Thursday 25 June 2015

উচ্চকিত পতাকাপ্রেম এবং ক্রিকেট উপকথন


একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা ফেসবুকে লিখেছে যে 'তার বিশ্বাস, বেশির ভাগ প্রবাসি দেশপ্রেমিক এবং সংবেদনশিল'!কি কন্টেক্সটে লিখেছে,তা আরো হাজারো স্টেটাসের মত আগা মোটা, গোড়া চিকন অবস্থা!আমার ধারনা ভদ্রমহিলার স্বামি বা বাবা কিম্বা উভয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনির সিপাহি বা অফিসার!আমাদের জানা আছে, ঢাকার হৃতপিন্ড এফোড় ওফোড় করা সেনানিবাসে ঢোকার সময় হরেদরে সকলকে 'দেশপ্রেমের' পরাকাষ্ঠা এবং প্রচণ্ড রকম 'সংবেদনশিল'তা দেখাতে হয়, না হলে কপালে খারাবি!অধুনার জাতে ওঠা বাংগালের ক্রিকেট রসবোধেও দেশপ্রেম একটা বড় ব্যাপার!ইংল্যান্ডের পাড় দক্ষিনপন্থি সাংসদ নরমান টেবিট ১৯৯০সালে এশিয়ান, ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকান অভিবাসিদের লক্ষ্য করে বলেছিল, ওভাল ময়দানে এরা কোন পতাকা ওড়ায় তা থেকে বুঝতে হবে ব্রিটেনের প্রতি এদের  দরদ কতটুকু!ঐ ন্যাক্কারজনক উক্তি থেকে 'টেবিটের পরিক্ষা' বাকধারাটা 'ক্রিকেট পরিক্ষায়' রুপান্তরিত হয়!সেসব পরিক্ষাতে পাস করে যে দ্বিতিয়, তৃতিয় প্রজন্মের অভিবাসি ব্রিটিশদের সাংসদ হতে হয় তা বলাই বাহুল্য!


 কনফেডারেট পতাকা হাতে চার্লেস্টনে  নয়জন কৃশ্নাংগকে হত্যাকারি স্বেতাংগ কিশোর ডিলান রুফ
ক্রিকেট কেন্দ্রিক পতাকাপ্রেমে আমি দেশে, বিদেশে সবখানে ব্যার্থ; কারন খেলাটা আমার ভাল লাগে না।ইংল্যাণ্ডে মিডলসেক্স কাউন্টিতে ইভেন্টস ব্যাবস্থাপনাতে কাজের সুত্রে পাওয়া ওভালের টিকেটগুলা স্টাফদের দিয়ে দিতাম!আমি হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবল,বাস্কেটবল, এথলেটিক্সের পোকা!একেক জনের একেক খেলা ভাল লাগতে পারে, কারো কারো কোন খেলাই ভালো লাগতে না পারে!টেবিটের ক্রিকেট কেন্দ্রিক পতাকাপ্রেম পরিক্ষাটাও যে সাবেক উপনিবেশের নাগরিকেরা টোকাটুকি করে আয়ত্ত করেছে তাও বলা বাহুল্য!এটা কি শুধু খেলাধুলার স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দিতা থেকে আসছে? না কি এর পেছনেও কাজ করছে অনেকধরনের জাতপাত ঘৃনাবোধ, ক্ষমতায়নের বৈশম্য যার গভিরে গেলে আমরা অনেকে স্বস্তিবোধ করবো না!

ধরা যাক গারোদের কথা, গারো আদিবাসিরা বাংলাদেশের ময়মনসিং এলাকা এবং সিমান্তসংলগ্ন ভারতিয় মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড়ে ছড়ানো!এখন চলেশ রিচিলের হত্যাকারি বাংলাদেশি টেবিটসগন এবং গুজরাটে মুসলিম নিধনে হাত পাকানো মোদি ভক্তগন যদি গারোদেরকে ক্রিকেট কেন্দ্র করে পতাকাপ্রেমের পরিক্ষা দিতে বলে তাহলে তা কি ফ্যাশিজম নয়?

২০১২ সালে ফ্রান্সের জাতিয় দাবাতে কিশোর পর্জায়ের চ্যাম্পিয়ান ফাহিম মোহাম্মদের কথাও এখানে স্মর্তব্যা!ফাহিমের বাবা দরিদ্র নুর মোহাম্মদ বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জের বাসিন্দা, সর্বস্ব পন করে  মেধাবি বালক ফাহিমকে নিয়ে অবৈধভাবে ফ্রান্সে এসেছিল ২০০৮সালে!অবৈধ অভিবাসির  অসহনিয় নৈমিত্তিক সংগ্রামের সামনে পতাকাপ্রেমের বৈধতা কির্তনের মত অমানবিক আর কি হতে পারে!ফ্রান্স পরে ফাহিম ও তার বাবাকে বৈধভাবে থাকবার অনুমতি দেয়; বাবা, ছেলের সংগ্রাম ও অর্জন বিভিন্নভাবে মিডিয়াতে তুলে ধরে!তুলনিয়ভাবে বাংলাদেশের মিডিয়া যেরকমভাবে দরিদ্র পটভুমি থেকে আসা ফাহিমের অর্জনকে দেশবাসির সামনে তুলে ধরতে পারে নাই, সেরকমভাবে ঐ একই মিডিয়া কেন বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের ক্রিকেটপ্রেমি সন্তানদের অনেকে দেশে, বিদেশে  ধর্মান্ধ হয়ে উঠছে তার গভিরে যেতেও ব্যার্থ হয়েছে!

গেল  দাবার বোর্ডে বাঙালি জিবনের কম্পমান চৌষট্টি ঘর এবং ক্রিকেট নিয়ে পতাকাপ্রেমের বলিহারি!কিন্তু প্রবাসিদের 'দেশপ্রেম এবং সংবেদনশিলতা' নিয়ে প্রগতি মহাসড়কের দেশিদের এত চিন্তা, দুশ্চিন্তা কেন?

বাংলাদেশের সামগ্রিক আয়ের সিংহভাগ আসে প্রবসিদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং গার্মেন্টস শিল্পের রফতানি থেকে।দুটা খাতের আয় পুরাটা ব্যায় করা হয় প্রতিরক্ষা খাতের ঝকমারি এবং অনুতপাদনশিল মিডিয়ার বাকোয়াজিতে!এই দুই খাতের শ্রমিকদের প্রতি এলিটদের আচরন বোঝা যায়, বিমানবন্দরগুলাতে তাদের হেনস্তায় এবং মিডিয়াতে না-মরলে-না-উল্লখে!প্রবাসিদের সাথে ধাপ্পাবাজি, দাও মারার চেষ্টা ইত্যাদিতো আছেই!আমি অর্থনিতির লোক না, সংস্কৃতির দু, চারটা কথা বলতে চাই!বাংলাদেশের জাতিয় সঙ্গিত রচয়িতা এবং জাতিয় কবি কেউ কিন্তু কথিত দেশি নন!নজরুল বাংলাদেশের অতিথি নাগরিক!বিশ্বের নোবেল জয়ি অনেক সাহিত্যিক তাদের জন্মের দেশে থাকে নাই, এমন কি কোন নির্বাসন দন্ড ছাড়াই!মহাকবিদের মহাগুরু ইটালির দান্তে আলিঘিয়েরি অবস্য নির্বাসন দন্ড কাধে নিয়ে জন্মভুমি ছেড়েছিল!পরে সে দন্ড তুলে নিয়ে নগরপালেরা দেশপ্রেমের ফুলুরি ঝরায় প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানালেও, দান্তে তাতে কর্নপাত করে নাই!টেবিটের ভাবগুরু,কট্টর উপনিবেশবাদি রুডিয়ার্ড কিপ্লিং-এর ইংল্যান্ডপ্রেম চড়াদাগে ফ্যাশিস্ট পর্যায়ের!কিপ্লিং কিন্তু ইংল্যান্ডে থাকাতে গররাজি ছিলো!ঘরের বড় কবি শামসুর রাহমান ১৯৭০এ লিখেছিল 'নিজ বাসভুমে' এবং ১৯৯০এ লিখেছিল সেই একই দেশে বসে 'সে এক পরবাসে'!শামসুরের সতির্থ আরেকজন বড় কবি শহীদ কাদরীও সম্ভবত দেহত্যাগ করবে পরবাসে!

আমার নিজের ঘরে বাবা,মার এক জন্মে তিনবার নাগরিকতা বদল!আদিবাসিদের সাথে, রোহিঙ্গাদের সাথে বাংলাদেশিদের দুর্ব্যাবহারের কথা বিশ্ববিদিত!আর আমার বাবাদের মত যারা সর্বস্ব পিছনে রেখে ১৯৭১এ পুরো পরিবারসহ উদবাস্তু অবস্থায়ও মরনপন নিজেদের সাবেক সৈনিক অভিজ্ঞতায় ট্রেনিং দিয়েছে অপরাপর তরুনদের; পরে যারা ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে বাংলাদেশ-বিমানসহ আরো আরো পতাকাবাহি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে; তাদের অনেকের অবসরকালিন ভাতা মুল্যহিন হয়ে গেছে আকাশ্চুম্বি চুরির হিড়িকে!প্রবাসিরা সিধ কেটে নিশ্চয় বাংলাদেশের সম্পদ চুরি করে নাই!দেশি-প্রবাসি ফারাক করবার ব্যাপারটাকে দেশি বুলিতে বলা যায় ছোটলোকি হিনমন্যতা! পতাকাপ্রেমের মুড়ি, মুড়কি এই আত্মপ্রবোধতুষ্ট-ছোটলোকেরা যে কাকে খাওয়াতে চায় তা তারা জানে, আর জানে তাদের পতাকা মোড়ানো মুর্দা ফরাস অভিভাভকেরা!

দক্ষিন ক্যারোলিনার চার্লেস্টনে  নয়জন কৃশ্নাংগকে হত্যাকারি স্বেতাংগ কিশোর ডিলান রুফ যে-বর্নবাদি-কনফেডারেট-পতাকার পুজারি তা গায়ে চড়িয়ে সে তার দেশের জনপ্রিয় খেলা বেসবল, সকার যাই দেখতে যাক সেটা যে খেলার প্রতিদ্বন্দিতা ছাড়ায়ে আরেকজনকে, আরেক সম্প্রদায়কে বিনাশের শিকড় তা তুলে ধরার মত বুঝদারের অভাব আমাদের চারপাশে!

মগজে লালিত জাতিয়তাবাদি পতাকাপুজা  এবং ১৯৭১ এর মুক্তিসংগ্রামি চেতনা এক জিনিস নয়!যখন বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের মিডিয়া ক্রিকেটের ধুয়া তুলে চার্লেসটনের বর্নবাদি হত্যা নিয়ে কোনরকম বিশ্লেষনে যায়না; তখন বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পশ্চিমবঙ্গে কেন বর্নবাদি বিজেপি বেশুমার দোসর খুজে পায়; কেন নব্বই, শুন্য দশকের বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা কিশোর ধর্মের দোহাই পেড়ে অপরকে হত্যা করতে দ্বিধাগ্রস্থ নয়!

চয়ন খায়রুল হাবিব
২৫/০৬/১৫
ব্রিটানি/ফ্রান্স