Wednesday 4 April 2012

মিনার মাহমুদঃ শব্দ-শ্রমিকের যে-সম্ভ্রম সাম্প্রতিকে আত্মঘাতি



নব্বই দশকের শুরুতে দেশ ত্যাগের পর শুন্য দশকের শেষে যে-বাংলাদেশে মিনার মাহমুদ ফিরেছিলো, ১৮ বছরে তার যে অদলবদল তার কতটুকু নারকিয় এবং কাদের কারনে; কতটুকু স্বর্গিও এবং কাদের জন্য; মিনারের ৩ বার জানাজাতে অংশগ্রহনকারিদের কি তা নিয়ে ভাববার কোন অবকাশ ছিলো?

মুম্বাই'র 'ধারাবি', করাচির 'মশানগর' এর মত ঢাকাতে অনবরত রেল লাইনগুলার ধার ঘেষে বস্তি গজাতে থাকলেও; আজম খান তার গানে সেই বস্তিবাসিদের গাথা বলে গেলেও; ফখরুদ্দিন-মাইনুদ্দিন-রাজউকের বুলডজার নিশ্চিত করেছে যে  ঢাকায বস্তি থাকলেও 'ধারাবি' বা 'মশানগরের' মত মানচিত্রগত কোন নিশানা তার থাকবে না! মুম্বাই, করাচিতে যেমন একজন সারাজিবন কাটায়ে দিতে পারে সাগরধারে না গিয়ে এবং সাগরের অস্তিত্ব না জেনে; সেরকম ঢাকা মহানগরেও দোলনা থেকে খাটিয়া অব্দি একজন কাটায়ে দিতে পারে বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব না জেনেই!

 দেশে-বিদেশে, হাটে-বাজারে, সাইবারে, সংস্কৃতিতে বাংগালির মুল প্রতিযোগিতা কতভাবে অভদ্রতা করা যায়; ভদ্রতাটা ধরা হয় ব্যাতিক্রমি ব্যবহার!মিনার যে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলো সেই ঢাকাতে বৈষম্যের, অনাচারের প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হ'তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে!মিনার নিজেও যে 'বিচিন্তার' জাতক, তারও পত্তনি জান্তাবিরোধি 'মেধাবি প্রতিবাদে'!এই 'মেধাবি প্রতিবাদের' ধারাপাতেই বাংলাদেশের আশির দশকি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে সে-সময়কার তরুন কার্টুনিস্ট শিশির ভট্ট, তরুন নাট্যজন লিয়াকত আলি লাকি প্রমুখেরা!

ষাটের, সত্তরের প্রাগ্রসর সংস্কৃতির ধারক এবং প্রজন্মান্তরে বিকশিত শামসুর রাহমান, কলিম শরাফি, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, ওয়াহিদুল হকেরা 'জাতিয় কবিতা পরিষদে', 'সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে' পাশে পেয়েছে রুদ্র শহিদুল্লাহ, তাসলিমাদের।আশিতে জান্তা বিরোধি আন্দোলনের পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে প্রতিহত করা হয়েছে মৌলবাদি রাজনিতি এবং ngo' মুতসুদ্দি পুজিকে!একই সময় সামরিক ছত্রছায়ায়, বিদেশি দুতাবাসগুলার নির্দেশনায় কোটি, কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে 'গননাট্য সংস্থার' মত ngo!ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশানুরুপ সাড়া না পেয়ে এবং সক্রিয় বাধার মুখে ngo রিক্রুটার ফয়জুল লতিফ, রোকেয়া কবিরদের রিক্রুটিং সেন্টার খুলতে হয়েছিলো রাবি, জাবি আর মফস্বলের কলেজগুলাতে!মুল লক্ষ্য  সংখ্যার মেলা বসায়ে মেধার উচ্ছেদ!

আমরা সংবাদপত্রে  গল্পকার মইনুল আহসান সাবেরের মুখে জানতে পারি যে দেশ ত্যাগের পর 'আঠারো বছরে ১ দিনের জন্যেও মিনার বাংলাদেশে আসে নাই''!বাংলাদেশ কতটুকু  মিনারদের কাছে গিয়েছে তার খবর আমরা জানতে পারি নাই!বাংলাদেশের সাথে একজন 'দেশে ফেরা' মিনারের  সম্পর্কটাতে আদায়ের নিকাশ যতটুকু, বরনের অবকাশ তাতে কতটুকু?কিছুদিন আগে তার মগজে বড়ধরনের অস্ত্রপচার হয়!ধারনা করি তাতে কস্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিড়াট অংশ ব্যায় করতে হয়েছে!'বিচিন্তা' মুনাফা করতে পেরেছিলো কি না; কিম্বা মুনাফা করতে না পারলেও কালো টাকা সাদা করার কারসাজিতে রিনখেলাপি দস্যুদের কারো সহায়তা পেয়েছিল কি না; মতিউর, শেফিক রেহমানদের মত মায়াজালের বিস্তারে এন্তার গল্পকার, কবিদের সহায়তা পেয়েছিল কি না তা আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে না পারলেও আচ করতে পারি যে তেমন সহায়তা পান নাই! 

সেই আঠারো বছরে মিনারের স্বপ্নসৌধ মঞ্চগুলার কতটুকু বিকৃতি ঘটেছে তার হিশাবও আমরা এড়ায়ে গেছি অনুক্ত মিথ্যাচারে!'জাতিয় কবিতা পরিষদ' মঞ্চে সেই আঠারো বছরের ভিতরেই মুল প্রবন্ধ পাঠের নামে  জ়ামাতি-মার্ক্সিস্টেরা শামসুর রাহমানের নামে ভিত্তিহিন বিষোদ্গ্বার করে বাহবা কুড়ায়েছে; এই পরিসরেই তৈরি হয়েছে rabএর মত অগনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান!মধ্যবিত্তকে আর এ-পরিসরে হতোদ্যম বলা যাবে না; বরং সব ngo, প্রথম আলো, বসুন্ধরা, রিয়েল স্টেট, জাতিসংঘ মধ্যবিত্তের কারো কারো হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সব পেয়েছির আলাদিন চেরাগ!সব কিছুই এতটাই গা-সওয়া যে জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা মায়না বাড়ানোর প্রতিবাদ করলে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর সৌহার্দ্য-সলিডারিটি জানানো হয় না; শাহবাগ, পাব্লিক লাইব্রেরি, ছবির হাটে ঘুরঘুর করা পুজরক্তদের সমিতি বই মেলার সামনে বসিয়ে দেয় রক্ত সংগ্রহ কেন্দ্র!

এই আঠারো বছরে ছয় সন্তানের জ্যাষ্ঠ মিনার নিউ ইয়র্কে যে-জিবন সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলো তা জানতে চায় নাই তারেক/ক্যথারিন মাসুদের পাশে ছবি তোলা সংস্কৃতিসেবিগন; শহিদ কাদরি বড় না সামসুর রাহমান বড় বিতন্ডায় নিয়োজিত ডায়াস্পোরাবাসিগন!মিনার মাহমুদও এসব করে নিজেকে জাতে ওঠাতে ব্যাস্ত হন নাই!যেভাবে দেখা গেছে সংবাদপত্রের পাসপোর্ট ছবিতে, সেই গোয়ারের একগুয়েমি নিয়েই মিনার ট্যাক্সি চালিয়েছেন নিউ ইয়র্কে।কে একজন একবার জিজ্ঞ্বেস করেছিল, 'কেমন চলছে?' উত্তরে মিনার বলেছিলো, 'এইতো ঝাকের কই, ঝাকে মিশে যাচ্ছি'!'বিচিত্রার' এই সাবেক সহকর্মির কোন খোজ কি নিয়েছিল  আজকের সামাজিক অধিপতি 'বিচিত্রা'র উত্তরসুরিরা?এই সাবেক সহকর্মিও কি অন্যদের খোজ রেখেছিলো?একটা যোগাযোগ সঙ্কট যে হয়েছিলো বোঝা যায়!তাতে হয়ত মিনারের নিজস্ব জাপন এবং সিধ্বান্ত গ্রহন ছাপ ফেলেছে অন্যদের চেয়ে বেশি!তাসলিমার সাথে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ, 'বিচিন্তা' গুটায়ে দেশ ত্যাগ, আবার ফেরা এক কিং লিয়ারিয় বিড়াটত্বের ইঙ্গিত দেয়!যেই বিড়াট আমরা পাই সুলতানের ক্যানভাসে, জিবনানন্দের কবিতায়!

অনেকে বলবে যে আমরাতো ওনাকে দেশ ছাড়তে বলি নাই, আমরাতো থেকে গিয়েছি এবং বহাল তবিয়তেই আছি!এই বহাল তবিয়তের মুল্যটা কি তা হাড়ে, হাড়েই বুঝেছিলেন সমাজতত্বের ছাত্র এবং 'বিচিন্তা' সম্পাদক!নব্বইতে এরশাদের পতনের পরপর রিনখেলপিরা আক্ষরিক অর্থে বস্তা,বস্তা টাকা নিয়ে মধুর ক্যান্টিন আর বিভিন্ন সম্পাদকের দফতরে ধর্না দিতে থাকে; ডি, জি, এফ, আই/প্রাইভেট ব্যঙ্কগুলাও মাঠে নামায় প্রচুর ব্যাবসায়িকে যার ফসশ্রুতিতে একদিকে সেনাবাহিনির ঢাল হিসাবে গজায় 'প্রথম আলো', আরেক দিকে সি,পি, বি ধরনের দলগুলার কর্মকর্তা বনে যায় প্রাইভেট ব্যঙ্কের বসেরা।এসময় কয়েক প্রজন্মের টাকা হাতিয়ে নেয় অনেক ছাত্রনেতা এবং কথিত সাংবাদিক!সেই খেলাতে যোগ দিতে চান নাই বলেই কি মিনার মাহমুদের দেশ ত্যাগ?বিদেশেও তাকে দিন আনি দিন খাওয়া সংগ্রামেই ব্যাস্ত থাকতে হয়েছিলো!বাংলাদেশে ফেরা কয়েকটা এপার্টমেন্ট বানায়ে গ্রামের এক ঘর লোকজনকে চাকর-বাকর বানায়ে, ডলার/পাউন্ড দিয়ে পাউরুটি কেনা অবসরপ্রাপ্ত পিশাচ মনোবৃত্তির কথাওতো মিনার সম্পর্কে শোনা যায় নাই।

কেন আত্মঘাতি হলেন?দির্ঘস্থায়ি অবসাদগ্রস্থতা বা ক্লিনিকাল ডিপ্রেশান ছিলো কি যার কোন নির্নয় বা চিকিতসা হয় নাই?তাসলিমা চিকিতসক হবার কারনে এবং রুদ্রের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় থাকার কারনে আমরা রুদ্রের বেশ কিছু ক্লিনিকাল অবস্থার কথা জানতে পারি।কিন্তু তাসলিমার সাথে মিনারের গেরস্থালি খুব কম সময়ের!আবার ডিপ্রেশান নিয়ে যত বাংলাদেশি ব্যবসা আছে, ঠিক ততটাই ট্যাবু ডিপ্রেশানকে ঘিরে!
মিনারের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে পুলিশ, ডাক্টার, জাতিয় দৈনিক তথ্য দেবার চেয়েও বেশি করতে চেয়েছে তথাকথিত ভদ্রতা।মৃত্যু হয় স্বাভাবিক, নয় অপঘাত, নয় দুর্ঘটনাজনিত, নয় আত্মহত্যাজনিত!এতে সামাজিক ট্যাবুর দৌরাত্ম বোঝা যায়।

খ্যাতিমান টিভি নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরির ছোট ছেলে কায়েস, গল্পকার হাসান আজিজুলের আপন বোনের ছেলে কুশলের ডিপ্রেশান গড়ায়েছে আত্মহননে।কিন্তু এরা যেমন ক্লিনিকাল অবসাদ্গ্রস্থতা নিয়ে কখনো বলেন নাই; তেমনি ট্যাবু এবং অজ্ঞ্বতার সুজোগ নিয়ে  ওষুধ কোম্পানি আর বিজ্ঞ্বাপনি  সংস্থাগুলা মুনাফা লুটেছে দেদার!আশির দশকে ইস্ট এশিয়াটিক(বর্তমানের এশিয়াটিক) লুডিওমিল নামের ঘুমের বড়ি বাজারজাত করে, ''বিষন্নতা কোন রোগ নয়'' নামের মনোহারি বিজ্ঞ্বাপনে!

মিনার মাহমুদের কবর হয়েছে জাতিয় বুদ্ধিজিবি কবরস্থানে।প্রবাসিদের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের সনদ বুকে ঝুলিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন।বাংলাদেশের লোকে জিজ্ঞেস করেঃ দেশে কবে আসবেন?...কিন্তু দেশ কতটুকু তোমার খোজ নেয়?দেশের ভিতরেই গার্মেন্টস শ্রমিকদেরই বা কতটুকু খোজ নেয়?বস্তি উচ্ছেদের আগে?'বিচিন্তা' শুধু একটা প্রতিবাদ ছিলোনা, একটা প্রবর্তনাও!সেই প্রবর্তনা থেকে বাংলাদেশকে কতটুকু দুরে টেনে আনা হয়েছে?সেই দুরত্বটুকুই মিনার মাহমুদের মৃত্যুর যথার্থ সুরতহাল!এই দুরত্বটুকুতেই জেডাই নাইট এবং ডার্ট ভেইডারদের খতিয়ান!কবরস্থানের সিমানা সেখানে কেবলই কস্মেটিক্স!

চয়ন
০৪/০৩/১২
ব্রিটানি