Friday, 28 November 2014

ওহ রবঈন্দ্রনাথ

টাইটেল ও নিচাংশের বানান হেরফেরের কারন,উদ্ধৃত নিচাংশ এসেছে ইতিমধ্যে প্রকাশিত আমারচিত 'বাংলা ক্রিয়াপদের বিবর্তন' শিরোনামে বিষদ এক প্রবন্ধ থেকে।মুদ্রিতভাবে পুরো প্রবন্ধটা পাওয়া যাবে প্রকাশিতব্য 'ভাষাপ্রমিতের সম্প্রদান : ভাঙ্গা-লিরিক, ভাঙ্গা-বয়ান' নামক আমার প্রবন্ধ সংগ্রহে।চখাহা।
রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ:
রামমোহন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলোঃ ”রামমোহন রায় যখন গদ্য লিখতে বসেছিলেন তখন তাঁকে নিয়ম হেঁকে হেঁকে কোদাল হাতে,রাস্তা বানাতে হয়েছিল।ঈশ্বর গুপ্তের আমলে বঙ্কিমের কলমে যে গদ্য দেখা দিয়েছিল তাতে যতটা ছিল পিণ্ডতা,আকৃতি ততটা ছিল না।”…
চর্যাপদের আমল থেকে,মধ্যযুগ ধরে ফার্সি,তুর্কি,হিন্দি প্রভাবকে আত্মস্থ করে বাংলা ক্রিয়াপদের যে স্থানীয় বিবর্তন হয়েছিল রামমোহনসহ আরো কিছু রেনেসাওয়ালা তাকে এড়ানোর ফলে সজনীকান্তদের হাতে ‘কোদাল’খোঁড়া কাচা ক্রিয়াপদের কর্কশ রূপটা দেখা যাক:
”গগনমণ্ডলে বিরাজিতা কাদম্বিনী উপরে কম্পায়মানা শম্পা সঙ্কাশ ক্ষণিক জীবনের অতিশয় প্রিয় হওত মূঢ় মানবমণ্ডলী অহঃরহঃ বিষয় বিষার্ণবে নিমজ্জিত রহিয়াছে।”সজনীকান্ত দাসের প্রবন্ধ থেকে।

কথিত উন্মেষ পর্বের নামে রাম মোহনের অধ্যায়টা পার হতে বাংলা ভাষাভাষীরা কৃতজ্ঞতাভরেই স্মরণ নিতে পারে বিদ্যাসাগরি গদ্যের।বঙ্কিমও বুঝতে পেরেছিল যে শুদ্ধতাবাদের কোদাল, শাবল, গাঁইতি দিয়ে সাহিত্য চর্চা হয় না।কল্পনাশক্তির এবং স্থানিক কথনভঙ্গির প্রতি পক্ষপাত গুনে ভাষাতে, ক্রিয়াপদের ব্যবহারে অসঙ্কোচ-নান্দনিকতা যোগে সমর্থ হলেও প্রবর্তনাগত দিক থেকে ধর্মীয় জাগরনবাদি স্কুলেই থেকে যায় বঙ্কিম!

আবার রামমোহনকে ‘কোদালধারি’ বলা রবীন্দ্রনাথও গৌরবগাঁথার খোজ করছে উত্তর ভারতে, সংস্কৃত পুরাণে!পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বাউলদের গানসহ, বিভিন্ন পুথি, পাঁচালিতে চর্যার আমল থেকে যে বিবর্তন হয়েছে, তা রবীন্দ্রনাথের পাঠে হয়’লোকসাহিত্য’বা’পল্লি-সাহিত্য’!ক্রিয়াপদের পথচলতি ব্যাবহারকে কয়েকশ বছর এগিয়ে দিয়ে মান্য প্রমিতে রূপান্তরে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা যুগান্তকারী হলেও,তার ভূমিকাকে প্রশ্ন-সাপেক্ষ করা যেতে পারে!

(১)”সাধু ভাষার বাংলা বর্ণমালায় আর-একটা বিভীষিকা আছে, মূর্ধন্য এবং দন্ত্য ন’এ ভেদাভেদ -তত্ত্ব। বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। মূর্ধন্য ণ’এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই!”….রবীন্দ্রনাথ,’বাংলাভাষা পরিচয়’

(২)”বাংলা বর্ণমালায় সংস্কৃতের তিনটে বর্ণ আছে, শ স ষ।…ওরা বাঙালি শিশুদের বর্ণপরিচয়ে বিষম বিভ্রাট ঘটিয়েছে। উচ্চারণ ধরে দেখলে আছে এক তালব্য শ।আর বাকি দুটো আসন দখল করেছে সংস্কৃত অভিধানের দোহাই পেড়ে। …যেমন, স্নান হস্ত কাস্তে মাস্তুল।শ্রী মিশ্র অশ্রু : তালব্য শ’এর মুখোশ পরেছে কিন্তু আওয়াজ দিচ্ছে দন্ত্যস’এর।”…রবীন্দ্রনাথ’বাংলাভাষা পরিচয়’

এরকম অনেক অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ নিজে নিষ্পত্তি না করে ভার তুলে দিয়েছেন সুনীতি কুমারদের হাতে।।হিন্দু, মুসলিম মিলায়ে ব্যাপক নিরক্ষর বাঙ্গালি কৌমের ক্রিয়াপদ ব্যাবহারে সহজতার প্রধান শর্ত যে প্রায়োগিক বানান সংস্কার সেটা বুঝেও ব্যাকরণের জাবেদা খাতাটা আনুষ্ঠানিক অধ্যাপকদের হাতে সমর্পণ সামাজিক আপোষ য্যামন, তেমনি নিজের বাড়ন,গড়নের পুরোটাই অনানুষ্ঠানিক হবার পরিপ্রেক্ষিতে স্ববিরোধীও বটে!
রামমোহনের সাথে পার্থক্য এখানেই যে উচ্চারণের দোহাই পেড়ে ক্রিয়াপদের পরম্পরা ও বিবর্তনের জন্য যে সাহেবি নাগরিকতার বাইরে নিরন্তর খোড়াখোড়ি চালিয়ে যাওয়া দরকার তার তাগিদও বার বার এসেছে রবীন্দ্রনাথ থেকেই!


চয়ন খায়রুল হাবিব
২০১০
ব্রিটানি