Saturday, 20 June 2015

মুস্তফা আনোয়ারের যৌন-ক্ষুর

'বাংলা ভাষাপ্রমিতের নোম্যান্সল্যান্ড', ২০১৫ লেখাটি গ্রন্থবদ্ধ

প্রাগুক্ত:

অগ্রজ কবি মুস্তফা আনোয়ারের সাথে আশির দশকে বিভিন্ন সঙ্গে, অনুষঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা থাকলেও, বর্তমান আলোচনা তার 'ক্ষুর' গ্রন্থ নিয়ে আবু রুশদের ইংরেজি রিভিউ ঘিরে আবর্তিত !রিভিউটা বেরোয় প্রথম সংস্করণ(১৯৭৯, মার্চ) প্রকাশের মাস তিনেকের ভেতর!
এক দশকেরও বেশি পর দ্বিতীয় সংস্করণে(১৯৯১) এই রিভিউটা দেবার আগ দিয়ে মুস্তফা লিখেছিল, ''তার(আবু রুশদের) উপদেশের গাণ্ডীবে আমি তূণ সংজোজন করতে, বারো বছরের হিংস্র খল দিবস-রজনী অতিক্রম করেও আজো কৃষ্ণ ব্যর্থতা বহন করছি।সাহিত্যের দার্শনিক মীমাংসা যদি কোনদিন আমার জন্য উন্মুক্ত হয় তবে তা নমস্য অধ্যাপকের স্নেহমেশা মৃদু ভর্তসনাই সে ঘটনার অণুঘটক।''এই 'কৃষ্ণ ব্যর্থতা' আমার কাছে আত্মপ্রবোধ মনে হয় নাই, বরং আত্মমুল্যায়িত সিমাবদ্ধতার নিরিখে যথার্থ 'মীমাংসাই' মনে হয়েছে!কাছাকাছি দেখা এই সিমাবদ্ধতার মিসিং
লিংকগুলাকে হেতুবদ্ধ করেই আমাকে 'ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ান'এর সিগ্নেচার টিউন তৈরি করতে হয়েছে! একই লক্ষ্যে 'বৈঠকখানা'র দ্বিতীয় সংখ্যাতে এ-শিরোনামের প্রথম কিস্তিতে কবি সাবদার সিদ্দিকীর যাপন, ঈক্ষণের ওপর আলোকপাত করেছিলাম!

জরুরি পারিপার্শ্বিকতাঃ

“ক্ষুর” গল্পগ্রন্থটা নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ই জুন “দ্য নিউ নেশানে” আবু রুশদ সদ্য সদ্য লিখেছিল:
“The writer has the gift of imagination and perception, but he has shown no evidence in this book that he can successfully handle themes not related to the Sartre or Camus orbit. If he can cultivate a greater interest in his immediate environment without loosing the freshness of his imagination it is possible for him to give us stories with a greater variety of theme and having a closer bearing of our every-day life.”

আবু রুশদ “immediate environment” বলতে 'জরুরি পারিপার্শ্বিকতা' এবং পরিবেশগত বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত দিলে, বোঝা দরকার কেন মুস্তফা “immediate environment”এর বদলে ব্যক্তিক মানসিক পরিবেশ নিয়ে ব্যাস্ত হয়েছিল!স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠক মুস্তফার বাংলাদেশতো ইমিডিয়েট এনভায়রনমেন্টের মাল মশলাতে ভরপুর ছিলো এবং আছে!মুস্তফার কাছে কি তাহলে সাহিত্য চর্চা নিজেকে আড়াল করবার হাতিয়ার ছিলো?না কি ব্যক্তিক
মনস্তত্বের অনুশীলন ছিলো জরুরি পারিপার্শ্বিকতাতে পৌঁছানোর আয়াস?

শিল্পীর জরুরি পারিপার্শ্বিকতাতো প্রথমে তার নিজের আশপাশ এবং নিজের ভেতরের টানাপোড়েন।এ-দুইএর দ্বন্দ্বেই শিল্প।আর আশপাশের সাথে ভেতরের দ্বন্দ্ব শুধু শিল্পীর ক্ষেত্রে নয় ব্যাক্তি মাত্রেই ভিন্ন।আমাদের দেহ একই কারণে জেব্রাদের মত একই রেখাতে চিনহিত না!আমরাতো আমাদের প্রেম সোহাগেও আর আর জন্তুর মত মৌসুমি না!
ছড়ির বাট তা সোনার, না রুপার তাতে যাকে গুঁতোনো হয় তার কি যন্ত্রণার উপশম হয়?হয় না যে তা আবু রুশদ জানত কড়ায় গণ্ডায়।সার্ত্রে, কামুর প্রসঙ্গে এসে রুশদ এটা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল যে মুস্তফার পক্ষ্যে উৎকেন্দ্রিক হবার পরেও কেন্দ্রনিবিড় হওয়া সম্ভব ছিল!

আবু রুশদ যা লিখেছে তা হুট করে লেখে নি।সেলিম আল দিন, মামুনুর রশিদরা তাদের নাট্য নির্দেশনায়; শামসুর রাহমান , শহিদ কাদরি, আল মাহমুদ তাদের কাব্য প্রেরণায় ; জহির রায়হান, মাহমুদুল হক তাদের গদ্য চর্চায় যে সামগ্রিক মন্ড তৈরি করেছিল , আবু রুশদের তুলনামূলক বিচ্চার এসেছে সেখান থেকে।প্রাগ্রসর এ-ধারাটি প্রভাবিত করেছে হাসান আজিজুল, সৈয়দ হক, মুহাম্মদ রফিক, আখতারুজ্জামান
ইলিয়াসদের।এর ভেতর কিছুদিন থেকে আল মাহমুদ প্রমুখেরা যে ধারাটি নিল তাকে ইসলামি ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীলতার সাথে লোক সংস্কৃতির মিশেল ধারা বলা জেতে পারে,যার শুরু ফররুখ আহমেদকে দিয়ে এবং দ্যোতনায় যা জসিমউদ্দিনের ধারক!

এক দিকে বাম প্রগতিশীল, আরেক দিকে মৌলবাদী সাহিত্যচর্চা; এই দুয়ের রক্ষণশীল প্রতীকগুলোর মধ্যে সুবিধাবাদী ভারসাম্য রক্ষা করে তথাকথিত সমাজ-বাস্তবতাবাদি গদ্যকারেরা ব্রতী হ'লো এমন এক ধারার যা পরে রূপ পেল জামাতি-মার্ক্সিস্ট শিবিরে; মার্ক্স-মাওদের ফু দেয়া এ-ফিউশানটাকে এক্ষেত্রে বলা চলে ক্যাপিটাল লেটারে, চড়াদাগের BAD ART!মন্দ শিল্প বা ভাল শিল্প যাই হোক, তিন তিনটি প্রবহমান
ধারা!কিন্তু তিনটি ধারার কোনটাতেই মুস্তফা আনোয়ার স্বচ্ছন্দ নন; এমন কি মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আব্দুলাহ আবু সাইয়িদদের সাথে 'স্বাক্ষরে' সক্রিয় থাকবার পরও!

গুড আর্ট, ব্যাড আর্ট:

“Life imitate art, art imitate life” একই ভাবে "Bad life immitate bad art, bad art immitate bad life."
এই ব্যাড আর্টের লোকজনদের সবখানে দেখা যাবে পাঠককে একমুখী, এক মাত্রিক করে দিচ্ছে!আবু রুশদের যে-বিচ্চার, সেখান থেকে মুস্তফার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার পরেও পাঠক আনুকূল্য পাবার কথা; কিন্তু পাঠক এবং মুস্তফার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল ব্যাড আর্টের বরকন্দাজেরা!এর উত্তরে মুস্তফার যে বিনির্মানমুলক অনুশীলন তাই পরবর্তীতে তাকে আশির প্রবর্তনামুলক কবিদের কাছে দরকারি করে তুলেছিল!আশি,
নব্বই, শূন্য এবং সহস্রাব্দের প্রথম,দ্বিতীয় দশকে বিভিন্ন ভাবে 'ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ানের' চর্চা হয়েছে!মুস্তফার কাজ অল্প, সে-কাজ নিয়ে তার হাত দিয়ে বিশ্লেষনমুলক টেক্সট আরো অল্প!সাহিত্যের পরম্পরাতে বিনির্মিতি একটা দরকারি যোগসূত্র!যৌনতাজ্ঞ্বাপনকে ব্যাক্তির সংগা এবং সজ্ঞ্বার ভারসাম্যে এনে মুস্তফা প্রমাণ করেছিল যে বিচিত্রমুখিতার 'সম্ভাবনা' সে সম্পন্নতায় আনতে পারে;
'ডাকঘরের' গ্রামীণ আবহ 'কোন ডাকঘর নেই' নাগরিক-নেতিতে বিনির্মিত হতে পারে!

এটা দুর্ভাগ্যজনক যে মুস্তফার শেষ জীবনে ঘনিষ্ঠ কেউ, কেউ নিজেদের সিমাবদ্ধতাকে আড়াল করেছে মুস্তফাকে লোকজ অধ্যাত্মে উতসাহি বলে!এর একটা বড় কারণ হচ্ছে নব্বই, শূন্য দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশ্ব সাহিত্যের চর্চার দুর্বলতাকে ঢাকা দিতে বিশ্ব সাহিত্যকে নেতিবাচক হিসেবে দেখাটা একটা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে যায় এবং আশির, নব্বইয়ের সম্ভাবনাময় অনেকে এই নেতিবাচকতায় আক্রান্ত
হয়।লাকা,ফুকোর মত মুক্তমনা দার্শনিকদের টেনেহিচড়ে এনে এ-সময় সাম্প্রদায়িক নেতিবাচকতা জায়েজ করা হতে থাকে!এই নেতিবাচকতার কারণে মুস্তফার ঘনিষ্ঠ অনুজদের কেউ তলিয়ে দেখতে চায় নাই কেন আবু রুশদ উতসাহি হয়ে মুস্তফার রিভিউ করেছিল!

নাগরিক-নেতি নির্দেশ করছে যে নাগরিকতার একটা ইতিবাচক দিক আছে; যেখানে বিচিত্রতা হয়ে উঠছে ব্যাক্তির নবায়িত শেকড়!চটপটি, ফুসকা, হালিম খাবার মত একজন নাগরিক লালন, হাসন নিয়েও উতসাহি হয়ে উঠতে পারে!কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাজকে সমসাময়িক নাগরিক বিনির্মিতির পার্স্পেকটিভে নিয়ে আসা একজন লেখককে যদি কয়েকটা লালন কেন্দ্রিক কবিতার জন্য লোকজ জায়গা থেকে দেখা হয় তাকে পূর্বনির্ধারিত
কুপমন্ডুকতা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে!

আবু রুশদের কাছে মূস্তাফা আনোয়ারের চরিত্রগুলো উৎকট; এরা ভিড়ের ভেতর একা।আবু রুশদ 'ক্ষুরের' রিভিউতে লিখেছিল, 'His writing is full of contorted, and sometimes verminious images...''।নিজের সত্ত্বা ও স্বাতন্ত্র্যের উদ্বোধন ঘটালে যে স্থান, কাল, পাত্রভেদে সম্পূর্ণ বিদেশি সমাজের সবচেয়ে নিচুতলাতেও সে-স্বাতন্ত্র্য চিনহিত করা যায় লা পিয়েরের 'আনন্দ নগর' তার দৃষ্টান্ত।মুস্তাফা আনোয়ারও করতে চেয়েছিল তাই, কিন্তু টুকরো
টুকরো মিনিমালিস্ট ক্যানভাসে!

কামু'র 'প্লেগ'ঃ

'ক্ষুর' রিভিউতে আবু রুশদ যে কামুর প্রসঙ্গ এনেছিল, সে-কামু'র চোখ দিয়ে বিশ্বটাকে দেখা যাক!ধর্ম, স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদের হাত ধরে যে ক্রমশ বর্ণবাদ, লিংগবাদ, যৌন বৈশম্যবাদ ইত্যকার সামাজিক অসুস্থতার বিস্তার হয়, তার প্রতীকগুলোকে এক সুতায় বেধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেয়ার কামু লিখেছিল তার কালজয়ী উপন্যাস ''প্লেগ''!

খেয়াল রাখা দরকার যে হিটলারের তাবেদার ফরাসি ফ্যসিবাদি সরকারের বিরুদ্ধে কামু সক্রিয়ভাবে রেসিস্টেন্স বা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল!খেয়াল রাখা দরকার যে 'প্লেগ' এর লেখক, 'আউটসাইডার' উপন্যাসেরও লেখক, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র আইনের অনুশাসন মেনে চলা একজন যান্ত্রিক নাগরিক যে এমন কি মায়ের মৃত্যুতেও দুঃখবোধে ব্যর্থ, তারপর হুট করে সে একটা অপরাধ ঘটায় এবং তা নিয়েও তার কোন
অনুশোচনা নেই!উপন্যাসিকের চোখ দিয়ে এই চরিত্রটা আবিষ্কার করে যে তার অপরাধেরই শুধু বিচার হচ্ছে না, তার আবেগশুন্যতারও বিচার হচ্ছে উপন্যাসের প্রতীকী কাঠগড়ায়!

লক্ষণীয় যে ধর্মের অনুশাসনকে যারা রাষ্ট্রের ক্ষ্মতায়নের কেন্দ্রে রাখতে চায়, তাদের নিরাবেগ, অনুশোচনাবিহিন তৎপরতাকে যতবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, ততবার তারা বলে ওঠে যে যা যা তারা করছে সেসবই ধর্মীও আবেগ এবং অনুভূতিজাত!চিন্তার যে এই দায়শূন্য, তত্বজাত মুখোশ তার সাথে কিন্তু আর আলোচনা চলে না, তার জন্য দরকার সক্রিয় প্রতিরোধ!কামুর ''প্লেগ'' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডাক্তার
রিউ'র মারি-প্রতিরোধ সঙ্ক্রান্ত বিজ্ঞ্বানসম্মত পরামর্শে কান না দিয়ে যাজক পেনেলুক্স আক্রান্ত শহরবাসীদের বুঝাতে চেয়েছিল যে দৈব অভিশাপের কারণে, ধর্মকর্ম ঠিকঠাক পালন না করাতে প্লেগ নেমে এসেছে!পরে অবশ্য পেনেলুক্স ডাক্তার রিউ'র প্লেগ-প্রতিরোধ-দলে যোগ দিয়েছিল!ধর্মের আবেগ, অনুভূতির নামে আমরা যেমন আবেগ-মুক্তির পথগুলোকে রুদ্ধ করে দিতে পারি না, তেমনি জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ
বিদ্বেষী হেইট ক্রাইমের প্রাতিষ্ঠানিক-প্লেগ আমরা চাইতে পারি না!

পাপ, প্যাশন ও ওয়াক ওভারঃ

'ক্ষুর' গ্রন্থের “পাপ” গল্পটার শুরুতে সার্তের উধৃতি , ''Man is a Useless Passion!'' দেখে বোঝা যায় মুস্তফা কোথায় যেতে চেয়েছিল!এখানে মুস্তফা কাঠামোতে অস্তিত্ববাদী হয়েও ঈক্ষণে, এষনায় নৈর্ব্যক্তিক, বিবমিষা এবং উইথড্রয়াল নির্ভর!'স্বাক্ষর'' গোষ্ঠীর সবাই কমবেশি অস্তিত্ববাদী হলেও অবলোকনে কামুর তুমুল-আত্মীকৃত-রাজনীতির-ক্যানভাস এরা ধরতে পারে নাই!সজ্ঞ্বার, সংগার ভারসাম্যে এরা প্রাইভেট
এন্টিটি বলতে বুঝেছে নৈর্ব্যাক্তিকতা; ফলে বহিরঙ্গের এই এন্টিটি প্রসাধন পার হয়ে আত্মীকৃত-রাজনীতি হতে পারে নাই!আর যাদের ক্ষেত্রে প্রসাধন রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তা হয়েছে কেবল পিছুটানের চলক হিশাবে!মান্নান সৈয়দের দৈববাদি হওয়াটা এক অর্থে মুস্তফার উইথড্রয়ালের আরেক পিঠ! প্রসাধন এবং আত্মীকৃত-রাজনীতির এই ফাকটুকু ধরতে পারা এবং প্রয়োগে সে ফাকটুকুর মিসিং লিংকগুলোকে
সূত্রবদ্ধ করাটাই আশি পরবর্তী গত কয়েক দশকের 'ভাঙ্গা লিরিকে, ভাঙ্গা বয়ানের' মুল পুজিঃ আত্মীকৃত রাজনীতি যে স্লোগানের ইজম নয়, বরং কবিতা এরকমটা, সেরকমটা হবে তার ভান বা প্রিটেনশানের বাইরে এসে বাককুষলতায় বিশ্বস্ত থাকাঃ নৈমিত্তিকতা নিংড়ে নান্দনিকতার উদ্বোধন!

প্যাশনটাকে মিথনির্ভর অলৌকিক প্রেমের যাজকিয় নির্দেশনা ধরা হলে, সার্ত্রের অস্তিত্ববাদকে বলা যেতে পারে লৌকিকতাকে মানুষের জীবনের কেন্দ্রে নিয়ে আসা!এদিক থেকে সার্ত্রে Anti Christ বা ধর্ম-বিরোধী হয়েও মানুষকে নিজের প্রতি ফেরাতে চাইছে!এই ফেরার পথ সার্ত্রের অস্তিত্ববাদে, জয়েসের মগ্ন চৈতন্য প্রবাহ ইত্যকার অনেক কিছুকে মেশাতে চেয়েছে মুস্তফা আত্মীকৃত মন্ডে!আবার এই মিশেল
গন্তব্যের একটা লক্ষ্যও নির্ধারণ করতে চেয়েছে!লক্ষ্যটা অত্যাবশ্যকিয়ভাবে কবিতা-কেন্দ্রিক!'ক্ষুর' গ্রন্থের শেষ গদ্য 'ব্লাকআউট'; যেখানে শুরুতে লোরকা উদ্ধৃত: ''Who showed you the path of the poets?''

'ব্লাকআউটে' মুস্তফা বলছে, ''পালা- পালা-এ-তার টপকে, - সুদূর ঘাসে;- ওই যে ঘোড়া চড়ে আসছে মলি; ...কৈ পুরানা প্যান্টটা দুমড়াইয়া ক্যেন ছুইরা মারলাম; -ও-ও, এইতো খুনির কাটাহাতের হ্যাঙ্গারে, ও ঝুলছে, ল্যাজ নাড়াচ্ছে, এবার অন্ধ-কুটির তালা মেরে পালা, পিছলে যা তুই ড্রেনে, নোংরায়।''

মুস্তফা, মান্নান, সাবদারের পরিপুরক ত্রিভুজঃ

মান্নান সৈয়দের 'সত্য নামের বদমাশ' পর্ব থেকে 'পাগল গদ্য, পাগল কাব্য' এক অর্থে মুস্তফার 'চর্চিত এনার্কির' একাডেমিক সম্প্রসারণ!আয়াসজাত এ-চর্চা দুজনকেই তরুণ সাহিত্য রশোপ্রার্থিদের কাছাকাছি রেখেছে!মান্নানের ক্ষেত্রে এ-সম্প্রসারণ নিহিতার্থে কোন নতুন মাত্রা আনতে পারে নাই, তার কারণ হচ্ছে মান্নানের অর্থোডক্স যাপনের কাছে এনার্কি, অস্তিবাদী একটি
বুদ্ধিবৃত্তিক-এক্সটিক-আফিম!জীবনানন্দ যাকে বলেছে, 'নিজের মুদ্রাদোষে হতেছি আলাদা'...সেভাবেও মান্নানের কোন মাত্রাগত মুদ্রাদোষ নাই!মুস্তফা এখানে আন-অর্থোডক্স; কিন্তু সন্ন্যাসী নন!বাইরে গৃহী হয়ে ভেতরে যে সন্ন্যাসী হওয়া যায় না ; সে-দ্বন্দ্বে নিজের গহিনে ফেরা এবং সে-ফেরাকে বাইরে ছড়িয়ে দেয়া যায় না তা মুস্তফা জানেন !এনার্কি বা নৈরাজ্যের চর্চাতে থেকেও; কবিতানাটকে genreগত
পর্বান্তর ঘটিয়েও মুস্তফা স্বভাবত মিনিমালিস্ট!অপর 'স্বাক্ষর' সহলেখকদের মত নগরমুখি এবং নাগরিকতায় নিবেদিত থাকার সুফল হিশাবে মুস্তফা মিনিমালিস্ট হবার পরেও যুক্ত থেকেছে সাধ্যানুযায়ী, কখনো মানসিক উত্তরণের চড়া মূল্যে, যার মুল চলক গুটিয়ে-নেয়া-প্রত্যাহার!

স্বভাবে এরকম হয়ে আয়াসে বহির্মুখী হলে ব্যাক্তি একটা টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়, একঘেয়েমিতে ভুগে! যারা নিজেদের 'তরুণ' দাবি করে এধরনের লোকদের কাছাকাছি হয়, সে-তরুণেরাও প্রবণতায় একই লক্ষণে ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে গেলে এধরনের লোকদের বের হবার পথও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে! সরকারি গণমাধ্যমের কর্মকর্তা, ধোপদুরস্ত শার্ট, প্যান্ট, জুতা পরা মুস্তফার সাথে চটের ছালার আলখাল্লা আর খড়ম পরা
বাউণ্ডুলে সাবদার সিদ্দিকীর বহিরঙ্গে পার্থক্য থাকলেও অন্তরঙ্গে তুমুল সাযুজ্য!অবস্য দুজনেই খুব ছোটখাটো ছিলেন!সাবদার ছিলেন অতিছোট, একহারা, দড়িতে পাকানো, রোদে তাতানো! আর মুস্তাফাও ছিলেন অতিছোট, তবে ফুলাফাপা-হোতকা ধরনের!'অতিছোট' বললাম আমার ছয় ফুটি বপুর তুলনায়!

নিজেদের ভেঙ্গে বেরিয়ে আসলেও সাবদার, মুস্তফা হুল্লোড়বাজ নয়, বরং ভিতরগুজা স্বভাবের আত্মবিলোপী; এদের মুল সাযুজ্য নাগরিকের নির্মোহ অবলোকনে; নির্মোহ কিন্তু নিরপেক্ষ নন!সাবদার, মুস্তফা দুজনেই মুক্তিযুধ্বে সক্রিয়!স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠক এবং পরে জাতিয় গণমাধ্যমের কর্মকর্তা হিশেবে মুস্তফা লবি করে নিজেকে অনেক পুরস্কার পাইয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু সেদিকে যান নাই!

মোটের ওপর আবু রুসদ তার রিভিউতে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে মুস্তফার এজরা পাউন্ড হবার যোগ্যতা আছে; অর্থাৎ তার নিজস্ব অনুশীলন জরুরি পরিপার্শ্বের প্রতি মনযোগী হলে তা থেকে পরবর্তী অনেক এলিয়ট লাভবান হবে!কিন্তু 'কৃষ্ণ ব্যর্থতার' দায় কাধে নিয়ে মুস্তাফা দিলেন ওয়াক ওভার; এজরা পাউন্ডিয় অভিভাবকত্বের ভার চলে গেল মান্নান সৈয়দের দিকে!মুস্তফা স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠক ছিলেন, কিন্তু
সে-সংগঠনের ভবিষ্যতবোধক দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিলেন!'কৃষ্ণ ব্যর্থতা' বৈ কি!


কৃষ্ণ ব্যর্থতার বনৌষধিঃ

সাবদারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলামঃ ''ষাটের প্রধান কবিদের সবার কবিতাতেই কি বিভিন্ন মাত্রায়...আত্মবিলোপী, বিস্মরিত বিবরণের আভাস মেলে না?...আরেকটু খোলা যাক!আত্মহনন একটা স্বেচ্ছাকৃত ছেদ।কিন্তু বিলোপনের ফলাফলটা আকস্মিকও নয়, হটকারিও নয়।এর গড়ানিটা সম্পন্নতায় যাবার পথেই রবিকরোজ্জ্বল।চড়াদাগে আত্মদহন, আত্মহনন, আত্মবিলোপনকে এক সামাজিক সরলরেখায় যুক্ত করা গেলেও, সুক্ষদাগে ব্যাক্তিত্ববিশেষে এই প্রবনতাগুলোই কখনো রোগ, কখনো বা আয়ুধ!''

সত্তরের দশকে আবু রুশদের 'ক্ষুর' রিভিউর পর নব্বই দশক অব্দি মুস্তফার কাছ থেকে গুনগ্রাহিরা একে, একে পেয়েছে, 'পরবাসে বসবাস'(কাব্যনাটক, ১৯৮০), 'কোন ডাকঘর নেই'(কবিতা, ১৯৮৩), 'তুঁত'(কবিতা, ১৯৮৩), 'ভিন্ন চোখে'(প্রবন্ধ ও অনুবাদ কবিতা, ১৯৮৫), 'নতুন সংসার'(নব্বইয়ের শুরুতে)।কয়েক দশক ধরে মুস্তফার কাজ কম না হলেও নির্গুণ, মান্নান সৈয়দের তুলনায় অত্যল্পই বলা চলে!মুস্তফার সামগ্রিক কাজের ভেতর আবু রুশদের ধরিয়ে দেয়া 'জরুরি পারিপার্শ্বিকতা' এড়ানোর প্রবণতা কিন্তু থেকেই গিয়েছিল!

পঞ্চাশের শামসুর রাহমান 'আসাদের শার্ট' জাতিয় কবিতার হাত ধরে বাংলাদেশের প্রমিতকে হেচকা টানে বের করে এনেছিল তিরিশিয় আবহ থেকে, এটা স্বীকার করেছে আল মাহমুদ!পরবর্তীতে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুকরণে চলে যাবার পরেও মাহমুদ এই স্বীকৃতির দায় কেন নিতে গেল?এর কারণ হচ্ছে মাহমুদ তার আন্তরিকতার জায়গা থেকে জানেন যে তিরিশিয় আবহ থেকে বের হওয়া ছাড়াও শামসুরের আরেক অবদান হচ্ছে, নান্দনিকতার সমস্ত দায় মিটায়ে জরুরি পারিপার্শ্বিকতার অনায়াস ব্যাবহার এবং এ-জায়গাতে কাদরী, মাহমুদ দুজনেই শামসুরের সাথে সম্পর্কিত!অতিপ্রজ মান্নান সৈয়দও তার শুধ্বতাবাদকে, পরাবাস্তবতাকে ব্যাবহার করেছিলো জরুরি পারিপার্শ্বিকতা এড়াতে!আশির এবং পরের দশকগুলোর কাছে  কাছে চ্যালেঞ্জ ছিলো এই জরুরি পারিপার্শ্বিকতার সাথে ব্যাক্তির উচাটনের সহজ যোগাযোগ ঘটানো; পারিপার্শ্বিকতা কখন ব্যাক্তিকে উচ্ছেদ করতে চাইছে তা কোন মাইন্ড-গেম ছাড়া চিহ্নিত করা এবং তা পেরিয়ে যাওয়া!!

মুস্তফার এবং মান্নান সৈয়দের সামগ্রিক অনুশীলনের ঘাটতি ধরতে পারাটা আশির 'ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ান'কে আশি পেরিয়ে সম্পন্নতার দিকে নিয়ে গেছে মিলেনিয়াম ছাড়ায়ে!মুস্তফার ঘাটতি এক্ষেত্রে ভিন্টেজ ওয়াইনের স্বাতন্ত্র্যের, সার্বভৌমের ঘাটতি!তার 'কৃষ্ণ ব্যর্থতা', আমাদের কারো জন্য বনৌষধি!

শেষ নিশ্বাস এবং ক্রমশ:
(১)
ঃ দেখবেন, দেখবেন, মুস্তফা ভাই'র মরণ-দৃশ্যের ভিডিও দেখবেন?'
ঃ মানে, আপনে কি ওখানে ছিলেন না কি?
ঃ আরে না, ঐসব কমা, টমা, বায়ুনল নাকে দিয়ে, মুখে দিয়ে, এইসব কুস্তাকুস্তিতে আমি নাই।ওনার এক ভক্তিন ভিডিও করে জাতি'কে দেখালো, লাইফ সাপোর্ট থামানোর ব্যাপার, এক্সক্লুসিভ, আমিও দেখলাম।টি, ভি'তে দেখানোর আগে ভক্তিন ফোন দিল। ভাবলাম, বাসা ছেড়ে পালাই।জীবনে খবর শুনিনা।খবরের সময় ঠিক ঠিক বসে বসে দেখলাম।আক্ষরিক অর্থেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগের দৃশ্য।দেখবেন, দেখবেন...
ঃ উনি না 'স্বাধীন বাংলা বেতারের' একজন সংগঠক ছিল।জাতিতো নিশ্চিত ভাবগাম্ভীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে সেই মরনদৃশ্যে!
ঃ গুল্লি মারেন, ঐসব সংগঠক, ফংগঠক।উনি তেমন খারাপ ভাবে মরে নাই।দিনে ৬০ হাজার টাকা'র লাইফ সাপোর্ট।গ্র্যচুইটি, ম্যচুইটি সব গেছে ঐ খানে, তার ওপর নিশ্চয় পরিবার'কে ধার, কর্য করতে হয়েছে।রেডিও, টি, ভি'তে বসগিরি করেও উনি ঐসব কিছুই বুঝে নাই।ভিডিওটা খারাপ হয় নাই।দেখবেন..
ঃ সরকারি হাসপাতালে গেলেত এই হাবিজাবি খরচ হ'তোনা।
ঃ পরিবার নেয় নাই।শরম লাগে।ওনারতো এইসবের বালাই ছিলনা।এখনতো সবই প্রাইভেট।দেখলে বলেন...
(২)
কে কিভাবে মরলো এবং তার পর সেই মরণের খবর কোন, কোন শব্দ ব্যবহার করে পরিবেশিত হ'লো তার ওপর নির্ভর করছে, 'দিওয়ানে শামস' লেখা হবে কি হবে না।
(৩)
ঘাড় ঘোরালেই ঘরকন্নার শিওরে, খুব কাছাকাছি ঘোরে সিলভিয়ার সিন্ড্রমঃ নেকাবের তলে জমে পৌরুষের অভিশপ্ত বেলজেবাবঃ গ্রহ-নক্ষত্রের ফের নাকচ করে নিউরোলজিস্ট অলিভার স্যাক্সের প্রাগ্রসরতায় অনেক শিশুই তাদের অবসাদ্গ্রস্থ বাবা, মাকে হননের নেপথ্য থেকে ফিরায় জীবনের পথ্য-চিকিৎসায়।
হে কবিতাসভা, অবসাদের, আত্মঘাতের বস্তাপচা রোমান্টিকতা বাদ দিয়ে যার যা কাজের মূল্যায়ন নগদে, নগদ মিটাও; মৃতকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে জীবিতের মূল্য কমাইও না!
(৪)
ছদ্মনামগুলো আড়াল না মায়াজাল না কি আত্মার ও সামাজিকতার কাফন তা ভাল বলতে পারতো প্রথমে সুমন সরকার নাম নেয়া এবং পরে কবি আবিদ আজাদে রূপান্তরিত 'শিল্পতরু' প্রেসের কর্নধার!শিল্পতরুতে যাতায়াত সূত্রে 'সিদ্ধার্থ' সম্পাদক মুস্তফা আনোয়ারের পরিচয় হয়েছিল সেইসব কবিদের সাথে যারা জাতিস্মর বার বার অজানির জানাজায়, নাজানির দোলনায় !
যা ঘটেছিল তা না ঘটলে কিশোয়ার কি এখনো ইটভাটার জ্বলজ্বলে তাণ্ডবে জেগে থাকতো নির্ঘুম অনলাইন ইথারে, সিলেটের জিন্দাবাজার'কে গমগমিয়ে বাজাতো ফজর ওয়াক্তের আজিম্পুর মোড়ে?
ভয়ার্ত পরিবারের সাথে বিষ্ণু'র সীমান্ত পারাপার, আহমেদ মুজিবের রোমে হার্ট য়্যাটাক কি পিলখানার লাইটপোস্টগুলোতে অভিমানে উমধা মাতাল দুঃস্বপ্নের সাইকাডেলিয়াঃ আজিম্পুরের জামাই'র হোটেলে চা-পাতারঙ্গা-বৈষ্ণবীকে কারা বলেছিল: তোমার ভাঙ্গা আচলে আমরা ভাঙ্গা লিরিক নাচাবো!
(৫)
খুলিতে বেধা মারণ-বোমার স্মরণ-টুকরা নিয়ে যশোরের মুস্তফা আনোয়ার দাড়িয়ে ছিল বুড়িগঙ্গার বেড়ি বাধের উপর!ভাষা ও ভাষাভাষিগন রাজধানিগামি হন কবি ও কবিতার মৃত্যুর আগে কখনো, কখনো!
(৬)
''ক্ষুর' এর প্রস্তুতিকাল পাকিস্তানি আয়ুবি শাষনামল!'ক্ষুর' এর ভ্রুনবিকাশ ১৯৭১!'ক্ষুর' এর আত্মপ্রকাশ বংগবন্ধু হত্যা পরবর্তী জিয়ার শাষনামল!একের পর এক জেনারেলের সাথে দশকওয়ারি কাবার করা মুস্তফা আনোয়ার খাটিয়াতে পৌছানোর আগে যে-বাংলাদেশ সেখানে মহল্লায়, মহল্লায় মাদক নিরাময় কেন্দ্র এবং মসজিদ কমিটির চিল্লা!'আদমের আত্মহনন' গল্পের উপসংহারঃ
''কালি মন্দিরের বেশ্যাপাড়ায় আগুন লেগেছে মাঝরাতে। ...... আত্মহননে যে আমার ভীষণ ভয়।কে আমি?আমি কি কোনদিন জানব?জানার সাহস কি আমার হবে কোনদিনও?''
 
যৌনতাজ্ঞ্বাপক স্বিকারোক্তিঃ

শুধু 'ক্ষুর' নয়, মুস্তফা আনোয়ারের সামগ্রিক চর্চার মূল ভরকেন্দ্র হচ্ছে চরিত্রে যৌনতাজ্ঞ্বাপন এবং যৌন-প্রতিনিধিত্ব!এ-ব্যাপারে মুস্তাফার জরুরি পরিপার্শ্ব কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? মুস্তফার কখনো সমযৌন, উভযৌন চরিত্রকে উপস্থাপন করে নাই, কিন্তু প্রতিযৌন চরিত্রের উপস্থাপনায় সামাজিক অনুষংগ ছাড়িয়ে গেছে মনস্তাত্বিক এবং যৌন অনুষংগ!

দেহগত আবেদনের যে-বিচিত্রমুখিতা মানুষকে স্বতন্ত্র করেছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তা অবহেলিত!পাঠক তার একটা সহজাত আচরনের প্রতিনিধিত্ব বাংলাদেশের সাহিত্যে না পেয়ে নাই-মামার-চেয়ে-কানামামা-ভালো জাতিয় শুন্যতা পুরন করেছে পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্য, বলিউড ,হুমায়ুন আহমেদ!শুন্যতা ভরাটে যারা সফলভাবে সহায়তা করে এসেছে, ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখার জন্য তাদের প্রতি অবস্যাই আমরা ধন্যবাদার্হ! কিন্তু একই সাথে মুস্তফা এবং আমাদের দুর্ভাগ্য যে এ-সাহিত্য উপস্থাপনের জন্য কোন আনন্দবাজার বা দেশ পত্রিকা এখানে তৈরি হয় নাই!যৌন আচরনে বিভিন্ন বিধিনিশেধ আরোপ হলে যে সামজিক, মানষিক অবসাদ, আত্মঘাতি প্রবনতা সমাজের যে কোন স্তরে বিস্ফোরিত হতে পারে তা বোঝা এবং তা চরিত্রের বয়ান হিশেবে আনাটা মুস্তফার জোর!

নাবোকভিয় আতিশয্য বনাম দেশিয় যাদু-বাস্তবতাঃ

মুস্তফার সামগ্রিক সাহিত্য চর্চার ভরকেন্দ্র যে অত্যবশ্যকীয়ভাবে যৌনতাজ্ঞ্বাপক এবং নাবোকভিয় আতিশয্যের সফল প্রয়োগ, এটা কি আবু রুশদের চোখে পড়ে নাই না কি তিনি তা ইচ্ছা করে এড়িয়েছিলেন তা এখন আর বলা যাবে না!'লোলিটা' অবলম্বনে সৈয়দ হকের 'খেলারাম খেলে যা' ইতিমধ্যে বাজারে এলেও হাতের কাছে আরো অনেক কাজ তখন ছিল না!সার্ত, কামুদের অক্ষে মুস্তফার মনন তৈরি হলেও এর অস্থি, মজ্জা, মাংস,রক্ত এসেছে নাবোকভিয় আতিশয্য বা হেডোনিজম থেকে!মেটামরফোসিসের মাকড়শা মন্থন এবং বিদেশী ম্যাজিক রিয়ালিজমের স্বদেশী টোটকা, দুটা থেকেই নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে মুস্তফা!

শহিদুল জহির এবং পরে 'খোয়াবানামার' সুত্রে ইলিয়াসের মত ম্যাজিক রিয়ালিজম চর্চাকারিরা আশেপাশে আওয়াজি অস্তিত্ব বজায় রাখলেও মুস্তফা এসবের দিকে কেন ঝুকে নাই? মার্কেজ থেকে ইসাবেল আলেন্দেদের হাতে ম্যাজিক রিয়ালিজমেরও একটা প্রধান চলক যৌনতাজ্ঞ্বাপন!কিন্তু তার বাংলাদেশিয়-করনে যৌনতাজ্ঞ্বাপনকে এড়ানোর ফলে চরিত্র এবং বয়ানে যে ডাইমেনশানগত ঘাটতি জহির, ইলিয়াসেরা তা পুরন করেছে ইতিহাসবোধ এবং শ্রেনী চেতনা দিয়ে!কিন্তু ইতিহাসবোধ, শ্রেনী চেতনা দিয়ে প্রমান্যতা বা ডকুফিকশানের আবহ তৈরি হলেও ফিকশানের বহুমাত্রিকতা তৈরি হয়না, ক্যানভাস যতই বড় করা হোক না কেন! দেশীয় ম্যাজীক রিয়ালিজমের লেখকেরা কখনো সখনো চরিত্রায়নে জেন্ডার প্রতিনিধিত্ব এক আধটু করলেও, তা যৌনতাজ্ঞ্বাপক না হওয়াতে ক্যানভাস হয়ে গেছে পোস্টারের মত দ্বিমাত্রিক!

দেশীয় ম্যাজিক রিয়ালিজম চর্চাকারি অনেকে মূলধারার আনুকুল্য পেয়েছে!কেন মূলধারার পত্রিকাগুলো এবং কথিত বামপন্থি মুখপত্রগুলো এদেরকে আনুকুল্য দিলো; কিন্তু আবু রুশদের রিভিউর পরেও মুস্তফাকে আনুকুল্য দিলো না!এর কারন হচ্ছে যাদু-বাস্তবতার মোড়ক ধারনকারীরা সেই রক্ষনশীল স্টেটাস-কো'কে ধারন করেছে যেখানে ব্যাক্তির অন্য যাই থাক তার যৌন আচরন নাই!অযৌন-চরিত্র কিন্তু কাঠামোগতভাবে শ্রেনী প্রতিনিধিত্ব করছে, যতক্ষন এই স্টেটাস-কো বজায় রাখা হবে ততক্ষন সে বয়ান মুলধারার কাছে নিরাপদ; এভাবে মিশ্র জনতার কাছে পপুলার হুমায়ুন আহমেদ; আর বুদ্ধিজিবি পাঠকের কাছে পপুলার হাসান আজিজুল হক, ইলিয়াস বস্তুত্ব একই এককোষি, একমাত্রিক, মধ্যবিত্ত রেখচিত্রের উঠতি দিক এবং যারা ব্যাপক পাঠক পায় নাই প্রকাশনা আনুকুল্য পাবার পরেও তারা পড়তির দিকে হলেও নিজেদের সান্তনা দিয়েছে বিকল্প লেখক হিসেবে!আর চরিত্রদের যৌন প্রতিনিধিত্ব, যৌন চেহারা নিশ্চিত করতে চাইলেই মুস্তফা আনোয়ার হয়েছে অবহেলিত, গাল খেয়েছে ক্ষয়িশ্নু বুর্জোয়া বলে, তাসলিমা নাসরিনের কাধে চেপেছে নির্বাসনের যোয়াল!কেন?কারন এ-যৌন-প্রতিনিধিত্বের ফাক ধরে চিচিং ফাকের মত বৈষম্যের কবলে পড়া অন্যান্য সহজাত ইস্যুগুলোও আমাদের কাছে মুখ ব্যাদান করে মনযোগ দাবি করবে!

'সিধ্বার্থ' বনাম কথিত 'শ্রেনীসংস্কৃতি'ঃ

ইলিয়াসের মৃত্যুর কিছুদিন পর তার বন্ধু হাসান আজিজুল একটা চিঠি প্রকাশ করেছিলেন, যাতে ইলিয়াস বলছেন যে প্রবাসি কবি ওমর শামস তাকে 'খোয়াবনামা' নামে একটি কবিতা সংগ্রহ পড়তে দিয়েছে; তিনি একই নামে একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন!হাসান আজিজুল ওমর সাহেবের কবিতার কিছুটা উঠিয়ে দিয়ে বলছেন, যারা ইলিয়াসের উপন্যাসটা পাঠ করেছে বা করবে তারা বুঝবে যে কবিতাটায় যে রক্ত, মাংস, অস্থি নেই তাই পাওয়া যাবে উপন্যাসটিতে! হাসান এটা পরিস্কার করেন নাই, ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা'তে রক্ত, মাংসের উতস কোথায়!যে-মোড়কেই ইলিয়াস তার কাজ করুক না কেন ঘুরেফিরে নৈর্ব্যাক্তিক ইতিহাসবোধ, শ্রেনীচেতনা তার রক্ত, মাংস, অস্থির উতস; ন্যারেটর তার লেখাতে পরোক্ষ!ফলে যে অস্থি, মজ্জার কথা হাসান বলছেন তা প্লাস্টিকের, তা ক্লোনজাত! শক্তিশা্লী অনেক গদ্যকার শ্রেনীচেতনা, ইতিহাসবোধ ব্যাবহার করেছেযৌনতাজ্ঞ্বাপনের-অভাবজনিত শুন্যতা পূরনে!এরা মনে রাখে নাই যে শুধু কাব্যিক বোধের চর্চাতে যেরকম ব্যাক্তির চেহারা ফোটে না, সেরকম রক্ত, মাংস, অস্থি হলেই একটা চেহারা দাড়ায় না!হাসানের 'নামহীন, গোত্রহীন', ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই' সবই চেহারা-হারানোর বয়ান ইতিহাসবোধ এবং শ্রেনী চেতনার আয়নায়!তাদের কাছে এই আয়নাগুলো বড় হয়ে গেছে, আয়নার সামনে দাঁড়ানো বিষয়ের চেয়ে!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কিন্তু অনেক কিছু করিঃ নিজেকে সাজাই, নিজেকে ভেঙ্গাই, মৈথুন করি, চোখ টিপ মারি কত কি!পরবর্তিতে আমাদের অনেকে পরিচয় সঙ্কটে ভুগেছে, তাও এই আয়নাসর্বস্বতার কারনে!চেহারা খোজের, চেহারা এপ্রিশিয়েশানের তাগিদ থাকলে অন্যা কারো চেহারার আগে নিজের চেহারার বোকাসোকা বা অতি চালাক ব্যাপারটা নিজের কাছে ধরা পড়বে, নিজের যৌনাংগের সাথেও একটা আদুরে বাতসল্য তৈরি হয়ে যাবে!নিজেকে যৌনতাজ্ঞ্বাপক দেহগত আদরের স্বিকৃতি দিয়ে যে স্তন্যপায়ি শিশুর পৃথিবীতে আগমন, তাকে কৈশরে, তারুন্যে এ-ডগমা, সে-ডগমা দিয়ে বামন করতে, করতে একটা মানষিক কৃচ্ছতার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!এই কৃচ্ছতার প্রতি মুস্তফা আনোয়ারের বিতরাগঃ সে খোয়াবে থাকে না, সে বাস্তবের আতিশয্যের ভেতরে থাকে, বিচুর্ন আয়নাতে নিজেকে না দেখে সে নিজেকে টিপেটুপে পরখ করে দেখে! যৌনতাজ্ঞ্বাপন,যৌন-প্রতিনিধিত্ব একাধারে মুস্তফার মসলা, মন্ড এবং মঞ্চ!অখ্যাত মুস্তফার এ-দার্ঢ্যতা পরবর্তি অনেকের কাজে যৌনতাজ্ঞ্বাপক-সঙ্কেত নির্নয়ে আমাকে সহায়তা করছে!এরা নিজেদের অজান্তে শুধু যে মুস্তফা আনোয়ারের আত্মিয় তাই নয়; বিচিত্র যৌনতাজ্ঞ্বাপনে আবহমান ভারতিয় পটভুমির সফল উত্তরাধিকারও বটে!

আজকের পরিসরে মুস্তফাকে আমরা খুব সহজে বাংলাদেশের সাহিত্যে যৌন প্রতিনিধিত্বের হারানো যোগসূত্রগুলোতে ভারসাম্য আনতে ব্যাবহার করতে পারি!মুস্তফা খ্যাতিমান বা প্রতিষ্ঠিত না-হবার-কারনে এই তুলনামুলক ভারসাম্যের বিবেচনায় আমাদের পপুলার-পাঠকপ্রিয় এবং ব্যাপক পাঠকের অগোচরে থাকা কিন্তু প্রতিশ্রুতিশীল সমাকালিন যৌনতাজ্ঞাপক, যৌন-প্রতিনিধিত্বমুলক কাজগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নির্নয়ের দরকার আছে!সেক্সুয়ালিটি, সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশানের রেখচিত্র আকলে দেখা যাবে মুস্তফার কাজের সাথে ওয়ারি বটেশ্বয়ারি যোগসুত্র হিশাবে মধ্যযুগের শাহ সগিরের 'ইউসুফ জুলেখা', জয়দেবের 'গিতগোবিন্দের' সম্পর্ক আছে!

সময় বদলেছে অবিরত!কিন্তু সাহিত্যে যৌনতাজ্ঞ্বাপনের ব্যাপারে মুলধারার প্রকাশক, সম্পাদক তার স্টেটাসকো বদলায় নাই!কখনো হয়তো হাসনাত আব্দুল হাইয়ের 'ক্যামেরার মেয়েটি' এসে একটু ঝাকুনি দিয়েছে, কিন্তু গোষ্ঠিগত-পাঠক-প্রতিক্রিয়ার অজুহাতে তাকে সাত তাড়াতাড়ি প্রত্যাহারও করে নিয়েছে সম্পাদকেরা!মূলধারার আনুকুল্য পেতে ম্যাজিক রিয়ালিজমের বাংলাদেশি চর্চাকারিরা
যৌনতাজ্ঞ্বাপনকে সযত্নে এড়িয়ে দেশী-হলুদ-মরিচ-দেয়া-চাইনিজমত একটা সারাতসারশুন্য ব্যাপার আমাদের উপহার দিয়েছে!কাফকার মেটামরফোসিস, মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিজমের গোড়াতে যে যৌনতাজ্ঞ্বাপন শক্তিশালি ভরকেন্দ্র তৈরি করেছে তা হয় আমাদের চর্চাকারিরা বোঝে নাই বা প্রকাশক আনুকুল্য পেতে সেটা এড়িয়েছে!এর ফলে ম্যাজিক রিয়ালিজমের চর্চাকারিরা আর যাই হোক ব্যাপক পাঠকের কাছে যেতে পারে নাই, যেরকমটা এর ল্যাটিন চর্চাকারিরা গিয়েছে।

ল্যাটিন যাদু-বাস্তবতা-ক্লাশে বাংলাদেশের চর্চাকারিরা পেছনের সারির ছাত্র! মানে মার্কেজ, ইসাবেল আলন্দেদের কাজে যাদু, টোটেম, ভৌতিক, পারলৌকিকের পাশে যৌনতাজ্ঞ্বাপন একটা প্রধান চলক যা পেছনের সিটে বসাদের চোখে পড়ে নাই!এখানে ল্যাটিন কাঠামো নিলেও নিজেদের সামাজিক, ব্যাক্তিক ফোবিয়া এরা প্রতিফলিত করেছে একের পর এক যৌন-প্রতিনিধিত্বহিন এক কোষি চরিত্রে; জন্তু, পোকা মাকড়ের মুখে কথা বসিয়েছে নিছক প্রকরন হিশেবে, কিন্তু এদের জন্তু জান্তব হয় না; এদের চরিত্র বির হয়, বাবা হয়, মা হয়, নায়ক-নায়িকা, খল হয় কিন্তু তার কোন যৌন প্রতিনিধিত্ব নাই!এরা একজন আরেকজন নিয়ে হয়ত এজন্য খোড়াখোড়ি করেনা যে তা করলে শুধুমাত্র একটা প্রকরনের হাড়্গোড় বের হয়ে আসবে, কিছুটা রক্ত মাংস তা থেকে পাওয়া যাবে না, কিন্তু কোন চেহারা পাওয়া যাবে না!

আমার বারবার মনে হয়েছে হাসান আজিজুল, আখতারুজ্জামাম ইলিয়াস তাদের জায়গা থেকে মুস্তফা আনোয়ারকে খোড়াখোড়ি করলে এবং তাতে তাদের ভিন্নমত থাকলেও বাংলাদেশের সাহিত্যের সেক্সুয়াল-কনফেশনাল genreটার আরো কিছু দিক আমরা জানতে পারতাম!হাসান আজিজুল এবং ইলিয়াস কেন পরস্পরকে নিয়ে এত মাতামাতি করেছে তাতেই নিহিত কেন এই যুগল মুস্তফাসহ আরো অনেককে প্রাপ্য স্বিকৃতি দিতে পারে নাই!হাসান এবং ইলিয়াস দুজনেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, দুজনেই 'লেখক শিবিরের' কান্ডারি, সাহিত্যের ব্যপারে দুজনেই আরেক আনুষ্ঠানিক শিক্ষক বদরুদ্দিন ওমরের স্টালিনবাদি বিক্ষাকে দিশারি হিশেবে নিয়েছে!মুস্তফা শিক্ষক নন, 'লেখক শিবির' কি কোন শিবিরভুক্ত কখনো ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন কিন্তু বদরুদ্দিন ওমর কি কারোই কোন বিক্ষাকে দিশারি হিসেবে নেন নাই; স্বম্পাদিত 'সিদ্ধার্থে' নিজের দিশা খুজে পেতে চেয়েছেন!কাভাফির মত নিজের কাজ এবং পছন্দনিয়দের কাজ নিজেই প্রকাশ করেছেন 'সিদ্ধার্থ' থেকে!


যৌনতাজ্ঞাপক স্বিকারোক্তির লোকায়নঃ

যৌনতাজ্ঞাপন করতে ব্যার্থ ব্যাক্তিক সিমাবদ্ধতা বা সামাজিক ট্যাবু যাকেই অজুহাত হিশাবে দেখানো হোক, মঞ্চ নাটকে যৌনতাবোধক কোন দৃশ্য, কোন সংলাপ না থাকা থেকে আমাদের মূলধারাতে এটা নিয়ে চড়াদাগে নাকচমুলক স্টেটাসকোর প্রমান মেলে!যৌনতাজ্ঞ্বাপনে ট্যাবু থেকে মাত্রিকতার যে শুন্যতা চারিত্রের রুপায়নে সেলিম আল দিন তা মিটিয়েছে আদিরসের আড়াল তৈরি করে! প্রমিতেরর চলিষ্ণূ ডাইনামিজমকে ব্যাহত করতে আঞ্চলিকতার যে তোড়জোড় তার পেছনে যৌনভিতি কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখাটা দরকারি!জুলেখা কবিতাগুলোরও আগে আশির মাঝ থেকে আমি বাককুষলতায় নৃশংসতা এবং যৌনতাজ্ঞাপনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম!সেখানেও বার বার মুস্তফা আমার পাঠসঙ্গিঃ ইত্যকার অনুষংগসহ সে-পাঠসংগ মুস্তফা আনোয়ার(মুআ), আবিদ আজাদ(আবিআ), রিফাত চৌধুরী(রিচৌ), এবং আমার(খায়হা) বেলাতে একটা সময় অব্দি
পারস্পরিকভাবে-নৃশংস!এ-পারস্পরিকতার নিয়ে কাজল শাহনেওয়াজ লিখেছিল এ-ভাবে...''মুআনো ল্যাংচাতে, ল্যাংচাতে উঠে গিয়ে ওর রক্তপিপাসু এনটি কাটারের পোচে খায়হার পিঠ ৪ ইঞ্চি ফাক করতে করতে একদিন চেঁচিয়ে বলেছিল...এইবার বোঝো বাপ.../...আবিআ এল.জি দেখিয়ে শাসিয়েছিলঃ মাস্তানি থামাও এবার.../কেন যে খায়হা যখোন রিচৌকে পেটাচ্ছিল আমি কট লাগা জন্তু দুজনকে ছাড়াতে ক্র্যকার ফুটিয়েছিলাম জান বাজী রেখে...('গৃহযুদ্ধের দিনগুলি', ফৃ স্ট্রীট স্কুল, ইশতাহার সঙ্খ্যা, ১৯৯৫)''!


এখানে লক্ষণীয় যে অনুজ গল্পপ্রয়াসিদের ভেতর মুস্তফার সাথে ঘনিষ্ঠ কাজল শাহনেওয়াজ তার  প্রাথমিক বিমূর্ত যাত্রা থেকে অতিস্লথ এবং আচম্বিত মূর্ত পরিক্রমণে মুস্তফার প্রতি/সাথে একটা পরিপূরক-বৈপরীত্য বজায় রেখেছে।মুস্তফা যেখানে যৌনতাজ্ঞ্বাপনে নির্দিষ্ট, কাজল সেখানে অনির্দিষ্ট ; মুস্তফা যেখানে জান্তব, কাজল সেখানে মানসিক!এটা দাঁড়িপাল্লার তুলনা নয়, বরং আত্মিক সাযুজ্যের; যেখানে শহিদুল জহির, ইলিয়াস কারো সাথে মুস্তফার কেন পারস্পরিকতা হয়না তার একটা মন্ত্রগুপ্তি থাকে: এটা উইথড্রয়ালের সাযুজ্য!ভাল গল্পে বহুমাত্রিক কল্পনা দেখলে সেটাকে কোন একটা কথিত যাদুবাস্তবতা, সমাজবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা ইত্যকার না করে আমরা পারিনা!আমরা খেয়াল করিনা যে 'ক্ষুধিত পাষাণের' লেখকের আধ্যাত্মিক 'গীতাঞ্জলী' অনুবাদ করেই স্প্যানিশ তথা ল্যাটিন আধুনিক সাহিত্যের সূত্রপাত!

বাংলাদেশের অবদমিত পটভুমিতে সাহিত্যে যৌনতাজ্ঞ্বাপনের খেলাটাকে রিলে রেসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে!এই রিলে রেসে যারাই দৌড়েছে তাদের বুঝতে হয়েছে যে সুচিত্রা, উত্তম, ববিতার পোস্টার দেখে পাশের বাড়ির ছেলে/মেয়েকে লুকিয়ে চিঠি লেখার পরেও যৌনতাজ্ঞ্বাপনের আরো কিছু কাজ আছে, যার সহায়তায় আমরা জরুরি পরিপার্শ্বের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি! এখানে আমরা নাবোকভ, লরেন্স, জর্জ বাটাই,প্লাথ, আন সেক্সটন, আনাইস নিনের সাথে অন্তরংগ অর্ধনারিশ্বর সম্পর্কে সম্পর্কিতঃ আমাদের ভুমাতে দাঁড়িয়ে!

যৌনতাজ্ঞ্বাপনকে প্রকরনের ওপর অগ্রাধিকার দিলে যে হয় মুস্তফার মত আড়ালে থাকতে হয় নয় তাসলিমা নাসরিনের মত নির্বাসনে যেতে হয় তা জেনেও জেন্ডার প্রতিনিধিত্বের এ-ঘটনাটা ঘটেছে অর্গানিক ভাবে, আমদানিজাত সিন্থেটিক ম্যাজিক রিয়ালিজমের ভনিতায় মরিচ-হলুদ-দেয়া-চাইনিজমত নয় বা আরব্য রজনির অতি ভাজা হরমোন দেয়া কাবাব নয়!আশার কথা যে অযৌন-কায়েমি-স্টেটাস-কোর চাপ থাকা সত্বেও কেউ কেউ তাদের অনুশীলনে যৌন-প্রতিনিধিত্বকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে! আশঙ্কার যে কথিত নারিবাদি শিবিরের লোকজন শিশুদের যৌনশিক্ষার দরকার নাই বলে সাহিত্যের পটভুমিকে জেন্ডার প্রতিনিধিত্বহিন করে দেয়!আশা ও আশঙ্কার এই টানপোড়েনে মুস্তফার 'ক্ষুর' এর প্রেমিস আরো শক্তিশালি হয়ঃ

''গালে, পরপুরুষের চুমুর দাঁতখাবলানো লাল আচড় দেখে ঈশ্বর, ঈশ্বর দাউ-দাউ করে পোড়া-পাতা, কাঠ-কয়লা, টায়ার, রাবিশ; আমি শেকলবাঁধা মাতালপ্রেমিক অগ্নিদাহে লেলিহান প্রেম নিয়ে বিপদ-সাইরেন বাজাই পাইপে, উদার ফুটোয়, সন্ত্রাস ডেকে-ডেকে আমি পিচ্ছিল ক্যনাল থেকে আবার ক্যনাল থেকে মৃত্যুর পিছুপিছু যাচ্ছি; হাই-ভোল্ট, বিজলিভরা কাটাতারের দিকে, - টপকে চলে যাচ্ছি- একদম কমপ্লিট ব্ল্যাকআউট।''('ক্ষুর', ব্ল্যাকআউট)

ক্ষুরধার ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক জমাটি আলোর গলে পড়ার গরম, আঠালো আচ পাই!তাতে নিজেদের স্যাঁক দিতে দিতে , নিজেদের ভাজতে, ভাজতে, নিজেদের আশ, শ্যাওলাসহ খেতে খেতে পরম তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আবারো আমরা শুরু করি এবং বার বার ফিরে আসি যেখানে মুস্তফা আনোয়ার শেষ করেছিল আলটপকা!


চয়ন খায়রুল হাবিব
৩০শে জানুয়ারি ২০১০
ব্রিটানি