টাইটেল ও নিচাংশের বানান হেরফেরের কারন,উদ্ধৃত নিচাংশ এসেছে ইতিমধ্যে প্রকাশিত আমারচিত 'বাংলা ক্রিয়াপদের বিবর্তন' শিরোনামে বিষদ এক প্রবন্ধ থেকে।মুদ্রিতভাবে পুরো প্রবন্ধটা পাওয়া যাবে প্রকাশিতব্য 'ভাষাপ্রমিতের সম্প্রদান : ভাঙ্গা-লিরিক, ভাঙ্গা-বয়ান' ...' নামক আমার প্রবন্ধ সংগ্রহে। চখাহা।
চয়ন খায়রুল হাবিব
২০১০
ব্রিটানি
যৌনতাজ্ঞাপক ক্রিয়াপদের বেহাল:
বাংলা সিনেমায় চুমু,সঙ্গম দেখানো যাবে না!বহিরঙ্গে ইত্যাকার না-বাচকতার হিসাব করলেই অন্তরঙ্গে বিকৃতি এবং অবদমনের এক অসুস্থ চিত্র ফুটে উঠে!বাংলা রেনেসাঁ যে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধে প্রভাবিত তার শেকড় যেমন কট্টর যৌন-প্রতিক্রিয়াশীল-অবদমনে আক্রান্ত, সেরকম বৈদিক যৌনতার নান্দনিক প্রকাশ যে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ তাও নারীকে অধস্তন সেবিকার রতিভার দিয়েই দায় সেরেছে; মধ্যপ্রাচ্যের ‘আরব্য রজনী’ বহু রকম যৌন বিবরণে ভরপুর হয়েও শেষতক নারীকে হয় ভোগ, নয়তো দুর্ভোগের জন্য দায়ী করেছে!
’আরব্য রজনী’সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক উপাখ্যান তাদের মুল্যবোধগত রসদ ‘ইদিপাস’ ধরনের গ্রিক নাটক থেকে গ্রহণ করলেও, যৌনাচারের সহনশীলতায় গ্রিক সমাজ সেই শাপ্য, কাভাফির আমল থেকেই অনেক, অনেক এগিয়ে গেছে।
সমকামিতা, উভকামিতার প্রতি সাংস্কৃতিক ভিতিবোধ প্রায়শই ভারতীয় এবং বাঙালি মানসে ককুরভিতির রূপ নিয়েছে!আবারো স্মর্তব্য যে বাঙালি এক চর্যা রচয়িতার নাম ছিলো কুক্কুরিপাদাম, তার সঙ্গী কুকুরের প্রতি ভালবাসার প্রতীক হিসাবে!জিবের অধিকারে যেরকম বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান বিশ্বস্ত নয়, সেরকম জিবের বিভিন্নরকম যৌন আবেদনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল নয়!পুংলিঙ্গ বাচক সোনা, ধন ইত্যাকার শব্দ সামাজিকভাবে আদরণীয় হলেও, স্ত্রীলিঙ্গ বাচক যৌনাত্মক শব্দ হামেশা ব্যাবহার হয় গালাগাল হিসাবে, সঙ্গম বাচক সাধারন্যের চলতি বুলিও আখ্যা পেয়েছে ছোটলোকের বুলি হিসাবে!শিবলিঙ্গ, কুমারী পূজার চল গাঙ্গেয় বাংলাতে শুরু বৈদিক আমলেরও আগে গঙ্গারিডই আমলে, একই সময় পরিসরের মহেঞ্জোদারোর নগ্ন কিশোরী মূর্তির ডৌল দেখেই বোঝা যায় সে-সময়ের দেহছন্দের মুক্ত উদ্ভাসন!
বাংলায় বোরখা বা হিজাব এসেছে অনেক পরে, কিন্তু সমাজকে অপরাধমনস্কতায় বাধবার তোড়জোড় হাজার বছরের!দেহের আগে মন গেছে কুঁকড়ে!অযৌন প্রেমকে অধ্যাত্ম হিশাবে ধার্য করা হয়েছে!এর বিপরীতে সাধুর সাথে ক্ষেপীর সহজিয়া শরীরী অর্পণ!ইসলামি কাব্যকলার নামে বাংলাতে যেরকম খাইয়ামের রুবাইকে যৌনতাশুন্য করা হয়েছে, সেরকম অযৌন, অলৌকিকের খোল নলচে পরানো হয়েছে লালনের লৌকিক যৌনসুত্রে!ডক্টর আহমদ শরিফদের মত অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন রকম ভাবে সমাজতন্ত্রের পক্ষে গিয়েও,জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’র প্রবর্তনাকে দেখেছেন অনাচার হিসাবে!
বাংলাদেশের কথিত উন্নয়ন কর্মীদের যে নারীবাদ সেখানে ‘চেইন’ এবং ‘লিঙ্কের’ অর্থ গুলিয়ে ফেলায় যৌনাত্মক অনেক বিশ্বজনীন আচরণই অপব্যখ্যার অবকাশ পেয়েছে।যৌনশিক্ষাকে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে পর্নোগ্রাফির সাথে!চুমুর ছবিকে, নগ্নতাকে এই একবিংশ শতকেও বাংলাদেশে চমক হিশাবে ধরা হয়!যৌনতার আলোচনায় পুরুষদের ভিড়ে অধিকার সচেতন নারীও আরো সচেতন হয়ে রক্ষণশীল ‘কিন্তু’তে চলে যান, যৌনতা মাত্রেই প্রায় অজাচার এবং কেলেঙ্কারি, আর তার পণ এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মরণ দিয়েই শুধতে হয় নারীকে!সমকামিতাকে লুকানো হয়, ‘চিরকুমার’ এর ছদ্মবেশে।গরিষ্ঠ সংখ্যক নারীকেই যেহেতু হয় স্ত্রী’র মর্যাদা, নয় পতিতার অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে হয়ে, সেই একই হেতু স্বাধীন নারীর মর্জাদাজ্ঞ্বাপক যৌন, অযৌন কোন শব্দ এখনো বাংলাতে নাই।
সমাজতান্ত্রিক দেশ ও সংস্কৃতিগুলোতে মানুষের বিভিন্ন রকম যৌনাচার ব্যাক্তির মৌলিক স্বাধিকারের সাথে, সাথে স্বীকৃত হলেও, মার্ক্সবাদী অনুশীলনে নারী, পুরুষের যৌন স্বাধীনতাকে পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের সাথে মিলিয়ে সঙ্গমকে নিছক প্রজনন এবং শ্রম হিশাবে দেখানোর প্রয়াস নেয়া হয়েছে।সঙ্গমের, যৌনতার যে শিল্প তা ধর্মবাদি এবং তাত্ত্বিক রাজনীতিতে নিখোঁজ হলেও নৃতাত্ত্বিক মিলন-মিথুন মূর্তি দেখলে বোঝা যায় যে গাঙ্গেয় রাড়ে বিচিত্র যৌনাচার গ্রহণিয় ছিল!বর্তমান প্রেক্ষাপটের ক্রিয়াপদগত অচলায়তন ভাংতে সেই মিথুনমুর্তিদের শিরোনামকেই নবায়ন করে নেয়া দরকার!
চয়ন খায়রুল হাবিব
২০১০
ব্রিটানি