Friday 28 November 2014

জিমুতবাহন বনাম বল্লালি হিন্দুত্ব

টাইটেল ও নিচাংশের বানান হেরফেরের কারন,উদ্ধৃত নিচাংশ এসেছে ইতিমধ্যে প্রকাশিত আমারচিত 'বাংলা ক্রিয়াপদের বিবর্তন' শিরোনামে বিষদ এক প্রবন্ধ থেকে।দুক্ষপ্রকাশ, জিমুতবাহনের বংশধরদের কাছে, কারন ওনার নিজ লেখা নামের বানান দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।প্রথম যেখানে প্রকাশ হয়, সেই আর্টস, ভিডি বাংলা একাডেমির বানান অনুসরন করে, যেমতি নিচাংশে কপি ও পেস্ট।মুদ্রিতভাবে পুরো প্রবন্ধটা পাওয়া যাবে প্রকাশিতব্য 'ভাষাপ্রমিতের সম্প্রদান : ভাঙ্গা-লিরিক, ভাঙ্গা-বয়ান'...' নামক আমার প্রবন্ধ সংগ্রহে। চখাহা।
   

পিতৃতান্ত্রিক ধমকের জের ধরে ক্রিয়া এবং ক্রিয়াপদের আবর্তনটা বাংলা থেকে জৈন-বৌদ্ধিক যাপনের অপসারণের আলোকে দেখা যাক।জৈন-বৌদ্ধ সমাজে জীব নির্বিশেষে সবার প্রাণের মর্যাদা এবং জীবিকা গ্রহণ, বর্জনের স্বাধীনতা সমান ছিল।সেন আমলে নবায়িত ব্রক্ষণ্য সমাজে মানুষ অর্জিত মৌলিক অধিকারগুলো হারালো।কৌলীন্য প্রথার অনুসারীদের কাছে তাতি, কামার, চামার,নাপিত, কুমোর, ঝাড়ুদার পেষার দরিদ্রদের উৎপন্ন সেবাসামগ্রী সবাই ভোগ করলেও, সামাজিক পর্যায়ে এদেরকে অভিব্যাক্তিশুন্য করে ফেলা হয়!
নাথযোগি তাতি, ধর্মঠাকুরের পূজারী, সহজযানী, মীননাথ, গোরক্ষনাথপন্থী বিভিন্ন শাখার যেসব বৌদ্ধ জেনোসাইড থেকে রক্ষা পায় তারা শূদ্র বা অস্পৃশ্যতার ভাগ্য বরন করে নিয়ে ব্রাক্ষণ্য সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসাবে আত্মরক্ষা করে!এই দুর্ভাগ্য বরনকে জন্মদোষ বা কর্মদোষ বলে জায়েজ করা হয়!এদের লেখাপড়ার অধিকার হরণ করা হয়; পুরো চালের ভাত খেতে পারবে না,উচ্ছিষ্ট খাবে, এঁটো না পেলে ক্ষুদ রেঁধে খেতে পারবে; পুরো কাপড় বা নতুন কাপড় পরতে পারবে না, ছেড়া কাপড় পরবে!

অধিকার হারানো, হীনবল, সম্ভ্রম বঞ্চিত এই প্রান্তিকেরা প্রাণধারণের যে অবর্ণনিয় সংগ্রাম বা ক্রিয়াকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল তাতে এ-সময়ে ক্রিয়াপদের বিবর্তনটা ছিলো শ্লথ, প্রায় শূন্য, অন্তর্মুখী!সেন শাসকদের আনুকূল্য পাওয়া ব্রাক্ষন, পণ্ডিতদের হাত থেকে অনুশাসনের সংস্কৃত ব্যাক্ষা, অপব্যাক্ষা বাদে বাংলার জনগোষ্ঠী কিছুই পায় নাই বলাটা অবশ্য সত্যের অপলাপ!জীমূতবাহন বৈদিক প্রাচীন উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের যে নির্দেশনা তৈরি করেছিলেন, তার মর্মার্থে পৌঁছালে এই ব্যতিক্রমী বাঙ্গালি মনীষার প্রতি হাজার বছর পরেও শ্রদ্ধা জানাবার ইচ্ছাটাই প্রবল হয়।

জীমূতের আইনি সংস্কার এবং নতুন ক্রিয়াপদ:
জীমূতবাহনের জন্ম পশ্চিম বাংলার রাধায়।দিন, তারিখ ক্ষণ সঠিকভাবে জানা না গেলেও সংস্কৃতে লেখা জীমূতের কালজয়ী আইনি শাস্ত্র ‘দায়ভাগ’ এর বিভিন্ন সূত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার লেখালেখির মুল সময়টা ছিল ১১০০ খ্রিস্টাব্দে বল্লাল সেনের শাসনামলে।মনুসংহিতার আমল থেকে জীমূতের আগে অব্দি হিন্দু পারিবারিক আইনে জন্মমাত্র ছেলে-সন্তান বাবার সম্পদের উত্তরাধিকারী হতো, আর সতীদাহ প্রথার ফলে স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের অনধিকার সহজেই অনুমেয়। এই দুই ক্ষেত্রে জীমূতবাহন মৌলিক সংস্কারের পরামর্শ দেন:

১)বাবার মৃত্যু হওয়া ছাড়া ছেলেদের ওপর আপনাআপনি জন্মসূত্রে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বর্তাবেনা।

২)বিধবাদের ওপর স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকার বর্তাবে, এমন কি স্বামীর জীবিত ভাই থাকলেও।

সেন আমলে যে বাংলাতে জীমূতের এই সংস্কার প্রয়োগ হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে!এই আইন দুটো মনু এবং মিতাক্ষরার বর্ণাশ্রম প্রথার মৌলিকভাবে বিরোধী! বিভিন্ন বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কুক্ষিগত করে ইতিমধ্যেই শক্তিশালী ব্রাক্ষনদের রাজনৈতিকভাবে আরো প্রভাবশালী হওয়াটা ঠেকাতেই হয়ত বল্লাল রাজ্য বিস্তারের সাথে, সাথে পারিবারিক সম্পত্তি আইন সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করে।

‘দায়ভাগ’ গ্রন্থের দীর্ঘমেয়াদী প্রায়োগিক সুরতহাল করলে দেখা যাবে আঠারো শতকের রামমোহন, বিদ্যাসাগরদের তুলনায় ব্রিটিশের হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারে জীমূতবাহনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।কোলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হেনরি টমাস কোলব্রুকের হাতে ‘দায়ভাগ’ গ্রন্থটা হাতে আসে ১৮১০ সালে।কোলব্রুক গ্রন্থটির আদ্যপান্ত অনুবাদ করান এবং এর বেশির ভাগ নির্দেশনাকেই হিন্দু পারিবারিক বিচারিক কাজে ক্রমান্বয়ে বিধিবদ্ধ করে নেন।১৮২৯ সালে যখন আইন করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করা হয়, বলাই বাহুল্য কট্টরপন্থী হিন্দুদের নিরস্ত করতে জীমূতবাহনের আইনি সংস্কারের দৃষ্টান্ত সামনে নিয়ে আসা হয় কাটা দিয়ে কাটা তোলার কৌশল হিসেবেই।

সতীদাহের বিরুদ্ধে মোঘল বাবর, শাহজাহান একের পর এক ডিক্রি জারি করেও কখনোই পুরোপুরি রোধ করতে পারে নাই!আকবরের আমলে অনুমোদন সাপেক্ষ বিধান করা হয় এবং সুবাদারদের অনুমতি না দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।এর থেকে অবশ্য সুবাদারেরা উৎকোচের সুযোগ তৈরি করে নেয়।১৬৬৩ সালে ঔরংজেব ডিক্রি জারি করে একে পুরোপুরি নিষীধ্ব করে!

এমন হতে পারে যে রেনেসার নব্য বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ সবাই বিভিন্ন সংস্কারের সিলমোহর, তকমা নিজেদের দিকে টেনে নিতে এতরকম কাল্ট, অকাল্ট ব্যবসাতে ব্যাস্ত ছিল যে বিব্রতবোধ ছাড়াও, বিলাতে না যাওয়া হাজার বছর আগেকার পণ্ডিত জীমূতবাহনের উল্লেখে ঐতিহাসিকভাবেই ঈর্ষা বোধ করেছে!ক্ষনার জিব ওপড়ানো, সতীদাহ জায়েজ করা সমাজে জীমূতবাহনের নির্দেশিত বিধাণমতে সম্পত্তিতে নারীর এবং বিধবার অধিকার নিসন্দেহে যুগান্তকারী!সতিদাহের সাথে জড়িত ক্রিয়াপদগূলোর যে জিমুতবাহনি সংস্কারের ফলে অন্তত কস্মেটিক সার্জারি করতে হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য!

চয়ন খায়রুল হাবিব
২০১০
ব্রিটানি