Tuesday 3 May 2022

ন হন্যতে নগ্নতা :

দেহছন্দের ফোকাস ও দীপা হকের দ্বিধা

শিল্পী, দীপা হক

'ন হন্যতে নগ্নতা : বাংলা শিল্পকলার ইতিবৃত্ত ও ফিগারেটিভ অপ্রতুলতা'  শিল্পকলা বিষয়ে আমার সামনে প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের নাম। বইটার ফোকাস, কেনো দুই বাংলাতে ফিগারেটিভ আর্টস বিকশিত হতে পারছে না তার আলোচনা, প্রাসঙ্গিক শিল্পীদের নিয়ে ডিস্কোর্স।

এতে আলোচনা করেছি হেমেন মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেঙ্গল আর্ট, যামিনী রায়, রাম কিঙ্কর, জয়নুল আবেদিন, সুলতান, নভেরা, রফিকুন নবী, শাহাবুদ্দিন, মাজহারুল ইসলাম, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, শামীম শিকদার, মৃণাল হক, রাশা, দিলারা বেগম জলির কাজ। সাথে শান্তিনিকেতনি ও বারোদা ঘরানার পার্থক্য, পটচিত্র ও রিকশা পেন্টিং এর বিবর্তন।

ন হন্যতে নগ্নতায়  'প্রপোর্শানের' বাংলা কোথায় আমি 'মাপসই' করেছি, তা দেখাতে নিচের দুটো প্যারা তুলে ধরেছিলাম ফেসবুকে :

''শামীম শিকদার, মৃণাল হক, রাশা ও দিলারা বেগম জলিকে আমি যে চতুর্ভুজে দেখি তার প্রবর্তনা তৈরি হয়েছে যামিনী রায়, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর, নভেরা, সুলতান, জয়নুল আবেদিনের হৃদয় মন্থন করে, যেখানে মাধ্যম পার হয়ে শিল্পের বক্তব্য দর্শকের সাথে সরাসরি বোঝাপড়া তৈরি করে। শামীম শিকদার মৃণাল হক জলি, রাশার কাজে আমি এই বোঝাপড়ার ঐকতান পাই। ঐকতান থাকবার পরও আমাদের ভাস্কর্যে এবং স্থাপনাগুলোতে মাপের যে গলতি তা এসেছে শিল্পকলা, স্থাপত্যকলা, নন্দনতত্ত্বের মাপসই ভারসাম্য তৈরি না হওয়াতে। স্থপতি মাপ বজায় রেখে শিল্পকর্ম করলেই যে তা উত্তীর্ণ শিল্প হবে তা নয়। গলতি বা ফ্লতেও শিল্পের বাড়তি আবেদন মাপসই ভারসাম্য অর্জন করতে পারে।

জাপানি, চিনারা মাপে সিদ্ধহস্ত, শিল্পকর্মগুলো তারা আসবাবপত্রের মত বানাতেই থাকে, আর্ট পারফর্মেন্স নামের বলিহারিও ওরা করে সেই চেয়ার, টেবিল বানানোর মত। কাছাকাছি দেশ হলেও, সেখান থেকে অনেকে প্রশিক্ষিত হয়ে এলেও আমাদের মাস্টার শিল্পীরা এসব চেয়ার, টেবিল বানানো মাপামাপির কারখানা নিয়ে উৎসাহিত হয় নি। মাপ ভাঙ্গতে এবং নূতন মাপসই ভারসাম্য অর্জন করতে আমাদের বড় শিল্পীরা মানদণ্ড হিশেবে নিয়েছে ইউরোপের শিল্পকে। এই বোঝাপড়াটা মাথায় রেখে ‘অপরাজেয় বাংলা’ গড়বার সময় ভাস্কর সৈয়দ আব্দুলাহ খালিদ 'কবি' ও স্থপতি রবিউল হোসাইনের সহায়তা নিয়েছিলেন। খেয়াল করুন কবি শব্দে উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়েছি! আব্দুল্লাহ খালিদ জানতেন কোথায় সম্মান জানালে শিল্পের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।''

পোস্টে কমেন্ট করেন অগ্রজ শিল্পী জাহিদ মুস্তফা :

''মাপসই যুতসই শব্দ! চয়ন প্রদত্ত শিল্পী তালিকায় মাজহারুল ইসলাম কে তো চিনতে পারলাম না! প্রয়াত মৃণাল হকের নাম কি অন্যদের সঙ্গে এককাতারে যায়? এখানে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর নাম থাকতে পারতো। যেমন মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, চন্দ্রশেখর দে, মনসুর উল করিম, ঢালী আল মামুন, শিশির ভট্টাচার্য প্রমুখ।''

চিঠির ছলে নিচের উত্তরটি জাহিদ ভাইর প্রতি হলেও, ন হন্যতে নগ্নতার প্রণোদনা ও রূপরেখা নিয়ে ধারনা পেতে সহায়তা করবে। 

প্রিয় জাহিদ ভাই,  

'এক কাতারে' ফেলা, থাকা খুব বিতর্কিত। হেমেন মজুমদার অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলালকে শিল্পী বলতে রাজি ছিলেন না।অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল সারা জীবনে হেমেনকে শান্তিনিকেতনে পা ফেলতে দেননি। আমি সব জনরে কভার করছি না, শুধু ফিগারেটিভ এবং তা কেন্দ্র করে কালখন্ডগত কিছু স্থানীয় সম্ভাবনা ও এন্টি থিসিস। তথ্যের ব্যাপারে সচেতন থেকেছি, যাতে চা দোকানের বাকোয়াজি তথ্য না হয়ে ওঠে,  ফাঁকিবাজি, পিট চাপড়ানি সাক্ষাতকারগুলো এড়িয়ে গেছি।

নবী স্যার সম্পর্কিত তথ্যগুলো সোর্সিং করবার পর ওনাকে ফোনে পড়ে শুনিয়েছি, উনি বলেছেন ঠিক আছে। অথচ অনেক পরিচিত উড়ো কথাকে তথ্য ধরে, কখনো দরকারি তথ্য চেপে গেছে বা সুবিধামত তথ্যের বয়ান তৈরি করেছে। নবী স্যারের পর উন্মাদ পত্রিকা সহ যারা কার্টুন ধর্মি স্টাইলাইজেশানে কাজ করেছে তা নিয়ে কিছু আলোচনা করেছি। শিক্ষকদের ভেতর যারা এধরনের কাজ করেছে, তারা নবী স্যারের সাথে যোগসূত্র নিয়ে নিজেরা কিছু না লিখলেও এখানে ওখানে তাদের নিয়ে লেখা দেখেছি। চারুকলার শিক্ষকদের এই একটি সুবিধা, অনেক আলোচনা ও পিয়ার্স ব্যাক আপ পান। এখন পান লাইকের লাখেরাজ।

শান্তি নিকেতন, বারোদা ঘরানার পার্থক্য, বাংলাদেশে তার প্রভাব ও বিমূর্ততার ঝোক আলোচনাতে তরুণ ঘোষ, শিশির ভট্ট, নিসার হোসেন, দীপা হকের প্রসঙ্গ এসেছে। দীপা হকের লিখিত বইয়ের ভিত্তিতে ওনার সাথে ডিস্কোর্সটাকে আমি প্রাধান্য দিয়েছি, ফিগারেটিভ নিয়ে ওনার ভাবনা, আক্ষেপ আমি গুরুত্ব দিয়েছি।

শিল্পী, মাতিস

দীপার ভেতর মাস্টার পেইন্টারদের দেহবল্লরি ধারণ করবার একটা প্রবণতা ছিলো। ওপরের কভারে দীপার যে পেইন্টিংটা ব্যাবহার করেছি,  তার সাথে মাতিসের লা ডন্স বা , পিকাসোর তিন নর্তকীর ধাঁচের মিল পাওয়া যাবে। সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের কাজ বাংলাদেশে এখন একবারে হচ্ছে না। বিমূর্ততা, স্টাইলাইজেশান, পোট্রেট আমার ফোকাস নয়, বরং দেহের উদ্ভাসন আমার ফোকাস। এ কারণে মুর্তজা বশীর সহ আরো অনেকে গুরুত্বপূর্ন হলেও আমার আলোচনাতে আসে নি। দীপা হকদের বেড়ে ওঠা আমাদের কিছু আগে, ওনাকে নিয়েও আলোচনা করেছি, যেহেতু ফিগারেটিভ নিয়ে ওনার আলোচনা আমার বিষয়ের সাথে মেলে। এখন ওনার সমসাময়িক বা পরে অনেকে নাম করেছে, কিন্তু নিজেদের কাজ নিয়ে লেখে না, সাক্ষাতকার দিয়ে খালাস। দীপা নিজের যাত্রাপথ নিয়ে কিছুটা লিখেছে। আমার লেখার সময় মনে হয়েছে উনি বেচে থাকলে ভালো ডিস্কোর্স হতো।

নবী স্যারের টোকাই আমার ফোকাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে, দেশের আনুপূর্বিক শিল্পের ইতিহাস ও ফিগারেটিভ দু জায়গা থেকে। পরের যারা কার্টুন ধর্মি কাজ করেছে, তারা পরম্পরাটি নিয়ে লেখেন না। একই ব্যাপার যারা নাই এর ভেতর  ফিগারেটিভ করেন তাদের ভেতরেও, কোনো সাক্ষাতকারে তারা হেমেন মজুমদারের কথা বলেন না।

শিল্প সমালোচক একজনকেও দেখি না, যারা এসবকে প্রাসঙ্গিকভাবে পরম্পরায় বেধেছে। আর্ট ক্রিটিক আসলে বাংলাদেশে নাই। পত্রিকার ৯০০ শব্দের যে লেখাকে শিল্প সমালোচনা বলে চালানো হয়, পলটনের জনসভার রিপোর্টিং তার চেয়ে ভালো। তার পর আছে, আমি অমুক শিবিরে, সুতরাং তমুক দাদাকে তুলে ধরবো। তার পর আছে এখনকার রিয়েল এস্টেট বুমের আলোকে আর্ট ডেকো ডিজাইনার বা স্থপতিদের নিয়ে হৈ চৈ। ধরুন, জামাল আহমেদ, শহীদ কবিরদের ফিগারেটিভ পারস্পরিকতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে আগে হেমেন মজুমদারের প্রসঙ্গে আসতে হবে। জামাল আহমেদ নিজেও বলতে পারেন। এটাতে ফিগারেটিভের সহায়তা হবে।

আমি দেখি, একটা ফিগারেটিভ, ন্যুড, সেমি ন্যুড অনেক ক্ষণ দেখার পর মজা লাগছে কি না, আবেগের মিশ্রতা ছুঁচ্ছে কি না। কোনটা প্রাকৃতিক আলো ফেলা কাজ, কোনটা বিদ্যুতের আলো ফেলা কাজ , কোনটা মডেলে, কোনটা ছবি দেখা কাজ তার প্রযুক্তিগত রকমফেরও ধরতে পারার পরের প্রতিক্রিয়ার কথা বলছি। ঢাকার অনেক বাসাতে একই ধরনের কিছু ফিগারেটিভ আমি দেখেছি। বোঝা যায় একজন একটা বিক্রি করেছে, তার পর গ্যালারিগুলো কাছাকাছি কপি করানো শুরু করেছে। এটা সেই জাপানি আর্টিস্ট, কথিত আর্ট পারফর্মার একই ফর্মে চেয়ার, টেবিল বানাচ্ছেতো, বানাচ্ছেই সেই রকম। অনেক স্থপতিও এটা শুরু করেছে, তাদের অফিসে ফ্রেমের জাহাজ, গ্যালারিকে বলে ফিগারেটিভ, এবস্ট্রাক্ট তৈরি করিয়ে নিচ্ছে। এই ওয়াল পেপার আর আর আর্ট ডেকো ফিগারেটিভ সম্পর্কে আমি কিছু বলি নি।এটা দরকারি ইন্ডাস্ট্রি, চারুকলার কমার্শিয়াল, নন কমার্শিয়াল দু পক্ষের জন্যই এটা দরকারি, সেতু আর রাস্তা বানানো যেরকম ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য দরকারি। এখানে আমি মৃণাল হকের প্রসঙ্গকে সামাজিক দরকারি, সামাজিক প্রতিক্রিয়া, ইন্ডাস্ট্রিয়াল দরকারি এসব জায়গা থেকে দেখেছি। সামগ্রিক শিল্পকলা, বিশেষ করে ফিগারেটিভ ভাস্কর্যের প্রতি আমাদের সামাজিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রেও ওনার লালন ভাস্কর্য ভাঙ্গা, লেডি জাস্টিস সরিয়ে নেয়া আসতে পারে।

আপনি আমার 'প্রপোরশান' বিষয়ক লেখাটি প্রসঙ্গে মৃণাল হকের কথা লিখেছেন। আমি বলেছি যে আমাদের স্থাপত্য ও স্থাপনায় চড়াদাগে মাপসই ভারসাম্যের গলতি দেখা যাচ্ছে। এখানে ব্যাপারটা শুধু যে শিল্পকলা, স্থাপত্যকলা, নন্দনতত্ত্বের মাপসই ভারসাম্য না হওয়াতে ঘটছে তা নয়। ভয়, পিছুটান থেকেও এটা ঘটছে। এখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নিয়ে আসতে হচ্ছে। হিন্দুরা ছোটবেলা থেকে দেব দেবী দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতে অভ্যাস্থ হয়ে এগুলো তাদের মানসে খেলার পুতুল হয়ে গেছে। বৌদ্ধিক এবং খ্রিস্টানেরাও বৌদ্ধমূর্তি, যিশুর মূর্তি দেখতে দেখতে অভ্যাস্থ। হিন্দু, বৌদ্ধিক, খ্রিস্টান শিল্পীদের এই মানসের খেলা বা পূজার আচারের বাইরে এসে ভাস্কর্য গড়তে হয়, কিন্তু তার সাথে তাদের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত বাধে না, তাদের কোনো ভয় এখানে কাজ করে না। ইহুদিরা নিরাকার জেহোভার পূজারি হলেও তাদের শিল্পীরা এসব ট্যাবুর বাইরে চলে এসেছে। কিন্তু আমাদের আব্দুল্লাহ খালিদ, শামীম শিকদার, মৃণাল হক, রাশা, জলিদের তাদের যাত্রাপথ চালু রাখতে হয় এসব ট্যাবু, আরোপিত ভয়ের মুখে। এখানে এদের যাত্রাপথকে আমার মাপের ভারসাম্যের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ময়মনসিংহ শহরের শশী লজের মত বাংলাদেশের আরো অনেক খানে ফোয়ারাতে অর্ধনগ্ন নারী মূর্তি ছিলো। রেসকোর্স উধাও হবার মত সেই নারী মূর্তিগুলোও উধাও হয়ে গেছে। সে পথ ধরেই লেডি জাস্টিসও সরিয়ে নেয়া হয়েছে।        

মাজহারুল ইসলাম হচ্ছেন ঢাকা চারুকলা, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, টিএসসি, নিপার স্থপতি, আবার পঞ্চাশের পুরো ঢাকার মাস্টার প্ল্যানার। মাযহারুল ইসলাম তার প্রামাণ্য আলাপগুলোতে সিম্বলিজমের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। সেখান থেকে আমি তাকে নিয়ে আলোচনা করেছি। ওনার স্থাপত্যগুলো দেখে মনে হয়েছে উনি পুরো ঢাকাতে একটা স্কাল্পচার গার্ডেন হিশেবে দেখেছিলেন। ফার্মগেটে, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে নভেরার কাজগুলো সেটাই মনে করিয়ে দেয়। আমি যে সামাজিক ভয়ের কথা আগে বলেছি, মাজহারুলের ঢাকা মাস্টার প্ল্যান আমার মনে হয়েছে সে ভয়কে মাথায় রেখে, তা উতরে আসার জন্য। প্রতীক বিরোধিতার ওপর উনি যে জোর দিয়েছিলেন তা যে তখনকার অন্য পরিকল্পকদের ভালো লাগে নি তা বলে দেয়া যায়। এখনকার প্রতীকবাদী, বিমূর্তবাজ, আর্ট ডেকো শিল্পীদের তা ভালো লাগবে বলে মনে হয় না।  

আমার বইটি ফিগারেটিভের বিকাশের ক্ষেত্রে আমার ভালো লাগাদের প্রতি ছোটো একটি নিবেদন। সবার প্রতি সুবিচার হয়তো আমি করতে পারবো না। তবে যাদের উল্লখ করেছি তাদের প্রতি যাতে অবিচার না করি তাতে সচেতন থেকেছি। চারুকলার অনেক প্রজন্ম, অনেক জনরে, অনেক শিবির, অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে গেছে। পুরোটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আমাকে কেউ পৃষ্ঠপোষকতাও করছে না। যারা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তারা এটুকুও খেয়াল করছে না যে ওয়াইকি মুক্তকোষে সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের জন্মদিন এখনো ঠিক করে দেয়া হয় নি। আমি নিজে পরিবারকে জানিয়েছি। তাদেরও মেইল করার সময় নাই। এত গুলো আর্টস ফ্যাকাল্টি, এত কর্তা কারো এসব তথ্য দেবার সময় নাই। কিন্তু ভুরি ভুরি সাক্ষাতকার। যারা সাক্ষাতকার নিচ্ছে তারা কিন্তু রিভিউকার হতে পারতো। এদিক থেকে পশ্চিম বঙ্গের শিল্পকলা বিষয়ক তথ্যগুলো অনেক নির্ভরযোগ্য। কিন্তু ওখানেও দীর্ঘদিন ফিগারেটিভ নিয়ে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। 

আমার লেখাতে অনেক বার নভেরার প্রসঙ্গ এসেছে। এটা অনেকটা ফিগারেটিভের শোকগাথার মত। নভেরা কিছু আবক্ষ পোট্রেট ভাস্কর্য করলেও, ফিগারেটিভ তেমন কাজ করে নি, স্টাইলাইজেশানে চলে গেছে। আমৃত্যু ইউরোপে থাকলেও এবং এখানে ওখানে বেশ কিছু প্রদর্শনী করলেও ইয়োরোপে উনি আসলে কোনো দাগ কাটতে পারেন নাই। যখন ফটোগ্রাফি, পেইন্টিংএ ওনার সমসাময়িক পশ্চিমা শিল্পীরা সব পিছুটান ছুড়ে দেহকে পুরোপুরি উন্মোচিত করছে, তখনো উনি স্টাইলাইজেশান থেকে বেরোতে পারেন নাই। মূলত দেশিয় পরিপার্শ্বে ফিগারেটিভ যেরকম ব্যাহত হয়েছে, সুযোগ থাকার পরও নভেরা ফিগারেটিভকে সেই ব্যাঘাতগুলো থেকে বেরিয়ে নিজের শিল্পচর্চায় বরণ করে নেন নি, আবার গিয়াকোমেত্তিসহ যাদের অনুকরণ করতেন তাদের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি।

বেঙ্গল আর্ট, শান্তিনিকেতনে হেমেন মজুমদারকে কখনো ডাকেনি, আমি শুরু করেছি হেমেন মজুমদার দিয়ে। ন হন্যতে নগ্নতা ফিগারেটিভ ধারাবাহিকতার সম্ভাবনা ও বিঘ্নতার একটা রূপরেখা। পরে আরো বাড়াবো আপনাদের উৎসাহ পেলে। অনেক বলে ফেললাম।ভালোবাসা জানিয়ে শেষ করছি।

 

চয়ন খায়রুল হাবিব 

২/০৫/২২

ব্রিটানি, ফ্রান্স


'ন হন্যতে নগ্নতা' বইতে দীপা হকের ওপর আলোচিত অংশ :


দীপা হক, ১/৭/১৯৫৩, ৪/০১/১৯৯৯
দীপা হকের দ্বিধা  

অকাল প্রয়াত শিল্পী দীপা হকদের(১/৭/১৯৫৩, ৪/০১/১৯৯৯) ব্যাচ যখন ১৯৭০সালে শেষ দিকে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াধীন, তার কয়েক মাসের ভেতর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীপাদের ক্লাস শুরু হয় ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ব্যাচ। ১৯৭৪এ বন্ধুদের সাথে ঢাকা পেইন্টার্স প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দীপা ন্যুড বা নগ্নতা নিয়ে দ্বিধার ভেতরে পড়েছিলেন, তার সাথে নিজের মত করে বোঝাপড়া করে একটি মীমাংসায় পৌছাতে চেয়েছিলেন, তা তার কাজের চেয়েও বেশি বোঝা যায়, নিজের যাত্রাপথ নিয়ে তার লেখায়। দীপা যখন ভারতের বারোদায় পড়াশোনা করছেন, তখন সেখানে চিত্রকলার শিক্ষক জি, এম, শেখ ও ভুপেন খাকার। দুজনের ভেতর খাকারের কাজ আমার প্রিয়। দীপা ওর লেখায় জানাচ্ছে যে এই দুজন তখন ন্যারেটিভ পেইন্টিংএ জোয়ার এনেছে। দীপা যে জিনিসটা খুলে বলেন নি, তা হলো খাকার কি ধরনের ন্যারেটিভ পেইন্টিং করতেন। আবার তার ঠিক আগের প্যারাতে লুসিয়ান ফ্রয়েড, বি কিতাইয়ের নামোল্লেখ করে যা লিখেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে দীপা নগ্নতা নিয়ে বলছেন।

 

আগে বলেছি খাকারের বেশির ভাগ আকাআকি হচ্ছে আত্মজৈবনিক এবং নগ্ন পুরুষদের সেখানে সমকামিতার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। জি, এম, শেখের আরেক পরিচয় হচ্ছে কবি এবং খাকারের ভক্ত। বারোদাতে চিত্রকলা বিভাগের ভার পাবার পর জি, এম, শেখ খাকারকে শিক্ষকতার নিমন্ত্রণ জানান। খাকারের মাপ কেবল একজন খাকারই ছুতে পারে। আশির দশকে লন্ডন, বার্লিন, আমস্টারডাম, টোকিওতে গ্যালারি মালিকেরা খাকারের কাজ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। শিল্পের অনুশীলনে খাকার কিন্তু পুরোপুরি স্বশিক্ষিত। খুব কাছে গিয়েও দীপা খাকার, জি, এম, শেখের কাছাকাছি যেতে পারলেন না। এই আক্ষেপটুকু দীপা যেভাবে তার লেখাতে উজাড় করেছে, তা আমাদের পিছুটানগুলোর টেস্টামেন্ট হয়ে থাকবে। দীপা যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দোরগোড়ায়, তখন ওর দুশো কাজ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি প্রদর্শনী হয়, সে উপলক্ষে একটি বই প্রকাশ হয়। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেখাটি লিখেছিল দীপা নিজে। এক জায়গাতে দীপা লিখেছে,  ‘’ড্রয়িং এর ভেতরেই আমাকে খুঁজে পেয়েছি আমি। এসব ড্রয়িংএ কিছু ন্যুড ছিল। তা দেখে কাউকে কাউকে ভ্রু কোঁচকাতে দেখেছি মনে পড়ে। আমাদের সমাজে নগ্ন মানব দেহের যথাযথ প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিধিনিষেধ আছে। এই বিধিনিষেধ এড়িয়ে যেতে শিল্পীদের স্টাইলাইজেশানের শরণাপন্ন হতে হয়। না হলেই ভালো হতো। শ্রষ্ঠার সকল সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহকে আমি সবচেয়ে বেশী নান্দনিক গুণসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করি। সমসাময়িক যে দুজন শিল্পীর মানব দেহের উপস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করেছে তারা হলেন আর, বি, কিতাই আর লুসিয়ান ফ্রয়েড।’’  

 

এর পরের প্যরাগুলোতে দীপা খাকারের কাজ উল্লেখ করেছে এবং সে-ধারাতে ১৯৮৬তে একটি  একক প্রদর্শনীর উল্লেখ করে আন্তরিকভাবে স্বীকার করছে যে ও খাকারের জগতের ভেতরে ঢুকতে পারে নি। কেউ আসলে কারো জগতে ঢুকতে পারে না। যা পারে তা হলো নিজের জগতকে আন্তরিকভাবে মূর্ত করে তুলতে। দীপা যাকে ‘মানব দেহের যথাযথ প্রতিকৃতি’ বলছে, অমৃতা শেরগিল, ফ্রিদা কাহলো, লুসিয়ান ফ্রয়েড, ভুপেন খাকারের কাছে  তা প্রথমত নিজের দেহ। নিজদের শরীর উন্মোচন করতে করতে তারা অন্য মডেলের শরীর উন্মোচন করেন। খাকারের, ফ্রিদার, লুসিয়ানের, অমৃতার ন্যারেটিভ এসেছে আশেপাশের অনুষঙ্গ থেকে, কল্পনা থেকে নয়। আশির দশকে  দীপা ও তার বন্ধুরা ঢাকাতে বসে পরাবাস্তবতা নিয়ে ক্লাসের বাইরে খোড়াখোড়ি করছে, কিন্তু পরাবাস্তবতার সাথে কবিতার যোগাযোগ যে ওতপ্রোত তা বুঝে উঠতে পারছে না, পরাবাস্তব সাহিত্য নিয়ে তুমুলভাবে কাজ করা আব্দুল মান্নান সৈয়দ, মুস্তফা আনোয়ারদের কাজের  সাথে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে না। মান্নান সৈয়দ কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কবি, পরাবাস্তব থেকে মৌলবাদের দিকে তার যাত্রাপথও বেশ প্রামাণ্য,  মুস্তফা আনোয়ার নিজেকে আড়াল করতেন। শিল্পীদের উদ্বোধনী ইত্যাদিতে বহুল পরিচিত শামসুর রাহমান, সৈয়দ হকদের দেখা যেতো, কিন্তু তাদের সাথে শিল্পীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন করলেও শিল্পধারা নিয়ে কোনো ওয়ার্কশপ করে নাই।

 

শিল্প স্বয়ম্ভু নয়, ভুঁইফোড় নয়। দাদা, পরাবাস্তব, ইম্প্রেশনিজম, সুরিয়ালিজম, কিউবিজম, বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট সবগুলো শিল্প আন্দোলন ঘটেছে কবিতার বাতাবরণে। সুরিয়ালিজম, কিউবিজম শব্দগুলো তৈরি করেছে ফরাসি কবি গিয়ম আপোলিনেয়ার। নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর তাদের বিপুল অধ্যায় কাটিয়েছে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ঢাকাতে এসে খুঁজে বের করেছেন সৈয়দ আলী আহসানদের। আমাদের যারা আশির দশকে বারোদা থেকে চিত্রকলা পড়ে এসেছেন, তাদের অনেকে বারোদার সে সময়ের চিত্রকলা বিভাগের প্রধান জি, এম, শেখের কবি পরিচয় জানেন না। আবার কবি জি, এম, শেখ যে ভুপেন খাকারকে চিত্রকলার শিক্ষক হিশেবে নিয়োগ দিলেন, সে খাকারের চিত্রকলা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। খাকার ও শেখের যোগাযোগ কবিতা ও শিল্পের যোগাযোগ। মনে রাখবেন, উত্তীর্ণ কবিতা এবং উত্তীর্ণ শিল্প। মিডিয়া খাওয়ালেই তা উত্তীর্ণ হবে তা নয়।

 

শিল্পীরা আর সাধারণের মতো সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছে এবং যোগাযোগগুলোকে গোষ্ঠী নির্ভর করে ফেলেছে। সাহিত্যিকেরাও। ফলে মাল্টাই জনরা মিডিয়াম খুলছে না, যার প্রভাবে টেলি নাটক, ফিল্ম, ক্যামেরা সবই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ডেয়ারিং টা নাই। সাহিত্য যে নান্দনিকতার শতশ্চক্ষু দিতে পারে তার সমকালীন নবায়ন নাই। হাসনাত আব্দুল হাই, আমি নভেরাকে নিয়ে খোড়াখোড়ি করেছি, কালকূট রামকিঙ্করকে নিয়ে লিখেছে। কিন্তু আজকের রমকিঙ্কর, নভেরা যশোপ্রার্থিরা সাহিত্যের কাছে আসছে না।

 

দ্বিধার সীমাসরহদ্দে এসে দীপা প্রচুর আত্মপ্রতিকৃতি, লতা, পাতা এঁকেছে। ক্লাসে যা শেখানো হয় নি, বন্ধুদের সাথে পারস্পরিকভাবে পরাবাস্তবতা, ইম্প্রেশনিজম নিয়ে খোড়াখোড়ি করেছে। পঞ্চাশের পর শিল্পের তত্ব ও ব্যাবহারিকতা নিয়ে এতো ব্যস্ত আমরা কাউকে পাই নি। দীপার সব কাজই শক্তিশালী এবং নয়নাভিরাম। কিন্তু দীপার লেখা পড়বার পর সেগুলোকে আক্ষেপের বিরাম চিহ্নের বেশি কিছু মনে হয় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দীপা এই লেখাটি রেখে গেছে, যাতে অন্যরা এই বিরাম চিহ্নগুলো পেরিয়ে উদ্দাম মূর্ততায়, বেহিসাবি নগ্নতায় লক্ষ্যভেদী হতে পারে।   

 

দ্বিধা ও ভয় পার হয়ে যে শিল্প আমাকে এগিয়ে নিতে চায়, তা আমি নেবো। যে শিল্প আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় তাকে আমি নেব না। এ-প্রবর্তনা থেকেইতো গুহাচিত্র আঁকতে আঁকতে আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম! আরেকটি ব্যাপার দীপা লক্ষ্য করতে পারে নাই, তা হলো জী, এম, শেখ ও ভুপেন খাকারের যোগাযোগ হচ্ছে কবিতা ও শিল্পের যোগাযোগ, তার ও বন্ধুদের ক্লাসের বাইরে যে পরাবাস্তবতার অনুশীলন তার গোড়াতেও আছে কবিতা ও শিল্পের যুক্ততা।

 

বাংলাদেশে শিল্পকলার তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অসুবিধা শিল্পীরা যেরকম প্রাতিষ্ঠানিকতা পেরোনোর ঝুঁকি নেন না, সেরকম সমঝদারিত্বের ব্যাপারটা সীমিত অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার ভেতর। ছবি তুললেন, বাসায় ছবি সামনে রেখে ল্যান্ডস্কেপ করলেন, ফিগারেটিভ করলেন, সেটা দক্ষতা-নির্ভর টেকনিক্যালি পারফেক্ট হলো, কিন্তু তাতে কোনো টেনশান নাই। টেনশানটা কি? একজন যখন নগ্ন হয়, সে তরুণ, বুড়া, চিকন, মোটা যাই হোক তার ঘাড়ে, হাঁটুতে, কনুইতে, চোয়ালে, চিবুকে বিভিন্ন মাপের স্নায়বিক টেনশান থাকে। মাস্টার পেইন্টার তাকে আলো, ছায়াতে খেলায়। আর ল্যান্ডস্কেপের বেলাতে পেইন্টার ঘণ্টার পর ঘণ্টা আবহাওয়ার রোদ, বৃষ্টি, মেঘের অদলবদলটাকে টেনশানে বদলায়। রেনোয়ার মত পেইন্টারেরা হচ্ছে ডাবল মাস্টার পেইন্টার। রেনোয়া একই সাথে ল্যান্ডস্কেপে নগ্ন মডেলদের টেনশান ধরতো।

 

আমাদের চারুকলার বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক স্টাইলাইজড বিমূর্ত কাজ করলেও যে অতি অল্প সংখ্যক ফিগারেটিভ কাজ করেন, তাদের ভেতর জামাল আহমেদ বিপুলভাবে পরিচিত। ওনার

কিছু কাজ দেখে হেমেন্দ্রনাথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। অনেকের ফিগারেটিভ কাজ দেখলে মনে হয় ছবি দেখে, বিদ্যুতের আলো ফেলা কাজ। ফিগারেটিভ শিল্পীরা সাক্ষাতকারগুলোতে পরম্পরা খুলে বলেন না। অনেকের কাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে হেমেন্দ্রনাথের স্পষ্ট প্রভাব। শিক্ষকদের দায়িত্ব এখানে পরম্পরা ধরিয়ে দেয়া, তা না হলে আমরা মিসিং লিং এর ভেতর পড়ি। এই মিসিং লিং এর ঠিকুজি কুলুজী এবং মীমাংসা আমাদের একাডেমিক, নন একাডেমিক দু’ক্ষেত্রের জন্যই জরুরি।

 

(ওপরের অংশটি 'ন হন্যতে নগ্নতা : বাংলা শিল্পকলার ইতিবৃত্ত ও ফিগারেটিভ অপ্রতুলতা' শির্শক বইয়ের অংশ।লেখক চয়ন খায়রুল হাবিব।যে কোনো মাধ্যমে কপি নিশেধ। প্রকাশনা স্বত্ব, শুধুমাত্র লেখকের।)