Sunday 27 November 2022

পিকাসো-ক্যাটালগ-রেসোনে এবং বাংলা চারুকলার শৈশব।

ক্রিশ্চিয়ান জারভোস এবং পিকাসো

ক্যাটালগ-রেসোনে বা সমালোচনামূলক ক্যাটালগ বা যুক্তিযুক্ত ক্যাটালগ হল একটি বিশেষ মাধ্যম বা সব মিডিয়াতে একজন শিল্পীর সমস্ত পরিচিত শিল্পকর্মের একটি ব্যাপক, টীকাযুক্ত তালিকা। এখানে কাজগুলো এমনভাবে বর্ণনা করা হয়,  যাতে তৃতীয় পক্ষ তা নির্ভরযোগ্যভাবে সনাক্ত করতে পারে এবং এ-ধরনের তালিকাগুলো প্রমাণীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ Catalogue Raisonné (or critical catalogue) একটি ফরাসি শব্দবন্ধ, যা ইংরেজিতে একই ভাবে ব্যাবহার করা হয় এবং একে এমেরিকাজানাইজ করা হয় নি।


পিকাসো তার ক্যাটালগ-রেসোনের ভার দিয়েছিল ক্রিশ্চিয়ান জারভোসের ওপর। গ্রীক বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক জারভোস ছিলো একাধারে শিল্পকলার ইতিহাসবিদ, সমালোচক, সংগ্রাহক, লেখক ও প্রকাশক। একই সাথে জারভোস 'কাহিয়ের দ্য আর্ট' নামে শিল্প বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা করতো।পিকাসোর ক্যাটালগ রেইসনি জারভোস শুরু করে ১৯৩২সালে এবং কাজটি শেষ হয় ১৯৭৮সালে। ৩৩খণ্ড এই ক্যাটালগ-রেসোনেতে ধরা আছে ১৮৯৫ থেকে ১৯৭২ অবধি পিকাসোর সমস্ত শিল্পকর্ম ও ১৬,০০০ সাদাকালো ছবি। কাজটি করবার সময় দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলেও জারভোস  কাজটি শেষ করেছিল।


ক্যাটালগ-রেসোনে নিয়ে আমার লিখবার কারণ হচ্ছে, দুই বাংলার শিল্প-ভাষা বয়সের দিক থেকে কোথায় আছে সেটা নিয়ে আলোচনা করা। উভয় বাংলাতে অনেক বড় শিল্পী থাকলেও আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিকভাবে শিল্প সমালোচনার ভাষা, শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা আঁতুড়ঘর পর্যায়ে আছে। এর একটি বড় কারণ আমাদের শিল্পচর্চার সাথে জড়িত শিক্ষক ও একাডেমির বাইরের অনুশিলকেরা বাইরের জন্রের সাথে লেনাদেনাতে অত্যন্ত অনীহ। আরো সরাসরি বলতে হলে চারুকলার সাথে জড়িতরা সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কোথায় তা বুঝে উঠতে পারছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চারুকলার লোকজন একাডেমিক ভাষা শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করলেও, অনানুষ্ঠানিক ভাবে যারা সাহিত্য চর্চা করছে, তাদের সাথে পারস্পরিক হতে পারছে না। আবার একাডেমিক ও নন-একাডেমিক উভয় ধরনের সাহিত্য অনুশিলক চারুকলার বিশ্বায়িত ভাষা এবং  ইতিহাসের জ্ঞানেও অত্যন্ত দুর্বল।


পিকাসোর আগে স্প্যানিশ ভাষা ও চারুকলার ইতিহাস হাজার বছর পাড়ি দিয়ে এলেও, সে-ভাষার দিকপাল হুয়ান র‍্যামন হিমেনেথ ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ করতে পিছিয়ে যায় নি, যে অনুবাদে তরুণ পাবলো নেরুদাও প্রভাবিত হয়। আর্জেন্টিনার তরুণী শিল্প সংগঠক  ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের আঁকাআঁকির প্রদর্শনী করলে তা দেখতে সে সময়ের খ্যাতিমান শিল্পীরা সবাই ভিড় করেছিল। নরওয়ের শিল্পী এডভার্ড মাঞ্চের বিপুল সময় কেটেছে সে-দেশের নাট্যকার ইবসেনের সাথে হাতে কলমে কাজ করে। শিল্পকলায় আমরা যে দাদাবাদ, পরাবাস্তবতা, কিউবিজম বলি তার সবগুলো শব্দই এসেছে কবি, সাহিত্যিকদের থেকে। দালির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো লোরকা, পিকাসোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো আপোলিনেয়ার। মাইকেলেঞ্জেলো একাধারে শিল্প ও কাব্য চর্চা চালিয়েছে এবং নিজস্ব ধরনে সনেট রচনা করেছে। বারোদাতে কবি ও শিল্পী গুলাম মোহাম্মাদ শেখের সাথে ভুপেন খাকারের সখ্যতাও এখানে দ্রষ্টব্য।


শিল্পের ভাষা যেখানেই সাহিত্যের পারস্পরিকতাকে এড়িয়েছে, সেখানেই সাংস্কৃতিক স্থবিরতা এসেছে, যার জ্যান্ত দৃষ্টান্ত আরব ও ইরানি সংস্কৃতি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিঙ্কর বেজ যে দেশিয় শিল্পধারা তৈরি করেছিল তার ভাবধারাগত ভিত্তিমূল ও প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল তৈরি করে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।কোলকাতা থেকে এসে পূর্ব পাকিস্তানে যখন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানেরা চারুকলা অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে, তখন তাদের সাথে সমকালীন লেখকদের ঘনিষ্ঠ লেনাদেনা ছিলো। বাংলাদেশের প্রথম চারুকলা ইন্সটিটিউটের স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সাথেও সমকালীন শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। ভারত ভাগ, পাকিস্তান আমল, পরবর্তীতে বাংলাদেশে একের পর এক সামরিক শাসনের মদদে আত্মপরিচয় সঙ্কট, এই সবকিছুই দুই বাংলার সাহিত্য ও শিল্প-ভাষাকে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী করে তুলেছে। দুই বাংলাতে বড় সাহিত্যিক, বড় শিল্পী অনেকে থাকলেও, শিল্প-ভাষা শৈশবাবস্থা পেরোতে পারেনি।


দেশিও কথিত ঐতিহ্যবাহী ধারার বিপরীতে ফিগারেটিভ বাস্তবতার ক্ষেত্রে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারদের যুক্তিগুলো আমরা জানতে চাই নি, যেহেতু অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল শাসিত শান্তিনিকেতন সে-যুক্তিগুলো আমলে নেয় নি এবং বিশ্বভারতী প্রশিক্ষিত কথিত শিল্পের ইতিহাসবিদেরাও তাকে গুরুত্ব দেয় নি। একই ব্যাপার ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানেও। জয়নুল আবেদিন ও তার সহকর্মিরা প্রধানত গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিকদের, যেখানে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার সামগ্রিক সাহিত্যের মণ্ড তৈরি হয়েছে নন-একাডেমিক অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক অনুশিলকদের হাতে। পারস্পরিক লেনাদেনার এ বিভক্তিগুলো আমাদের ক্যাটালগ-রেসোনেগুলো তৈরি হতে দেয় নি। মজার ব্যাপার যে কবি ও সাহিত্যিক বলে পরিচিত রবীন্দ্রনাথের ক্যাটালগ-রেইসোনি আছে, কিন্তু জয়নুল একাডেমী থাকা স্বত্বেও জয়নুলের ক্যাটালগ-রেইসোনি নেই। আমাদের দেশে জয়নুল আবেদিন সহ অনেকের জন্মজয়ন্তী ঘটা করে পালিত হয়, পশ্চিমি শিল্পীদের ব্যাপারে এটা দেখা যায় না।  ক্যাটালগ-রেসোনে না থাকলে ভবিষ্যতে জয়ন্তীর মঞ্চেই শিল্পীদের কাজের পাইরেসি বিক্রি হবে। 


বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর ক্যাটালগ-রেসোনে না থাকবার জন্য ভাষার শৈশবাবস্থাকে আর দায়ী করা যাবে না। বরং ভাষার সমকালীন চর্চার কাছে যেতে শিল্পীদের অনীহাকে দায়ী করা যাবে। আবার শিল্পীরা যখন যট্টুকু ভাসা ও সাহিত্যের কাছে যাচ্ছে তা হচ্ছে হয় দায়সারা, নয় শিবিরে বিভক্ত। মনে পড়ছে, আশির দশকের সম্ভাবনাময় শিল্পী প্রয়াত দীপা হকের কথা। মৃত্যু শিয়রে দীপার বন্ধুরা যখন শিল্পকলায় তার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল, তার মূল লেখাটি দীপা নিজেই লিখেছে, কিন্তু সম্পূরক হিশেবে নেয় একাডেমিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের লেখাকে। বারোদা প্রশিক্ষিত এই দীপাই এক খানে আক্ষেপ করেছে যে পরাবাস্তবতার ধারাটিকে বুঝতে চেয়েও বুঝতে পারে নি। অথচ সে সময় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ পরাবাস্তব আঙ্গিকে অনেক কিছু লিখেছে। দীপা মান্নান সৈয়দের খোজ পায় নি। মঞ্জুরুল ইসলামও দীপাকে মান্নান সৈয়দের কথা বলে নি  বা হয়তো বলেছিল, দীপা আমলে নেয় নি। আমি নিজেও অনেক বছর ধরে দেখলাম, লুইস বুর্জোয়ার জীবিতকালীন শেষ রেট্রোস্পেকটিভ টেড মডার্নে সরেজমিনে দেখার পর, সেটা এবং আরো কিছু প্রদর্শনী নিয়ে বিডিআর্টসের শুরুতে  বিস্তারিত লিখলেও সুধী শিল্পী সমাজ আমাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করে নি!


বলাবলি এবং নীরবতার বিশেষ ধরন কিভাবে আমাদের পারস্পরিকতাকে সঙ্কুচিত করে তার একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। ২০১৩র শাহবাগ আন্দোলনের আগে ব্লগ জগতে বিভিন্নমুখী চিন্তার সমাবেশ ঘটে।আমরা তখন পাই সচলায়তন, মুক্তমনা, মুক্তাঙ্গন শিরোনামে অনেক ধরনের ব্লগ প্ল্যাটফর্ম। আমি নিজে ব্লগ লিখতাম নিজের প্ল্যাটফর্ম থেকে। মুক্তমনা প্রতিষ্ঠা করেছিল প্রয়াত অভিজিৎ রায়, মুক্তাঙ্গন চালাতো রেজাউল করিম সুমন। একবার দেখলাম শিল্পী নভেরার কাজ তেমন ভাবে না জেনে  রেজাউল করিম সুমন একটা পোস্ট দিয়েছে এবং তাতে অনেকের সাথে আলোচনায় যোগ দিয়েছে কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম ও শিল্পী বন্ধু রশীদ আমিন। তার কিছুদিন আগে  আমি 'বাংলাদেশের হংসী' নামে নভেরাকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম, যা পাঠ করি লিঙ্ক বাংলা ও সুরমা-লন্ডন আয়োজিত আমার একক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে লন্ডনের ব্র্যাডি সেন্টারে। আমার কবিতাটি ব্লগে পোস্টের সময় ঢাকা যাদুঘরে মঞ্জুরুল আজিম পলাশের তোলা নভেরার বিপুল পরিমাণ কাজের ছবিও সাথে দেই।হলো কি, লন্ডনের এক সুহাসিনী আমার কবিতার লিঙ্কটি রেজাউল করিম সুমনের পোস্টের নিচে সেঁটে দিলো এবং আমাকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানালো। রবাহূত আলোচনায় আমার প্রবল আপত্তি আছে। উপরন্ত ব্র্যাডি সেন্টারের অনুষ্ঠানে আমার কাজ নিয়ে ইমতিয়ারের  লেখা সুরমাতে প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে নভেরা কবিতাটির উল্লেখ আছে। পরে আমার আমার মিশ্র সঙ্কলন 'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্বের' প্রচ্ছদ নক্সা করেছিল আমিন, যাতে নভেরা কবিতাটি ছিলো। এমনও হতে পারে যে ইমতিয়ার ও আমিনের সাথে ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে মুক্তাঙ্গনের সে আলোচনাতে আমি যোগ দেই নি।সঙ্কলক, সঞ্চালকদের পক্ষপাতের কারণেও আমাদের অনেক পারস্পরিকতা বিঘ্নিত হয়। এই পারস্পরিকতা  ছাড়া ক্যাটালগ-রেসোনের যাত্রা শুরু অসম্ভব।


১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আমাদের যে পরিচয় সঙ্কট থাকবার কথা নয়, তাই চাপানো হয়েছে গত ৫০ বছরে। শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা তাদের জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। স্বতন্ত্রতা উৎসাহিত না হলে,  আরোপিত পরিচয় সঙ্কটের রাজনীতিতে শিল্পধারাও বিভ্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে ফিগারেটিভ  স্থবিরতার মুখে, বিমূর্ত শিল্পের বিকাশও  সে-বিভ্রান্তির লক্ষণ। একই সময় দেখা যাচ্ছে 'কিউরেটিং', 'রেট্রোস্পেক্টিভ' বিভিন্ন টার্ম নিয়েও আমাদের বিভ্রান্তি আছে। কিছুদিন আগে ঢাকার জাপান এম্বাসিতে প্রয়াত শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার ৫০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। 'শিল্পপ্রভা' সম্পাদক রফি হকের দেয়া তথ্যমতে সে প্রদর্শনীর ৪০টিরও বেশী কাজ আগে কোনো প্রদর্শনীতে দেখা যায় নি। অথচ প্রদর্শনীটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে, 'Kibriya; A Retrospective.'


প্রদর্শনীর শিরোনামে যে 'রেট্রোস্পেক্টিভ' শব্দটি ব্যাবহার অসঙ্গতিপূর্ণ তা আমি রফি হোকের পোস্টে সরাসরি জানাই এবং রফি তাতে একমত হয়। 'জুলেখা সিরাপ মেটাভার্স' গ্রুপে, আঁকাগুলো আদৌ মোহাম্মদ কিবরিয়ার কি না, অর্থাৎ প্রামানীকিকরণ বা সত্যায়নের প্রশ্ন ওঠানো হয়েছে। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছে কিবরিয়ার আপন সন্তান এবং রফি হক নিজেও ওনার ছাত্র। এক্ষেত্রে আমার মতে যা ঘটেছে তা হলো ক্যাটালগ-রেইসোনির অভাব। আজকে কিবরিয়ার প্রদর্শনী নিয়ে ছোট জায়গা থেকে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, অচিরে অনেক শিল্পীর প্রদর্শনী নিয়ে সচেতন মহল আরো বৃহত্তর আঙ্গিকে একই প্রশ্ন ওঠাবে।

  

'ন হন্যতে নগ্নতা' শিরোনামে শিল্প বিষয়ক একটি পাণ্ডুলিপিতে আমি মূলত আলোচনা করেছি, কেনো দুই বাংলাতে ফিগারেটিভের বিকাশ নেই। সেখানে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, হেমেন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর, জয়নুল আবেদিন, সুলতান, নভেরাকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখি, এরা সহ কারোই ক্যাটালগ-রেসোনে নেই, ফলে স্টাইল তস্করতা ধরা খুব কঠিন হয়ে উঠবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের নাম দিয়ে অন্যের কাজ বিক্রির আশঙ্কাও বাড়বে। আমাদের অনেক স্থপতি যেরকমভাবে শিল্পী অভিধার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তাতে ক্যাটালগ-রেসোনের প্রয়োজন আরো বাড়ছে।


চারুকলার পাঠাগারগুলোতেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুদ্রিত ক্যাটালগ-রেসোনে সংরক্ষণ ও ছাত্রছাত্রীদের তা দেখাবার প্রয়োজন আছে। ফ্রান্সে বিভিন্ন উপলক্ষে একে অন্যকে ক্যাটালগ-রেইসোনি উপহার দেয়। এটা ফ্যাশনেবল বা বড়লোকের স্নবারি নয়। আমাদের শিল্পীরা বিভিন্নভাবে বিদেশে যাচ্ছে, তারাও ক্যাটালগ-রেইসোনি সংগ্রহ করে চারুকলা ফ্যাকাল্টিগুলোকে দিতে পারে। সমালোচনাকেও চারুকলার ফ্যাকাল্টিদের স্বাগত জানাবার মনোভাব দরকার। বন্ধু দিলরুবা পাপিয়া ফ্যাকাল্টি নয়, কিন্তু জয়নুলসহ আরো শিল্পীর ওপর ওর যে কিছু গবেষণা আছে, সেগুলোকে ক্যাটালগ-রেসোনের আকর কাজ বলা যেতে পারে। কিছুকাল আগে অমৃতা শেরগিলের ওপর জাহাঙ্গীর নগরের চারুকলার ফ্যাকাল্টি শিকোয়া নাজনিনের একটি বড় লেখা বিভিন্ন খানে পোস্ট হয়। লেখাটির নিচে কোনো সূত্র চিহ্ন নেই। এখন ওয়াইকিপিডিয়াতে সূত্রসহ এতো তথ্য আসছে যে ফ্যাকাল্টিদের এ-ব্যাপারে অতিরিক্ত সাবধানতার দরকার আছে।


পিকাসো যে গ্রিক-ফরাসি ক্রিশ্চিয়ান জারভোসকে তার ক্যাটালগ-রেসোনে সঙ্কলিত করতে দিয়েছিল, তা প্রথমে উল্লেখ করেছি। এর একটা কারণ হতে পারে, স্পেনে তখন রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে এবং অনেক শিল্পীও বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পিকাসোর সমসাময়িক দালি সামরিক জান্তা ফ্রাঙ্কোকে সরাসরি সমর্থন না করলেও, ফ্রাঙ্কো শিবিরের দিকে ঝুঁকে গেছিলো, যে-শিবিরের লোকেরা দালি, পিকাসোর বন্ধু লোরকাকে হত্যা করে। পিকাসো যে তার ভাষার কাউকে ক্যাটালগ-রেসোনে করতে বলে নি, তার মানে এই নয় যে সে ভাষাতে এর জন্য উপযুক্ত কেউ ছিলো না, বরং পিকাসো যে নির্ভরযোগ্য কাউকে খুঁজে পায় নি, তাও একটি বেদনাদায়ক সত্য। পশ্চিম বাংলার রাজধানী কোলকাতা একসময় পুরো ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিলো। ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। কোথায় য্যানো আমাদের শিল্পীদের নিজেদের পরিচয় নিয়ে দ্বিধা আছে। রিক্সা-প্লেট থেকে পট-চিত্রে সবখানে এই দ্বিধাটা দেখা যাবে। দ্বিধা এক অর্থে ভালো যে এটা উপসংহারমূলক নয়। আবার দ্বিধাগ্রস্তের পক্ষে বিশ্বায়িত হওয়াটাও কঠিন। ক্যাটালগ-রেসোনের একটা দিক সমালোচনা, আরেকটা দিক যুক্তি। এ-দুই-ক্ষেত্রে উদার না হলে যে চারুকলা ফ্যাকাল্টির সংখ্যা বাড়িয়েও চারুকলার প্রকৃত ব্যাপ্তি বাড়বে না তা লেখা বাহুল্য।


'গের্নিকা'র শিল্পী তার নিজের ভাষা ছেড়ে, গ্রীক-ফরাসিকে নিজের ক্যাটালগ-রেসোনের ভার দেয়া থেকে বোঝা যায়, গৃহযুদ্ধরত হাজার বছরের ইতিহাসধারি স্প্যানিশ বিদ্বজ্জনদের প্রতি পিকাসো আস্থা রাখতে পারে নি। আমাদের শিল্পীদের, চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ভেতর যে এককাট্টা মনোভাব তাও শিশুদের দলবেঁধে খেলার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। এ-য্যানো সেই রবি ঠাকুরের 'খেলিছ আনমনে....।' খেয়াল করলে বোঝা যায় যে এটা ঠিক আনমনে খেলা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে অতি হিশেবের ফল। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলনের পর ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পাবার পর আমাদের শিল্পী ও সাহিত্যিকদের পারস্পরিক আস্থা বাড়বার কথা, সে আশাবাদে নিবেদন ইতি! 


চয়ন খায়রুল হাবিব

২৮/১১/২২

ব্রিটানি, ফ্রান্স