Wednesday 20 February 2013

রাজীবের প্রমিথিউস প্রত্যয়েইঃ এবারের একুশে


রাজীব হায়দারের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর যখন খবর আসে শাহবাগ থেকে ফেরবার সময় সাংবাদিক সুমন মাহবুবের আক্রান্ত হবার তখন দির্ঘ মেয়াদি অবিচলতার জন্যই স্বল্প মেয়াদে ঠিক করে নিতে হয় চলমান প্রত্যয়ের লক্ষ্যভেদি নিশানা!

১৯৫২'র পর একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে অনেক বার!এবারের ভাষা দিবস আমাদের দাড় করিয়ে দিচ্ছে পরিচয়গত সুষ্পষ্ট মেরুকরনের সামনে!সেই সিমারেখায় ধর্মবিশ্বাস কিছুতেই  প্রজন্ম চত্বরের থার্মোমিটার হতে পারে না!রাজীবের হত্যাকান্ড নির্দিষ্ট করে দিয়েছে  প্রজন্ম চত্বরের পারদাঙ্ক!জিবিত লাকী আক্তারেরা, আসিফ মহিউদ্দিনেরা ধর্মে বিশ্বাস করে কি না এ-প্রশ্নের উকি মাত্রই  প্রজন্ম চত্বরের অর্জনকে অসম্মান করা হয়; আমরাই হয়ে দাড়াই রাজীবের ঘাতক!কিন্তু আমরা তা নই!



bdnew24.com এর গেল রোববারের নিয়মিত জরিপে পাঠকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- ‘'মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশে রাজনীতি করার। সারাদেশে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি ওঠার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আপনি কি একমত?’'

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বাংলা হোমপেজের মাধ্যমে এই জরিপে মতামত দিয়েছে ১৯ হাজার ৭৩২ জন।এর মধ্যে ৯০ শতাংশই বলেছে ‘হ্যাঁ’। অর্থাৎ, তারা মনে করে, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির রাজনিতি করার কোনো অধিকার নেই।একই জরিপের ইংরেজি ভাষ্যে অংশগ্রহনকারিদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ প্রধানমন্ত্রির বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছে।

এই জরিপের পর bdnews24.com কর্মিদের কাছে একের পর এক হুমকি আসতে থাকে যার জের ধরে মঙ্গলবার রাতে ঘরে ফিরবার সময় আক্রান্ত হয় সাংবাদিক সুমন মাহবুব!হোন্ডারোহি সুমনকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় ঘাতক প্রাইভেট কার!সুমন অল্পের জন্য বেচে যায়!এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ছেলে সুমন!সুমনের আক্রান্ত হওয়া, রাজিবের জবাই বলে দেয় যে রাস্ট্রের নিরাপত্তা বেস্টনিতে শাহবাগ আন্দোলনের বিকাশ হয়নি!সর্বস্তরের জনতাই যে এই আন্দোলনের উজ্জিবক তা বুঝেই জামাতের বেছে বেছে আক্রমন!

৭১এর যুধ্বাপরাধিদের সর্বোচ্চ শাস্তির লক্ষ্যে সংগঠিত প্রজন্ম চত্বরের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই জামাতি প্রোপাগান্ডার মুল হাতিয়ার হচ্ছে যে এটা ধর্মবিরোধিদের সমাবেশ!ধর্মকে মাঝখানে আনার লক্ষ্যে এবং সংগঠকদের এর প্রতিক্রিয়াতে আনতে বাধ্য করতে কেউ কেউ তাহরির স্কয়ারের তুলনা দিতে শুরু করে!জাহানারা ইমামের প্রতিককে কেন্দ্রে রেখে এবং জয় বাংলা স্লোগানের সার্বজনিনতা দিয়ে সমবেত আন্দোলনকারিরা ১৯৭১এর মুল্যবোধগুলোকে সফলভাবেই এজাবত আন্দোলনের কেন্দ্রে ধরে রেখেছে!

রাজীব হায়দারের হত্যাকান্ডের ভিতর দিয়ে আন্দোলনবিরোধিরা আবার নাস্তিক/আস্তিক এসব ধুয়া তুলে আন্দোলনের কেন্দ্রে ধর্মকে নিয়ে আসার প্রয়াস চালায়!আনু মুহাম্মদ তার স্টেটাসে এর যথার্থ উত্তর দেয় ''আমাদের মনে রাখতে হবে যে, টুপি পরা দাড়িসহ এদেশের অসংখ্য মানুষ, তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে শরীক আছেন। আধুনিক পোশাকের অপরাধীদের কথাও মনে রাখতে হবে।... সাকা চৌধুরীর দাড়ি টুপি নাই।..অন্যদিকে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে যারা আল্লাহর নাম নিয়েই যুদ্ধ করেছেন।...''...চলমান আন্দোলনের পক্ষ্যে আনুর এই সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে অন্যদের বিভ্রান্ত করতে কথিত কিছু বিপ্লবি বাম যারা আদতে মৌলবাদিদের সমর্থক তারা বদরুদ্দিন ওমরের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধিদের বিরুধ্বে সংসদে আনা নতুন অধ্যদেশের সমালোচনা শুরু করে, জামাতকে নিশিদ্ধ্ব করলে ভয়াবহ কি কি ঘটতে পারে তার ফিরিস্তি দিতে থাকে এরা!প্রজন্ম চত্বরের গান, আবৃতি, মোমবাতি জ্বালানো, বেলুন ওড়ানোকেও এরা নরমপন্থিদের কাজ বলে সমালোচনা করে হুড়ো দিতে থাকে!প্রজন্ম চত্বরের পুরো আয়োজনটাই যে ''ডাইরেক্ট একশান'' এবং উদ্ভাবনাধর্মি অহিংসতাই যে এর নৈতিক শক্তি এটা এই কথিত বিপ্লবিরা বুঝেও  না বোঝবার ভান করতে থাকে!

সংসদে যুধ্বাপরধিদের বিচারিক ট্রাইবুনাল সঙ্ক্রান্ত নয়া সংশোধন এবং তাতে ''সংগঠন'' শব্দটা যোগ করা প্রজন্ম চত্বরের চলমান আন্দোলনের অর্জন এবং জয়ের নির্দেশক বলেই আন্দোলন বিরোধিরা এর সমালোচনা করছে। আবার দেখতে হবে যে ১৯৭১এ-ও বার বার মুক্তিযুদ্ধকে বিভ্রান্ত করতে ধর্মকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি, সরকার এবং তার দোসরেরা ব্যাবহার করতে চেয়েছে; তাতেও মেরুকরনে ব্যার্থ হয়ে পাইকারি গনহত্যা ঘটিয়েছে!কিন্তু তাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুজিব নগর সরকার, 'স্বাধিন বাংলা বেতারের'' প্রচারকেরা খোন্দকার মোশতাকের কাছে প্রমান করতে বসে যায় নাই যে তারা কতটুকু ধার্মিক, কতটুকু বিশ্বাসি, কতটুকু অবিশ্বাসি!১৯৭১এ জাতিকে স্বাধিন করা বা ২০১৩তে জাতিকে আবারো জাগিয়ে তোলার সাথে গনতকারের কাজকে মিলিয়ে দিলে চলবে না।

ষাটের দশকে ডঃ আহমেদ শরিফ, সিরাজুল আলম খানদের 'নিউক্লিয়াস' গঠনের আমল থেকেই ধর্মকে বাংলাদেশ আন্দোলনের কোন বিতর্কেই প্রধান ইস্যু করা হয় নাই, করতে দেয়া হয় নাই!সে পথ ধরেই ১৯৭২ সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' এসেছিল!আশির পুরো দশক জুড়ে জান্তা বিরোধি আন্দোলনেও শাষকদের সমস্ত উতর চাপান, ট্রকে চাপা দিয়ে হত্যাও ধর্মকে কেন্দ্রে আসতে দেয় নাই!জাহানারা ইমামের ডাকা 'গন আদালতে'র বিরুদ্ধে মৌলবাদিদের শত অপপ্রচার স্বত্বেও সমাবেশে গনমানুষের সমর্থন, সমাবেশ বাড়তেই থাকে!নিপিড়ন, নির্জাতন থেকে উদ্ধারে বাঙালি তিতুমিরকে যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, সেই একই শ্রদ্ধার আসন জারি রেখেছে সুর্জসেনের জন্য, প্রিতিলতার জন্য!  

গত আধা শতকে বাঙালি বার বার ধর্মভিত্তিক রাজনিতি এবং ধর্ম ব্যবসা দুটির বিরুদ্ধ্বেই রায় দিয়েছে।!প্রজন্ম চত্বরের অন্যতমো মুখপাত্র ইমরান সরকার বলেছে যথার্থ, ''যখনি ধর্ম ব্যাবসায়ীরা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে, তখনই মানুষের ধর্মানুভুতিকে ব্যাবহার করে...।এ কাজটি ওরা একাত্তরেও করেছে।ধর্মকে ব্যবহার করে এসব শয়তানেরা গনহত্যা, ধর্শন, লুটপাট জায়েজ করতে চেয়েছিল!...ধর্মের নামে কোন অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না...।এই মঞ্চে যাবতীয় যাবতিয় ঘৃনার উচ্চারন যুদ্ধাপরাধি, রাজাকার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে!...ধর্ম যার যার, রাস্ট্র সবার।''

রাজীব হায়দারের জানাজাতে লাখে লাখে অংশ নিয়ে বাঙালি দেখিয়েছে যে তারা কোন অপপ্রচারেই কান দেয় নাই!রাজীবের রেখে যাওয়া আগুন যেরকম তার সুযোগ্য বন্ধুরা ধারন করেছে; সেরকম এই জাতি মেঘলা রাতে তাদের  মশালচিদের আরেকবার খুজে পেয়েছে!

লেখার শেষটুকুতে পৌছানোর ধৈর্জ যারা দেখালেন, তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্কিং-এ ব্লগার রাজীবের সর্বশেষ স্টেটাসটা স্মরন করিয়ে দিতে চাই!ঐ স্টেটাসে রাজীব জামাতি ইসলামির সাথে সংস্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জনের অনুরোধ জানিয়েছিল।ইসলামি ব্যাঙ্ক, দিগন্ত টিভি, ইনকিলাব, আমার দেশ, মানারাত বিদ্যালয়, ফোরাম কোচিং এদের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে সাইনবোর্ড বা শেয়ার হোল্ডার বদলে যাতে এরা  লুকিয়ে পড়তে না পারে, তার লক্ষ্যে একটা মেকানিজমে পৌছানোর ইচ্ছাও রাজীবের স্টেটাসে ছিল!যে তরুনেরা কোন দলের সাথে না জড়িয়ে এরকম ধরনের চলমান গন আন্দোলনের প্রনোদনা তৈরি করতে পারে, সেই তরুনদের ধিশক্তি যে তাদের আর্থিক বুনিয়াদ ধ্বংশেও পারঙ্গম হবে তা জামাত বুঝেছে ঠিকই!এর সাথে আস্তিকতা, নাস্তিকতার কোন সম্পর্ক নেই!

চয়ন খায়রুল হাবিব
২১/০২/১৩
ব্রিটানি/ফ্রান্স

আহমেদ রাজীব হায়দারের যাপন ও স্বপ্নকে নিয়ে একটা ফটো এলবাম এখানেঃ
Face Of A Futuristic Architect
https://www.facebook.com/media/set/?set=a.487236578000521.110057.100001425485811&type=3