Saturday 31 August 2013

সেলটিক শিমাস হেনে যেভাবে বাংলা কবিতার আকাশে

রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলি, জীবনানন্দ ছাড়া ঈ, ঊ, ণ, চাদবিন্দু ব্যাবহার হয় নাই লেখাতে।চখাহা।

শিমাস হেনের নোবেল ভাষন

সেলটিক গীতাঞ্জলি

নোবেল জয়ি আইরিশ সেলটিক কবি শিমাস হেনে'র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলির শুরুতে কেন 'গীতাঞ্জলি'?এটা কি ধান ভানতে শিবের গিত না কি আদিসুর, আদিছন্দগুলোর আন্তভাষিক যোগাযোগ ও বিবর্তনের অতি দরকারি এক বিশ্বায়িত গাজন?

'গীতাঞ্জলির'  স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলো সে সময় ইতিমধ্যে পশ্চিমি আধুনিক কবি, চিন্তাবিদদের গুরু বলে পরিচিত আইরিশ কবি ইয়েটস!রবীন্দ্রনাথকে কৈশোরে যখন বিলাতে পাঠানো হয় পশ্চিমি কেতাকানুন শিখতে, তখন ও লন্ডনে এক আইরিশ পরিবারের সাথে বসবাস করতো!এই বসবাসের সময় রবীন্দ্রনাথ আইরিশ পরিবারটির মাধ্যমে খ্রিস্টিয় গির্জাসঙ্গিত বা চার্চ মিউজিকের এবং  গির্জাতে বাজানো বিশেষ অর্গান-মিউজিকের সাথে পরিচিত হয়েছিলো, যা পরে ''ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে...'' থেকে প্রচুর গানের সুরে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।


ইউরোপের আয়ারল্যন্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, ফ্রান্সের ব্রিটানি প্রদেশ, ইংল্যান্ডের কর্নওয়াল সেলটিক জাতির অধিষ্ঠান।সেলটিকদের নিজস্ব ভাষা গেইলিক, ওয়েলস প্রদেশ ছাড়া যা প্রায় হারানো একটি ভাষা এখন ইংরেজি, ফরাসির চাপে।সেলটিক অঞ্চল থেকে যে কবি, সাহিত্যিকেরা বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান হওয়া আয়ারল্যন্ডের ইয়েটস, শিমাস হিনি, ওয়েলসের ডিলান টমাস লিখেছে ইংরেজিতে।ভাষা প্রায় লুপ্ত হলেও সেল্টিকদের নাচের ছন্দ, বাজনা বাদ্যির বাশি, ব্যাগপাইপ, ভায়োলিন টিকে আছে স্বদর্পে!রোম থেকে ল্যাটিন গির্জা কর্তৃপক্ষ্যের বিভিন্ন অনুশাষনে ভাষা হারিয়ে ফেললেও সেলটিকেরা তাদের শিরায়, উপশিরায় বাহিত খ্রিস্টধর্মপুর্ব আত্মিকৃত যাপিত ছন্দগুলো ধরে রেখেছিলো এবং এখনো তার অনুশিলিত বিবর্তনের ডাইনামিক্স চলছে!রবীন্দ্রনাথ যে খ্রিস্টিয় গির্জাসঙ্গিতে প্রভাবিত হয়েছিলো, তা মুলত খ্রিস্টধর্মপুর্ব আইরিশ সেলটিক ঢং এর মিউজিক!

ইয়েটসের লেখা পরিচিতিসহ 'গীতাঞ্জলি' ইংরেজিতে প্রকাশিত হলে, স্পেনিশ আধুনিক সাহিত্যের পুরোধা বলে অভিহিত হুয়ান   রেমন জিমেনেথ স্ত্রিসহ মিলে তার স্প্যানিশ অনুবাদ করে এবং তা স্প্যানিশ ভাষাভাষি সুধিমহলে ছড়িয়ে পড়ে!এভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা কিশোর পাবলো নেরুদার হাতে আসে এবং তার প্রথম সংগ্রহ রবীন্দ্র প্রভাবে ভাস্বর!ঘুরেফিরে ক্যাথলিক অনুশাষিত স্প্যানিশ সংস্কৃতি ঘরের কাছের খ্রিস্টপুর্ব সেলটিক প্রভাবটার সাথে লেনদেন শুরু করে একজন ভারতিয়ের মাধ্যমে!ইয়েটস নিজেও বোধ করি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলো 'গীতাঞ্জলি'তে সেলটিক মুর্ছনার অন্তস্রোতে!পরে ইয়েটস এবং তার শিষ্য এজরা পাউন্ড ফ্যাসিজমের দিকে  প্রবলভাবে ঝুকে পড়লে রবীন্দ্রনাথসহ অনেক বরেন্য সাহিত্যিক তাদের প্রতি মনযোগ হারিয়ে ফেলে।

প্রতিরোধ এবং প্রাগ্রসর প্রত্যাবর্তন

শিরোনামে শিমাস হেনে দিয়ে অপরাপর সেল্টিক, স্প্যানিশ এবং ভারতিয় শিবদের গাজন  তৈরি হলো!অতিব প্রয়োজনিয় এক বিশ্বায়িত গাজন!নোবেল জয়ি শিমাশ হেনে'র মৃত্যুর অব্যবহতি পর আশা করা যায় যে তাকে নিয়ে এখানে সেখানে বাংলা ভাষাতে কিছু লেখা হয়ে থাকবে।কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার  ডাইনামিক্সে কখনো সরাসরি, কখনো ঘুরপথে সেলটিক প্রভাব কতটুকু গভির তা কিন্তু আমরা খ্রিস্টিয় অক্সফোর্ডের যাযিকা কেতকি কুশারিদের থেকে জানতে পারছিনা!মাইকেলের পর যেরকম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের নিজস্ব ঢং এর ভেতরে আবহমান বাংলার আদিসুরগূলো বজায় আছে!সেল্টিক অঞ্চলের ইয়েটস, ডিলান টমাস, শিমাস হেনে, পল মালদুনদের হাত ধরে সেরকম খ্রিস্টপুর্ব আদিসুরগুলো বজায় আছে!ইংরেজের শেকসপিয়ার, ল্যাটিন ইটালির মাইকেল এঞ্জেলো, পেত্রার্কার পরম্পরা থেকে শিমাস হেনে, পল মালদুনেরা কোথায় সার্বভৌম এবং প্রবলভাবে সমান্তরাল তাই আমি লিখেছিলাম , ''ভাঙ্গা লিরিকের শিথিল সনেটে'', যা প্রকাশিত হয়েছিলো আর্টস.বিডি...তে!

মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদারের সনেট কাব্যকৃতি ভেঙ্গেচুরে বুঝতে গিয়ে রাশিয়ার পুশকিন, আয়ারল্যান্ডের শিমাস হেনে, মালদুন নিয়ে সরাসরি লিখেছিলামঃ

''সেখান থেকেই আমার নতুন লোকনকাচে, নতুন পাঠে সিমাস হেনে, পল মালদুনদের অনিয়মিত মাত্রার সনেটের পাশাপাশি ভাঙ্গা লিরিকের মোজাইকে সাইয়িদ আতিকুল্লার পরপরই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে ওমর আলি ও সাবদার সিদ্দিকী। ৪/৪/৪/২ তে ঢুকে যায় ৮/৪/২; নিয়মিত দাদরাতে পা ঠুকে, ঠুকে ঠুমরী বাজাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় রুবিক্স কিউব: হাজার, হাজার কম্বিনেশানঃ রেঙ্গুন নদিতে রক্তাক্ত গেরুয়ায় জড়ানো ভিক্ষুর নিষ্ক্রান্ত শরীর! খেয়াল করুন আমাদের হাতে আসা হাজার বছর আগের একমাত্র অক্সিটান সনেট’টাও ছিল রণাঙ্গনের সংবাদ!''(আর্টস.বিডিকৃত বানান)

মাইকেলের, ''রাগে জ্বলি উঠি''; নজরুলের ''আমি বিদ্রোহি আমি রনক্লান্ত''...এসেছিলো উপনিবেশবাদের চাপানো বিভিন্ন মাত্রার রনাঙ্গন থেকে প্রাগ্রসর প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে!একই ভাবে রনাঙ্গন থেকে প্রত্যাবর্তনের আত্মিক জায়গাগুলো তৈরি হয় রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দে!শিমাস হেনের যে বিভক্ত আয়ারল্যান্ডে জন্ম তার সৃজনশিলদেরও ক্রমাগত তৈরি করতে হয়েছে প্রতিরোধের পাশাপাশি আত্মিক স্বাশ্রয়ের জায়গা!পল মালদুন এখনো বেচে আছে এবং বিশ্ব সাহিত্যকৃতিতে অত্যন্ত সক্রিয়!নোবেল জয়ি আয়ারল্যান্ডের শিমাস হেনে এবং আফ্রিকার ওলে সোয়িঙ্কাতে আমি নিজে সরাসরি প্রভাবিত!সোয়িঙ্কার কাজ অনুবাদে, নাট্য মঞ্চায়নে ধারন করেছিলাম সেই ১৯৯০তে ঢাকাতে; দেখা হয়েছিলো ২০০৮এ লন্ডনে!শিমাস হেনেকে ধারন করেছি নিজের ক্রম-বিবর্তনে!দেখাতো কখনো হয় নাই!ধারনের ভেতর যে লালন তাইতো সাক্ষাতকার!

চয়ন খায়রুল হাবিব
৩১/০৮/১৩
ব্রিটানি-ফ্রান্স