Tuesday, 29 August 2017

প্রধান বিচারপতি সকাশে অগ্নিকন্যার মন্তব্যে

যা হতে পারতো চায়ের পেয়ালার ঝড়, তা এখন পাড়া মাতানো বিসম্বাদ, যাতে সরাসরি কেউ আহত না হলেও, ভবিষ্যতে আমাদের ইতিমধ্যে লুপ্ত প্রায় বাকস্বাধিনতার পথকে আরো দুর্গম করে তুলবে।ধরুন লিখলাম স্যাটায়ার ছলে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা চায়ের টেবিলের অপর পাশে বসা কৃষিমন্ত্রি মতিয়া চৌধুরীর শাড়ির প্রসংশা করে বললেন...... কি বললেন?স্যাটায়ার বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসি!কাজের কথায় আসতে গিয়েও তো সবাইকে সন্তুষ্ট করা যাবে না।বিমুখেরা বলে বসবে, স্যাটায়ারেও কিন্তু আপনি পুরুষালি দৃষ্টিকোন থেকে বেরুতে পারেন নাই, লিখলেইতো পারতেন, চা খেতে খেতে মতিয়া চৌ টেবিলের অপর পাশে বসা সুরেন্দ্র কুমার সিনহার শার্টের কাটিংয়ের প্রশংসা করলেন!তারপর এসে যাবে সংখ্যালঘু, গুরু প্রশ্ন, চা খাওয়াটাই বরবাদ।বরং বিসংবাদেই থাকি!পিকাসোর হাতে ধরিয়ে দেই রিভলভার!
যুদ্ধাপরাধিদের সাজা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ডক্টর কামাল হোসেনের অতি মানবতাবাদি মেয়ের জামাই ডেভিড বার্গম্যানের চাটুয়া পার্টি মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধ্বে উষ্মা প্রকাশ করে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কোন আস্পর্ধায় উনি প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে বলেন, পাগলা গারদে যেতে বলেন।যেই আস্পর্ধা নিয়ে মতিয়া চৌ কিছুদিন আগে সংসদে মুহিতের বাজেটকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই একই আস্পর্ধায়।

একই আস্পর্ধা নিয়ে মতিয়া যদি সেবিকাদের আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় প্রশ্ন তুলতো, সেবিকাদের দাবির পক্ষ্যে দাড়াতো, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যাবস্থা প্রাইভেট ও ngoদের কুক্ষিগত হবার বিরুদ্ধে কার্জকরভাবে দাড়াতো, আদিবাসি নির্জাতন, উচ্ছেদে প্রতিরোধে সামিল হতো, অগ্নিকন্যা উপাধি আরো সার্থকতা পেতো।মুহিতের বাজেটের বিরুদ্ধ্বে অবস্থান নেয়াতে যেরকম সাব্বাশি জানিয়েছি, প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধানে ষোড়ষ সংশোধনি বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধ্বে রাস্তায় নেমে আসাকেও সাব্বাশি জানাই।

মনে রাখা দরকার বৃটিশ সাংসদেরা এক সময় সংসদিয় গনতন্ত্রের পথ সুগম করতে এক রাজার শিরোচ্ছেদ করে এবসলিউট মনার্কির পতন ঘটিয়েছিল।যদিয় পরে রেস্টোরেশন প্রক্রিয়াতে বৃটিশ সংসদ এবং রাজতন্ত্র সহবস্থানের আপোষ করে।ফরাসি বিপ্লবে রাজারানির শিরোচ্ছেদের পর থেকে আজতক সংসদিয় গনতন্ত্রের পথে যতরকম আপোষ হয়েছে, তার বিরুদ্ধ্বে সংসদে ও জনপথে সংগ্রাম জারি আছে।জেনারেল নেপোলিয়ন বিপ্লব হাইজাক করে নিজেকে সম্রাট ঘোষনা করেছিল, তার বিরুদ্ধ্বে ভিক্টর হুগোসহ অপর সমাজতন্ত্রিরা সংগ্রাম অব্যাহত রাখে এবং আবারো সংসদিয় গনতন্ত্র কায়েম করে।হিটলারের সহায়তায় ফরাসি দক্ষিনপন্থিরা ফ্যাসিবাদি স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে, যার বিরোধিতা করে দ্যাগল নির্বাসনে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।মতিয়া চৌধুরিরা বুঝতে শিখুক, জনগনের বলার জায়গা বন্ধ করে দিতে থাকলে নিজেদের বলার জায়গাও কমতে থাকে।আবার প্রতিবাদিদের রাস্ট্রিয়ভাবে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার সামরিক পরিকল্পকদের দোসর করে সংসদে বসলে তার প্রতিনিধিত্বও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে উঠে।

ডেভিড বার্গম্যানের সাংগপাঙ্গরা, ষোড়শ সংশোধনি বাতিলের রায় নিয়ে গোলাম মোর্তোজা নামক মেধাবি সাংবাদিকের কথিত সাতকাহন ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।সেই সাতকাহনে সাবেক বিচারপতি মানিককে খন্ডন করে যেই মন্তব্যগুলো তার সাথে একমত হলেও, মোর্তোজার প্রেমিস থোড় বড়ি খাড়ার বাইরে আসে নাই। কারন, আসতে চায় নাই।ষোড়শ সংশোধনি রায় বাতিলের শত শত পৃষ্ঠা পর্জবেক্ষন বা সাফাই  মোর্তোজা পড়েছেন বলে দাবি করেছেন, কিন্তু তার বিস্তারিত পড়ে প্রশ্ন জাগে, সিতা কার বাপ?কেন?কারন, ষোড়শ সংশোধনি বাতিলের মুল জায়গাটিকে ঘোলা করতে বিচারপতিরা যেরকম বিস্তর বাকোয়াজি করেছেন, সেরকম মোর্তোজাও মুল প্রবর্তনামুলক জায়গাটাকে এড়াতে বিস্তর শব্দ ঘাটাঘাটি করে শব্দের সাথে অর্থের দাঙ্গা বাধিয়েছেন।বিচারপতিরা এবং মোর্তোজা জাতিয় মেধাবি সাংবাদিকেরা এই শব্দের সাথে অর্থের দাঙ্গা জেনেবুঝেই ঘটিয়েছেন।

কিন্তু ওয়াইকিপিডিয়ার পাতায়,পাতায় থাকা অজ্ঞাতনামা কিন্তু আরো বাঘা তেতুলেরা বিচারপতিদের এবং মোর্তোজাদের সাত কাহন পার হয়ে ষোড়শ সংশোধনিসহ পুর্বাপর অন্যান্য সংশোধনির বহালি ও বাতিলি কার্জকরন সারসঙ্খেপ ধারাবাহিকতায় তুলে ধরেছে।সেই ধারাবাহিকতা পাঠ করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় একের পর এক উসিলায় জনগনের প্রতিনিধিত্ব খর্ব করা হচ্ছে।ষোড়শ সংশোধনি বাতিলের রায় হবার পর আজকের সংসদ যদি বুঝে থাকে যে তারা কস্মেটিক্স নয়, লিপ সার্ভিস নয়, আই ওয়াশ নয়, এবং তা বুঝে যদি রাস্তায় নেমে আসে তা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়!

ব্যাক্তিগত আক্রমনের জায়গাগুলো এড়ায়ে এই সাংসদেরা প্রতিনিধিত্বমুলক গনতন্ত্রের ব্যাপারে যদি আন্তরিক ও সৎ হন, তাহলে র‍্যাব জাতিয় প্রতিষ্ঠান থাকবার কথা নয়।সংসদ খবরদারির জন্য নয়, মতপ্রকাশের স্বধিনতাকে খর্ব করার জন্য নয়, বিরোধিদের গায়েব করবার জন্য নয়, গার্মেন্টস কর্মিদের ন্যাজ্য মজুরি অস্বিকার করবার জন্য নয়, আদিবাসি ও সঙ্খ্যালঘুদের উপর জুলুমবাজির জন্য নয়। সংসদ যদি বুঝে থাকে যে সে দলের মুখপত্র নয়, জনগনের মুখপত্র, তাহলে জনগনকেও সে পাশে পাবে।

জনগন যখন নাটশেলে বা সারসঙ্খেপে জানতে চাইবে ষোড়শ সংশোধনি বাতিলের রায় কি, কেন, কিভাবে তাদের প্রতিনিধিত্ব খর্ব করে, নাকচ করে তা মানিক বা মোর্তজার এক চোখো সাত কাহনে পাওয়া যাবে না।আবার জনগন যদি বুঝে থাকে যে আমাদেরতো দাড়াবার কোন জায়গাই আর নাই, সেই পায়ের তলে না থাকা মাটির ভৌতিক দখলদারি নিয়ে কামড়াকামড়িতে আমরা মাথা গলাবো কেন, তাহলে বুঝতে হবে রাস্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এক তলাহিন অন্ধ গহবরে এসে ঠেকেছে।এখান থেকে উঠে আসতে হলে ভুল স্বিকার করে আন্তরিক প্রয়াস ছাড়া আর উপায় নাই।নাগরিককে ভয় দেখানো রাস্ট্র বলতে পারে না যে আমি তোমার পক্ষ্যে।নাগরিকের পক্ষে আসতে হলে রাস্ট্রকে এনজিও, কর্পোরেট স্বার্থ, পুলিশি নিপিড়নের বাইরে আসতে হবে।এদের পক্ষে থাকবো, আর ভান করবো জনপ্রতিনিধিত্বের, তাহলেতো ভাল কথায়ও আমাদের অবিশ্বাস জন্মাবে।সন্দেহ, অবিশ্বাস চলে আসলে তার ফাকফোকর দিয়ে ঢুকে যাওয়া বিশ্বাসের ফেরিওয়ালারা যে কিভাবে তান্ডব চালাতে পারে তার নজিরও আমরা কম দেখছি না।আমাদের ঘরে ঘরে এখন পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।

সবচেয়ে বড় অবিশ্বাসের জায়গাটা হচ্ছে, আগের বাতিল করা সংশোধনিগুলোর ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধি অধ্যাদেশগুলো বজায় রেখে সংসদ রাস্ট্রকে প্রতিক্রিয়াশিল জায়গাতে নিয়ে গিয়েছে।ষোড়ষ সংশোধনি বাতিল করতে গিয়ে বিচারপতিরা এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে।তবে ষোড়শ সংশোধনির মুল প্রসংগ হচ্ছে,  ''বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেয়া''।এটা বাতিল  করতে গিয়ে বিচারপতিরা ৭২ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসংগ আনলো কেন?সরকার পক্ষ্যের এটর্নি যখন সুপ্রিম কোর্টে বাতিল পঞ্চম সংশোধনির প্রসংগ আনেন, বিচারপতিরা দেখান যে সে-সংশোধনির  একটা অংশ সংসদে প্রয়োগ করা হচ্ছে।পঞ্চম সংশোধনি যা পরে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে তাতে বলা হয়েছিল ''১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধতা দান,বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন।''সুপ্রিম কোর্ট য্যানো প্রকারান্তুরে সংসদকে জানালো যে, যারা নিজেরাই একটি বাতিল অধ্যাদেশের গোড়াটুকু রেখে আগাটুকু ছেটে ফেলে, তাদের কাছে জবাবদিহিতার দরকার নাই।কিন্তু এই প্রেসিডেন্সকে জায়েজ করলে  অপরাপর অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজেদের জবাবদিহিতার বাইরে নিয়ে যাবে।

আবার র‍্যাব জাতিয় প্রতিষ্ঠানের হাতে চুড়ান্ত বিচারিক সিদ্ধান্তমুলক অধিকার দিয়ে দিয়ে সংসদ গোড়াতেই নিজের প্রতিনিধিত্বশিলতাকে দুর্বল করে দিয়েছে।র‍্যাব প্রসংগ অবস্য বিচারপতিরা  আনেন নাই, এটা আমার পর্জবেক্ষন!ষোড়শ সংশোধনি বাতিলের রায়ের ফলে আমরা বুঝতে পারছি কোন ধরনের আমলাতন্ত্র প্রতিনিধিত্বশিল, জবাবদিহিতামুলক গনতন্ত্রকে খর্ব করতে চায়।কিন্তু আমাদের প্রতিনিধি কারা, সেটাই আমরা আর বুঝে উঠতে পারছি না।ফলে বন্ধুবেশি ডেভিড বার্গম্যানদের ফাদে পড়ছি আমরা।ষোড়শ সংশোধনি বাতিলের রায় যদি জবাবদিহিতামুলক সুশাষনের পথকে বাধাগ্রস্থ করে দুশাষনের পথ প্রশস্ত করে, তাহলে সেই দুশাষনের দায়ভার বিপুলভাবে সংসদের ওপরও বর্তায়।

চয়ন খায়রুল হাবিব
২৯/০৮/১৭