Friday 28 September 2018

সৈয়দ শামসুল হক : যথার্থ ও অযথার্থতা

মার্জিনে মন্তব্য।ভুমিকা।সৈয়দ শামসুল হক।

গতকাল ২৭শে সেপ্টেম্বার ছিলো কিংবদন্তিতুল্য লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) দ্বিতিয় মৃত্যুবার্ষিকি।সঙ্খেপে ওনাকে ডাকা হতো সৈয়দ হক।

বাংলা সাহিত্যে 'প্রায়' সর্বত্রগামি ছিলেন।'প্রায়' লিখলাম এ কারনে যে গিতিনৃত্যনাট্য বা অপেরা লিখেছিলেন কি না তা আমার জানা নাই।তাহলে 'সব্যসাচি' উপাধিটি যথার্থ হতো, আবার রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাংগদা', 'মায়ার খেলা'র ধারাবাহিকতায় আমরা কিছু সার্থক অপেরা পেতাম।অপেরার লিব্রেটো লেখার মুল ভাষিক ভিত্তি যে স্বরলিপি বা স্টাফ নোটেশান তা সৈয়দ হক জানতেন কি না, তাও আমার জানা নেই, তবে তিনি প্রচুর গান লিখেছিলেন।সাহিত্যের যে যে শাখায় সৈয়দ হক বিচরন করেছেন, তার সব কটিতে তিনি কালিক ও নান্দনিক মানে উত্তির্ন।কালপরিক্রমায় তুলনামুলক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার উপন্যাস, নাটক, কবিতা, অনুবাদ, কলাম, চিত্রনাট্য, সমালোচনা যে আলোচিত হবে এবং প্রাসঙ্গিক থাকবে তাও লেখা বাহুল্য।আমার বর্তমান ব্লগপোস্টটি সৈয়দ হকের সামগ্রিক কাজের মুল্যায়ন নয়, বরং তার একটি পর্জবেক্ষনের প্রতিক্রিয়াজাত।


পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, মাহমুদুল হক, জহির রায়হানের তৈরি প্রমিত ভুমার ওপর দাড়িয়েই আমিসহ আমার সতির্থরা সাহিত্যচর্চা করে আসছি।রবীন্দ্রোত্তর তিরিশিও কবিরা যেরকম বাংলা সাহিত্যে মোড়বদলের সুচনা করেছিল, পঞ্চাশের অনুশিলকেরা সেরকম একই চলিষ্ণু পরম্পরার অংশিদার হবার পরেও উপস্থাপন শৈলিতে হেচকা টানে বেরিয়ে এসেছিল তিরিশিও আবহ থেকে।এর পরের তুমুল অথচ মৌলিক ভবিষ্যতবোধক ধাক্কাটি তৈরি হয় আশির দশকে।এই পুরো সময়খন্ডে সক্রিয় থেকেছেন সৈয়দ হক।কখনো উপহার দিয়েছেন কালোত্তির্ন 'নুরল দিনের সারা জীবন' , আবার তার লেখনির তুলনায় দুর্বল  'বাংলার মাটি, বাংলার জল' জাতিয় অপুষ্ট মঞ্চ উপস্থাপনায়ও থেকেছেন বিড়ম্বনাহিন।তার 'ম্যাকবেথ'  অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে ও মঞ্চনাটকে এক অনবদ্য সংযোজন, আবার একই কলমে 'টেম্পেস্ট'  অনুবাদ দুর্বল পংতিভোজ।একই কথা বলা যাবে তার প্রকাশিত বিপুল উপন্যাস সম্ভারের ক্ষেত্রে।প্রজন্মান্তরে সৈয়দ হকের কাজ নিয়ে কথা থেকে যাবে, কারন সাহিত্যের সাথে আস্টেপৃষ্ঠে, আপাদমস্তক জড়িত এরকম চরিত্র দুর্লভ।অবমুল্যায়ন না করেও বলা যায়, তার সাথে তসলিমা নাসরিন এবং অপরাপর সাহিত্যরশোপ্রার্থিদের পরিচয় তার সাহিত্যের কির্তিগুনে, যে গুনটি দোষের দায়ভারসহ তার স্বোপার্জিত, স্বনির্মিত।

স্বনির্মিতির পথে ও পরিনত পর্জায়ে সৈয়দ হকের অনেক উচ্চারন আমাদের যেরকম প্রানিত করবে, সেরকম সে উচ্চারনগুলোর সাথে মতভেদাভেদ সাহিত্যের সাথে, ভাষার সাথে আমাদের পথবন্ধনকে প্রশস্ত করবে।নিচের মন্তব্যটি বিবেচনা করা যাক :

 "আমরা প্রচুর শব্দ ব্যবহার করি না বুঝে। এই যে ‘মহান একুশে’ ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’ ... ‘মহান’ কেন বলে? কেন ‘গৌরবময়’ নয়? সে বুঝতে পারবে না, সে মনে করবে বুঝি ঠাট্টা করছো। হ্যাঁ অমর একুশে। অমর একুশের অনেক আমি জানি। কিন্তু তোমরা আমাকে বোঝাও এই যে অমর একুশে কনোটেশনটা কি শুনতে ভালো লাগে বলে সবাই বলে। শুধু একুশে বললে ন্যাংটো মনে হয়? ঐ যে বললাম শ্যামল এ কুলোয় না সুশ্যামল। শীতল-এ কুলোয় না সুশীতল। যে জাতির গদ্য ঠিক নয়, যে জাতি শব্দ ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন নয় জানবে যে সমূহ বিপদ তার এবং আমি এটাকে যে কোনো রাজনৈতিক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক সংকটের চেয়ে অনেক বড়মাপের সংকট বলে মনে করি। আমি খুব শংকিত চারদিকের অবস্থা দেখে।" - সৈয়দ শামসুল হক/বাংলাবাজার/ সাক্ষাতকার (১৯৯৬)।


আগে বলে নিয়েছি যে ওপরের উদ্ধৃতিটি একটি সাক্ষাতকারে তাতক্ষনিক কথন।এটিকে উপসংহারমুলক হিসেবে দেখে অযথা কিছু কুতর্কের অবকাশ তৈরি করা যেতে পারে।কুতর্কের আড়তদাড়িতে না গিয়ে, সৈয়দ হকের সামগ্রিক সাহিত্য-যাপন ও রাজনৈতিক অঙ্গিকারের দিকে তাকালে আমরা তাকে একুশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ্যের একজন আমৃত্যু কলম সৈনিকের অক্লান্ত ভুমিকাতে দেখতে পাই।এই দেখতে পাওয়াটা বজায় রেখেও এবং ওপরের বক্তব্যের শেষাংসের সাথে ঐকান্তিকতা প্রকাশের পরেও, কয়েকটি শব্দবন্ধ, বাক্যবন্ধের সাথে আমার দ্বিমত এ আসরে লিখে রাখতে চাই। 


‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’ ... ‘মহান’ কেন বলে? কেন ‘গৌরবময়’ নয়?......এর উত্তরে সবচেয়ে আগে আমার মাথায় আসে, মহান  শব্দটি গৌরবময়  শব্দটির চেয়ে মাপে ছোট হলেও  ব্যুতপত্তিগতভাবে শব্দটি গৌরবের  পুরো ব্যাঞ্জনা ধারন করে।শুধু বাচনিক দিক থেকে নয়, টাইপোতে গৌরবের ঔকার  বার বার একটা খটোমটো বাধিয়ে বসবে।'অমর একুশে কনোটেশনটা কি শুনতে ভালো লাগে বলে সবাই বলে। শুধু একুশে বললে ন্যাংটো মনে হয়?'....আমার কাছে অমর একুশে কনোটেশনটা   ভাল লাগে, শুধু একুশে ন্যাংটো   মনে হয়।কনোটেশান বা শব্দের গুনবাচক পুর্বাপর শব্দগুলোর সাথে ইতিহাসের ভুমিকা থাকে।নিউজিল্যান্ডের জাতিয় রাগবি দল পৃথিবির যে প্রান্তে যাক না কেন, খেলা শুরুর আগে তারা সেখানকার মাওরি আদিবাসিদের হাকা তান্ডবের হুঙ্কার  দিয়ে জোশের সঞ্চার ঘটায়।ফরাসিরা মাঠে ঘাটে বলে ভিভ লা ফ্রান্স ।বাংলার শিয়ারা মার্শিয়ার মাতমে বুক চাপড়ানোর সময় বলে হায় হুসেন, হায় হাসান!পুর্বাপর গুনবাচকতা দিয়ে গাম্ভির্জ, উল্লাস, শোকের মাত্রাটা প্রকাশ করা হয়। সৈয়দ হকের মাপের লেখক এসব জানবার  পরেও বলেন, 'যে জাতি শব্দ ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন নয় জানবে যে সমূহ বিপদ তার এবং আমি এটাকে যে কোনো রাজনৈতিক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক সংকটের চেয়ে অনেক বড়মাপের সংকট বলে মনে করি।' কেন বলেন?

বাংলাদেশের স্থানিয় রাজনৈতিক ইতিহাসের মেরুকরনে সৈয়দ হক বরাবর প্রতিক্রিয়াশিলতার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে প্রাগ্রসরতার পক্ষ্যে থেকেছেন।রাজনৈতিক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক সংকট কে যে তিনি গৌন করে দেখেন না, তার সম্যক প্রমান তার যাপন ও লেখনি।এখানে তিনি মুলত ভাষা  চলিষ্ণুতা এবং তার ক্রমশ পরিশিলনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, চড়াদাগে ভাষিক প্রতিক্রিয়াশিলতার দিকে আঙ্গুল উচিয়েছেন।যে সৈয়দ হক বাংলা প্রমিত পত্তনির একজন শক্তিমান অংশিদার, সে সৈয়দ হকের হাত দিয়ে বেশ কিছু আঞ্চলিক ভাষার উত্তির্ন কাজ বের হয়েছে।যিনি দেয়ালের দু'দিকের অবস্থান ও বৈরিতা সম্পর্কে সচেতন, সেই তিনি সাবধান করছেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে।লেখক এখানে  পাঠকের কাছে পৌছাবার আগে নিজের সাথে বোঝাপড়া সেরে নিচ্ছেন।সাক্ষাতকারগ্রহনকারি এখানে নিমিত্তের মিস্তিরি।

একজন সৈয়দ হক জানেন, ভারত বিভাজনের সুত্র ধরে বাংলা ভাষার হৃতপিন্ডে ক্ষত তৈরির অবকাশ তৈরি করা হয়েছে।এক শ্রেনির কথিত বুদ্ধিজিবি খুব সহজে বলে বসে 'দুই বাংলার বাংলা ভাষা', 'পুর্ববঙ্গের বাংলা ভাষা'।এরা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চায় যে লালন ও রবীন্দ্রনাথ একই বাংলা ভাষায় দৈনন্দিনতা চালাতো; এরা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চায় শান্তিনিকেতনে পরিশিলিত সিলেটের মুজতবা আলি ও বরাবর সিলেটবাসি হাসন রাজা একই বাংলা ভাষার উত্তরাধিকারে ঐশর্জবান; এরা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চায় যে বেগম রোকেয়া ও ইলা মিত্র একই ভাষাভাষির ওপর চাপানো সামন্তবাদের বিরুদ্ধ্বে সংগ্রাম করেছে; এরা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চায় যে পাঞ্জাবের আবু সাইয়িদ আইয়ুব ও আসামের ভুপেন হাজারিকা একই বাংলা ভাষাতে তাদের সৃজনশিলতা প্রকাশ করেছে।যারা বলে 'পশ্চিমবঙ্গের ও পুর্ববঙ্গের বাংলা ভাষা' তারা ঠোটের এক কোনা দিয়ে উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করে, ঠোটের আরেক কোনা দিয়ে উপনিবেশবাদিদের চাপানো 'ডিভাইড এন্ড রুলের' মানষিক সম্প্রসারন ঘটায়।সংঘর্ষ, সঙ্কট, বৈষম্যের বিবিধ রাজনিতি পার হয়ে একজন সৈয়দ হক যে তার কথনে, লেখনে ও যাপনে বাংলাভাষি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেলবন্ধনের ওপর জোর দিয়েছেন তা লেখা বাহুল্য। 

চয়ন খায়রুল হাবিব
২৮/০৯/২০১৮
ব্রিটানি





মিস্তিরি শিল্পী নন, কিন্তু প্রতিটি শিল্পীই নিপুণ মিস্তিরি। যে চেয়ারের পা টলমল করছে, পিঠ খোঁচা দিচ্ছে, তার নকশা যত নতুন হোক, ঘরে দিন দুয়েক রাখবার পর গৃহস্ত তাকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে চাতালে, অবশেষে বিস্মৃতির গুদামে ফেলে রাখবেন। মহাকাল নির্মম এক গৃহস্থ; তিনি এইসব আপাত মনোহর আসবাব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

Read more at: http://www.amarboi.com/2012/07/marjinay-montabya-syed-shamsul-haq.html


মিস্তিরি শিল্পী নন, কিন্তু প্রতিটি শিল্পীই নিপুণ মিস্তিরি। যে চেয়ারের পা টলমল করছে, পিঠ খোঁচা দিচ্ছে, তার নকশা যত নতুন হোক, ঘরে দিন দুয়েক রাখবার পর গৃহস্ত তাকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে চাতালে, অবশেষে বিস্মৃতির গুদামে ফেলে রাখবেন। মহাকাল নির্মম এক গৃহস্থ; তিনি এইসব আপাত মনোহর আসবাব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

Read more at: http://www.amarboi.com/2012/07/marjinay-montabya-syed-shamsul-haq.html


মিস্তিরি শিল্পী নন, কিন্তু প্রতিটি শিল্পীই নিপুণ মিস্তিরি। যে চেয়ারের পা টলমল করছে, পিঠ খোঁচা দিচ্ছে, তার নকশা যত নতুন হোক, ঘরে দিন দুয়েক রাখবার পর গৃহস্ত তাকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে চাতালে, অবশেষে বিস্মৃতির গুদামে ফেলে রাখবেন। মহাকাল নির্মম এক গৃহস্থ; তিনি এইসব আপাত মনোহর আসবাব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

Read more at: http://www.amarboi.com/2012/07/marjinay-montabya-syed-shamsul-haq.html