Wednesday 19 February 2020

বাবরনামা, ডেইলি স্টার, টিউলিপকুন্দন, অতঃপর রবীন্দ্রকথন!

বাবরনামাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পুষ্টিবিশারদ সেজো বোন রুবি ক্যারোলাইনা থেকে ডেইলি স্টারের একটি খবরের লাগসই জবাব দিয়েছে ইংরেজিতে।বেদবাক্য ঢং এর বানিজ্যিক কারসাজির ভাষাতে ডেইলি স্টার খবর দিয়েছে, গাজিপুরে না কি কে বা কারা 'সম্প্রতি প্রথম বারের মতো টিউলিপ ফুল ফুটিয়েছে।' রুবির মুল ইংরেজি জবাবটি কপি/পেস্টের সাথে নিচে আমার বিস্তারিত মন্তব্যসহ বাংলাটা দিলাম :
''মোঘলাই সম্রাট বাবর তার বাবরনামাতে লিখিয়েছিলো, 'হিন্দুস্তানের কিছুই ভালো না।লোকজন খুব অসামাজিক, ছোটোখাটো এবং মনে টানে না।' ও ব্যাটা আরো লিখিয়েছিলো, 'হিন্দুস্তানের ব্যাংগুলো অব্ধি হতকুৎসিত।' পর্তুগিজেরা এসে জানালো যে ভাত ভালো না, আলু নিয়ে এলো নিজেদের খাবারের জন্য।ভারতে না কি কোনো পানিয় নাই, তাই বৃটিশেরা নিয়ে এলো চা।বাঙালি না কি ভালবাসতে জানে না, এরকমটা ভেবে শেফিক রেহমান ভ্যালেন্টাইন দিবস আমদানি করে বাঙালিকে ভালবাসা শেখাতে চাইলো।এখন তার মতো আরো অনেকে ভাবছে, বাঙালির আবহমান কদম, কামিনি, বেলি, চম্পা,শেফালি, গন্ধরাজ, সুর্জমুখি কুন্ড, কৃশ্নচুড়া, রাধাচুড়া এসবের মালা গেথে, তোড়া বেধে প্রেম নিবেদনটা আর ঠিক হালনাগাদ ফ্যাশান নয়।প্রেমিক, প্রেমিকাকে তুষ্ট করতে নেদারল্যান্ড থেকে শ্রিমতি টিউলিপকে নিয়ে আসতে হবে।বন্ধুগন, আমার বুঝ বলে যে, ভারত ও বাংলাদেশ বরাবরই লোভি ব্যাবসায়িদের জন্য এক উর্বর স্বর্গরাজ্য।''**
বাবর মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো তা ঠিক।তার আকাটমুর্খতা বুঝে মুঘল ভারতের সবচেয়ে বড় সম্রাট আকবর ভারসাম্যের প্রয়োজনে প্রচার করেছিলো দিন ই ইলাহি এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের পন্ডিতদের সমাহারে গড়ে তুলেছিলো নান্দনিক নবরত্নসভা।সে-সভার অন্যতম রত্ন, গায়ক মিয়া তানসেনের পেছনে যে বৈষ্ণব গুরু হরিদাশ ঠাকুরের রেওয়াজি দিক্ষা প্রভাব ফেলেছে, তার স্বিকৃতি হিশেবে আকবর প্রামান্যভাবে হরিদাশ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে যেতো।আকবর যা যা করেছে, লিখেছে, লিখিয়েছে, সেসব দৃষ্টিকোন থেকে আমরা যেরকম বাবরের একদেশদর্ষিতা বুঝতে পারছি, সেরকম তার ধারাবাহিকতায় আজকের একজন ফরিদা রুবির সমালোচনা থেকে ডেইলি স্টার এবং তদিও তল্পিবাহক শেফিক রেহমানদের বানিজ্যমুখি কির্তিকলাপকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।আজকের মোদিদের বর্নবাদ, গতকালকের বাবরের বর্নবাদ থেকে ভিন্ন নয়।আবার বাবরের আগে কথিত আরব পন্ডিত ইবনে বতুতাদের লেখাতেও ভারতিয়দের নামে কেবলই বিষোদ্গার।রাজ দরবারের আবদ্ধ নিয়মনিষ্ঠতায় সেসব বিষোদ্গার যখন হয়ে ওঠে শিক্ষানিতি, তখন একজন রাজকুমার বা রাজকুমারির দানবে রুপান্তরিত হতে আসমানি অভিষাপ দরকার হয়না।বর্নবাদ বিরোধি বুদ্ধের শত উচ্চারন স্বত্বেও ক্ষত্রিয় অশোকের মদদপুষ্ঠ বৌদ্ধিক পুরোহিতেরা জৈন অনুসারিদের আজকের রোহিঙ্গাদের মতো ব্যাপক হারে হত্যা করেছিলো।সবই ঘটেছিলো ধর্মের নামে ভুমিদস্যুতাকে জায়েজ করতে।
একটা থেকে আরেকটা চলে আসে।ফ্রান্সের জনগন ভের্সাই বাগানের মালিকদের গিলোটিনে চড়িয়ে কতল করেছিলো, কিন্তু ভের্সাই ধ্বংশ করে নাই।দোষ টিউলিপেরও না, টিউলিপ চাষিরও না।'বানিজ্য বসতে লক্ষি' দানপাশা উলটে হয়ে যায় 'বনিকের মানদন্ড হয়ে গেলো শাষকের রাজদন্ড'।বনিক ও শাষককে লক্ষি হিশেবে মান্য করবার শিক্ষা থেকে আমরা আরবের আলখিল্লা, পশ্চিমের স্যুট, টাইকে নিছক পোষাক হিশেবে না দেখে পুজনিয় স্থানে নিয়ে যাই, এসবকে অবলম্বন করে নৈতিক বিবৃতি দিতে থাকি।খবরের নামে ডেইলি স্টার পুরোটাই বিপননের ধোকাবাজি কারসাজি।আজকে হিজাব বেজবে, গতকালকে মাইনাস টু বেচতে চেয়েছে, পরশু হিজাব ফ্রেশ বেচবে, তরশু টিউলিপ বেচবে, এরকম করে কয়েকবছরের বেচাকেনার ফর্দনামাকে খবর বলে চালিয়ে দিচ্ছে।আর শেফিক রেহমানেরা হচ্ছে তার চালিয়াত বিপনন ব্যাবস্থাপক।

পর্তুগিজ আলু ব্যাবসায়ি হোক, ব্রিটিশ চা ব্যাবসায়ি হোক প্রথমে আমাদের হিনমন্যতায় ফেলেছে না কি মাগনা আলু, চা দিয়ে চাহিদা তৈরি করেছে, না কি দুটো একসাথে ঘটেছে, তা আমরা আর জানছি না।একবার চাহিদা, আসক্তি তৈরি হয়ে গেলে তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করেও লাভ হয় না।ফেনসিডিল, টিউলিপ ইত্যাদি মাগনা দেয়া হচ্ছে না এবং দেখা যাচ্ছে এগুলোর জন্য আমরা খরচ করতে রাজি আছি।বিচিত্রতার ব্যাসন মানবিক বিবর্তনের শর্ত।বিচিত্রতা আসলে কি?ছদ্ম, মন ভোলানিয়া, প্লাস্টিক, চাইনিজ, স্বস্তা ভোগ্যপন্য বিচিত্রতায় আমরা কি মানষিক বৈচিত্রহিন সরলরৈখিক ভোক্তাতে রুপান্তরিত হয়েছি? আত্মপ্রবোধে এসব প্রশ্নের সুরাহা হচ্ছে না বলেই সাধারন মানুষের সাধারন জ্ঞান থেকে মুল বংগ ভুখন্ড থেকে দুর ক্যারোলাইনা, ব্রিটানিতে একজন রুবি ও একজন চয়ন বিড়ম্বনায় ভুগছে।

রবীন্দ্রনাথ ঢাকার বলধা গার্ডেনে একটি ফুলের নাম রেখেছিলো, বিচিত্রবকুল, তার মুর্ছনা যে আমরা কখনো টিউলিপে পাবো না, তা লেখা বাহুল্য।অন্য একটি মুর্ছনা পাবো তা ঠিক।সে-মুর্ছনা বা দ্যোতনা কি নতুন না কি শ্বাসরোধি পরগাছা না কি করোনা ভাইরাসের মতো হাইব্রিড তার মিমাংসায় হয়তো হাজার বছর পর আবার কোনো বাঙালি বাবরনামার বর্তমান মিনিয়েচারদের ঠিকুজি কুলুজি নির্নয়ে মশগুল হবে।আমরা একটা জায়গাতে এসেছি, যেখানে প্রমিত মানদন্ডকে একদল ভদ্রলোকের তামাশা বলে আঞ্চলিক কুপমন্ডুকতাকে বলছে শেকড়ের ঠিকানা।আরেকদল ঈদ থেকে ইদ করলে তেড়েফুড়ে আসছে।শব্দের পেছনে যে-সুর, তা এক বিশ্বায়িত চলিষ্ণুতার মিশ্র ফসল।মুল তর্কটি আসলে দেশি ফুল, বিদেশি ফুলের নয়, মুল তর্কটি হচ্ছে, সুরের প্রানরস কি অর্থনিতির যোগান ও চাহিদার ছকে চলবে এবং বিপননের কারসাজিতে সে-প্রানরস নিয়ন্ত্রিত হবে?না কি আত্মস্থ পরিবেশবাদি নন্দনের গহিনে আমরা 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' গানটির পাশাপাশি 'ক্যামেলিয়া' কবিতাটিকেও অনায়াসে ধারন করতে পারবো?

চয়ন খায়রুল হাবিব
১৯/০২/২০
ভ্যান, ফ্রান্স
**তারকা চিহ্নিত অংশ, মুল ইংরেজি ফরিদা রুবি, দক্ষিন ক্যারোলাইনা/অনুবাদ চয়ন খায়রুল হাবিব, ১৯/০২/২০, ভ্যান, ফ্রান্স।''Emperor Babur wrote in his ' Babur Nama', " There is nothing good about India" People are very unsocial, short and totally unattractive" He also wrote, " Even the frogs of India are ugly". Then came the Portuguese and said Rice is no good and brought potato for them. There is nothing to drink in India so British introduced tea. Shafiq Rehman at first thought Bangali does not know how to Love so let me import Valentin's Day to teach them how to Love. Now someone else like him thought Bangali flowers like Kadam Kamini Beli Chapa Shefalika Gandharaaj Shurjamukhi Kunda Krishnachura Radhachura are not stylish enough to propose a girl. Lets bring Miss Tulip from Netherlands to impress her. My conclusion friends,India and Bangladesh was always a fertile ground for greedy people doing business.''(Farida Ruby, facebook, 19/02/20)