Monday 5 December 2016

বিজ্ঞাপনজাত লক্ষি এবং শিল্প সরস্বতির বিবাদভঞ্জন

মসলিন পরনে ঢাকাই রমনি, ১৮ শতক।ফ্রান্সেস্কো রেনাল্ডির আকা।এধরনের তেলচিত্র ব্যাবহার করা হতো ইউরোপের সম্ভ্রান্ত দরবারগুলোতে মসলিনের বিজ্ঞাপন হিশেবে।
বাংলার মসলিন ও পাটালি গুড় ধরা যাক বাংলার এখো গুড়, পাটালি গুড়, ঢাকাই মসলিনের শতাব্দি প্রাচিন কারিগরেরা আজকের বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি হাতে পেল!যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিতকালে খেজুর রস সংগ্রহ করে বিশাল, বিশাল গর্তে সেগুলো ঘন পাটালি গুড়ে রুপান্তর করে ভরা হতো মাটির কলসে, তারপর সেগুলো আনা হতো হাটে, হাট থেকে সওদাগরেরা পাইকারি দরে কিনে চালান দিত চট্টলা, ধলেশ্বরির বন্দরে, তারপর সেই গুড় বড় বড় জাহাজে চেপে চলে যেত রোম, ভেনিস সহ দুরান্তের নগরগুলোতে!গুড় বানিজ্য থেকেই কি বাংলার নাম হয়েছিল গৌড়? হাটে, বন্দরে আগত নাবিকদের মুখের কথা ছিল তখনকার বিজ্ঞাপনের বাহন!

মসলিন পরনে ফ্রান্সের শেষ সম্রাজ্ঞি মেরি আন্তোয়ানেত, যার মৃত্যদন্ড ফরাসি বিপ্লবের পর গিলোটিনে কার্জকর করা হয়!লুইস এলিজাবেথ ভিজির আকা, ১৭৮৩।
একই ভাবে স্কটিশরা তাদের স্কচ হুইস্কি, আইরিশরা তাদের গিনেস বিয়ার গ্রামগুলোতে গাজিয়ে গঞ্জে চালান দিত ঘোড়ায় টানা গাড়িতে, গঞ্জ থেকে নগরে তা যেত জাহাজে, সেখানেও মুখে মুখে ঘোরা সোয়াদের বর্ননা ছিল বিজ্ঞাপনের বাহন!এভাবে ইটালিয়ানরা তাদের পিজ্জা, পাস্তা সদ্য আবিস্কৃত এমেরিকাতে জনপ্রিয় করে তুলেছে হাটে বাজারে চিৎকার করে।আজকের দিনে হুইস্কি, গিনেস, পিজ্জার আন্তদেশিয় বিজ্ঞাপন, বিপননের সাথে আমাদের গুড়ের বিজ্ঞাপন, বিপননের তুলনা করা হলে আমরা দেখতে পাব পন্য হিশেবে গুড়ের শুধুমাত্র আভ্যন্তরিন বানিজ্যে সিমিত হবার পেছনে মুল কারন হচ্ছে আমাদের এটিচুড বা প্রবনতা।একটা স্থানিয় পন্যকে ঐতিহাসিক পর্ব থেকে নবায়িত মোড়কে উপস্থাপনের আগেই আমরা বিভিন্ন অজুহাত তৈরি করে ফেলি।
উত্তরবঙ্গে গুড়ের বাজার

বলা হয় যে নিজেদের সস্তা কাপড় বাজারজাত করতে ব্রিটিশ উপনিবেশিরা তাতিদের বুড়ো আংগুল কেটে দিয়ে মসলিন শিল্প ধ্বংশ করে!কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের সাবানের মোড়ক হিশেবে, বিভিন্ন অস্ত্রপচারের পর ব্যান্ডেজ হিশেবে পাইকারিভাবে মসলিন ব্যাবহার প্রমান করে যে মসলিন শিল্প ধ্বংশ হয় নাই, বরং স্থানিয় সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠি মসলিনের প্রতি অনুরাগ হারিয়ে ফেলে এবং সম্ভ্রান্তদের পৃষ্ঠপোষ্কতা হারানো তাতিরাও চাহিদার অভাবে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে।
ধরা যাক ঐ তাতিগন আজকের বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি হাতে পেলো, আর স্থানিয় চাহিদা পড়ে যাওয়া সত্বেও বিদেশে তন্মধ্যে তৈরি হওয়া বাজার ধরে রাখতে পারলো!ব্যাপারটা, কোন হতে পারতো জাতিয় অলিক চিন্তা নয়!আজকে যেরকম নয়া টাকার ফাটকাবাজারি বুর্জোয়া চ্যানেল মালিক তার পাতি বুর্জোয়া শিল্পিদের দোশর করে দেশি পন্যের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছে, সেরকম কয়েকশ বছর আগে নয়া লবন ব্যাবাসায়ি, নীল ব্যাবসায়ির দোসর বাঙালি বুর্জোয়া গুড়ে বা মসলিনে নগদ লগ্নি সরিয়ে নিয়ে প্রবাদ চালু করেছিল, 'লাভের গুড় খায় পিপড়ায় !'বটে!ইটালির প্রত্যন্ত গ্রামের পিজ্জা বানানো পরিবারগুলো এমেরিকাতে প্রসারের দৌলতে বিনিয়োগ করতে পেরেছে আরো অনেক ব্যবাসায়, রান্না বান্নার শিল্প থেকে বাড়তি মুনাফা এসে লগ্নি সরবরাহ করেছে ফ্যাশান শিল্পে!তার পাশাপাশি আমাদের খেজুর রস সংগ্রাহক গ্রাম্য কিশানের পোষাক, পুষ্টির দিকে তাকানো যাক।লাভের গুড়টুকু যে আমরা খেজুর রস সংগ্রাহকের সাথে শেয়ার করতে চাইনা, সে প্রবনতা লুকাচ্ছি সংস্কৃতি রক্ষার ধুয়া তুলে!বিদেশি চ্যানেলে দেশিয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধের কথা বলে আমাদের কেউ কেউ আসলে দেশিয় সংস্কৃতির বিকশিত ডাইনামিজমকে অঙ্কুরেই ধ্বংশের উদ্যগ নিয়েছেন!
দেশি পন্যটাই বা কি?মিজোরাম, মেঘালয়ের আদিবাসিরা বাংলাদেশের পাহাড়িদের মত দোচুয়ানি, ধানকাট্টি ধরনের ভাত গেজানো মদ পান করে!জাপানিরা নির্দিধায় তাদের প্রযুক্তিগত সামগ্রির পাশে সাকের বিজ্ঞাপন দেয়; রাশিয়ানরা স্পেস টেকনোলজির পাশে ভোদকা বিক্রি করছে; ফরাসিরা মিরেজ বিমানের পাশে শ্যাম্পেইন বিক্রি করছে; আইরিশদের অন্যতমো রপ্তানি দ্রব্য হচ্ছে গিনেস জাতিয় বিয়ার; স্কটিশদের বিশ্বজুড়ে নাম তাদের স্থানিও হুইস্কির দৌলতে!সেখানে ধর্মিয় এবং সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধের কারনে বাংলাদেশের অনেক পন্য আভ্যন্তরিন এবং বিদেশি বাজারে বিজ্ঞাপিত হতে পারে না!একসময় যখন মিজোরাম, মেঘালয়ের যুবক, যুবতিরা কোলকাতা, মুম্বাই ঘুরে বিজ্ঞাপন ও বিপননের খুটিনাটি জেনে যাবে এবং তার সাথে সাংস্কৃতিক উদারতা যোগ করবে, তখন কি ওদের আর বাংলাদেশের পেয়ারার জেলি, কোয়ালিটি কন্ট্রোলে রিজেক্ট হওয়া প্যান্টি, ব্রাতে প্রান ভরবে?
বিচুর্ন জেনিফার লরেন্স কিম্বা স্বপ্নের ডেভিড বাওয়ি
জাদরেল ফরাসি প্রসাধন কোম্পানি ডিওর জানে 'হাঙ্গার গেম' খ্যাত বিশ্বের সবচেয়ে দামি তারকা এমেরিকান তরুনি জেনিফার লরেন্সের চেহারা বিজ্ঞাপনে ব্যাবহার করা হলে দেশে ও বিদেশে বিক্রি হু হু করে বেড়ে যাবে!
মার্কিন জেনিফার লরেন্সের চেহারা ফরাসি পার্ফিউম ডিওরের চাহিদা আকাশচুম্বি করে দেয়; রক তারকা ডেভিড বাওয়িকে সাকে পান করতে দেখে জাপানে এবং পশ্চিমে সাকে পানের চল বেড়ে যায়; আবার ব্রুস লিকে হুইস্কি বিজ্ঞাপনে দেখে প্রাচের দেশগুলোতে হুইস্কি বিক্রি বেড়ে যায়; বিশ্বের অন্যতমো পার্ফিউম ফরাসি শ্যানেল ৫ এর সর্বকালের সবচেয়ে দামি বিজ্ঞাপিত অবয়ব হতে সানন্দে ক্যামেরার সামনে এসে দাড়ায় অস্ট্রেলিয়ার লাস্যময়ি ললনা নিকোল কিডম্যান!বিত্ত, বৈভবে পুরস্কারে নিকোলের তো আর বাড়তি আয়ের দরকার ছিলনা, তবু কেন নিকোলের এই বিজ্ঞাপিত বিচুর্ন আয়নাতে দাড়াবার বাসনা?এই মেধাবি অভিনেত্রি জানে গ্ল্যামার ক্ষনস্থায়ি এবং ক্ষনস্থায়ি বলেই হয়তো এর দুর্লভতাকে বাধা হয় অলৌকিক দুর্মুল্যে!মিজোরাম, ত্রিপুরার আদিবাসি ছেলেমেয়েদের কাছে আটো প্যান্ট শার্ট পরা বা ভারি কোমরে ওড়না পেচানো বিজ্ঞাপিত ঢাকাই ছেলেমেয়েও পরাবাস্তবের বিচুর্ন জেনিফার লরেন্স কিম্ব দুরান্বয়ি স্বপ্নের ডেভিড বাওয়ি!
জাপানি সাকের বিজ্ঞাপনে রক গায়ক ডেভিড বাওয়ি।
অনুষ্ঠান আসতে দিব না, বিজ্ঞাপন যাইতে দিব না!বাংলাদেশের চ্যানেল শিল্পিরা আন্দোলন করছে ডাবিং করা বিদেশি (মানে ভারতিয়) অনুষ্ঠানের সম্প্রচার রোধে এবং বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেলে (মানে ভারতিয়) চ্যানেলে প্রচার রোধে!মোদ্দা কথ, অনুষ্ঠান আসতে দিব না, বিজ্ঞাপন যাইতে দিব না!
বাংলাদেশি চ্যানেলের মালিক ও শিল্পিদের মজুরির বাইরে 'প্রান, আড়ং, গ্রামিন, বাংলা মেলা, নিত্য উপহার জাতিয় বাংলাদেশি শিল্পের সাথে জড়িত বিবিধ কর্মসংস্থানও এখানে আসতে পারে!'প্রান' এবং আরো বেশ কিছু বাংলাদেশি শিল্পের বড় বাজার সিমান্তবর্তি ভারতিও রাজ্যগুলোতে, যেখানে কোলকাতার মাড়ওয়ারি হাউসগুলা বাংলাদেশি হাউসগুলার প্রতিদ্বন্দি!সিমান্তবর্তি ভারতিয় রাজ্যগুলোতে বিপননের বড় হাতিয়ার হচ্ছে বিজ্ঞাপন!সিমান্তবর্তি রাজ্যগুলোতে যদি বিজ্ঞাপনের ঝড় তুলে বাংলাদেশি পন্য জাকিয়ে বসতে পারে, এ পথ ধরে সংশ্লিষ্ট আরো শিল্প ও সেবাসামগ্রি বিকশিতা হবার কথা!সাথে শিল্পিদের মজুরিও বাড়বার কথা!কিন্তু শিম্পিরা তাহলে আন্দোলনে কেন?আবার, বাংলাদেশের পন্যের বাজার বিদেশে বিকশিত হোক, শিল্পিরা তা চাচ্ছে না, তাও ভাবতে পারছি না!প্রশ্নটা উঠছে বৈষম্যমুলক প্রতিযোগিতার এবং বানিজ্যিক ঘাটতির, শিল্পিরা যার সরলিকৃত গোয়ার সমিকরন করেছে, আসতেও দিমু না, যাইতেও দিমুনা!
৩০শে নভেম্বার, কেন্দ্রিয় শহিদ মিনারে ফেডারেশান অব টেলিভিশনস প্রফেশলানস অর্গানাইজেশনস (এফটিপিও) আয়োজিত টেলিভিশন শিল্পী কলাকুশলীদের সমাবেশে বক্তারা পাচ দফা দাবি জানায়,১)দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বাংলায় ডাব করা বিদেশি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করতে হবে, ২)টেলিভিশন অনুষ্ঠান ক্রয় ও প্রচারের ক্ষেত্রে এজেন্সির হস্তক্ষেপ বন্ধে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হবে, ৩)টেলিভিশন শিল্পের সর্বক্ষেত্রে এআইটির নূন্যতম ও যৌক্তিক হার পুনঃনির্ধারণ ৪)ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশিয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে, ৫)দেশের টেলিভিশন শিল্পে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবৈধভাবে কাজ করা বন্ধ করতে হবে।(পত্রিকা থেকে)
ডাবিং বা ভাষার দিক থেকে দেশিয়করন অন্যান্য দেশে হরহামেশা হচ্ছে!ফরাসিতে ডাব করে ফ্রান্সে ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, ভারতিয়, মার্কিন ইত্যকার সিনেমা দেখানো হচ্ছে, কিন্তু নিজেদেরটা ১৬ আনার ওপর ১৮আনা ঠিক রেখে!ইউরোপিয়ান ইকোনমি অঞ্চলে শ্রমের মুক্ত বাজারের সাথে বিনোদনের বাজারও আবশ্যকিয়ভাবে মুক্ত!তবে ছোট দেশগুলো যাতে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে এবং কোন দেশ যাতে বিনোদনের বাজারে মনোপলি করতে না পারে, তার দিকেও প্রখর চোখ রাখা হয়েছে!বাংলাদেশে শিক্ষা পদ্ধতিতে যে বৈশম্য, তাতে ডাবিং ছাড়া ইংরেজি কার্টুন নিম্নবিত্তদের ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে!লোকজন যদি হিন্দি অনুষ্ঠান দেখে দেখে হিন্দি শিখে ফেলে তাও ভাল বৈ মন্দ না।
চ্যানেল শিল্পিদের ২, ৩, ৪, ৫ দাবি শুনলে বোঝা যায় প্রতিবেশি ভারতিয় বিনোদন সংস্থাগুলোর সাথে বাংলাদেশি সংস্থাগুলোর বানিজ্য ঘাটতি ঘটছে রেগুলেশানের ফাক গলে!
বাংলাদেশের অনেক বড় শিল্পি আছেন যারা বিশাল বহুজাতিক বিজ্ঞাপনি ও বিপনন সংস্থার কর্নধার!এখানে গার্মেন্টস শিল্পের ব্যাবস্থাপনার কথা আসে, বাংলাদেশে গত বিশ বছরে বিপুল পরিমান ব্যাবসায় প্রশাসনের স্নাতক বের হলেও, সে অনুপাতে গার্মেন্টস মালিকেরা দেশিও স্নাতকদের উচু পর্জায়ের ব্যাবস্থাপনাতে নিয়োগ দেন নাই, নিয়োগ দিয়েছেন ভারতিও এবং শ্রিলঙ্কানদের!এখানে বাংলাদেশি নিয়োগকর্তাদের হিনমন্যতা ছাড়াও দেশি স্নাতকদের দ্বিভাষি যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার সিমাবদ্ধতাকেও অনেকে কারন হিশেবে দেখিয়েছেন, যা আমার কাছে গ্রহনযোগ্য নয়!ব্যাবস্থাপনা একই সাথে স্বতোতসারিত এবং অনুশিলিত প্রক্রিয়া!অনুশিলিত প্রক্রিয়াতে শ্রিলঙ্কান যদি সময়োত্তির্ন হয়, বাংলাদেশের ছেলেও হবে সুযোগ ও সময় দিলে।
এটিচুড ব্র্যান্ডিং বনাম গোয়ারের সরলিকরন নিজের ব্র্যান্ড দাড় করাতে হলে, এটিচুডকেও ব্র্যান্ডের চলক হিশেবে দেখতে হবে।এই এটিচুড ব্র্ব্ব্যান্ডিংয়ের জায়গা থেকেই আমাদের শিল্পিদের আন্দোলনটি  অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন!শিল্পিরা কি প্রান, গ্রামিন, রবি, ব্র্যাক বা গার্মেন্টস শিল্পের দক্ষতার জায়গায় আসতে পেরেছে, না কি রানা প্লাজার মালিকের মত সোনার ডিম পাড়া হাসটার পেট কেটে সমস্ত ডিম একবারে বের করে আনার আত্মপ্রবোধে পরিতুষ্ট হতে চাইছে?বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলার প্রবনতা শুধু বিদেশিদের সাথে অসম বানিজ্যের কারনে নয়, সেটা দেশের ভিতরেও ঘটতে পারে, ঘটছে।বিভিন্ন বিজ্ঞাপনি সংস্থার কর্নধারেরা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে জড়িত থাকলেও, প্রবিন শিল্পিরা সময়মত মেধাবি নবিনদের জায়গা  না ছেড়ে দেয়াতে গ্রুপ থিয়েটার ব্র্যান্ডটির কোন নবায়ন হয় নাই!
আজকে যে প্রযুক্তির এত সুবিধা থাকা স্বত্ত্বেও চ্যানেল টিভির অনুষ্ঠান নির্মাতারা বিদেশি বাজারে যেতে পারছে না, তার পেছনেও আছে মেধার ঘাটতি এবং স্বজনপোষন প্রবনতা!আগে এই আন্দোলনকে গোয়ার এবং সরলিকরন বলেছি, কারন, পাতি বুর্জোয়া শিল্পি মুরুব্বিদের সামনে রেখে বুর্জোয়া চ্যানেল মালিকেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বসে আছে!এখন য়্যাক্টিভিস্টদের বাহানার পিছে আছে এই হাউসে হাউসে মামলার স্বার্থ!য়্যাক্টিভিস্টেরা নিজেরা কিম্বা তাদের পরিবারগুলা জড়িত এসব হাউসের সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন সংস্থায়, কিম্বা গনমাধ্যমে!
শিল্পিদের অনেকেতো য়্যাক্টিভিস্টদের ডাকে নাটক করে দিয়ে আসে, গান গেয়ে আসে!যারা মাগনা করে দিয়ে আসে, তাদেরকে শুধু য্যাক্টিভিস্টেরা নিবে, কমার্শিয়াল চ্যানেলগুলাতে কাজ করে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের পাশে য়্যাক্টিভিস্টেরা দাড়াবে না?আবার নুন আনতে পানতা ফুরানোরাও যে কাতারে কাতারে শহিদ মিনারে এসেছে তাও নয়!পাশাপাশি দাড়িয়ে পড়লেই যে কোন আন্দোলন সফল হয়ে যাবে তাও নয়।বাংলাদেশের লোক সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে শ্রমের বাজার আরো সংকুচিত হোক তা নিশ্চয়ই কেউ চাইছে না!রোহিঙ্গা শরনার্থিদের থেকে মুখ ফিরায়ে নেয়া থেকেও বোঝা গেছে যে শুধুমাত্র ধর্মের কারনে বাংলাদেশিরা দুর্গতকেও আশ্রয় দিতে রাজি না!তাহলে কি শিল্পিদের সাথে কথিত বিবিধ এক্টভিস্ট নেতাদের মৌলিক কোন বিরোধ আছে?
ধরা যাক রাম্পাল প্রকল্পের বিরোধিতার কথা।এখানে রামপাল থেকে প্রকল্পটি সরিয়ে নেবার দাবি জানানো হচ্ছে এবং ভারতিয় কোম্পানির সাথে আরো সমতাভিত্তিক চুক্তির দাবি জানানো হচ্ছে, কিন্তু প্রকল্পটি বাতিলের দাবি জানানো হচ্ছে না।কিন্তু শিল্পিরা যে দাবি জানাচ্ছে তাতে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও পাকিস্তান আমলের পরিস্থিতি অর্থাৎ অনুষ্ঠান/বিজ্ঞাপন লেনদেন বন্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।একটা কিছু বন্ধ করলে, তার সুত্র ধরে আরো কিছু বন্ধের উস্কানিও তৈরি হতে পারে!
বিজ্ঞাপন ও প্রতিদ্বন্দিতাপ্রতিদ্বন্দিতায় বাংলাদেশ যে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ভারতের বেশ কিছু রাজ্য থেকে তা আমরা তুলে ধরছি না!রাম্পাল নিয়ে প্রতিবাদ এসেছে, বিজ্ঞাপন রফতানি বন্ধের দাবি উঠেছে।এসবের পটভুমি থেকে গ্রামিন জাতিয় প্রতিষ্ঠানের ঋনসেবা সামগ্রি ভারতে রফতানির ব্যাপারটা কি আমরা তলিয়ে দেখছি?সিমান্তবর্তি রাজ্যগুলোতে প্রান এর পন্য রফতানির কথা আগে বলেছি।শ্রমের বাজারের পাশাপাশি আমরা কি পুজির বাজারও চড়াদাগে কেটেছেটে ফেলবো?না কি আমাদের বিনোদন শিল্পকে আমরা প্রান, গ্রামিনের মত দক্ষ করে তুলবো?শত দক্ষতার পরেও গ্ল্যামারের ব্যাপারটা থেকেই যায়!সেখানে বামনদের কাধে ময়ুর পুচ্ছ চড়িয়ে আর কতদিন আমাদেরকে ফাকি দেয়া হবে?অনেকে ভাবতে পারে রাম্পালিদের শিল্পকলাতে বাহাস করতে দেয়া হয় নাই বলে হয়তো তারা শহিদ মিনারে এসে শিল্পিদের পাশে স্লোগান দেয় নাই!কিন্তু আসলে কি ঘটনাগুলা, তুমি আমার সাথে আসো নাই, সুতরাং আমি তোমার সাথে যাবনা জাতিয়, না কি এর তাৎপর্জ আরো সুদুর প্রসারি?বিজ্ঞাপন রফতানি বন্ধের দাবিদাররা বলছে, দেশি পন্যের বিজ্ঞাপন বিদেশে প্রচারিত হলে না কি দেশের টাকা পাচার হয়ে যায়! এটা একেবারে এলেবেলে অভিযোগ! তারপর এরা অভিযোগ করছে,দেশি চ্যানেলগুলো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কম মূল্যে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে দর্শকরা বিরক্ত হচ্ছে।স্বিকার করছে না যে নিজেদের বিনোদন সামগ্রির মান বস্তাপচা এবং তা কেউ নিতে চাচ্ছে না।যথার্থই একটি দৈনিক শিরোনাম করেছে, 'বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন বন্ধের আবদার'!বিজ্ঞাপনজাত লক্ষির সাথে শিল্প সরস্বতির আদৌ কোন বিবাদ নাই বইয়ের একজন লেখক থাকে একজন প্রচ্ছদশিল্পি থাকে।প্রচ্ছদশিল্পি লেখক নন এবং এটা পুর্নাংগ শিল্পও নয়, কিন্তু প্রকাশনা শিল্পে মুদ্রন, প্রচ্ছদ, বাধাই সমস্ত সংশ্লিষ্ট শিল্প হিশাবে কাজ করে।কোন কতৃপক্ষ্য যদি বলে, প্রচ্ছদটা চলবে কিন্তু ভিতরের লেখা বাজেয়াপ্ত করা হলো, সেটা হবে আজগুবি অধ্যাদেশ!বিজ্ঞাপন হচ্ছে সেরকম দরকারি একটি বিপনন সংশ্লিষ্ট শিল্প, যার সাথে বিনোদনসহ সেবাসামগ্রির আরো অনেক শাখা জড়িত থাকে এবং সমান্তরালভাবে বিকশিত হয়।বিজ্ঞাপন কোন সামাজিক রোগও নয়, রোগলক্ষনও নয়।সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে একই বিজ্ঞাপনের উপস্থাপনাভঙ্গি বদলাতে পারে।কিন্ত দেশি পন্যের বিদেশে বিজ্ঞাপিত প্রচার বন্ধের প্রস্তাবনা সামাজিক সেন্সরশিপের চুড়ান্ত রুপ!শিল্পিদের কাছ থেকে এধরনের প্রস্তাবনার অর্থ দাড়ায় যে নিজেদের সৃজনশিল কাজেও তারা সেন্সরশিপ মেনে নিবে!চ্যানেল মালিক শিল্পিদের মজুরি যোগাড় করে তার নিজস্ব উৎস বা বিজ্ঞাপন থেকে।সরকার বা ব্যাক্তি মালিক যখন নিজস্ব উৎস থেকে মজুরি সর্বরাহ করে তখন তাকে ভর্তুকি বলা যায়।বিজ্ঞাপনদাতা বেশি বিজ্ঞাপন দিতে পারবে, তার পন্যের বাজার সম্প্রসারনের ওপর ভিত্তি করে!পন্যের  এবং সেবাসামগ্রির সরকারি  বা ব্যাক্তি নির্মাতাকে বিজ্ঞাপন প্রচারে শর্ত বেধে দিলে তা হয়ে দাড়াবে, যে ডালে বসে আছি সে ডাল কেটে ফেলার সামিল!
মুদ্রাস্ফিতির মত চ্যানেলস্ফিতিঢাকা শহরের অনেক ভবন ঢাকা পড়েছে ঝুলন্ত বিল বোর্ডের দৌরাত্মে।প্রত্যেক নগরের যে প্রাথমিক নান্দনিক ভিত্তি থাকে যা কেন্দ্র করে অন্যান্য সুকুমার বৃত্তি বিকশিত হবে, সে ভরকেন্দ্রটার শ্বাসনালি য্যানো জবরদস্তি চেপে ধরা হয়েছে।হাতির ঝিল জাতিয় মুক্ত পরিবেশগত স্থাপত্য শৈলির পাশাপাশি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়ে উঠছে নদি ভরাট করে ভুমিদস্যুতার খবর।অলস পুজির এবং কালো টাকার সহজ লগ্নির জায়গা হয়ে উঠেছে মিডিয়া।বাংলাদেশে যে পরিমান চ্যানেল, উন্নত অনেক দেশে এত চ্যানেল নাই।ফলে বিজ্ঞাপনদাতাদের সেচুরেশান পয়েন্ট তৈরি হয়েছে এত তাড়াতাড়ি।যেখানে পন্যের গুনগত মান নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না, সেখানে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনের মানও নিয়ন্ত্রন সম্ভব না!গুনগত মান নিয়ন্ত্রন বা কমপ্লায়েন্স ঘিরে যে অরাজগতা তার শিকার হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দক্ষ শিল্প মাধ্যমগুলো।বাংলাদেশের চামড়া শিল্প বিপুল্ভাবে বৈদেশিক বাজারের ওপর নির্ভরশিল।চামড়াশিল্পের সংশ্লিষ্ট বিপনন সংস্থা, বিজ্ঞাপনি সংস্থা, নক্সাকারিদের অনেকে বিদেশি।তেজগাও এলাকার বা কোন নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলের পন্যসামগ্রির উপর যদি বিদেশে বিজ্ঞাপন দেয়া যাবেনা বিধিনিষেধ চাপানো হয়, তার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়বে চামড়াসহ বিদেশি মুদ্রা উপার্জনকারি আরো শিল্পের ওপর।
শেষে এসে বলা যেতে পারে, যে কোন ধরনের ফ্যাশিজমের শুরু হয় কথাবার্তায়, শেষে আসে বিধিনিষেদের আড়ালে কন্ঠরোধ!চ্যানেলগুলোর একটা ন্যাজ্য দাবি হতে পারতো, সরকার এবং অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের সুষ্ঠূ বিতরন।একই সাথে মুক্ত প্রতিদ্বন্দিতাকে বরন করে নেয়ার সাহসে বলিয়ান হওয়া দরকার চ্যানেলগুলোর।আয় কমে যাওয়া মানে, আগের থেকে অনেক বেশি তথ্য পাওয়া সাধারন দর্শক তার সাধারন জ্ঞানের জায়গা থেকে মেধাহিনতার মেলাকে প্রত্যাখ্যান করছে।হুমকি, ধামকি দিয়ে সে দর্শককে আর টেনে ধরে রাখা যাবে না।শুধু চ্যানেল শিল্পি নয়, অন্যান্য শিল্পিদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে 'বিদেশি বাজারে দেশি পন্যের বিজ্ঞাপন বন্ধের' নামে সে আগামি দিনের শিল্পির মননশিলতাকে সেন্সরশিপের আগাম ছকে বন্দি করবে না কি করবে না!

চয়ন খায়রুল হাবিব
৬/ ১২/১৬
ব্রিটানি