Friday 29 May 2015

দান্তে আহ্লাদিত রবীন্দ্রনাথ


ইটালির প্রথম নারী-মহাশুন্যচারি সামান্থা ক্রিস্টোফোরেট্টি, গত ২৪শে এপ্রিল, ২০১৫ আন্তর্জাতিক মহাশুন্য স্টেশানে তার নিয়মিত কাজ থেকে সময় বের করে নেয় দান্তের 'ডিভাইন কমেডি' থেকে আবৃতির জন্য! সামান্থা পাঠ করে, 'পারাদিসো' পর্বের উদ্বোধনি ক্যান্টো, যেখানে দান্তে আগুনের ঘোরানো সিড়ি বেয়ে ঈশ্বরের দিকে তার যাত্রার বর্ননা করছে:

''বেহেস্তের একেবারে ভিতরে আমি
যেখানে ঈশ্বরের আলো এবং দেখলাম
যারা ঐ চুড়া থেকে নেমে আসে, ভুলে যায় সব
অথবা আর কথাই বলতে পারে না।''

উপরের পংতিগুলো পড়ার সময় ক্রিস্টোফোরেট্টিসহ মহাশুন্য-স্টেশান ঘন্টায় সতের হাজার মাইল বেগে পৃথিবী প্রদক্ষিন করছে, তার পাঠ সরাসরি দেখানো হচ্ছে ফ্লোরেন্সের এক প্রেক্ষাগৃহে! এর দশদিন পর, অস্কার জয়ি ইটালিয়ান নির্দেশক, অভিনেতা রবার্তো বেনিনি ইটালির সিনেটে পাঠ করে পারাদিসোর শেষ ক্যান্টো:

এখানকার ফোর্স আমার ফ্যান্টাসিকে হার মানায়,
কিন্তু এর মধ্যেই আমার কামনা, বাসনা
ঘুরপাক এমন এক চরকায় এমন এক ভালবাসায়
যা সূর্য তারাদের দেয় সুষমার মূর্ছনা

পাঠ শেষে সিনেটরেরা বেনিনিকে দাড়ায় অভিবাদন জানায়! দান্তের সাড়ে সাতশো বছর জয়ন্তী উপলক্ষে সিনেটের ঐ অনুষ্ঠানে পোপ লিখে পাঠায়, ' ...আমি তাদের সাথে যোগ দিচ্ছি, যারা সমস্বরে দান্তে আলিঘিয়ারিকে বিশ্বায়িত মূল্যবোধে প্রাণিত সর্বোচ্চ মানের শিল্পী হিসাবে স্বীকার করে!'

দান্তের আসল নাম দুরান্তে আলিঘিয়ারি (Durante Alighieri), সংক্ষেপে দান্তে। জন্ম সাড়ে সাতশো বছর আগে ফ্লোরেন্সে, মে মাসের শেষ সপ্তায় বা জুনের প্রথম সপ্তায়! মধ্যযুগীও দৈব-নির্ভর তত্বগুলোর সাথে আমাদের দূরত্ব স্বত্বেও, পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের মধ্য দিয়ে দান্তের কাল্পনিক যে-যাত্রাপথকে আমরা 'ডিভাইন কমেডি' হিসাবে জানি তা বিভিন্নভাবে মানবসভ্যতার জরুরি উপকরণ হয়ে উঠেছে!

কেন এতদিন ধরে এ-কবিতাটা টিকে আছে?

দান্তের মাস্টারপিসের প্রথমভাগে জ্বলন্ত চুলাতে টগবগায়ে জ্যান্ত সিদ্ধ হবার দিকে আমাদের সবার কল্পনা যেতে না চাইলেও মৌলবাদীদের আরোপিত বাস্তবতা অবশ্য সেদিকে যেতে চায়! কিন্তু দান্তের বিশ্বায়িত পাড় ভক্তদের ভেতর অনেকের যাপনে মৌলবাদের ছিটেফোটাও নাই! আপাত নাস্তিক, নোবেল বিজয়ী স্যামুয়েল বেকেট ১৯৮৯ সালে প্যারিসের এক হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শিয়রের কাছে 'ডিভাইন কমেডির' একটা কপি রাখতো! রুশ কবি ওসিপ মান্ডেলস্টাম দান্তের প্যাপারব্যাক কপি ছাড়া ঘর থেকে বেরোতো না!
ফ্লোরেন্সে বিয়াত্রিসের সাথে দান্তের সাক্ষাত!
বিয়াত্রিস মাতম

ইটালির স্কুল ছাত্রছাত্রী মাত্র স্বর্গ-নরকে দান্তের যাত্রাপথের সাথে পরিচিত! এক শুক্রবার ভোরবেলা অতিপ্রাকৃত এক জংগলে এ-যাত্রার শুরু! 'ডিভাইন কমেডি'তে দান্তে নিজেও একজন প্রধান চরিত্র, যে একাকীত্বে ভুগছে এবং ভয়তাড়িত মাঝ বয়সে এসে জঙ্গলে পথ হারায়েছে! লাতিন কবি ভার্জিলকে দান্তের কাছে পাঠায়েছে এক ছায়াবৃতা রমণী, বিয়াত্রিস। ভার্জিল দান্তেকে প্রথমে নিয়ে গেলো নরকে ভয় দেখাতে! পাঠকের মনে শত শত বছর ধরে এক ধাধা, কে এই বিয়াত্রিস?

হতে পারে বেশ কিছু কারণে দান্তে তীব্র ভাবে পাপ, পুণ্য নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল! বিয়াত্রিসের প্রতি যে তার প্রচণ্ড প্রেমাসক্তি ছিলো তা বোঝা যায়! বিয়াত্রিসের প্রতি দান্তের বিহ্বলতা ৯ বছর বয়স থেকে, কিন্তু ১২ বছর বয়সে পারিবারিক বন্দোবস্ত অনুযায়ী তাকে বিয়ে করতে হয় অন্য মেয়েকে! বিয়ের অনেক দিন পর আবার দান্তের সাথে বিয়াত্রিসের দেখা হয়, কিন্তু বিয়ের বাইরে কোন সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায় না। কুলীন বংশে জন্মানোর এবং সক্রিয়ভাবে বেশ কিছু যুদ্ধে অংশ গ্রহণের সুবাদে দান্তে ফ্লোরেন্সের বেশ কিছু প্রভাবশালী পদে নিয়োজিত ছিলো। এসব পদের আনুষঙ্গিক প্রতিক্রিয়াতে তার শত্রুসংখ্যাও বেড়ে যায়! শত্রুপক্ষ তাকে দুর্নীতির দায়ে ফ্লোরেন্স থেকে বহিষ্কার করে! পরবর্তী বিভিন্ন শাসকেরা প্রায়শ্চিত্ত বা জরিমানা সাপেক্ষে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করবার আশ্বাস দিলেও দান্তে কখনো তা করতে চায় নাই, কারণ প্রথমত দুর্নীতির অভিযোগটাকেই দান্তে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল!

ক্যাথলিক খ্রিস্টান মতে শুধু যে বিয়ের বাইরে সঙ্গম মহাপাপ তাই নয়, হস্তমৈথুনও মহাপাপ! আর খ্রিষ্টীয় তত্ত্বের বিশাল অংশ ব্যয় করা হয়েছে যৌন আচরণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে! কনফেশান বা স্বীকারোক্তির পুরাটা দাড়ায়ে আছে কে কবার মৈথুন করেছে বা মৈথুনের চিন্তাভাবনা করেছে তার উপর! হতে পারে যে মৃত বিয়াত্রিসকে মনে পড়লে দান্তে হস্তমৈথুন করতো, আর তার পর প্রবল পাপবোধে আক্রান্ত হত, মনে করতো যে তার এসব পাপাচারী চিন্তার ফলে বিয়াত্রিস পরপারে কষ্ট পাচ্ছে! এক অর্থে বিয়াত্রিসকে দান্তে মানসে পরপারের অবরোধবাসিনী বলা চলে, যাকে প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে, স্বর্গারোহণের মাধ্যমে মুক্তি দেয়াটাও দান্তের লক্ষ্য! নারীবাদী, মৌলবাদী, হেনবাদি, তেনবাদি সবাই যার যার হিসাব অনুযায়ী দান্তে থেকে অনেক কিছু পাবে!

যা জানা যায়, দান্তে তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রচল ভেঙ্গে তার এই মহাকাব্য বা মজাকাব্য লাতিনে না লিখে, স্থানীয় টসকানো গনবুলিতে লিখেছিল! মহাকাব্যটার প্রথম ভাগ অর্থাৎ 'ইনফার্নো' লেখা শুরু করে ১৩০৭ সালে, ফ্লোরেন্সে থেকে ভুয়া দুর্নীতির দায়ে তাকে বহিষ্কার করবার পাচ বছর পর! সে হিশাবে দান্তে, ইংরেজ কবি জেফ্রি চসারের প্রায় ৮০ বছর আগে লাতিনকে শিকায় উঠিয়েছিল। দান্তে জন্মভূমি ফ্লোরেন্সেও আর ফিরে নাই!

দান্তের হাতে টসকানার ভাষার সাহিত্য ভাষা হয়ে উঠবার পালাবদলকে বলা হয়, 'Dolce stil novo'  বা 'মিষ্টি নূতন ঢং'। স্থানীয় টসকান গনবুলিতে লিখবার সাফাই হিশাবে দান্তে অবশ্য লাতিনে লিখেছিল, De Vulgary Eloquentia! 'ডিভাইন কমেডির' ভাষিক প্রক্ষেপণের শক্তি এমনই যে আঞ্চলিকতার সীমানা পেরিয়ে তা হয়ে দাঁড়ায় ইটালিয় সাহিত্যের মানভাষা! একদিকে ভেনিস, আরেকদিকে পালার্মোর বাসিন্দারা যে মহাশূন্যে ভাসমান সামান্থার উচ্চারিত টসকান 'পারাদিসো' বুঝতে পেরেছে, তার কারণ আক্ষরিকভাবে ডিভাইন কমেডির বাচনিক শক্তি!

ইলিয়ট, পাসোলিনি থেকে হলিউডে

ইলিয়টের কাছে বিয়াত্রিস হচ্ছে গথিক অন্ধকার থেকে রেনেসার আলোর দিকে যাবার প্রতীক। দান্তে তার কাছে খ্রিস্টীয় সভ্যতার চূড়ান্ত উৎকর্ষ! দান্তেকে নিজের মূল্যবোধের জায়গা থেকে দেখতে গিয়ে ইলিয়ট আধুনিক মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে দেউলিয়া হিসেবে গণ্য করছে এবং সেখান থেকে লিখছে, Waste Land!

দেখা দরকার, যে-ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতার জায়গা থেকে এলিয়ট দান্তেকে পাঠ করছে, দান্তে কি শুধু সেখানে সীমিত কি না? দান্তে তার মাস্টারপিসে রোমান ক্যাথলিক তত্ত্বের সাথে ধ্রুপদী দর্শন এবং সমকালীন রাজনীতির এমন একটা কালোত্তীর্ণ, ভূগোলোত্তীর্ণ মন্ড বানায়েছিল যে তাতে একেবারে পরস্পরবিরোধী সৃজনশীলদেরও দান্তে শিবিরে মাথা নোয়াতে হয়!ষাটের দশকের প্রখ্যাত ইটালিয়ান কবি, চলচ্চিত্র নির্দেশক পিয়ের পাওলো পাসোলিনি এলিয়টের মত খ্রিস্টীয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী নয়। ইটালিতে বসবাসরত এলিয়টের ওস্তাদ ও ফ্যাশিজমের সমর্থক এজরা পাউন্ডের সাথে কিছুটা যোগাযোগ থাকলেও নিজের ঈক্ষণ, অনুশীলন কোনটার জন্য পাসোলিনি পাউন্ডকে দরকারি মনে করে নাই! পাউন্ড পাসোলিনির ব্যাপারে নীরবতা বজায় রাখলেও মার্কিন সমালোচনা সাহিত্যের দিকপাল হ্যারল্ড ব্লুম পাসোলিনিকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসাবে গণ্য করেছে! সমাজতন্ত্রের প্রতি পাসোলিনির বিশ্বাস এবং খোলামেলা সমকামী যাপন, যেরকম ফ্যাশিস্টদের কাছে তেমনি তখনকার খ্রিস্টীয় চর্চায় ঘোরতর অপরাধ! মার্কিন ধাচের ভোগবাদ এবং ধর্মভিত্তিক সুবিধাবাদী রাজনীতির সমালোচনা করে পাসোলিনি দান্তের বিনির্মাণ করে সমকালীন ভাষাতে, 'ডিভাইন মিমেসিস' নামে, যা প্রকাশিত হয় ১৯৭৫এ, নয়া ফ্যাসিবাদী ভাড়াটে খুনির হাতে পাসোলিনি নিহত হবার পর। দান্তের মত পাসোলিনি আক্রোশ প্রকাশ করেছিলো রাজনীতিবিদ, ধান্দাবাজ এবং ধর্মব্যাবসায়িদের বিরুদ্ধে!

আজকের ইটালিটে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে দান্তে পড়ানো হচ্ছে, সিনেটে তাকে নিয়ে প্রবল করতালি, ভ্যাটিকান তার জয়ধ্বজা ওড়াচ্ছে! কিন্তু দান্তে তার কাজে ও আচরণে ছিলো আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী, প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং তত্ত্বীয় স্বৈরতন্ত্রের ঘোরতর সমালোচক। যেদিকে ঘুরে তাকিয়েছে, দেখতে পেয়েছে ভণ্ডামি, দুর্নীতি এবং দুর্বলের উপর সবলের গা-জোয়ারি! ফিরে দাড়ায়ে কলম তাক করেছে স্বয়ং পোপদের দিকে, তাদের ঠেসে পুরে দিয়েছে জ্বলন্ত কবরে, নিজের শিক্ষকদের নেংটা করে ধাওয়া করেছে গা পোড়ানো বালুরাশির ওপর দিয়ে! এই দান্তে কি পিঙ্ক ফ্লয়েডের 'ওয়ালস' গানের অনুপ্রেরণা নয়?

১৯৩৫এ হলিউডে নির্মিত হয় মেলোড্রামা, 'দান্তের ইনফার্নো'। স্পেন্সার ট্রেসি অভিনীত ছবিটাতে ১০মিনিট ধরে দেখানো হয় মধ্যযুগীও দান্তের কলম থেকে নেমে আসা পাতালপুরী, যেখানে গুনাহগারদের পুরে দেয়া হয়েছে সালফার ঠাসা নরক কুণ্ডে, আর তারা চোখের পানি দিয়ে তাদের পাছা ঠাণ্ডা করছে! ইটালিয়ান,স্থানীয় ঘরোয়া ভাষাতে যেভাবে জমায়ে দান্তে লিখেছে এবং শত বছর পরেও আজকের অভিনেতা বেনিনি, মহাশূন্যচারিনী সামান্থা তার সাথে যেভাবে একাত্ম হতে পারে, সে ভাষাকে কিভাবে লাগসই অনুবাদে আনা যায় তা নিয়ে ভাবিত হয়েছে ইংরেজ কবি লংফেলো, আইরিশ কবি বেকেট, বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ! লংফেলোর, বেকেটের সুবিধা ছিলো যে তাদের চর্চিত ইংরেজি ভাষা সেসময় পোক্ত সাবালকত্বে পৌছে গেছে, আর রবীন্দ্রনাথের চর্চিত বাংলার মানভাষা তখন কেবল শৈশব পাড়ি দিচ্ছে!

যাযকিয় ক্যাথলিসিজমকে প্রত্যাখ্যান করায় বেকেট  দান্তেইয়ান গদ্য, All Strange Away-তে দান্তের সাথে সাধর্ম্যে পৌছাতে পেরেছে, বর্ণাশ্রম প্রত্যাখ্যান করেও 'ভিক্টোরিয়ান আনুষ্ঠানিকতায়' জারিত হবার কারণে রবীন্দ্রনাথ সেখানে পৌছাতে না পারলেও তার দান্তে ব্যাবচ্ছেদে অঙ্গীকারের অভাব ছিলোনা! খেয়াল করা দরকার যে 'ভিক্টোরিয়ান আনুষ্ঠানিকতা' তে উদ্ধৃতি চিহ্ন বসিয়েছি, 'ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধ' লিখি নাই! চেতনায়, মূল্যবোধে, অঙ্গিকারে, নিবেদনে রবীন্দ্রনাথ স্বততই রেনেসার বরপুত্র, যে রেনেসার আতুড়ঘর ইটালি এবং রবীন্দ্রনাথ তা আন্তরিকভাবে সুনির্দিষ্ট করতে পেরেছিল!

ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিকতার ওরিয়েন্টালিস্ট অভিভাবকত্ব পার হয়ে অপরাপর ইউরোপীয় সাহিত্য, সংস্কৃতির পাঠ এখনকার তুলনায় নিশ্চিতভাবে রাজ আমলে আরো অনেক বেশি কঠিন ছিলো! দীর্ঘদিন লন্ডন ও ভার্সাইতে কাটিয়েও মাইকেল তার সমসাময়িক ফরাসি জাদরেল সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর খোজ জানতে পারে নাই! কোলকাতায় লাতিন বিশেষজ্ঞ অনেক মিশনারি শিক্ষক থাকলেও তারা প্রচার করতো  ব্রিটিশ এংগ্লিকান চার্চের শিক্ষাক্রম! যেসব পর্তুগিজ, ফরাসি লাতিন জানা মিশনারি কোলকাতায় কাজ করতো তাদেরও ব্রিটিশের শর্ত মেনে মুচলেকা দিয়ে প্রচার চালাতে হত! উপনিবেশিক খাওয়াখাওয়িতে অনেক পিছায়ে পড়া ইটালির পক্ষে তাদের রেনেসাজাত শিল্প, সাহিত্য, কৃষ্টি ইউরোপ পার করে অন্যত্র রপ্তানি করা সম্ভব ছিলনা! ধরে নেয়া যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের দান্তে আহ্লাদ একান্তই তার নিজস্ব এবং পারিবারিক আবহ থেকে এসেছে! ইউরোপীয় রেনেসার মূল্যবোধ রবীন্দ্রনাথের লেখালেখিতে যেরকম বিশ্বায়িত মানবতাবোধের বিস্তার ঘটায়েছে, সেরকম এই একই মূল্যবোধ জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর তাকে নাইটহুড প্রত্যাখ্যানে অবিচল রেখেছে।



রবীন্দ্রনাথ: 'বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য'

রবীন্দ্ররসে জারিত দান্তে সুধা পান করতে হলে 'বিয়াত্রিচে দান্তে ও তাঁহার  কাব্য' প্রবন্ধটা প্রণিধানযোগ্য।এই প্রবন্ধে আগাগোড়া রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ভার্জিলকে বর্জিল বলেছে, তাতে সন্দেহ হয় যে দান্তেকে দন্ত বলে নাই হয়ত শুধুমাত্র দেহশুচিতার কারণে!

সম্ভবত লংফেলোর ১৮৬৫ সালের দান্তে অনুবাদটা রবীন্দ্রনাথের হাতে আসে!সেকালের কোলকাতায় ইউরোপের ধ্রুপদ সাহিত্যের পুরোটাই এসেছে ইংরেজের ভিক্টোরিয়ান ছাকনকাচে! রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি দখল বোঝা যায় স্বকৃত অনুবাদে ইয়েটসকে মুগ্ধ করবার মাধ্যমে।একই রবীন্দ্রনাথ 'রক্তকরবীর' দুর্বল অনুবাদ 'রেড অলিয়েন্ডার' করে বুঝে ফেলছে মৌলিক ইংরেজি সাহিত্য তার কাজ নয়! আবার স্প্যানিশ কবি হুয়ান র্যামন জিমেনেথ ইংরেজি থেকে 'গীতাঞ্জলী' অনুবাদ করল স্প্যানিশে, আর তা পড়ে প্রভাবিত হলো তরুণ নেরুদা!

মোদ্দায় দাড়াচ্ছে, অনুবাদের জন্য মুল ভাষা না জানলেও চলে। তবে লংফেলোর অনুবাদে হয়ত রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিল দান্তের প্রেমভাবের সাথে তার একাত্মতা থাকলেও, দান্তেকৃত টসকানার যে গনবুলি পরে ইটালির মানভাষাতে রূপান্তরিত হয়েছে, তার খোলামেলা উৎপ্রেক্ষার সাথে তার শুদ্ধাচারী রুচিবোধ মেলে না! বেকেট তার দান্তেইয়ান গদ্যে সাবলীলভাবে 'পাছা' বলতে পারে, নেরুদা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পার হয়ে উদ্দাম দেহসংলগ্ন প্রেমের কথা বলতে পারলেও, রবীন্দ্রনাথ নিজে তার প্রভাব পার হতে পারে নাই! দান্তেকে পুরোপুরি পেতে হলে, যখন সে একের পর এক পোপদের নরকে পুরে দিচ্ছে এবং তারা চোখের পানি, নাকের পানি এক করে পাছা ঠাণ্ডা করছে, তা আজকের ইংরেজিতে কি গতকালকের ইংরেজিতেও দাড়াবে  arse অর্থাৎ পোদ বা পুটকি!

অনুবাদের এই নিষ্পত্তির ভার রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছেড়ে দিত সুনীতি চট্ট এন্ড কোর ওপর! দান্তের যেরকম বিয়াত্রিচে, রবীন্দ্রনাথের সেরকম যৌবনে কাদম্বরী দেবীর আত্মহননের ভার, বুড়ো বয়সে কিশোরী ওকাম্পোর প্রতি অনুরাগের বিড়ম্বনা এবং বিজয়া-কবিতাসভার উৎসারণ! দান্তে, রবীন্দ্রনাথ দুজনেই লোলিটা সিন্ড্রোমে আক্রান্ত, কিন্তু নাবোকফের মত তার ফয়সালাতে দেহতত্ত্বে না গিয়ে নান্দনিক পরিত্রাণ খুজেছে অধ্যাত্মে! নাবোকফ কি তাহলে দান্তের সচেতন এন্টিথিসিস?

সাড়ে সাতশো বছর আগের দান্তে গগনবিদারী হাহুতাসে, অনুভবের আগে সামাজিক বোঝাবোঝির সাথে ফয়সালা সেরে নেয়! এখানে দান্তে পদবীধারীদের পদ সরাসরি উল্লেখ করে তাদের শুলে চড়াচ্ছে, জ্যান্ত সিদ্ধ করছে এবং প্রেমের পথে যে তারা বাধা তা জোরেশোরে বলছে! বোঝাবোঝির সাথে ফয়সালার এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে দান্তে, বোক্কাশিও, পেত্রার্কাদের লাতিন থেকে সরে আসা।রবীন্দ্রনাথের বেলায় বোঝাবোঝির আগে অনুভবের ফয়সালা এবং এতে করে বিজয়া ওরফে ওকাম্পো কক্ষনো ভারতে না এলেও, কক্ষনো রবীন্দ্রনাথের প্রেমভাবে সাড়া না দিলেও রবীন্দ্রভক্তদের কাছে, 'হয়ত কিশোরী ওকাম্পো কাউকে না জানিয়ে ভারতে গুরুদেবের কাছে এসেছিল!'

দান্তের নিজ মুখে বিয়াত্রিসের জন্য তার কৈশরিক বিহ্বলতা রাবিন্দ্রীক অনুবাদে, ''ক্রমে ক্রমে আমার স্বাস্থ্য এমন নষ্ট হইয়া আসিল যে, আমার আকার দেখিয়া বন্ধুরা অতিশয় চিন্তিত হইলেন; আবার যে গূঢ় কথা সকল-কথা অপেক্ষা আমি লুকাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছি, কেহ কেহ অসদভিপ্রায়ে তাহাই জানিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আমি তাঁহাদের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া যুক্তি ও প্রেমের পরামর্শে উত্তর দিলাম যে, প্রেমের দ্বারাই আমার এই অবস্থা হইয়াছে। আমার আকারে প্রেমের চিহ্ন এমন স্পষ্ট প্রকাশ পাইতেছিল যে, সে গোপন করা বৃথা।'' এই অনুবাদে কি একজন কিশোরের কামেচ্ছা বা কামজ্বরের আভাষ মেলে না? হরেদরে যে মেলে তা বুঝে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে পারমার্থিক প্রেমের জায়গাগুলোর অনুবাদ করে তৃপ্ত ছিল কি? বিজয়া কবিতাগুলোর তাড়না পড়লে বোঝা যায়, দান্তের মত কল্পিত পোড়া মাংসের নারকীয় যজ্ঞে মেতে উঠতে না পারলেও,একজন কিশোরী বা তরুণী যে দিব্যলোকের আকাশ-পরি হবার আগে মর্ত্যলোকে তাকে পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আশা বা হতাশা তৈরি হয় সে হিশাবটা বুঝেছিল! আবার এও দুজনেই তাদের পাঠকদের উপলব্ধি করাতে চেয়েছিল যে মর্ত্যধামের এই কিশোরীগন শুধু মাংসপিণ্ড নয়, তাদের একটি স্পর্শকাতর মন আছে।

দান্তের অনুভবের আগে সামাজিক বোঝাপড়া এবং রবীন্দ্রনাথের সামাজিক বোঝাপড়ার আগে অনুভবের ফয়সালাতে প্রায়োগিক অনুশীলনের পার্থক্য থাকলেও প্রবর্তনাগত দিক থেকে দুজনের সবচেয়ে বড় মিল হচ্ছে, দুজনেই দেহের আগে মনকে স্থান দিয়েছিল, এবং মনের উচাটনকে সাহিত্যের প্রধান প্রণোদনা হিশাবে স্থির করেছিল! এ সেতুবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথ দান্তের চোখে বিয়াত্রিসকে দেখে,

জাগি উঠি স্বপ্ন যদি ভুলে যাই সব,
তবু তার ভাব যেমন থাকে মনে মনে,
তেমনি আমারো হল, স্বপ্ন গেল ছুটে
মাধুর্য তবুও তার রহিল হৃদয়ে।

দান্তের জন্ম সাড়ে সাতশো বছর আগে! শেক্সপিয়ার ইংরেজের প্রধান সাহিত্যিক হয়েছে দান্তের তৈরি ইটালিয়ান সাহিত্যকে আত্মস্থ করে এবং ভারতে রবীন্দ্রনাথসহ দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন সময়খন্ডে বেকেট, মান্ডেলস্টাম, পাসোলিনি, এলিয়টদের ওপর দান্তের প্রভাব, অনুসরণ তার কালোত্তির্নতা বার বার স্মরণ করায়! স্মর্তব্য যে মহাকবিদের মহাকবি দান্তে তার জন্মভূমি ফ্লোরেন্স থেকে নির্বাসিত হয়েছিল এবং পরে প্রচুর  নিমন্ত্রণ স্বত্বেও সেখানে আর ফেরে নাই! পরের মেজর, মাইনর সব কবিকে ঐ মহাপরাক্রান্ত দান্তে স্মরণ করায়ে দিয়েছে: কবির এবং কবিতার দেশ নাই, সাহিত্যের চূড়ান্ত উৎকর্ষের সাথে জন্মভূমিতে থাকা না থাকার কোন সম্পর্ক নাই!
চয়ন খায়রুল হাবিব
২৬/০৫/১৫
ব্রিটানি/ফ্রান্স

সূত্র:
রবীন্দ্রনাথ:'বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য'
লংফেলোর ইংরেজি অনুবাদে দান্তের ইনফার্নো
টি এস এলিয়ট  Waste Land
স্যামুয়েল বেকেট All Strange Away
হ্যরল্ড ব্লুম Western canon
ওয়াইকিপিডিয়া, ভ্যাটিকান রেডিও, ইউটিউব, নাসা ওয়েবসাইট
এবেল ফেরেরা নির্দেশিত পাসোলিনি ডকুমেন্টারি