কাছে জিমা ইয়ংজং হিমবাহে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। ব্রক্ষপুত্রের হাজার পুত্রকন্যার একজন হলো সুতিয়া,  শিলা হচ্ছে নাতনি!

গতিপথ বদলে ফেলার কারণে ব্রক্ষপুত্র কোথাও আদি-ব্রক্ষপুত্র, কোথাও পুরাতন, কোথাও মরা-ব্রক্ষপুত্র বলে পরিচিত। ব্রহ্মপুত্র  তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে জামালপুর ও ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছে। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদ এর তলদেশ‌ উত্থিত হ‌ওয়ায় এর গতিপথ বদলে  যায়।


শিলা নদী, ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।
ফটো, লেখক।
বর্ষাকালে শিলা নদী প্লাবিত হয়। শুকনো মৌসুমে স্থানীয় লোকেরা নদীতে আড়াআড়িভাবে মাটির বাঁধ দিয়ে পানি আটকে সেচের কাজে ব্যবহার করে। এখন লোকজন নদীর পাড় ভরাট করায় এর প্রশস্ততা দিন দিন কমে আসছে। এছাড়া পলির প্রভাবে তলদেশ ভরাট হওয়ায় অতীতের তুলনায় পানির প্রবহমানতা কমে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশের মানুষের সুখদুখের গল্পগাঁথা, কিচ্ছা, জারিগান, চিত্রপট, এমনকি পুরাণের আখ্যান নদী বিধৌত। কালিকা পুরাণে আছে, আসামের পূব দিকে মিসিমি পাহাড়ের চুড়ায় ব্রহ্মকুণ্ড নামে একটি কুণ্ড আছে৷ এটি হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ৷ এই ব্রহ্মকুণ্ডে পরশুরাম পাপ থেকে উদ্ধার পান, অর্থাৎ এখানে তার হাত থেকে কুঠারটি খসে পড়ায় তিনি এর মহিমা দেখে অন্যের উপকারার্থে পারটি কাটিয়ে দেন ৷ ফলত এর জল দেশ-দেশান্তরে যায়৷ পরিতাপের বিষয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশে শুধু নগরে নয়, গ্রামেও এখন বেশির ভাগ মানুষ সাঁতার জানে না। শিল্পী কাজল আমাকে তার নয় বছরের এক চাচাতো বোনের পুকুরে পিছলে ডুবে মৃত্যুর করুন কাহিনী জানিয়েছিলেন। তিনি ও তার ডেনিশ স্ত্রী লিস মশাখালীতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চান, যার শিক্ষা কর্মসূচিতে সাঁতার শেখা অন্তর্ভুক্ত হবে।


ব্রক্ষপুত্রের গল্প আমাকে বার বার টানে। হাজার বছর ধরে, ব্রক্ষপুত্র পারে হাজারো রুপাই ফসল ফলায়, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাধায়, সাজুদের প্রেমে কাতর হয়। ব্রক্ষপুত্রের গতি বদলের মত গানের সুর, শিল্প- সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি বদলায়। ২০২৩সালের ফেব্রুয়ারিতে মশাখালি ছোয়া ব্রক্ষপুত্রের নাতকুর শিলা নদী পারে বসে শিল্পী রা,কাজলের মুখে যেরকম একের পর এক তার শৈশব, কৈশোরের গল্প শুনছিলাম, আশির দশকে এগারোসিন্দুর ট্রেন ধরে সেরকম কবি রিফাত চৌধুরী ও আমি বার বার গেছি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চিরে বয়ে যাওয়া ব্রক্ষপুত্র পারে, তখন সেখানকার ছাত্র, সতীর্থ কাজল শাহনেওয়াজের কাছে। নিজেরাই হয়ে উঠেছিলাম নতুন গল্প, নতুন কবিতার রুপকার। 


মধ্যযুগে কিশোরগঞ্জ থেকে আমরা পেয়েছি 'মনসা মঙ্গলের' রচয়িতা বংশীদাস ভট্ট এবং তার মেয়ে বাংলা ভাষায় 'রামায়ন' রচয়িতা চন্দ্রাবতীকে। 'মৈমনসিংহ গীতিকার'  কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ 'চন্দ্রাবতী চরিতকথা' রচনা করেন। উপনিবেশিক আমলের শেষ বেলায় একই কিশোরগঞ্জের  নীরদ চন্দ্র চৌধুরী রচনা করেন 'আত্মঘাতী বাঙালি'। সত্তর দশকের  লিরিকাল কবি আবিদ আজাদও কিশোরগঞ্জের। বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে আমরা পেয়েছি রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মামুনুর রশিদ, তসলিমা নাসরিনের মতো শক্তিশালী লেখক, লেখিকাদের। আমার বড় ভাই, বাংলাদেশের প্রথম সুপারসনিক বৈমানিক শহীদ ফ্লাইট লেফটেনেট আইনুল হাবিব ৭০ দশকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ার সূত্রে, শৈশবে বাবার গাড়িতে প্রতি মাসে অন্তত একবার গেছি বংশাই নদী তীরের মির্জাপুরে। কেউ বলে বংশাই, কেউ বলে বংশী, এটা পুরাতন ব্রক্ষপুত্রের একটি শাখা নদী। নরসুন্দা তীরে কিশোরগঞ্জেও গেছি কয়েকবার, যে নরসুন্দাও এসেছে পুরাতন ব্রক্ষপুত্র থেকে। কংশ নদী পারের বারহাট্টাতে সময় কাটিয়েছি নির্মলেন্দু গূনের সান্নিধ্যে তার বাড়িতে। ব্রক্ষপুত্রের শাখা, প্রশাখা ঢুকে গেছে আমার কবিতার শিরা, উপশিরায়, হয়ে উঠেছে আমার 'নৈকট্যধাম'  : 

''পোড়ানি বাড়লে ব্রক্ষপুত্রে আসি

আমার মত এই নদেরও বৌ প্রবাসি''***


শিলা নদী তীরে 
দ্বারকানাথ মিত্রের দাহমন্দীর।
ফটো, লেখক।

গফরগাঁও, মশাখালী গ্রামে অবস্থানের সময় এক বিকেলে শিলা নদী পাড়ে বসে কাজলদার মুখে শুনলাম, ওনার শৈশবে ১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধ্বের সময়কালে সেই শিলা নদীর পাড়ে ঘটে যাওয়া এক মর্মন্তদ ঘটনা। কিশোর কাজলকে ওনার মা পাঠিয়েছেন দুধ আনতে। পথে বয়সে কিছু বড় কয়েক জন তরুনের সাথে ওনার দেখা। তখন গফফরগাঁওয়ের এখানে ওখানে পাক সেনারা ঘাটি গেড়েছে, সাথে পেয়েছে স্থানীয় রাজাকারদের। এরকম একটি দল বন্দুক উচিয়ে ওনাদের থামালো।

কালো পোষাকের রাজাকারদের কজন আসেপাশের গ্রামের, যাদের কারো কারো সাথে ঐ তরুণদের পরিবারের জমি সংক্রান্ত বিবাদ রয়েছে। রাজাকারদের একজন কাজলদাকে চিৎকার দিয়ে হটিয়ে দিলো, বাকিদের নিয়ে গেলো স্থানীয় ক্যাম্পে। দুধ নিয়ে ফেরার পথে, নদী তীরে জটলা দেখে এগিয়ে কিশোর কাজল শুনতে পেলো, ক্যাম্প থেকে ফেরত এনে শিলা নদী তীরে সার বেঁধে দাড় করিয়ে সাথের বন্দী তরুনদের হত্যা করা হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ঐ হত্যাযজ্ঞের মুখে অনেক দ্বারকানাথের অধস্তন শেষ সম্বল হাতে করে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেছিলেন।

ভুতের গলি থেকে তিস্তা এক্সপ্রেসে 

গফরগাঁওয়ের ধামাইলে এশিয়ান হাইওয়ের ঢাল ধরে করা রা, কাজলের স্লোপ আর্ট দেখতে যাবার আগের রাতটুকু কাটিয়েছিলাম ওনার ঢাকাস্থ ভুতের গলির ফ্ল্যাটে। সেটাও ইতিহাসের যাদুঘর! আশির দশকে ওনার প্রদর্শনীগুলোতে দেখা কিছু চিত্রকর্মের সাথে আমার প্রিয় কবিদের একজন ভবঘুরে সাবদার সিদ্দিকীর দুর্লভ পোট্রেট। এটাই সাবদারের জীবনকালীন একমাত্র আঁকা পোট্রেট। সে ইতিহাসের যাদুঘরের রেশ নিয়ে ফ্লাইওভারের জাল গলে, রাজধানীর ভোরবেলার দুর্লভ ফাকা রাস্তা ধরে সিএনজির চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা ধুলো মেশানো নরম বাতাসে কমলাপুর স্টেশনে এসে, তিস্তা এক্সপ্রেসে চড়ে দু ঘন্টার একটু বেশি সময়ে পৌছালাম গফরগাঁও। 

স্টেশনের কাছাকাছি ধামাইল চৌরাস্তার মোড় পেরোবার সময় দেখতে পেলাম ঢালে আকা সেই অপরুপ ম্যুরালটিকে। ট্রেনের ঝিকিঝিকি দোলুনির সাথে ফোনের ক্যামেরাতে ধরে রাখলাম বাংলার আবহমান কাঠের ব্লকে ছাপানো একটা লম্বা শাড়ির জমিনকে। সদ্য রোপা ধান খেতের সবুজাভ আবহে, খেতের গোড়ালি ডোবা পানির ঝিলিকে, চলন্ত ট্রেন থেকে দেখা ছড়ানো ম্যুরালের বিচিত্র রঙ, রেখা, অবয়বের আড়াল থেকে কয়েক হাজার সাজু, রুপাইর মোজাইক-মুখ কি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলো?

                                               তিস্তা এক্সপ্রেস থেকে দেখা।ভিডিও, লেখক।
 গফরগাঁওয়ে স্বাগতম 

গফরগাঁও স্টেশানে  শীত সকালের রোদের ঝলকানিতে আমাদের স্বাগত জানালো কাজলদার 'লোকজ সুন্দর' প্রকল্প  সহকারি, ত্রিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার স্নাতোকোত্তর সুমন ও কম্পিউটার সহযোগি ইব্রাহিম। গফরগাঁও লেখা স্টেশন সাইনবোর্ডের পাশে কিছু ছবি তুলে আমরা নাস্তা সারতে গিয়ে বসলাম কাছাকাছি রাজলক্ষী রেস্তোরায়। তেল ছাড়া পরোটা, ওমলেট ও চমচম সাবড়ে হাজির হলাম সুমন, ইব্রাহিমের আস্তানা সরকারি ডাক বাংলোতে। 

বিশাল ডাক বাংলোটি ৫ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, যার প্রভুত পৃষ্ঠপোষকতার ফলে 'লোকজ সুন্দর' প্রকল্প থেকে স্লোপ আর্ট বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। নতুন নির্মিত ঝকঝকে, তকতকে ডাক বাংলোতে, বিপুল এক মিলনায়তন, বিশাল কোরিডোরের পাঁশে বিশালতর খালি খালি হলঘর নিয়ে ভবনটি এক অর্থে ভুতের আড্ডাখানা, আর ভুতেরা রুপ নিয়েছে মশায়, ওপরের একটা সোফা জোড়া দেয়া বিছানায় বালিশ নাড়তেই হাজারো মশা একসাথে উড়ে এলো। 

তার পর গা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে পেলাম এক তলাতে কনফারেন্স রুমের পাশের ঘরে সুমন, ইব্রাহিমের শয়ন কক্ষ, এক কোনায় মেঝেতে আরামদায়ক তোশক পাতা, আরেক কোনায় শত শত রঙের ডিব্বার পাঁশে একটা গ্যাসের চুলো, আরেক কোনায় ওয়াশ রুম। কিছুক্ষন গড়িয়ে হাজির হলাম গফরগাঁও সরকারি কলেজে, উদ্যেশ্য কাজলদার কাছ থেকে শেখা শৈলীতে কলেজের বিভিন্ন অংশে সুমনের ম্যুরালগুলো দেখা।

বাম থেকে সুমন, অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, আমি, ইব্রাহিম,
সর্বডানে রা,কাজল।গফরগাঁও সরকারি কলেজে। 

গফরগাঁও সরকারি কলেজে ঢুকতে স্বাগত জানালো এক ঝাক সূর্যমুখী এবং ফুলে ফুলে ছাওয়া একটি পলাশ গাছ। যাত্রার সমস্ত ক্লান্তি জুড়িয়ে গেলো। একটু ঘু্রে বুঝলাম, এ-নান্দনিক পরিবেশের পেছনে নিশ্চিতভাবে কারো যত্নবান নির্দেশনা আছে। ঘোরাঘোরি করতেই দেখা হয়ে গেলো মিশুক অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদের সাথে। কাজলদা ও আমাকে দেখে উনি অত্যন্ত খুশি হলেন, ঘুরে ঘুরে কলেজ ক্যাম্পাসের শোভা বাড়াতে ওনার উদ্যোগের কথা জনালেন। ক্যাম্পাসের মূল ভবন ও মাঠ পেরিয়ে, মাঝারি আকারের পুকুরের পাড় ধরে ছাত্রীনিবাসের দেয়ালে দেখতে পেলাম সুমনের ম্যুরাল, ঘুরে ফিরে যেখানে ফুল, লতা, পাতার আবহে দেখা মিলছে এক পেচকের! বুঝলাম, রুহুল আমিন কাজলের স্লোপ আর্টের সুবাদে আবহমান নকশী কাঁথার মাঠ ছড়িয়ে পড়ছে গফরগাঁওএর জমিনে ও আচলে।

মহাশুন্যেতে উড়াল

সরকারি কলেজ থেকে বেরিয়ে অটো চড়ে রওনা দিলাম ধামাইলের দিকে, কাজলদার ম্যুরালে অবগাহন করতে। বেলা গড়িয়ে তখন অস্তাচলের গোধূলি খেলা করছে দিগন্তে। রোপা ধানের সবুজ ও খেতের রুপালি পানি মিলে তৈরি হয়েছে এক বর্ণালি স্বপ্নের আবেশ।যে পথের দু'পাশের ঢালে ম্যুরালের বিস্তার তাতে সরাসরি নয়া থেমে এক পাশের একটা চায়ের স্টলে বসলাম আমরা। আমি য্যানো মনের ক্যামেরার দৃষ্টিকোণগুলো ঠিক করে নিচ্ছি। স্মার্টফোনের ক্লিক ক্লিক চালালেও লুই মালের মতো বিষয় ও আমার মাঝামাঝি  ক্যামেরাটাকে অদৃশ্য করে ফেলছি। চায়ের দোকান থেকে ম্যুরালে আকা প্রতীক, অবয়ব, নক্সাগুলোর সাথে ভাবনাকে একাকার করে দিতে দিতে বুঝতে পারছিলাম, সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে, ম্যুরালটাই একটা ছড়ানো পালঙ্ক, একটা উড়ন্ত কার্পেট :
''কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে''*
ম্যুরাল থেকে শিল্পীর সাথে সূর্যাস্ত দেখা, 
সাথে লোকজ সুন্দর প্রকল্প সহযোগী সুমন।ফটো, ইব্রাহিম।

তার পর ধীরে ধীরে ম্যুরালটার মুখোমুখি হলাম । স্থানীয় তরুন দম্পতিদের একটা দঙ্গলকে দেখলাম ছবি তুলছে ম্যুরালটার ওপরে দাঁড়িয়ে, মোটর বাইক আরোহী কিছু তরুণকে দেখলাম আশেপাশে, সবাই তাদের গতি নিয়ে ম্যুরালটার আসেপাশে স্লথ হয়ে আসছে। কিম্বা আমি হয়তো কল্পনায় ঝুপ করে এক ঝাক বালি হাসের গোত্তা খাওয়া দেখলাম ম্যুরালটার এখানে ওখানে আকা হাসের আদলে। চাইকোভস্কি অনায়াসে এখানে 'সোয়ান লেক' ব্যালের মঞ্চায়ন করতে পারবে। এসব মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ম্যুরাল ছাড়িয়ে এবং ম্যুরালের  বিস্তারকে সাথে নিয়ে হাটতে থাকলাম ধানক্ষেতের আল ধরে। সে আবেশের রেশ ধরে আবার অটোতে চেপে, প্রবল ভাঙ্গা রাস্তায় তুমুল ঝাকুনি খেতে খেতে হাজির হলাম, কাজলদা ও ওনার ডেনিশ স্ত্রী লিজ রাসমুসেন কাজলের বাড়ি মশাখালী গ্রামে।

কিশোরী শারমিন।ফটো, লেখক।

সাজুর মায়ের লাউ শাক

টিনচালা বাড়িটা ঘিরে পুকুর, বিভিন্ন জাতের গাছের বাগান, আর যত দিকে চোখ যায় ধানক্ষেত। তার ভেতর দাড়ি, কমার মত এখানে ওখানে আরো আরো টিনচালা বাড়ি, খড়ের চিন, টং ঘর, মসজিদের মিনার, কোথাও আর পতিত জমি নেই। এত ধানক্ষেত, এত জমাটি সবুজ দেখে স্বস্তি না কি অস্বস্তিতে ভুগবো, এসব ভাবতে ভাবতে চলে এলো কাজলদার ভাইয়ের বৌয়ের হাতের রান্না। এই রান্নাতে যে ভাত, ডাল, চ্যাপার ভর্তা, লাউ শাক ভাজি, কখনো হাসের মাংস, তার সবকিছুতে পুষ্টির পাশাপাশি একটা স্বতন্ত্র-সুঘ্রান রয়েছে। একটু ঝালের দিকে হলেও সুঘ্রানের পরতগুলো মলিন হয় না। আটপৌরে স্বল্প ব্যাঞ্জন রন্ধন শিল্পের সমস্ত নন্দনকে আদায় করে নেয় কড়ায়গণ্ডায়। সে-রান্না বয়ে নিয়ে আসতো কাজলদার ভাসতি কিশোরী শারমিন। এর পর শারমিনকে দেখেছি এটা, ওটা করছে, বটি হাতে মাচা থেকে লাউ শাক কাটতে। মনে পড়ে গেছে সেই রুপাই আর সাজুকে!

''কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা,
তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।''*
'লোকজ সুন্দর' প্রকল্পের ব্যানারে ডেনমার্ক নিবাসি যে রুহুল আমিন কাজল তার পূর্বসুরীদের পীঠস্থান মশাখালী গ্রাম থেকে অল্প দূরে ধামাইল হাইওয়ের ঢালে বিস্তির্ন ম্যুরালটি করেছে, সে-কাজল এক অন্তস্থ ঘোরকে মূলত বহিরঙ্গে ছড়িয়ে দেয়। ৭০দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার ছাত্রাবস্থা থেকে একুশের আল্পনা আঁকাতে  অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। বাংলাদেশে আশির দশকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হলে, ডেনমার্ক থেকে যখনই এসেছেন তাতে অংশ নিয়েছেন। ইয়োরোপে অংশগ্রহন করেছেন বিভিন্ন গণ শিল্প বা পাবলিক আর্ট প্রকল্পে। ধামাইলে কাজ করবার সময় প্রচন্ড গরমে কঙ্ক্রিটের ঢালে দাড়ানোটা ছিলো একটা অগ্নিপরীক্ষা, তার ওপর দাঁড়িয়ে একের পর এক অবয়ব আগে থেকে তৈরি নক্সার ভিত্তিতে ফুটিয়ে তোলা ছিলো তপস্যার মত। সে-সময় উনি এবং সহযোগীরা কাজ শেষে ডেরা বেধেছেন কাছাকাছি এক বাসায়।

গ্রামের বাড়িতে সকালের নাস্তার
রুটি বেলছেন রা, কাজল।
ফটো, লেখক
মগ্ন চেতনা প্রবাহের আনন্দে

শিল্পী রা, কাজলের সাথে গফরগাঁওয়ে যাবার পেছনে আমার মূল উদ্যেশ্য ছিলো, ওনার চিন্তাকে কাজে প্রয়োগের রসায়নটি কাছ থেকে   দেখা। ওনার ম্যুরালতো আপাতত শেষ হয়েছে, তাতে আরো যোগ হবে এবং সে-সময়গুলোতে আমার ওখানে যাবার সম্ভাবনা কম। আমি কারো সাক্ষাৎকার নেই না। ম্যাঞ্চেস্টারে কবি বেলাল চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটি ছিলো ব্যাতিক্রম।সাক্ষাৎকারকে সর্বোতোভাবে একটি ফাকিবাজি মাধ্যম মনে হয়। তাহলে যার কাজ দেখতে আসলাম, তার চিন্তা ও প্রায়োগিক যোগসূত্র কিভাবে বের করবো? নাটক লেখাতে এবং মঞ্চে তা নির্দেশনাতে চরিত্রায়নে যে-প্রক্রিয়াটি অনুসরন করি, এখানেও তাই করলাম। অর্থাত চরিত্রটি খোলামঞ্চে মহড়া কিভাবে করে  মুক্ত পরিবেশে তা অবলোকন। জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিলকে ভাস্কর রদ্যার কাজ  ও যাপন এরকম একাগ্র অভিনিবেশে দেখতে দেখতে, দেখার সেই শক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন অপরাপর দৃষ্টিপাতে এবং চিড়িয়াখানার বন্দী বাঘকে নিয়ে লিখেছিলেন এক অবিস্মরনীয় কবিতা। শিল্পকর্মে, সঙ্গীতে, কবিতায় ফুটে উঠবার আগে আবেগের স্তরগুলোওতো আসলে বন্দী থাকে!
 

এক্ষেত্রে আমার বেগ পেতে হলো না, কারণ মশাখালী গ্রাম, শিলা নদী, ধামাইল, গফরগাঁও রুহুল আমিন কাজলের সহজাত মঞ্চ। এখানে তার কোনো প্রম্পটিং লাগে না এবং উনি তোড়ে কথা বলতে ভালোবাসেন, এতো বিভোর ভাবে কথা বলেন যে সেখানে ঢোকা অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন। কথার চেয়েও বেশি জানতে চাইছিলাম, যে হাত দিয়ে উনি পথে, ঘাটে এই ইমেজগুলো ফুটিয়ে তোলেন, সে হাতের সাথে ওনার মননের সম্পর্ক। 

আমরা যখন যাই, তখন বরইর মৌসুম, সকাল বেলা দেখতাম উনি পেছনের উঠানে গাছ থেকে পড়া বরই কুড়িয়ে খাচ্ছেন, কোনটাতে কাঠবেড়ালি বা পাখির ঠোকরের দাগ তা দেখছেন। সকালের নাস্তাতে ওনাকে দেখলাম বারন্দার কোনায় বানানো রান্নার জায়গাতে দাঁড়িয়ে আটার মন্ড করে রুটি বেলছেন, তা সেঁকছেন। সে বরইর সালাদ চেখে, সে রুটি খেয়ে  আমি ওনার মননের সাথে ওনার তুলির সম্পর্কটা বুঝে নিলাম! 

ক্যানভাসে, ভাস্কর্যে, পাবলিক মুর‍্যালে, বরই কুড়ানো-রুটি সেঁকা-রা,কাজলের প্রণোদনা আসে জান্তবভাবে মিশবার, পরিপার্শ্বের সাথে হাতে, কলমে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় থেকে, যা ওনার ভেতর মগ্ন চেতনা প্রবাহের বহুসচল জলপ্রপাতের মত উদ্ভাসিত হয়ে মননের চড়াই, উৎরাই পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গানের লিরিকে, ধানের শিষে, স্লোপ আর্টে, আনন্দলোকে। একই চেতনা প্রবাহের আনন্দ থেকে ছোটখাটো, পলকা গড়নের শিল্পী কাজল নিজের ধরণে গান বাধেন, সুর দেন এবং তা অন্যকে গেয়ে শোনান। ক্যানভাসে ও পাবলিক স্পেসে ওনার কাজগুলো একই সাথে সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা ও চিত্ররুপময়তা তৈরি করে। রঙয়ের ভেলাতে এ-সঙ্গীতের সাথে সখ্যতা করা যায়, এর চিত্ররুপময়তা ছুটন্ত রুপাইকে আদর করে ডেকে বসায়, অপেক্ষারত সাজুর মনে ছুটে বেরিয়ে পড়বার বেপরোয়া প্রশ্রয় জাগায়!

রুপবান যাত্রাপালায় 

রাজধানীর জটে ফেরার দিন ঘনিয়ে এলো। তার  আগের বিকেলে কাজলদার বাসায় দেখা করতে এলেন মশাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির ভাই। যাবার সময় সেদিন রাতে রুপবান যাত্রাপালার নিমন্ত্রণ জানালেন। মশাখালীর স্কুলের বাজারে মুখি শাহ মিসকিনের মাজার প্রাঙ্গণ সংলগ্ন মাঠে আয়োজন করা হয়েছে এই রাতব্যাপি পালার। চেয়ারম্যান মনিরকে চায়ের নেমন্তন্ন জানাতে কাজলদার উঠানে হাজির হলো গ্রামের কিছু বধু। তাদের সাথে স্বাচ্ছন্দ কথাবার্তায় এবং পরে যাত্রাপালার মহাভিড়েও মনির ভাইকে দেখলাম অনাবিল, আন্তরিক।

চেয়ারম্যান মনির সর্বডানে,
কাজলদা ও আমি রুপবানের সাথে।

রাত নটার দিকে আমাদের যাত্রাপালা প্রাঙ্গণে নিয়ে যেতে অটো নিয়ে এলো কাজলদার এক জ্ঞাতি ভাই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে, ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় এক্রোবেটিক করতে করতে এগিয়ে চলছে অটো। সামনের হেডলাইট ধানক্ষেতে, রাস্তায় আছড়ে পড়ছে হারিকেনের আলোর মত। ড্রাইভারকে পেয়ে বসলো গল্পে। এক কালভার্টের কাছাকাছি হতে সে বললো, ব্রিজের নিচে খালে কয়েক বছর আগে একটা বস্তায় পাওয়া গেছিলো একজনের কাটা হাত, পা, আর আরেক বস্তায় কল্লাকাটা মুখ। দূর গ্রামের যারা এই বীভৎস হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছিল, তাদের সবাই ধরা পড়েছিল কাটা মুখের চেহারা স্থানীয়রা চিনে ফেলায়। ব্রিজের কাছাকাছি হতে নিচের পানির দিকে তাকাতে আমার রীতিমত ভয় লাগছিলো, ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখি হালকা মোচের তলে সে মুচকি মুচকি হাসছে।

অবশেষে পৌছালাম শাহ মিসকিনের মাজার প্রাঙ্গণের মাঠে। সেখানে বিপুল শামিয়ানার নিচে চারপাশে তুমুল ভিড় নিয়ে মাঝখানে হেলোজেনের আলোতে উজ্জল যাত্রামঞ্চ। একস্টিকের জায়গা নিয়েছে শক্তিশালী এমপ্লিফায়ার বুমবক্স। মনির ভাই ওনার বক্তৃতার সময়  কাজলদা ও আমাকে দুই পাশে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। চেয়ারম্যনের আতিথ্যের সুবাদে যখন একেবারে সামনে বুমবক্সের সামনে বসানো হলো, প্রমাদ গুনলাম! এক কানে একেবারেই শুনি না, বাকি কানের পর্দাও বুঝি এবার গেলো।

প্রম্পটার ও রহিম বাদশা।
ফটো, লেখক।
পালা শুরু হতেই অধিকারী, প্রম্পটার একেবারে আমাদের সামনে হাজির। মেহেদি রাঙ্গানো চুলে, ক্লিন শেভ অধিকারী পরে আছে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট। তার খুব উত্তেজিত অবস্থা, কুশিলবদের সংলাপ ধরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত নন, অভিনয়ের সঙ্কেতও দিয়ে যাচ্ছিলেন হাত, পা দাপিয়ে।  রহিম বাদশা, জংলি সর্দারসহ একের পর এক চরিত্র মঞ্চে আসছে, প্রম্পটারের উত্তেজনা পৌছাচ্ছে চরমে। বাজিয়েরা তাদের ইলেক্ট্রিক বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাচ্ছে ভালোই, কিন্তু সাউন্ডের লোক লেভেলিং করতে না পারায়, তা হয়ে উঠেছে বিকট শব্দ। 

বেশ মজা পাচ্ছিলাম, কিন্তু বাদ সাধলো কান, আমার মাথা দপদপিয়ে উঠলে মনির ভাই, কাজল দা ও আমাকে নিয়ে গেলেন মঞ্চের পেছনে, মেকাপ রুমে, সেখানে বসে আমরা মূল মঞ্চের কিছুটা দেখতে পাচ্ছিলাম, আর উপভোগ করছিলাম মঞ্চের পেছনে আরেক রসালো মঞ্চ নাটক। দর্শকদের ভেতর অত্যাল্প সঙ্খ্যক বোরখাধারী কিছু মহিলা, আর কিশোর, কিশোরী থাকলেও মূল ভিড় ছিলো পুরুষের, যাদের সবাই একটু রুপবানকে দেখতে চায়। চেয়ারম্যানের অতিথি হিশেবে এখানেও আমরা অগ্রাধিকার পেলাম। কড়া মেকাপে খুবই ছোটখাটো রুপবানের সাথে ছবি তুললাম মনির ভাই, কাজল দা ও আমি। 

ফটো শুটের পর মনির ভাই আমাদের মিসকিন শাহর মাজার ঘুরে দেখালেন, মাজারের লেটকা খিচুড়ি খাওয়ালেন। আশেপাশের ছোট ছোট টানা টিনচালা, পাকা একতলা ঘরগুলো তখন ফাকা। ওরশের সময় এখানে মুরিদ, মাস্তানেরা ঢোলের দমদমায় গান গেয়ে সুফি জিকির-আসকার করে। রাত একটার দিকে  আবার ফেরা, নৈশব্দের ঝিমুনি ধরানো ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুরো অটো তখন হয়ে উঠেছে এক অতিকায় জোনাক পোকা, গল্পের ভেতরে ভাসমান এক গহীন গল্প!  

রুপসী বাংলায় ভাঁটফুলের দেশে

গফরগাঁওয়ে এখানে ওখানে জলজংলায়, পথের ঢালে ঘুঙ্গুরের মত ফুটে থাকা ধবল ফুলগুলো আমাকে বার বার টানছিলো। নাম মনে করতে না পেরে নিজের ওপর রাগ হচ্ছিলো। কাজলদার স্লোপ ম্যুরালের ঢালেও হাটু সমান গাছগুলোতে সেই নাম মনে না পড়া ফুল ফুটে আছে থোকায় থোকায়, হাইওয়ের ট্রাফিকে সবুজ পাতাগুলো ধুলায় ধুসরিত, পিপাসায় কাতর। কাজলদাও নাম মনে করতে পারছিলো না। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে বলে, 'এই ফুলের নাম নাই, এগুলা আগাছা।' 

ভাঁটফুলের আবহে স্লোপ আর্ট।ছবি, লেখক।

মশাখালী গ্রামে কাজলদার বাবামায়ের কবরের পাশে উনিশ বছর বয়সী তরুণী যূথীর কবর। ভাঁটফুলের নাম মনে না করতে পেরে, নতুন নাম দেবার তাড়নায় কাজলদার পরামর্শে তরুণী যূথী স্মরণে ফুলগুলোকে আপাতত নাম দিয়েছিলাম, 'ফাল্গুনী যূথী'! বোটানিস্টতো কাউকে চিনি না , প্যাথলজিস্ট অধ্যাপিকা ডক্টর শাহনাজ পারভীন সাথী ফুলের নামের প্রতি যত্নবান। ছবি তুলে পাঠাতে,  সাথী জানালো ঐ ফুলগুলো 'ভাঁটফুল', সাথে পাঠালো জয়পুরহাটের তুলশীগঙ্গা তীরের ভাঁটফুলের ছবি এবং জীবনানন্দের 'রুপসী বাংলা' থেকে, 

"বেহুলাও একদিন ---
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়,
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়"**

শিল্পকর্ম কখন মহত্বের মহিমা পায়? যখন তা আরো আরো মহৎ শিল্পকর্মের সাথে তুলনীয় হয়ে মিশে যেতে পারে, অন্যকে আরেকটু এগোতে উৎসাহিত করে, নিজেকে ছাড়িয়ে যায়। ধামাইলে রুহুল আমিন কাজলের স্লোপ আর্ট গড়িয়ে গড়িয়ে মিশে যায় শিলা নদী ধরে ধরে সেই সুদূরের তুলশীগঙ্গায়! 


চয়ন খায়রুল হাবিব

৫/০৩/২৩

ঢাকা, বাংলাদেশ


সূত্র :

 স্লোপ ম্যুরাল, শিল্পী রা, কাজল। 'লোকজ সুন্দর' প্রকল্প। 

গৌরচন্দ্রিকা তথ্য, ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন রচনাবলী। 

*জসিম উদ্দীনের 'নকশী কাঁথার মাঠ' থেকে উদ্ধৃতি।

**জীবনানন্দ, 'রুপসী বাংলা' থেকে উদ্ধৃতি।

***চয়ন খায়রুল হাবিব, 'নৈকট্যধাম' থেকে উদ্ধৃতি।

নদী বিষয়ক তথ্য, ড. অশোক বিশ্বাস, 'বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা'

ফটো, সুমন, ইব্রাহিম ও লেখক।