Thursday 19 July 2018

ক্ষুধিত পাষাণ দেশে, বিদেশে!

Or Last Year at Marienbad


কেন?জুলেখা ট্রিলজি  সমাপ্তির পাঠপ্রস্তুতি ও মঞ্চের প্রায়োগিক অনুশিলনে, ময়মনসিংহ গীতিকা যেরকম, সেরকম রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ, কঙ্কালের  পাশাপাশি কাফকার মেটামরফোসিস ও  এলা রেনে নির্দেশিত ফরাসি চলচ্চিত্র  L'Année dernière à Marienbad ( Last Year at Marienbad ) খোড়াখোড়ি  প্রয়োজন হয়।


 গুরুকথন :

কাকতলিয়ের চেয়ে কাকতলিয় চিন্তাচক্রের মুহুর্মুহু রোলারকোস্টারে গতরাতে ভাবতে থাকি ক্ষুধিত পাষাণ, কঙ্কাল, জীবিত ও মৃত, নিশিথে, মণীহারা, দুরাশা  ধরনের  রবীন্দ্রনাথের অতিলৌকিক  গল্পগুলো ঘিরে।ক্ষুধিত পাষাণের  ইংরেজি অনুবাদ  Hungry Stones, একই গল্প অবলম্বনে একই নামে তপন সিংহের বাংলা ছায়াছবি, গুলজারের হিন্দি লেকিন  ইত্যাদি ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে সার্বিও এক চলচ্চিত্র সমালোচকের ব্লগে পেলাম Hungry Stones এর পরপর  খ্যাতিমান ফরাসি চলচ্চিত্রকার এলা রেনের ছবি L'Année dernière à Marienbad ( Last Year at Marienbad )!

ফরাসি নুভেল ভাগ  বা নয়া ধারার  অন্যাতমো  অংশিদার এলা রেনের নাম নেয়া হয় জা লুক গদারের পাশাপাশি।আরেকটু খোড়াখোড়ি করে জানলাম  কাকতলিয়ভাবে এলা রেনের জন্ম হচ্ছে ব্রিটানির যে শহরে আমি থাকি সে শহর ভ্যানে।এলা রেনের কাজটা লাইব্রেরি থেকে বা দোকান থেকে সংগ্রহ করবো এরকমটা ভাবছি, জানতে পেলাম ষাটের দশকে নির্মিত ছবিটার খোজ পাওয়া দুস্কর।তার কয়েক ঘন্টা পর প্যারিস ভোগ  অনলাইনে জানালো কোকো শ্যানেল এক স্টুডিওর সাথে মিলে ছবিটা পুনরুদ্ধার করেছে এবং শিঘ্রি বাজারে ছাড়বে।কোকো ছবিটার পোষাক নক্সা করেছিলো।   



ক্ষুধিত পাষাণ  ও L'Année dernière à Marienbad হুবহু  এক গল্প না হলেও, এদের  অন্তর্গত সাযুজ্য প্রবল।

রবীন্দ্রনাথের গল্পে  প্রধান চরিত্র পশ্চিমের ছোট  এক শহরে  কর সংগ্রাহকের নিয়োগ নিয়ে এসেছে।এখানে  তার  বাসস্থান হিশেবে যে প্রাচিন প্রাসাদটি বরাদ্দ করা হয়েছে তা  আশেপাশের লোকের কাছে এক হানাবাড়ি নামে কুখ্যাত।এখানে সে মুঘল আমলের  ছায়াদের  ফিশফাশ শুনতে পায় এবং এক রুপসির দেখা পায়।গল্পে চরিত্রদের নাম প্রায় নাই বললেই চলে।

বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের কাজের জায়গা আহমেদাবাদে বেড়াতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ  ভাইয়ের কাজ ও একই জায়গাতে বাসস্থান  মুঘল সম্রাট শাহজাহানের বানানো মতিশাহি মহল প্রাসাদে বসবাস করেছিল।বাস্তবের প্রাসাদটি ছিল সাবরমতি নদিতিরে, গল্পে যার রুপান্তর ঘটে সুস্তা নদিতে।


এলা রেনের ছবির গল্পটায় ফেরা যাক।মনোরম পার্কের ভেতর এক বিলাসবহুল হোটেলে এক পুরুষ এক নারির কাছে  ঘোষনা করে যে এক বছর আগে তাদের ম্যারিয়েনবাদে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, মেয়েটি তখন তাকে এক বছর পর দেখা করতে বলে।মেয়েটি সবকিছু অস্বিকার করে।আরেকজন পুরুষ মেয়েটার ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং একই হোটেলে অবস্থান করছে।নতুন পুরুষটি বারবার ঐ প্রভাব বিস্তারকারি পুরুষটির হাতে একটা গানিতিক খেলায় হেরে যায়।চরিত্রগুলোর কোন নাম নাই, বর্ননা ও সময়খন্ড সাঙ্কেতিক, একটা সময় আরেকটা সময়ের ভেতর ঢুকে পড়ছে, পুরো ব্যাপারটা য্যানো ঘটছে স্বপ্নে।একদল কাজটিকে মাস্টারপিস আখ্যা দিয়েছে, আরেকদল দুর্বোধ্য বলে খারিজ করে দিয়েছে।



জুলেখা কথন :

অনুশিলনগুলো ধরে রাখি ছোট, বড় কবিতাকথনে।কখনো তা, Klimt : কঙ্কাল ও চুমু, কখনো তা, জাকেরগন যখন কঙ্কলিলা মঞ্জিলে হারালো, কখনো তা, কাফকার পুতুল*, কুড়ানো কেতলি ও পত্রসরসি উপকথা !

মঞ্চনাটক একটি সরাসরি যোগাযোগ শিল্প।জুলেখা ট্রিলজির  প্রকাশিত দুই পর্ব ও মঞ্চায়িত একটি পর্বের  সাথে  সংগতি রেখে সমাপ্তি পর্বের বয়ানও গিতল অপেরাধর্মি।তবে এই গিতল  অংশের বয়ান দুই বাংলার স্থানিয় বুলির মিশ্রন, যাকে প্রমিত ভারসাম্যে এনে পরিবেশন করা হয়েছে।এই মিশ্রনে পৌছাতে ঘুরেঘুরে শুনেছি নদিয়ার কৃশ্ননগর থেকে পদ্মাতিরের চাদপুরের মরিচ কুড়ানিয়া নারিদের পারস্পরিক কথন, মিশেছি রাঙ্গামাটির চাকমা অনাথ আশ্রমের অনাথ ও শিক্ষকদের সাথে, খুলনাবাসি রামপাল পরিবেশ আন্দোলনকারিদের সাথে। ফলে জুলেখা ট্রিলজির  ভাষা অনেকগুলো ধ্রুপদ ঝর্নাধারাতে অবগাহিত হবার পাশাপাশি বহুসচল সাম্প্রতিকতায় সিক্ত হয়েও নিজস্ব মৌলিক উচ্চারনে  সাগরমুখি, স্টাইলের দিক থেকে যাকে বলা যেতে পা্‌রে, ভাংগা লিরিক ও  ভাংগা বয়ান

ভাষা শৈলির মিশ্রনের বাইরে সময়খন্ডের জায়গাতে জুলেখা ট্রিলজির প্রকাশিত ও মঞ্চায়িত পর্বে আজকের সময়ে আছড়ে পড়ছে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব, লৌকিকের সাথে অতিলৌকিকের সিমাসরহদ্দ থাকছে না।এক অর্থে জুলেখা নাট্য ট্রিলজি প্রাচিন গুরুদের উলটো বয়ান, আবার আরেক অর্থে একই গুরুদের কঙ্কালিত রিভিশান, যে কঙ্কালে মেরুমজ্জাসহ চেহারার সুনির্দিষ্টতাকে কায়েমি মুখোশের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে সুখবোধ্য সুর ও যোগাযোগ প্রবন সঙ্কেতসুত্রে।

প্রথম পর্ব জুজু : জুলেখার জুয়াচাক্কিতে  জুলেখা বধুবেশে, মাদকাসক্ত হিসেবে, সেনাকর্তা হিসেবে ইউসুফের সাথে  একের পর এক সাইকাডেলিয়া পার হয়েছে।দ্বিতিয় পর্ব ডৌল :জুলেখার জেরা পর্বে  জুলেখা মুখোমুখি দৈব ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইউসুফের। শেষ পর্বে কি তাহলে জুলেখা তার নিজের কঙ্কালের মুখোমুখি হবে?

চয়ন খায়রুল হাবিব
২০/০৭/২০১৮
ব্রিটানি

প্রথম ও দ্বিতিয় সাদাকালো ছবিগুলো L'Année dernière à Marienbad চলচ্চিত্রের দৃশ্য।