বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, প্রথমা না কি রকমারি?
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অনুদিত বইগুলোর ভেতর অন্যতম জনপ্রিয় বলতে হবে আনোয়ারা বেগম অনুদিত কৃষণ চন্দরের 'গাদ্দার'। এখন আনোয়ারা বেগম পরিচিতি নিয়ে একটা ঝামেলা আছে, সে সুযোগে তার অনুবাদ এন্তার পাইরেসি হচ্ছে। পাইরেটেড কপি অন্য অনুবাদকের নাম বসিয়ে বিক্রি হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বই বিক্রি কেন্দ্রে, প্রথমা, রকমারি সহ আরো দোকানে অনলাইনে, অফলাইনে। আইন বলে চুরি করা অপরাধ, চোরাই পণ্য বিক্রিও অপরাধ।
আনোয়ারা বেগমের নাম নিয়ে ঝামেলার কথা বলছিলাম। যাদের নাম নিয়ে ঝামেলা নাই, তাদের সাথেও গাদ্দারি হচ্ছে। 'মাসুদ রানার' অপর লেখক/ অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম কোটি টাকা রয়্যালটি তসরুফের অভিযোগে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিলেন। আনোয়ারা, জাহানারা এসব নাম বাঙালি মুসলিম ঘরে ঘরে। 'গাদ্দার' অনুবাদক আনোয়ারা বেগমের নাম একের পর এক সংস্করণের জোরে তার পরিচিতি নিয়ে আর সন্দেহ থাকবার কথা নয়। 'মুক্তধারা' থেকে বইটি ১৯৭৫ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। আনোয়ারা বেগমের ভূমিকা সহ ২০০৮ অবধী আমরা ৮টি সংস্করণ পাচ্ছি।কথিত হাওলাদার প্রকাশনীর কথিত অনুবাদক অমিয় রায়-চৌধুরীর নামে 'গাদ্দার' অনুবাদের পাইরেসি শুরু না হলে, আর পাইরেটেড কপি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, প্রথমা, রকমারি, গ্রন্থ কেন্দ্রের মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে বাংলাদেশে না ছড়ালে আনোয়ারা বেগমের অনুবাদ এদ্দিনে নিদেন পক্ষে আরো ১০টি সংস্করণ বের হতো। হাওলাদার প্রকাশনীসহ উল্লেখিত দোকানগুলো আনোয়ারা বেগমকে কয়েক লক্ষ টাকা রয়্যালটি বঞ্চিত করেছে।
কিছুদিন আগে আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাই, বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা-চেষ্টার অভিযোগে করা মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগমকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এই আনোয়ারা বেগমের বয়স হবে আশির কোঠায় এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। 'গাদ্দার' অনুবাদের ভূমিকা অনুযায়ী অনুবাদক কাজটি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। এই আনোয়ারা বেগম এবং 'গাদ্দারের' অরিজিনাল অনুবাদক একই কি না আমি নিশ্চিত নই।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রয়াত স্ত্রীর নামও আনোয়ার বেগম, এবং ইনিও একজন শিক্ষাবিদ। সম্ভবত ইনি 'গাদ্দারের' অনুবাদক নন। জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর অনুবাদ পাইরেসি করবার আগে হাওলাদার, তরফদারদের কয়েক বার ভাবতে হবে।
হাওলাদারদের কথিত অমিয় রায় চৌধুরীর অনুবাদটি যে পাইরেসি, তাতে আসবার আগে, 'মুক্তধারা' প্রকাশিত 'গাদ্দার' যে একজন আনোয়ারা বেগম অনুবাদ করেছিলেন এবং তার অষ্টম সংস্করণ হয়ে গিয়েছিলো, তা প্রমাণ করা জরুরি। অবশ্য অমিয় রায় চৌধুরী বলে আদৌ কেউ আছে কি না, তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত গৌতম রায় নিজের নামে একটি ব্লগ চালান। এতে উনি ওনার পাঠগুলোর রিভিউ দেন। ১৭ বছর আগে জুন মাসে উনি 'গাদ্দার' অনুবাদ পড়ে নিজের ব্লগে রিভিউ করেছিলেন। রিভিউ শেষে উনি লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম দেন, যাতে অনুবাদক এবং সম্পাদক হিশেবে আমরা আনোয়ারা বেগমের নাম পাচ্ছি।
আমি নিজের নামে ব্লগ করে আসছি অনেক বছর। অন্যান্যদের ব্লগও পড়ি। 'মুক্তমনা', 'সচলায়তন', 'সামহোয়ার ইন' ব্লগ মঞ্চগুলো প্রায়ই ঢু মারতাম। এখানে ওখানে ব্লগে দেখেছি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের 'আলোকিত ইশকুল' প্রকল্পে জড়িতরা 'গাদ্দারের' বাংলা অনুবাদকের নাম অনেক সময় এড়িয়ে যায়, কিন্তু হাওলাদার প্রকাশনীর নামোল্লেখ করে। পরে খোজ নিয়ে জানলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র তার পাঁচ বছর ব্যাপী আলোকিত ইশকুল প্রকল্পের শুরুতে 'গাদ্দার' পড়ায় এবং অংশগ্রহণকারীদের দিয়ে তা নিয়ে আলোচনা করতে বলে। একজনকে বললাম, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বিপণন কেন্দ্রে খোঁজ নিতে, সেখানেও সেই হাওলাদার প্রকাশনীর অমিয় রায় চৌধুরীর অনুবাদ। দেশে গেলে ঢাকার যেখানে যেখানে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠ-কেন্দ্র পাই, কিছুক্ষণ থেমে কি কি আছে দেখি, সেখানেও এই হাওলাদারদের অমিয় রায় চৌধুরীর 'গাদ্দার'।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র হাওলাদারি অমিয় রায় চৌধুরীর গাদ্দারিতে সয়লাব দেখে কিন্তু অবাক হই নাই। সারা বাংলাদেশে এটা চলছে। সবাই বলবে, বই ব্যবসা ভাই লস, সেটা হচ্ছে লেখক, অনুবাদকদের ঠকানোর জন্য। এটা হতেই পারে না যে আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ মুক্তধারা প্রকাশনীর 'গাদ্দার' এবং অনুবাদক আনোয়ারা বেগমের নাম জানেন না। তাহলে তার সংগঠক এবং ক্রয়কারীরা হয় খুব কাঁচা, নয় জ্ঞানপাপী। আলোকিত ইশকুল প্রকল্পে আবু সাইয়িদ সাহেবে সরাসরি জড়িত, অংশগ্রহণকারীদের সাথে সরাসরি জড়িত থাকেন। যেখানে লেখক, অনুবাদকের শ্রমকে যথার্থ মর্যাদা দেয়া হয় না, গুরুত্ব দেয়া হয় না, সেখানে সজ্ঞা কতটুকু আলোকিত হতে পারে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এখানে ব্যতিক্রমী কিছু করছে না, বরং প্রকাশনা এবং লেখক, অনুবাদকদের ঠকানো নিয়ে বাংলাদেশে যে ব্যাপক জোচ্চুরি চলছে, তার গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। রকমারিডটকম একই সাথে আনোয়ারা বেগম, অমিয় রায় 'চৌধুরীর' গাদ্দার বিক্রি করছে। প্রথমা জোরেশোরে বিক্রি করছে কথিত অমিয় রায়ের অনুবাদ।
বাংলাদেশ সরকারি গ্রন্থ কেন্দ্রের ব্যাপক বই ক্রয় কমিটিতে আছেন আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ এবং প্রথমা/প্রথম আলোর কর্মকর্তারা। এরা সবাই যদি আনোয়ারা বেগমের অনুবাদটি এড়িয়ে যান, তাহলে তো বলতে হবে যে তাদের হাতে আরেকটি ভালো অনুবাদ আছে। অমিয় রায় কেন, যে কোনো অরিজিনাল কাজ যে কেউ অনুবাদ করতে পারেন। যদিও গুগলে কয়েকজন অমিয় রায় চৌধুরীকে পাওয়া যায়, তাদের কেউ হাওলাদারদের অমিয় রায় কি না আমার সন্দেহ আছে। হাওলাদারেরা তাদের 'গাদ্দারে' অমিয় রায়ের নামে যে ভূমিকাটা দিচ্ছিলো, তা হুবহু আনোয়ারা বেগমের ভূমিকা। ভেতরে একটু আধটু অদল বদল করা হয়েছে, কিন্তু ভূমিকাতে পাইরেসি বমাল ধরা পড়ে। এখন হয়তো আর ভূমিকা দেয় না।
প্রথম আলোর কর্তা ব্যক্তিরা যে সমকালীন লেখক, অনুবাদকদের পরিচিতি এবং কপিরাইট নিয়ে জোচ্চুরি করেন, তা বুঝেছিলাম তাহমিমা আনামের ইংরেজি বইয়ের ধারাবাহিক বাংলা প্রকাশে অনুবাদকের নাম না দেখে। ঢাকাতে 'টুয়েলভ এংরি ম্যান' নাটকটি অভিনয়ে, সংলাপে খুব নাম করেছিলো। এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প, যাতে উপদেষ্টা ছিলেন আবদুস সেলিম, কিন্তু উনি এটার অনুবাদক ছিলেন না, ছাত্রদের ভেতর যে বা যারা অনুবাদক ছিলেন, মঞ্চায়নের ব্রোশিয়ারে তাদের নাম দেয়া হয় নাই।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আলোকিত ইশকুলের কোর্স সিলেবাসের খোজ নিয়ে দেখলাম, আমাদের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন বয়সীদের সাথে আলোচনা করছে। ব্লগে যারা এ নিয়ে লিখেছে, তাদের লেখা হরেদরে খারাপ না। কিন্তু মনে হয়েছে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সাথে আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদের দূরত্ব যোজন, যোজন। আবার হয়তো সচেতন ভাবে সমকালীন নিরীক্ষা ধর্মিতাকে এড়িয়ে চলেন। কিম্বা কাউকে কাউকে নেন, যেভাবে 'প্রবর্তনা' তাদের 'রাষ্ট্রচিন্তায়', কিম্বা 'বাংলাদেশ লেখক শিবির' তাদের 'সংস্কৃতি' পত্রিকায় সবার জন্য এক সাইজের জুতাকে চেতনার মুকুট মনে করে। এরা সবাই লেখকের রয়্যালটি ফাকি দিচ্ছে।
কে কি দিয়ে তাদের চেতনার মুকুটে জ্ঞানের মনি, মুক্তা বসাবে, আসলটা না পেলে ইমিটেশান বসাবে কি না, যার যার ব্যাপার। বিশ্ব জুড়ে যেরকম খনি শ্রমিকদের বঞ্চিত করে জহরত ব্যবসায়ীরা সম্পদের পাহাড় বানায়, লিখতে দ্বিধা নাই ওপরে উল্লেখিত সবগুলো মঞ্চ ঢালাও ভাবে বাংলাদেশে লেখক, অনুবাদকদের সাথে জোচ্চুরি করে আসছে।
চয়ন খায়রুল হাবিব
৩১/০৫/২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স