Friday 26 September 2008

ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি... বাড়ি কই গো...

বাংলাদেশের মানুষ এ-কথা সে-কথার পর না সুধিয়ে পারে না, জিজ্ঞ্বেস করেঃ বাড়ি কোথায়?

রবিন্দ্রনাথের কত বাড়ি ছিল- জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ি, শিলাইদহে কুঠিবাড়ি, বোলপুরে উত্তরায়ন, দার্জিলিং, লন্ডন, ব্রিস্টল আরো কত কি!বাড়ি মানে বাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি!রবিন্দ্রনাথ বেশ হিশাবি লোক ছিলেন।ওর জিবতকালে জোত জমা যেমন বাড়িয়েছিলেন, তেমনি নিজের মেধাকেও মুহুর্তের জন্য কমতে দেন নাই।বাড়িগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলে ফেলেছিলেন।

মাইকেলেরও অনেক বাড়ি ছিল।কিন্তু ওর বাবা ছেলের ধর্মান্তরে রেগেমেগে ঐসব বাড়িতে মাইকেলের প্রবেশে নিশেধাজ্ঞ্বার পাশাপাশি মাইকেলকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।
আয়-ঊপার্জনহিন,বাড়িবিহিন, বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার মাইকেল স্ত্রিসহ উঠেছিলেন কোলকাতার সবচেয়ে বনেদি হোটেলে!

নজ়রুলের বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার পুরুলিয়ায়।নজরুলের ডাক নাম দুখু মিয়াই বলে দেয় নজরুলের বাড়ির হাল!পরে গ্রামোফোন কোম্পানিকে গান বেচে নজরুল কামিয়েছিলেন অঢেল।নিউরো সিফিলিসে পঙ্গু নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার স্বাধিনতার পর ঢাকার ধানমন্ডিতে অত্যন্ত সুন্দর দোতালা বাড়ি দিয়েছিল।বাড়ির সাথে সেবা ও অঢেল খাই খরচ।খিলখিল কাজিদের বিমানে মাগনা ঘোরাঘোরি।বাংলাদেশের অবস্থা তখন খুবই খারাপ।খুবই খারাপ।দারিদ্রের আত্মস্লাঘা দেশ ভুলতে চেয়েছিল আতিথিয়েতার মাহাত্মে!

জিবনানন্দের জন্ম বরিশালে।কাজসুত্রে কোলকাতায় বসবাস।বাড়ি ছিল , কিন্তু বৈঠকখানা ছিলনা!

কবিদের বাড়ি আছে কি নাই; সে বাড়িতে শোবার ঘর, বসবার ঘর , রান্নাঘর, স্নানের ঘর এসব কি কবিতাকে প্রভাবিত করে?সবাইত ভালভাবে থাকতে চায়।কিন্তু অন্যেরটা কেড়ে ভাল থাকা কবিরা নিশ্চই চায় না।রুটিকে পুর্নিমার পোড়া চাদ হিসেবে দেখতে সুকান্তের হয়ত তেমন ভালও লাগে নাই।আর সুকান্তের কবিতা ব্যবহার করে যে কমিউনিস্টরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার চিরস্থায়ি বন্দবোস্ত করেছে তাদের পাশন্ডতা, পাশবিকতাত সব অর্থে মানুষের যে কোন মানবিক অর্জনকেই ধুলিস্মাত করে দিতে পারে।

যে বাংলাদেশ নজরুলকে বাড়ি দিয়েছিল ঢাকাতে, সেই শহরেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে বস্তিগুলোকে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বুলডজার দিয়ে।কবি নজরুলের কবিতা পাঠকেরাই এ-কাজটি করেছে।রোম শহর পূড়বার সময় নিরোর বাশি বাজানোর মত বস্তিবাসিদের দফায় দফায় উদবাস্তু বানানোর সময় বই মেলা, ইদের আনন্দমেলা কোনোটাতেই কমতি পড়ে নাই।

শামসুর রাহমানের সবসময় ছিলেন ভাড়াটে।্যে গনতন্ত্রের জন্য ও আমৃত্যু সংগ্রাম করেছিল তাতে বাড়িওয়ালা, ভাড়াটে, বস্তিবাসি সবার অংশগ্রহনের অধিকার থাকবার কথা।অভিজাত এবং মধ্যবিত্যদের নাক উচু, নৈর্বাক্তিতার ব্যক্তিগত সমিকরন তৈরি করতেই কি শামসুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের পড়ার বা ডিগ্রি সনদের তোয়াক্কা করেন নাই?শ্বৈরতন্ত্রের প্রতিবাদে সরকারি চাকুরিতেও ইস্তফা দিয়েছিলেন।

বিশ্বের আর বাদবাকি মধ্যবিত্তের মতই বাংলাদেশি মধ্যবিত্তও নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বেশ একজোট।সৈনিকদের হাতে চাত্রদের লাঞ্ছনা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কারাবন্দি করবার পর মিডিয়াতে, রাস্তায়, অন লাইনে, দেশে , প্রবাসে আমরা মধ্যবিত্তদের না মরতেই গায়েবানা জানাজার সমস্বর মোনাজাতও শুনেছি।শুনতে না চাইলে গাড়ি পুড়িয়ে, রাস্তার ছোট ব্যবসায়িকে হত্যা করে শুনতে বাধ্য করা হয়েছে।কিন্ত্য যে লোকগুলো বৈশাখি মেলাতে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বেলি ফুলের মালা গাথে; ফুচকা, চটপটি ফেরি করে; বাসা বাড়ি আর গার্মেন্টসে কায়িক শ্রম সর্বরাহ করে তাদের উচ্ছেদে মধ্যবিত্তের এককাট্টা না হওয়া ্যে হাত খাওয়ায় সে হাত কেটে ফেলবারই শামিল।

জালিয়নওয়ালাবাগে ব্রিটিশের পৈশাচিকতার পর , অর স্বেতাংগ এবং স্বদেশি অভিজাতকুল নাখোশ হবে জেনেও রবিন্দ্রনাথ নাইটহুড খেতাব ফেরত দিয়েছিলেন।শান্তিনিকেতন গড়েছিলেন এমনি আক্ষরিক বিশ্ব ভারতির আদলে যে ওখানে সমাজের সবচেয়ে উচু শ্রেনির ইন্দিরা ও সবচেয়ে নিচু শ্রেনির রাম কিঙ্কর অনায়াসেই তাদের মেধার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।সাওতালদের জন্য গড়েছিলেন একের পর এক স্কুল আর হাসপাতাল।

আমি নিশ্চিত নান্দিগ্রাম আর ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি উচ্ছেদে রবিন্দ্রনাথ চুপ করে থাকতেন না।

আমার জ়ন্ম , বেড়ে ওঠা ঢাকাতে।ওখানে কেন , কোথাও আমার বাড়ি নাই।কিন্তু তবু আমি ঘরামি!দুয়ার বন্ধের চাবি আমি ঘর খোলা মাত্র বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি!

চয়ন খায়রুল হাবিব

লন্ডন সেপ্টেম্বার/২০০৮