Sunday 19 July 2015

শবেবরাতের স্বরলিপি

ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানের সামনে  বসবাসের সূত্রে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যে দেখা  নিত্যদিনের জানাজা পার্টি, আশুরার মহররমের মেলা, শবেবরাতের  অনুষঙ্গগুলো আমার কবিতাসভায় চুড়িপট্টির দেশজ মাস্তিতে জারিত হয়ে পৌঁছেছে বিশ্বায়িত প্রতীকের শান্ত-মত্ততায়!


সম্প্রতি শবেবরাত কেন্দ্রিক কিছু লঘু-রসাত্মক কাপ্লেট ফেসবুকে স্টেটাস হিসেবে দিলে, খুলনা নিবাসী সুহৃদ নুরুল ইসলাম সিদ্দিক, লাবলু ১৯৯১সালে প্রকাশিত আমার 'মৌল রুমাল' গ্রন্থিকার 'পণবন্দী' কবিতার শেষ দুটি ছত্র, 'যে একা সে ভিড়/শবেবরাতের রাতভর পণবন্দী ফকিরদের ফন্দি ফিকির' মন্তব্যের পরিসরে উল্লেখ করলে সময় নির্জিত প্রতীকগুলোর বিবর্তিত রসায়নের দিকে আমি আবারো ফিরে তাকাই!দেখতে পাই, সিকি শতকের সময়যজ্ঞে শবেবরাতি প্রতীকগুলো নোঙ্গর ফেলেছে, পাল খুলেছে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কৃষ্টিতে, বিভিন্ন স্বরক্ষেপে নৈরাজ্যিক-সাইকাডেলিয়াতে, ভবিষ্যৎ-বোধক সামাজিক ঈক্ষণে, শৃঙ্গার-রসের আন্দোলনে, নান্দনিক-নৃশংসতার উদ্ঘাটনে!শবেবরাতের প্রতীকী বাহনে যেরকম ময়নাতদন্ত করেছি মৌলবাদ ও ক্রসফায়ারের মত আত্মঘাতী সামাজিক ভাইরাসের, সেরকম একই প্রতীকের বিস্তৃত মাত্রিকতা যোগ করেছি   রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিবেদনে, স্বকৃত সনেটগুচ্ছের উপসংহারী বয়ানে!আত্মতা চিহ্নিত আরো বিচিত্র সব অনায়াস প্রতীকের পাশে শবেবরাত আরেকটি উপলক্ষ, লক্ষ্য যেখানে বরাবর বিশ্বায়িত বাংলা ভাষার স্বরলিপি-সিক্ত ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ান!

বরাতের চিত্রিত মোচড়ে, যাপনের চার রকমের মোড়ে লেখা চারটি শবেবরাতি-কবিতার নিবেদন পাঠক করকমলেষু!

চয়ন খায়রুল হাবিব
জুলাই/২০১৫
ব্রিটানি/ফ্রান্স

পণবন্দী

ডিজেল মোবিল হাঁটুরে টেম্পো ট্রাফিক টিফিন ক্যারিয়ার
ক্যানভাসার চোখটিপ কোস্টার পকেটমার
দরজা জানালা বন্ধ অন্ধকারে দুজনে দুজনার নয়
সম্পর্কের চ্যাটচেটে তাপ ঢোলমলমে হাতেকলমে ছোঁয়া
কিলবিল কিলিবিল ফার্মগেট গুলিস্তান নবাবপুরের মোড়ে

ঝারিয়াঝঞ্জাইলের চাপাট খুন্তি সোনারগাঁর মুড়ি মুড়কি
লাংগলবন্দের নাগর দোলা জিঞ্জিরার টুকরি কুলা
চিনামাটির রবীন্দ্রনাথ প্লাস্টিকের পদ্ম শালুক
একদম আসলের মত নক্ল রংদার ইসপিরিংয়ের সাপ
দমহরি তুই শংকরী আলীর নাম ভোমকালি
ডাবলে ডাবল

ইস্কায় ফেলান ভাইজ চিড়িয়ায় ঘুরান
খেলোয়ালে পাঁচে দশ দশে বিশ
সুইট সুইট মাত্র পনেরো টাকার টিকিট
সুইট সুইটমিট ডানা কাটা হুরবানু মর্জিনাদের দিলদিকদারি ড্যান্স

ওপরে ওড়া ওজনশূন্য চিলচোখে
নিচের গিজগিজ মাথাগুলো সমুদ্রে ভাসমান নারকেল

আঁতে ঘা আঁতে ঘা
দিনের পসরাগুলো রাতপলিথিনে ঢাকা
চোরাই লাইনের লাইটে
হাত মাপন্তি জায়গার ভাড়া জুয়ার বখরা নিয়ে
পুলিশ ও মাস্তানদের দহরম
মহররম মহররম
গরম গরম সপ্তাভর আজিমপুর রোড জুড়ে মেলা

যে একা সে ভিড়
শবেবরাতের রাতভর পনবন্দী ফকিরদের ফন্দিফিকির

ঢাকা ১৯৯১

মৌল রুমাল গ্রন্থিকায় প্রথম প্রকাশ, , ১৯৯১
জুলেখা সিরাপ এ গ্রন্থবদ্ধ, ২০০৭


রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ সংগ্রহের শেষ সনেট :

।৩০।

এক সময়কার আদর্শ মধ্যবিত্ত পাড়াটিতে
 আশি থেকে পানির সংকট আর বর্শায় জলাবধ্বতা
 জাবেদা খাতায় বিয়োগের খাতে আত্মীয় কুটুম্বিতা
 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমান সেনা
 বাংলাদেশ বিমানের যান-প্রকৌশলের ম্যানেজার
 ভদ্রলোকটি অবসরভাতার সাথে মুদ্রাস্ফীতির
 কুস্তাকুস্তিতে একবার খুললেন প্রেস
একবার মুদি দোকান: বরাত কিন্তু খুললনা
 শেষ শবেবরাতের রাতে আবহাওয়া-বিধ্বস্ত সিথানে
 আঙ্গুলগুলো সোঁদা গন্ধের এক দিন পঞ্জিতে লিখল
"হাজার রজনীতে আমি মাছের সওয়ার।
 শিকারের অধুনা সংস্করণ হছ্যে সাক্ষাৎকার।
 সাক্ষাৎকারের পরমে ব্যক্তির উদ্ধার গৌতমে,
আর সমাজতন্ত্রে উদ্ধার বিড়ম্বিত সামাজিকতার।"

৩০টি সনেট সেপ্টেম্বার ২০০৭-মার্চ ২০০৮
লন্ডন ও ব্রিটানিতে লেখা
রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ সংগ্রহে গ্রন্থবদ্ধ, ২০০৯

 
ইস্কুলের ভিতরেঃ ইস্কুলের বাইরে

ইস্কুলের ভিতরে কিন্তু মাস্টারেরা আর বাচ্চাদের ক্রশফায়ারে মারতে পারবে না
ইস্কুলের বাইরে মাস্টারেরা বাচ্চাদের ক্রশফায়ার মারতে পারবে কি পারবেনা

এই নিয়ে অভিভাবকেরা বেশ একটু সংশয়াচ্ছন্ন
মানে কালো সান গ্লাস পরা চুলে দাড়িতে কলপ মাখা
মাথায় কালো ফেট্টি বাধা বাবদ ইস্কুল মাষ্টারদের
যে আরেকটা খন্ডকালিন দায়িত্ব আছে তা কিভাবে পালিত হবে

ক্রশফায়ারে মারা আর বেত দিয়ে মারা
চড় থাপ্যড় মারা ডাস্টার ছুড়ে মারা
মারা'গুলার মায়ের উপর বেত আর বুলেটের
গুনগত পার্থক্য বুঝাতে ক্রশফায়ারে মারা'র মা'য়ের উপর
লো লো লো চাদবিন্দু বসানো হোক
বেত দিয়ে মারা'তে রা' য়ের উপর লো লো লো চাদবিন্দু চাদবিন্দু

চাদবিন্দু ছাড়া চাদের মায়াবিপনা যোগ হোক
ক্রশফায়ারে মারা মানুষের মায়েদের মেহেদি রাঙ্গানো হাতে
এই শবেবরাতে
আসমানি সানকিতে ছোলাভাজ়া বেগুনি বরা পেয়াজুর রক্তাভায়

তাল
মিস্রি
ভাঙ্গা
সেহেরির সাইরেন

কাউকে কি মারা হবে এই রমজানে রোজার ইদের রাতে
তারপর নথিপত্রে ১৫ কোটি বার না কি ১৬ কোটি লম্বা ঈকার
যাতে ক্রশফায়ারের বুলেট পায় রাইচেং বেতের চেয়ে উচ্চাশন
দুর্গার আজ্ঞ্বার পাশাপাশি আখেরি চাহারেও ক্রশফায়ার ক্রশফায়ার

ইস্কুল মাস্টারেরা এখন লেডি মাস্টারনিদের পাছা উদিলা করে
বেতানোর উসিলায় পাড়াতে বেপাড়াতে ঘাটে অঘাটে ক্রস ড্রেসিংযের ক্লাব
সাবালক সাবালিকারা নাবালক নাবালিকাদের ইস্কুলের পোশাকে
নব বিবাহিতরা সবাই তাদের আগত সন্তানের ইস্কুলের পোষাকে
সমস্ত নাগরিকেরা বাধ্যাতামুলক ইস্কুলের পোষাকে
রাস্তাঘাটকে ইস্কুলের বারান্দা ভাবো আর যেই প্রতিষ্ঠানটাকে
সমস্ত নাগরিকেরা তরাশে এড়ায় তাকেই ভাবো ইষ্টনামের প্রধান ইস্কুল

এপথেই সুরাহা হবেঃ
ইস্কুলের বাইরে মাস্টারেরা বাচ্চাদের ক্রশফায়ার মারতে পারবে কি পারবেনা
ক্রশফায়ারের পাশে মারা শব্দটা আদৌ আর ব্যবহার করা যাবে কি যাবে না

ইস্কুলের ভিতরে কিন্তু মাস্টারেরা আর বাচ্চাদের ক্রশফায়ারে মারতে পারবে না

১২/০৮/২০১০
ব্রিটানি
choyonsdhuturafm.blogspot.com এ প্রকাশিত, ২০১০
ব্লগের ঈ, ঊ, ণ, চাদবিন্দুহিনতা বজায় রেখে কপি/পেস্ট

আমার ওকাম্পোঃ রবীন্দ্রনাথ'কে নিবেদিত কবিতা-সিরিজ থেকে :

(৫)

মনে পড়ে আম্মা প্রতি শবেবরাতে টাকা দিতো
তারাবাতি মোমবাতি কিনতে
চঞ্চল দুই বালক বালিকা দৌড়ে দৌড়ে
বাংলো বাড়ির গোল বারান্দা জুড়ে
জ্বালাচ্ছে শত শত ছোট ছোট আঙ্গুল সাইজ মোমবাতি
ছোট ছোট ভ্রূণ ছোট ছোট হারানো জরায়ু
আম্মা বোলতোঃ শবেবরাতে রবীন্দ্র-পাঠে বাড়ে হায়াত দরাজ আয়ু

শুনতে পেয়েই য্যানো লোকটা খসালো অনন্তকালের অন্তরে
মৌসুমের বাইরে মহাশূন্যের নির্ভার রিতু:
রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরায়ত নিভু-নোভা
লোকটার নাম কখনো 'অবাক' কখনো 'আভা'

হাত বদল হতে হতে কারখানা থেকে পাইকারে বা মুদি ঘরে
কখনো বাসরে কখনো কবরে
ঠোট পোড়ালো সে শিতে ফাটা ঠোটের আস্লেশেঃ
ভালোবেসে নিজের দহন
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ আস্ফালন

খসড়া এপ্রিল-জুন/২০০৯ লন্ডন
চূড়ান্ত সম্পাদনা জুন-জুলাই/২০১৪ ব্রিটানি

ডৌল : জুলেখার জেরাপর্ব, সংগ্রহে গ্রন্থবদ্ধ, ২০১৫