Saturday 8 August 2020

মগের মুল্লুক ও আলাওলের ফাকিবাজি তোহফা!


প্রাককথন!

প্রথমত মানুষ, তারপর মেজর, মৌলভি, মোক্তার ইত্যাকার পদকর্তা।সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনী, মিষ্টির কারিগর, সমাজতন্ত্রী, মৌলবাদীর সবার এ-বুঝটি দরকার।এ-বুঝটি ধারণের সাথে সাথে মানবিক সংস্কারের সূত্রপাত হয়।





মিষ্টিতে ভেজাল দিয়ে ময়রা যেরকম মানুষ মারতে পারে, মৌলবাদীও সেরকম পরকালের মিষ্টি দেখিয়ে ইহকালে অনাসৃষ্টি ঘাটাতে পারে, ঘটাচ্ছে।ময়রা, মোক্তার, সমাজতন্ত্রি, মৌলবাদী, সবারই ক্রমাগত সংস্কার, ক্রমাগত নবায়ন দরকার।সকলেরই কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, উকিল,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সৈনিক,  ময়রা ও মৌলভি হবার অধিকার আছে।কিন্তু তত্বের জোরে, ধর্মের জোরে, দলের জোরে, বন্দুকের জোরে, টুপির জোরে, ইউনিফর্মের জো্‌রে, চাপাটের জোরে, জোর যার মুল্লুক তার, পদ বিশেষে সে-মুল্লুকের বেশি ভাগীদার এরকম সমাজ ব্যবস্থা এই পৃথিবীতেই বহু অঞ্চলে পরিত্যক্ত।প্রথমত মানুষ, সমানভাবে তার প্রাণরক্ষা ও বিকাশে অন্যবিধ সব উপকরণের প্রয়োগ না হলে বিকাশটা ফাঁপা ওপরচালাকির বাইরে আসবে না।(ইয়োরোপ, মৃত্যুদন্ড এবং কল্যানবোধক বিচ্চার) 


সম্প্রতি বাংলাদেশে পুলিশের হাতে নিহত মেজর সিনহাকে মেজর বলার আগে মানুষ হিশাবে দেখি এবং ওনার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাই, বিচার চাই।সিনহার হত্যাকান্ডের সময় গ্রেপ্তার ছাত্র, মিডিয়া কর্মি শিফাত ও শিপ্রার মুক্তির দাবি জানাই।বাংলাদেশি বাঙ্গালির প্রতি তার সরকার, তার পুলিশ, তার সেনাবাহিনী, তার মসজিদ সমাজ সকলেই নির্মমতা দেখাচ্ছে।লিখেছি, প্রথমত মানুষ।কিন্তু মনুষ্যত্বের বীজবপন করতে হলে তো শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক গুণাবলিকে অধীত বিদ্যা করে তুলতে হবে, সেটা স্কুল, মাদ্রাসা, পুলিশ শিক্ষাকেন্দ্র, সেনানিবাস সবখানে।জন্ম, বাৎসল্য, বন্ধুত্ব, প্রেম, যৌনতা, সম্পর্কের ভিত্তি যে মানবিক গুণাবলি, ধান্দাবাজের গা জওয়ারি নয়, তার বীজ প্রাথমিক শিক্ষায় আনা দরকার।

রবীন্দ্রনাথের বানিতে বলিয়ান হয়ে গান্ধি দেখিয়েছে অহিংসার পথ অধিকার আদায়ের পথ হতে পারে।মুসলিম পরিবারে জন্মালে ঔরঙ্গজেবকে মাথায় তুলতে হবে, বৌদ্ধ পরিবারে জন্মালে অশোককে শ্রেষ্ঠ মানতে হবে, এগুলো আমাদের মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটায় না, বরং প্রতিশোধের ঐতিহাসিক অজুহাত তৈরি করে।সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের হাতে নিহত হলে সেখানকার পুলিশি ব্যবস্থার বর্ণবাদি উপসর্গগুলোর আমূল পরিবর্তনের দাবির পাশাপাশি, পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য উপড়ে ফেলা হয়।বাংলাদেশে যাদের জাতীয় নেতা বলে শেখানো হয়, তাদের অনেকে জাতিবিদ্বেষি পাকিস্তান আন্দোলনের পুরোধা ছিলো।

পাকিস্তানি সামরিক শাসনের সূত্র ধরে বাংলাদেশে যতবার সামরিক শাসন কায়েম হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ছাত্রদের ততবার ধারাবাহিকভাবে নারকীয় হত্যা ও হ্যানস্থার শিকার হতে হয়েছে।আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি ১৯৮৫-৯০।পুরো আশির দশক জুড়ে সামরিক বাহিনীর দোসর হয়ে পুলিশ ট্রাক চাপা দিয়ে, মিছিলে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যা করেছে।এজন্য কাউকে কখনো বিচারিক জবাবদিহিতার ভেতরে আনা হয় নাই।হত্যার বাইরে ছাত্রদের ওপর জেল, জুলুম ছিলো নৈমিত্তিক ঘটনা।সেগুলোর কোনো বিচার হয় নাই।নিহত ছাত্রদের পরিবার যেরকম বিচার পায় নাই, একই ভাবে বিচারবঞ্চিত কল্পনা চাকমা, চলেশ রিচিল, তনুর পরিবার।

গারো নেতা চলেশ রিসিলের জন্য শোকগাথা

মগের মুল্লুকে!
পুরো পাকিস্তানি শাসনামল, ১৯৭১ এর গণহত্যা, বাংলাদেশে নামে, বেনামে দীর্ঘ  সামরিক শাসনামলে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ট্রমার মুখোমুখি করা হয়েছে, তাদের শ্বাস ফেলবার অবকাশ দেয়া হয় নাই।তরুণ প্রজন্মকে নির্জিব,আত্মমুখি করে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে রাসায়নিক মাদক।গণমুখী কুদরতে খোদা কমিশনের শিক্ষানীতি এড়িয়ে গনপ্রত্যাখ্যাত মজিদ খানের  বেসরকারি, ৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্য-নিতি আমাদের ওপর চাপানো হয়েছে যাতে মানুষের আগে মুনাফাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যার সূত্র ধরে আমাদের চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি হয়ে উঠেছে রক্তচোষা, রাজনীতি ও সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছে সে রক্তচোষনের দোষর, আইন রক্ষাকারী বাহিনী হয়ে পড়েছে রক্তচোষনের হাতিয়ার।

আমাদেরকে মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে মুক্তচিন্তাকে পায়ে মাড়িয়ে।মুক্তবাজার অর্থনীতির একটা মানবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে সমবায় অর্থনীতি।সমবায় অর্থনীতিতে মুক্তবাজার ও সাম্যবাদের মিশেল থাকতে পারে।রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, স্পেনের বিখ্যাত বার্সিলোনা ফুটবল ক্লাব বিকশিত হয়েছে সমবায় সমিতির মাধ্যমে।আমাদের বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য-নিতি থেকে অর্জিত টাকা জমা
পড়ছে বিদেশে, অধ্যাপক ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ থেকে পাওয়া মুনাফার পাহাড় জমা হচ্ছে নরওয়েতে।দেশের ভেতরেও কম মুনাফার পাহাড় হয় নাই।কিন্তু সে মুনাফার সাথে মনুষ্যত্বের সম্পর্ক নাই।

মনুষ্যত্বের মূলে যে মননশীলতা তা হয়ে পড়েছে সস্তায় পড়ে পাওয়া তিন আনা, এখান থেকে চুরি করে ওখানে লিখে দিলাম, দল পাকিয়ে গুটি চালতে থাকলাম, বুদ্ধিজীবী হয়ে গেলাম, সাংবাদিক বনে গেলাম।
ইতিহাসের সব সময়খন্ডই কম বেশি পচনশীল।আক্ষরিকভাবে সময়ের পচনশীলতা থেকে সময়ের উর্বরাশক্তি তৈরি হয়।কখনো কখনো হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় এক সপ্তাহের ঘটনা তৈরি হয়, কখনো এক সপ্তাহের ঘটনায় হাজার বছরের অভিঘাত তৈরি হয়। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭২ এর সংবিধান বাঙ্গালির সেরকম যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ।

পাকিস্তান আমলের আগে বাংলার জনপদে যে কসমোপলিটান, বহুসংস্কৃতির বহুসচল মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল, তা বোঝা যায় আরমানিটোলা ও পানাম নগরের ইতিহাস পড়লে।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আরমানিটোলার আর্মেনীয়রা, পানাম নগরের হিন্দু ব্যবসায়ীরা পূর্ব বংগ ছেড়ে ভেগেছে।ধর্মিয় পরিচয়কে সম্বল করে এগোতে চাইলে আমাদের ভেতরের অন্তর্ঘাত বাড়তেই থাকবে।কয়েক প্রজন্ম বসবাসের পর বিহারি মুসলিমদের প্রতি আমাদের অমানবিক আচরণ তাই বলে।সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে এখন উচু পদের আমলা, কিন্তু সংখ্যাগুরু যদি বৈষম্যমূলক রক্ষণশীলতা আকড়ে ধরে রাখতে চায়, সংখ্যালঘুও তাতে সংক্রমিত হবে, হচ্ছে।

কোভিড-১৯ কে বড়লোক, কে ছোটলোক হিশাব করে নাই।কিন্তু এই মহামারির প্রতিটি স্তরে আমাদের আমলা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক গরিবের শেষ সম্বল কেড়ে নিতে চেয়েছে।এখন আরেক সবক দেয়া হচ্ছে, যেহেতু বিশ্বের সর্বত্র এটা ওটা বন্ধ হচ্ছে, সেহেতু যট্টূকু পাচ্ছো তাতে শোকর করো, টূ শব্দ কোরো না, অধিকারের কথাবার্তা মাচায় তুলে রাখো।অধিকারের কথা বলা, সমাজতন্ত্রের কথা বলা লোকজনের পলটিবাজ কালো মন দেখে দেখে মানুষও তাদের কথা শুনতে চায় না, তাদের সিনেমা দেখতে চায় না, তাদের বইপত্র পড়তে চায় না।তাহলে মননের ব্যাপারটা কে করবে? মুনাফার আগে যে মানুষ তা কে বলবে?আমাদের সবাইকেই বলতে হবে।

নিহত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ভাইয়ের হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে মাঠে নেমেছেন।প্রতিষ্ঠান পাশে থাকলেও তিনি জানেন যে এই দুর্ভাগা দেশে টাকাতে বাঘের চোখ মেলে, কিন্তু শক্তিমান পাশে না থাকলে বিচার মেলে না।বিভিন্ন সময় যারা রাষ্ট্রের হাতে, রাষ্ট্রের এজেন্টদের হাতে নিহত হয়েছে, গুম হয়েছে, হ্যানস্তার শিকার হয়েছে, তারা ভিক্টিমস ফ্যামিলি রাইটের জায়গা থেকে শারমিন শাহরিয়ারকে সামনে রেখে সমবায় সমিতি করুন, যাতে কল্পনা, চলেশ, তনুদের পরিবার আইনগত সহায়তা পায়।আল্লার নেয়ামত আল্লায় নিয়েছে বলে শারমিন ছেড়ে দেয় নাই, রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়েছে।রাষ্ট্রকেও তার বিমূর্ত, নৈর্ব্যক্তিক, কায়েমি সামন্তবাদ থেকে সরে আসতে হবে।

আইনের অজুহাতকে দম্ভ হিশেবে নিলে, সে-দম্ভ যে প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্রব্যবস্থাও কায়েম রাখতে পারে নাই তার প্রমাণ  গ্রীক রোমান, মুঘলদের পতন, অটোমানদের পতন, নাৎসিদের পতন, উপনিবেশিক শাসনের পতন, সোভিয়েতের পতন।১৯৭২এ বাংলাদেশের সংবিধানের প্রবর্তনাগত মূলনিতি ছিলো গনতন্ত্র, জাতিয়তা, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা।এ-প্রবর্তনা ছিলো রাস্ট্রের সাথে জনগনের সম্পর্কের ও পারস্পরিক সুরক্ষার সনদপত্র।তার পর একের পর এক সংশোধনি এনে পারস্পরিক সুরক্ষাকে ৌন করে দিয়ে রাস্ট্রের কাঠামোকে করে ফেলা হয়েছে স্ৈরতান্ত্রিক ও সংখ্যাগুরুকে ধর্মিয় পরিচয়ের নামে সান্তনা দেয়া হয়েছে।সংশোধনিগুলো যে শুভঙ্করের ফাকি এবং কায়েমি শাষনের আড়াল তা আমরা বুঝতে পারি কল্পনা, চলেশ, তনুদের বিচার না পাওয়া এবং সাবেক মেজর সিনহার পরিবারের প্রতি বিচারিক আশ্বাসে, সে প্রক্রিয়ার সূত্রপাতে।

বিমানবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা থেকে জন প্রতিনিধিদের সাথে সাধারন জনতার সম্পর্ক এখন হুমকি ও উতকোচের সিমাসরহদ্দে বাধা।গারো পাহাড়ে চলেশকে ধরে নির্জাতন করে মারার পর বলা হয়েছিলো সে  দুস্ৃতিকারী। টেকনাফে সিনহাকে মারার পর বলা হলো সে মাদক পাচার করছিলো।তাহলে ধরে নেয়া হচ্ছে দুস্ৃতি্কারী ও মাদক পাচারকারির জন্য রাস্ট্র এধররনের আচরন নির্ধারণ করে রেখেছে এবং আইন রক্ষাকারীদের অঘোষিতভাবে বলে দেয়া হয়েছে, কাউকে মেরে এসব অভিযোগকে অজুহাত হিশেবে ব্যাবহার করা যাবে।মগের মুল্লুকের আর বাকি থাকলো কি!

আলাওলের তোহফা!

প্রসংগত বাংলাদেশের ইতিহাসে মগের মুল্লুকি তাতপর্জটা একটু লিখতে হয়।সেটা মুঘল স্ম্রাট শাহজাহানের শেষ সময়। চিটাগাং এসময় আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো।তাজমহল বানানো প্রায় শেষ পর্জায়ে তখন।সম্রাটের চার ছেলে দারাশুকো, সুজা, মুরাদ ও ঔরংগজেবের ভেতর লেগে গেলো তুমুল লড়াই।সুজা তখন বাংলা মুলুকের সুবাহদার।শাহজাহান বড় ছেলে দারাশুকোকে ভাবি সম্রাট ঠিক করেছে।অন্য ভাইরা তা মানবে না।সুজা নিজেকে সম্রাট ঘোষনা করে দিল্লির পথে রওনা হলো।মুরাদ সমর্থন জানালো ঔরংগজেবকে।দিল্লির পথে ঔরঙ্গের পাঠানো্ মির জুমলার হাতে পরাজিত হয়ে সুজা পালিয়ে এলো ঢাকাতে।মির জুমলাও এলো পিছু নিয়ে।সুজা অল্প কিছু ৈনিক ও পরিবারসহ পালালো চিটাগাং। আরাকানি রাজা সান্ডা থাডাম্মা বা শ্রিচন্দ্র সুধর্ম সুজাকে আশ্রয় দিলো পুরোপুরি তার সাথে আনা বিপুল রত্নরাজি আত্মসাতের জন্য।।শ্রিচন্দ্র সুজার বড় মেয়েকে বিয়ে করলো সুজার অ্্মতিতে।বিয়ে ঠেকাতে সুজা শ্রিচন্দ্রকে উতখাতের পরিকল্পনা করে।সে পরিকল্পনা টের পেয়ে শ্রিধর্ম সুজাকে ধাওয়া করে জংগলে হত্যা করে।বছর খানেকের ভেতর শ্রিধর্ম সুজার তিন ছেলেকে হত্যা করে, এক মেয়েকে আত্মহত্যায় বাধ্য করে এবং যাকে বিয়ে করেছিলো সেই বড় মেয়েকে গর্ভবতি অবস্থায় না খাইয়ে মারে।সুজার আত্মঘাতি কন্যার সাথে ঔরংগজেবের ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছিল।ততদিনে দারাশুকোকে হত্যা করে ঔরংগজেব দিল্লির ময়ুর সিংহাসনে  আসীন।সুজার হত্যাকান্ডে ঔরংগ ব্যাথিত হয়েছিলেন কি না জানা জায় না, তবে ভাইপো, ভাইজিদের হত্যাকান্ডের খবর শোনার পর শায়িস্তা খানকে পাঠান শ্রিচন্দ্রকে উৎখাত করতে।শায়িস্তা খান শ্রিচন্দ্রকে উতখাত করতে না পারলেও চিটাগাংয়ে  স্থায়ীভাবে  আরাকান শাষনের অবসান ঘটান।এর পর  আরাকানি রাজারা আর দাড়াতে পারে নাই।মারাঠি বর্গিদের মতো আরাকানিদের ব্যাবসা হয়ে ঁড়ায় সিমান্ত ও সাগরে দস্যুতা, হত্যা, লুটতরাজ।


বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগিয় দিকপাল আলাওল উল্লেখিত আরাকানি রাজা সান্ডা বা শ্রিধর্মের দরবারি কবির মর্জাদা ভোগ করছিলেন।সুজার আরাকানে আসার পর আলাওল ও সুজার সখ্যতা গড়ে ওঠে, আলাওলের লেখাতে তার উল্লেখ আছে।সুজাকে হত্যার পর শ্রিধর্ম আলাওলকে দরবার থেকে সরিয়ে দেয়।এর পর আলাওল শ্রিধর্মের অন্যান্য মুসলিম সেনাপতি ও মন্ত্রিদের আশ্রয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়।সুজা ও তার ছেলেমেয়েদের হত্যাকান্ডের পর এবং রাজ  দরবার থেকে উচ্ছেদের পর আলাওল নিশ্চিতভাবে নিজের প্রাণ বাচিয়ে লেখালেখির ব্যাপারে্ সাবধান হয়ে পড়েন।হিন্দি কবি মালিক মুহাম্মদ জায়সির পদুমাবতের অনুবাদে পদ্মাবতীর কবি আলাওল তার সময়ে ঘটে যাওয়া নারকিয় ঘটনাগুলোকে এড়িয়ে ব্যাস্ত থাকেন রাসুল বন্দনায় ও তোহফা রচনায়।শ্রিধর্মকে চিটাগাং থেকে উতখাতের সময় শায়িস্তা খান আলাওলকে পেলে কি করতেন তা এখন আর বলা যাচ্ছে না।শায়িস্তা খান চিটাগাং থেকে বিপুল পরিমান আরাকানিকে ধরে এনে ঢাকায় বসতি স্থাপন করায়, যা থেকে সম্ভবত মগবাজার শব্দের শুরু।

আলাওলের পদ্মাবতীর চরিত্র হচ্ছে সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতী, চিতোরের রাজা রত্নসেন ও দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি।পদ্মাবতীর প্রিয় সংগি হচ্ছে সুকপাখি হীরামন।সংগ, অনুষংগ মিলিয়ে এটি একটি কল্পকাহিনী।এটি বাংলা ভাষাতে লেখা হলেও সেসময়ের বা তার আগের বাংলাদেশের কোনো অনুষংগ এখানে নেই।কল্পনার দিক থেকেও লেখাটি ৌলিক নয়, অনুবাদ।এর পর আলাওলের বড় কাজ সয়ফুমুলুক বদিউজ্জামান হচ্ছে আরব্য রজনীর আলিফ লায়লার অনুকরন।সুজা, মির জুমলা, শায়িস্তা খানের আমলে ঢাকায় এলে আলাওল একটি নতুন নগরের পত্তনিতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাচমিশালি জনতার ৈরি তখনকার ঢাকার কুট্টি বাংলা ভাষাটি জানতে পারতেন, কিন্তু তার পরভাষি কল্পলোকে সে ঢাকা  আশ্রয় পেতো কি না সে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে, আবার আশ্রয় পেলেও সেটা লিখে উঠতে পারতেন কি না তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।বন্দরনগরিতে অবস্থান করেও তার লেখাতে নাবিকদের কথা নেই,নেই  জেলেদের কথা, নেই আবহাওয়ার সাথে জড়িত সাগরতীরের মানুষদের উঠতি পড়তির কথা নেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের ৈস্বর্গিক বর্নণাও সেখানে নেই।সে সময়কার পশ্চিমি লেখকদের লেখায় তাদের সময় উঠে এসেছে।শেষ সময়ে এসে আলাওল লিখলেন গ্রিক দিগবিজয়ী আলেকজান্ডারের কাহিনী ফার্সি কবি নিজামী অবলম্বনে।পেটে খাওয়া পিঠে সওয়া বাংগালির যাপনে তার মন উঠলোনা মগের মুল্লুকের আতিথেয়তায়!সেটাও যে আক্ষরিকভাবে তিথি ভাঙ্গা তাও আমরা পেলাম তার স্বাগতিক রাজার ঐতিহাসিক পাশবিকতায়।

বাংগালি বুদ্ধিজীবিদের ভেতর পরভাষি কল্পাশ্রয়ীতায় আলাওল একা নন।তার হাজার বছর আগে ঢাকার ধলেশ্বরী তীরের অতীশ দিপঙ্কর তার সারা জীবন ব্যায় করেছেন আর্জ রাজকুমার ৌতমের সংস্ৃত বানীকে পালিকরন করে তিব্বতে প্রচার করে।অতীষের কোনো লেখাতে বাংলাকে পাওয়া যায় না।আলাওলের সময়ের অনেক বাংগালি লেখক আরাকানের রাজাকে ৌদ্ধিক হিশেবে দেখাতে চেয়েছেন।অতিষের সময় থেকে আলাওল অবধি  রাজাশ্রয়ী বুদ্ধিজীবিদের এ-ফাকটুকু কি সাধারন মানুষ ধরে ফেলেছিল?আমরা যেরকম এখন আমাদের ওপর চেপে বসা অপশাষনগুলো ধরে ফেলছি!ধরে ফেলবার পর আমরাও কি আলাওলের মতো হীরামনের পালকের দিকে তাকিয়ে নিজের গহিনে  নিজের সাথে লুকোচুরি খেলছি? লুকোচুরি খেলতে খেলতে নিজেকে এতটুকুই হারিয়ে বসে আছি যে সামনে আয়না ধরলেও আমরা যে সুকপাখি নই সেটা আর বুঝতে পারছি না! 


চয়ন খায়রুল হাবিব
৯/০৮/২০
ব্রিটানি

cholesh ritchil video, text Choyon Khairul Habib, vocalist Pinu Sattar, video Monjurul Azim Palash.
Photography, Chittagong coastal area Rolland and Sebrina Mechud