বৌদ্ধ ভিক্ষু নেতৃত্ব দিচ্ছে কথিত রোহিঙ্গা বিরোধি আন্দোলনে?! |
গৌতম যে নির্বানের দর্শন প্রচার করেছিল, তা কি চামড়া আরো ফর্সা হবার দর্শন?পুর্ব এশিয়াতে গৌতমের বানি যারা নিয়ে গিয়েছিল, তাদের অন্যাতমো ছিলো অতিষ দিপঙ্কর, যিনি বাংলাদেশের ধলেশ্বরি তিরের বাসিন্দা।অতিষের মুখাবয়ব যে সিনো-তিবেতান ছিলো না তা লেখা বাহুল্য।
কথিত বর্মি বৌদ্ধিক সমাজ রোহিঙ্গাদের সাথে যে বর্বর আচরন করছে এবং মেনে নিচ্ছে; কথিত বৌদ্ধিক সিংহলি সমাজ তামিলদের উপর যে পৈশাচিকতা চাপিয়েছে; তাতেই লুকিয়ে আছে কেন ভারতের বিশাল, মিশ্র জনগোষ্ঠি বৌদ্ধ ধর্মকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানাবার পরেও কাতারে কাতারে আবার পরিত্যাগ করেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়রুপি বিশাল স্তুপাগুলি ঢাকা পড়ে গেছিলো জনশুন্য ইতিহাসের অরন্যে।
এখান থেকে আজকের বাংলাদেশের মুলধারার মুসলিম জনগোষ্ঠিরও শেখবার আছে।শাষকের সাথে মিলে যখন ধর্মিও নেতারা অপশাষন, জুলুমবাজির শরিক হয়, তখন সাধারন মানুষ না পারতে কিছুকাল মেনে নিলেও, মন থেকে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং সুজোগ আসলে তার সমস্ত বিধিবিধান আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে।মানুষ অবদমন নেয় না, তা ধর্মসহ আসুক বা ধর্ম ছাড়া আসুক।রোমানরা হাজার বছর সাম্রাজ্য চালিয়েও তাদের দেবদেবিদের টিকাতে পারে নাই; সমাজতন্ত্রের নামে মানুষের প্রকাশভঙ্গিকে শৃঙ্খলিত করবার অপবাদ নিয়ে অপসৃত সোভিয়েত সাম্রাজ্য; ফ্যাশিস্ট জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে বিশ্বের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধি জনগন প্রতিরোধ করেছে ধর্ম, বর্ন, জাতিয়তার বাইরে এস; মুসলিম ভাতৃত্ববোধের জিগির তোলা পাকিস্তানি বাকোয়াজির ফাকিঝুকি বাঙ্গালি বুঝে গেছিলো কয়েক যুগের ব্যাবধানে।
কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি, সিরিয়ার গৃহযূদ্ধে সব হারানো শরনার্থিরা আশেপাশের মুসলিম রাস্ট্রগুলোর উপর সম্পুর্ন আস্থা হারিয়ে, ঝড়ঝঞ্জা মাথায় নিয়ে , সাগর পাড়ি দিয়ে লাখে, লাখে ইউরোপের দিমান্তগুলো পার হচ্ছে।এই সিরিয়ান এক্সোডাসের মুখে কোন কোন ইউরোপিয় দেশ সিমান্ত পাহারা আরো জোরদার করেছে, কোন কোন দেশ সিমান্ত খুলে দিয়ে শরনার্থিদের স্বাগত জানিয়েছে।যে ব্রিটেনে সিরিয় শরনার্থিদের প্রবেশ ছিল হাতে গোনা, সেখানে অভিবাসিদের জুজু দেখিয়ে ব্রিটেনকে ইউরোপিও কমিউনিটির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গনভোট করে।আর যে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে সিরিয় শরনার্থিরা গিয়েছে আরো কম, সেখানে ট্রাম্পের সাংগপাঙ্গরা সাম্প্রদায়িকতার ঝিকির তুলে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রবর্তনাকে করেছে ভুলুন্ঠিত।সামনে দাড়ানো একজন মানুষের দিকে আমরা কিভাবে তাকাবো?
''চাকমা চিত্র'' সিরিজ শোকগাথাটি লিখেছিলাম পাহাড়িদের ওপর বাংলাদেশি শাষকদের চাপানো নিপিড়ন, নির্জাতন তুলে ধরতে।সেখানে কালিন্দি রানিসহ আরো অনেক প্রায় লুপ্ত প্রতিকের কথা বলেছিলাম, যা পড়ে দুর প্রবাসে এক চাকমা পাঠক বলেছিল, অনেক চাকমাই এখন আর কালিন্দি রানির কথা জানে না।সেই পাঠক অবস্য, 'আপনারা বাঙ্গালিরা...' বলে আমাকে দুক্ষিত করতে কুন্ঠিত হন নাই।বর্মি সেনাদের হাতে নিহত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের স্মরনে লিখেছিলাম ''রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ'', যেখানে তুলে ধরেছিলাম নিপিড়নের পাশাপাশি আবহমান সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।গারো নেতা চলেশ রিচিলের হত্যাকান্ডে প্রতিবাদ করে গান লিখে প্রচার করেছিলাম।
চাকমা ও অপরাপর পাহাড়িদের দেখেছি মানুষ হিশেবে, নিহত বর্মি ভিক্ষুদের দেখেছি মানুষ হিশেবে, চলেশ রিচিলকে দেখেছি মানুষ হিশেবে।এই দৃষ্টিপাতের সময় পাহাড়ি আদিবাসিদের, বর্মি ভিক্ষুদের, চলেশ রিচিলের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম ভুলে যাই নাই।নিজেও যে বাংলা ভাষাতে লিখে বাংগালির প্রতিনিধিত্ব করছি তাও ভুলে যাই নাই।কিন্তু কোন বাংগালির?বংগবন্ধু, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল, জীবনানন্দ, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম যে অসাম্প্রদায়িক বাংগালির কথা বলেছে, সেই বাংগালির।
চাকমা চিত্র নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে দেখেছি সাধারন চাকমাদের নামের সাথে থাকে চাকমা, আর একই সম্প্রদায়ের উপর তলার লোকদের নামের সাথে থাকে দেওয়ান এবং আরো কিছু।সাধারন চাকমাদের হাতে জমিজমার কোন দলিল না থাকলেও, অনেক দেওয়ানের হাতে বৃটিশ আমলের জমির দলিলপ্ত্র আছে।চাকমাদের পাশে আরো সাধারন পাহাড়িরা এই দেওয়ানদের জমিতে অনেকটা কুলি বা বর্গাচাষি হিশেবে খাটে।এসব নিয়ে পাহাড়িদের যে টেনশন তা বাঙ্গালির চাপানো নয়, তবে বাংগালিরা এই জমি নিয়ে দলিলি ভেদাভেদকে অন্যায্যভাবে ব্যাবহার করেছে, আর এই অন্যায্যতার সুজোগ নিয়েছে দেওয়ান ও কারবারিরা।সন্তু লারমার যে আন্দোলন তার বিপুল অংশ বাংলাদেশি প্রশাষনের বিরুদ্ধ্বে হলেও, একই আন্দোলন দেওয়ানদের বিরুদ্ধেও।এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে একেবারে চেপে যাওয়া হয়েছে, উপরতলার অভিজাত পাহাড়িরা প্রশাষনের কাছাকাছি থাকার কারনে হয়তো।একই দেওয়ান, কারবারিদের বিরাগভাজন না হতে হয়তো আমার চাকমা বন্ধুরা তাদের ভাষাতে আমার চাকমা চিত্র সিরিজটি অনুবাদ করে নাই, প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্বেও।
চাকমা এবং অপর পাহাড়ি নৃগোষ্ঠির পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্খ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টানেরাও বিভিন্ন দিক থেকে সাম্প্রদায়িক চাপের ভেতরে আছেন।প্রশাষনকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে, রায়ট বাধিয়ে জমি দখল করছে রাজনিতিক নেতারা।আজকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সঙ্খ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন অনলাইনে, অফলাইনে যে নিরবতা, তির্জকতা এবং অশ্লিলতা দেখাচ্ছে, তাকে কি স্বাভাবিক বলে গা সওয়া করে নেব আমরা?আবার সংখ্যালঘুদের উপর মূলধারার লোকজন ব্যাপকভাবে যে অবিচার, অত্যাচার করে আসছে এবং সেসবের মুখে নিরব থাকছে, তার অপরাধমনস্কতা থেকেও সঙ্খ্যাগুরুর সুবিধাভোগিদের অনেকে আজকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক আশরাফ, আতরাফ মন্তব্য করছে।রোহিঙ্গা মেয়েরা একটার পর একটা বাচ্চা বিয়াচ্ছে, তাদেরকে সবচেয়ে আগে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করাও ইত্যাদি অশ্লিলতা আমরা পাচ্ছি বাংগালি মুসলিম লোকজনের মুখ থেকে।
রোজার সময় সারাদিনের রোজার পর ইফতারির ভুরিভোজের আমরা ছবি তুলে দেখাই।কিন্তু পরিস্থিতির চাপে যদি আপনাকে অভুক্ত থাকতে হয় এবং পরের বেলা খাবার আসবে কি আসবে না, মাথা গোজার ঠাই পাব কি পাব না এসবের মুখে সবচেয়ে সুশ্রি চেহারাও কুশ্রি হতে বেশিক্ষন লাগে না।জহির রায়হানের 'স্টপ জেনোসাইডে' আমাদের পুর্ব পুরুষদের হতক্লিষ্ট চেহারার দিকে সাহস করে তাকান।
বসনিয়ার সেব্রিনিকায় যখন সার্বিও মিলিশিয়ারা গনহত্যা চালাচ্ছিলো, সেসময় আমি লন্ডনে ব্রডকাস্টিং ডিপ্লোমা করছিলাম।শেপহার্ড বুশের একটি স্টূডিও থেকে সেব্রিনিকা শিবিরের কাছাকাছি এক কোয়ার্টারে আমরা ফোন করেছিলাম এক বসনিয়ান সহকর্মির সহযোগিতায়।অপর পাশের গৃহকত্রির সাথে ফোন ইন করার সময়, গৃহকত্রি হঠাত ফোন কেটে দেয় এবং কিছুক্ষন পর ফোনে এসে আর্তকন্ঠে জানায় যে সামনের উঠান থেকে তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিশিয়ারা.....এখনো সেই আর্তকন্ঠ আমার কানে বাজে।
চয়ন খায়রুল হাবিব
৩/০৯/১৭