Sunday 2 October 2022

শিবনারায়ণ রায় এবং বইপত্রের মিথ্যামিথ্যি বিজ্ঞপ্তি!

শিবনারায়ন রায়


২০২১এর ২০ এ জানুয়ারি চলে গেলো শিবনারায়ণ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী। জন্মেছিলেন ১৯২১এ ব্রিটিশ ভারতের কোলকাতায়। মৃত্যু বরন করেছেন ৮৭ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে ২০০৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। এর ভেতর রাশি রাশি লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন।মানবতাবাদী চিন্তাবিদ  মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বিশ্ব মনিষী বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছিলেন, 
''শিবনারায়ণ রায়ের দৃষ্টিকোণ সারা পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ......আমাদের সময়ের যে কোনো লেখকের তুলনায় তার লেখালেখি অনেক বেশী যুক্তিগ্রাহ্য।'' 'Sibnarayan Ray stands for a point of view which I consider important in every part of the world. ... His writings ably represents a more reasonable point of view than that of most writers of our time."

রাসেলের ইংরেজি মন্তব্যটির যে অনুবাদ পাওয়া যায় ওয়াইকিপিডিয়া বাংলাতে, তাতে বাংলা ভাষার অনুবাদের সামগ্রিক দুরবস্থা বোঝা যায়।ওপরের অনুবাদটি আমার করা।ওয়াইকি বাংলা অনুবাদক শিবনারায়ণ ও মানবেন্দ্রনাথকে গুলিয়ে ফেলেছেন।এ ধরনের অনুবাদকের কাছে যাহা রায়, তাহাই সত্যজিৎ। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে কিছুদিন কোলকাতা সিটি কলেজে পড়িয়েছেন। তার পর ষাট দশকে যোগ দেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্বে অধ্যাপক হিশেবে, সেখানে বিভাগীয় প্রধান হিশেবে অবসর নেন ১৯৮০র শেষ দিক অবধি।অবসরের পর ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ পশ্চিম বঙ্গে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। সারা জীবন বিশ্বের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খন্ডকালীন অধ্যাপনা করেছেন।

শিবনারায়ণ রায় যখন অবসর নিয়েছেন অর্থাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হই। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে বিভিন্ন সেশন জটে আটকে ১৯৯০তেও স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষে আটকে আছি। সে সময় অনুবাদ করি ওলে সোয়িঙ্কার 'স্ট্রং ব্রিড' নাটকটি, 'রক্তবীজ' নামে। একই সালে সদ্য গঠিত নাট্যকলা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ ও ডাকসুর যৌথ প্রযোজনায় নাটকটি নির্দেশনা দেই কমনওয়েলথ লিটারেচার সেমিনারে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে। সে-সময় নাটকটি প্রকাশ করেন প্রয়াত কবি  আবিদ আজাদ ওনার শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে। তার আগে থেকে আবিদ আজাদের 'কবি' ও 'শিল্পতরু' সাহিত্যপত্রসহ ঢাকার অন্যান্য  সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত লেখায় ব্যাবহার করতাম শুধু 'খায়রুল হাবিব'। শিল্পতরু প্রকাশিত 'রক্তবীজেও' লেখক নাম 'খায়রুল হাবিব'। ১৯৯৫ সালে সতীর্থ কাজল শাহনেওয়াজ তার সম্পাদিত 'ফৃ স্ট্রীট স্কুল' সাহিত্য পত্রের প্রথম ইস্তাহার সঙ্খ্যাতে, আমার লেখা গদ্য 'অনামি সৃজনশীলতার মেনিফেস্টো ৯৫' এবং দীর্ঘ কবিতা 'উল্লাশ পীরের মজমা' ছাপাবার সময়ও লেখক নাম 'খায়রুল হাবিব' জারি থাকে। ১৯৯৩ থেকে আমি দেশ ছেড়ে বিলাতে চলে এসেছিলাম, কাজল ভাই ওনার হার্ড ড্রাইভে থাকা আমার লেখাগুলো 'ফৃ স্ট্রীট স্কুল' পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন।  দীর্ঘ ১৭ বছর নিরুদ্দিষ্ট থাকবার পর ২০০৭সালে আবার বাংলা প্রকাশনাতে ফিরে আসি 'চয়ন খায়রুল হাবিব' নামে।     

২০০৪ সালে একই নাটক আমার ভূমিকাসহ পুরোপুরি প্রকাশ হয় শিবনারায়ণ রায় ও শামীম রেজার যৌথ সম্পাদনায়, 'আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহ' দ্বিতীয় খণ্ড সঙ্কলনে, কোলকাতার দেজ পাবলিশিং ও ঢাকার কাগজ প্রকাশনীর সমন্বয়ে। প্রকাশক ছিলেন কাগজ প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশে  তথ্য প্রবাহে যুগান্তকারী মাত্রা সঞ্চালক কাজী শাহেদ আহমেদ। সঙ্কলনটি শিল্পতরু প্রকাশনার অনুবর্তি হয়ে খায়রুল হাবিব নাম ব্যাবহার করে।  বিলেতে আমার হাতে সঙ্কলনটি  পৌছে দেয় 'রক্তবীজের' কেন্দ্রীয় চরিত্র রুপায়নকারী অপু চৌধুরী। শিবনারায়ণ রায়ের বয়স তখন ৮৩। কখনো ওনার সাথে দেখা হয় নি।

১৯৯৯তে প্যাট্রিসিয়াসহ শান্তিনিকেতনে কিছুদিন ছিলাম। দেখা করবার সুযোগ ছিলো, কিন্তু তখন আমি ও ফরাসি তরুণী প্যাটি পরস্পরে বিভোর। বৃন্দাবনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনায় সুর্যদয়ে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে সংস্কৃত মন্ত্র শিখছি, স্কটল্যান্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে তাবু গেড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি ব্যাকপ্যাকার রুকস্যাকে। শিবনারায়ণের নাম অনেকের সাথে আমিও জানতাম, কিন্তু জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেবের যেভাবে তুলনা করেছিলেন, তাতে আমার মনে হয়েছিল, উনি আমার সময়কে হয়ত বুঝতে পারবেন না। দেখা হলে হয়তো শেষ বেলায় ওনাকে না বুঝে, তর্ক করে ব্যথা দিয়ে ফেলতাম। এখন উনি আমার কাছে সেই না দেখা হওয়া কিন্তু খুব কাছের একজন অধ্যাপক। ওনার সম্পাদনায় আমার অনুবাদ জায়গা করে নিয়েছিল, এটা ভেবে আমি কেপে উঠি,  সাহিত্যের অনানুষ্ঠানিক নিষ্ঠায়, নিজের লেখালেখিতে আস্থা বাড়ে।  'আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহে' 'খায়রুল হাবিবকে' পেয়ে, চয়ন খায়রুল হাবিব আবারো বাংলা ভাষার তুনে আরো আরো তীরের ফলা জড়ো করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, বাংলা ভাষার সাথে আবারো শুরু হয়েছিল তার যাযাবর-রোমান্স! 

অবাক লাগে বাংলাদেশে অনুপস্থিত একজন অনুজ লেখককে শিবনারায়ণ শেষ বেলায় খুঁজে নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাশে জায়গা করে দিচ্ছেন, কিন্তু এবম্প্রকার  যোগাযোগের যুগে  বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে-মেলবন্ধন তৈরি করতে পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছে। শিল্প, সাহিত্যের হিতৈশি সাজা ভাওতাবাজিগুলো  শিবনারায়ণের অভিজ্ঞ অথচ চির সবুজ চোখ চিহ্নিত করেছিলো এবং অনানুষ্ঠানিকের সাথে আনুষ্ঠানিকের সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্রতি হয়েছিল আন্তরিক অঙ্গিকারে। তুলনামূলক সাহিত্যের বোঝাবোঝিতে কিভাবে দল, মতের বাইরে এসে একটা মানদন্ডগত অবস্থান তৈরি করা যায়, তার প্যারাডাইম আমরা শিবনারায়ণের সঙ্কলনগুলোতে পেতে পারি।    

'রক্তবীজের' দ্বিতীয় সংস্করণ এখন প্রেসে চলে গিয়েছে ঢাকাতে জাগৃতি প্রকাশনীর তত্বাবধানে। একই প্রকাশনী থেকে একত্রে বের হবে 'ইল পোস্তিনো' সিনেমাতে ব্যাবহার করা পাবলো  নেরুদার কবিতাগুলোর আমার অনুবাদ এবং আমার দ্বিতীয় মৌলিক সনেটগুচ্ছ 'মেহগনি বনে'। 'রক্তবীজের' জাগৃতি সংস্করণে ভূমিকা ৩০ পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। শিল্পতরু সংস্করণে ভূমিকা ছিলো সাকুল্যে আড়াই পৃষ্ঠা। ৩২ বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণের বিস্তারিত ভূমিকা ও প্রুফ রিডিং-এর সময় আমার বার বার মনে হয়েছে যে শিবনারায়ণ ওনার মোটা ডাটির চশমা চোখে স্মিত হেসে আমাকে আশীর্বাদ করছেন। সে-আশীর্বাদের জোরে ৯ বছর ধরে শেষ করেছি 'জুলেখা ট্রিলজি'  এবং ২০১৬ সালে নির্দেশনা দিয়েছি 'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব'। যার অদৃশ্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার পাথেয়, কি ধরনের লেখালেখি করতেন সেই শিবনারায়ণ রায়? 

যারা বাংলাদেশের দার্শনিক আহমদ শরীফকে উল্টেপাল্টে পড়েছেন, তাদের কাছে শিবনারায়ণ রায়কে আপন মনে হবে। আহমদ শরীফের 'বাঙলা, বাঙালী ও বাঙালীত্ব' গ্রন্থটি পড়বার পর শিবনারায়ণ রায়ের ‘স্বদেশ, স্বকাল, স্বজন’ প্রবন্ধটিকে মনে হবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একটি দৃষ্টিকোণ। শিবনারায়ণ বাঙালি শিক্ষিত সমাজে তিনটি প্রবণতাকে চিহ্নিত করেন। প্রথমটি  ধর্মপরায়ণতা, দ্বিতীয়টি স্বজাতিপরায়ণতা তৃতীয়টি মার্কসবাদ। এই তিন ধারাকে তিনি 'স্রোত' হিসেবে আখ্যা দিয়ে মুক্তমনা বলতে একজনকে এই তিন "স্রোতের বিরুদ্ধে' ও মানবতাবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর আহবান জানান।

প্রতিতুলনার জায়গাতে শিবনারায়ণকে রাহুল সাংকৃত্যায়নের যাত্রাসঙ্গীও বলা যেতে পারে, তবে গন্তব্য ভিন্ন। কেদারনাথ পাণ্ডে নামে রাহুলের জন্ম ১৮৯৩, মৃত্যু ১৯৬৩। সর্বগ্রাসী পাঠক শিবনারায়ণ যে 'ভলগা থেকে গঙ্গার' লেখকের কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সনাতন হিন্দু ব্রাক্ষন পরিবারে জন্ম নিয়ে বর্ণাশ্রম ত্যাগ করে মার্ক্সবাদ ঘুরে রাহুল বৌদ্ধ দর্শনকে জীবনের পাথেয় করেছিলেন, কিন্তু মূল অন্বেষা ছিলো সামগ্রিক মানবতার মুক্তি। শিবনারায়ণ জন্মেছিলেন যে নাম নিয়ে সে নাম, পদবী বজায় রেখেছেন আজীবন, কিন্তু তার সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্কারগুলোকে বর্জন করেছিলেন।মার্কসবাদের পথে গিয়েও যে মানব-মুক্তির কথা বলেছেন তাতে নৈর্ব্যাক্তিক নির্বাণের বদলে ব্যাক্তির স্বাতন্ত্র্য ও বোধের বৈচিত্র্য প্রাধান্য পেয়েছে, তত্বের জোয়াল পরিত্যাগে বার বার উৎসাহিত করা হয়েছে।   

জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেবের তুলনা করে শিবানারায়ণ লিখেছিলেন,  

''তাঁর(জীবনানন্দের) রচনা পড়ে আমার মনে হয়েছে যেন তিনি এক নক্ষত্র-বিম্বিত জলাশয়, যেখানে গভীর অন্ধকারের স্তরে স্তরে নানা অনুভব ও ভাবনার ওঠাপড়া আছে, কিন্তু কোনও বহমানতা নেই। অপরপক্ষে বুদ্ধদেব যেন কোনও তুষারাবৃত শৈলশিখর থেকে উৎক্ষিপ্ত একটি নির্ঝর, ধাপে ধাপে বহমান, ক্রমে নদী এবং তার শাখাপ্রশাখায় প্রসারিত হয়ে মহাসমুদ্রের দিকে নিয়ত প্রবাহী। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় বুদ্ধদেবের মতো এত বহুমুখী এবং নিয়ত গতিশীল প্রতিভা আর একটিও দেখতে পাই না।'

সজনীকান্তদের নিরন্তর নেতিবাচক খোঁচাখুঁচির মুখে জীবনানন্দ 'সমারূঢ়' কবিতাটি লিখলেও, শিবনারায়ণের তুলনামূলক আলোচনাকে আমি সেখান থেকে দেখবো না। আমার কাছে মনে হয়েছে টপ ডাউন দৃষ্টিপাতের বদলে শিবনারায়ণ চেয়েছেন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সমান্তরালে চলে একটি জায়গাতে মিলিত হোক এবং সেখান থেকে নতুন ধারা তৈরি হোক। গায়ত্রী চক্রবর্তি স্পিভাক যে কাজটি করেছেন পশ্চিমা সাহিত্যের তুলনামূলক দর্পণ তৈরি করতে, তা বাংলা সাহিত্যের জন্য করেছেন শিবনারায়ণ।মেলবোর্ন থেকে শান্তিনিকেতনে অধ্যক্ষ পদে ফেরার পর নিসন্দেহে পশ্চিম বঙ্গের লিটেল ম্যাগ আন্দোলনের ছোট, বড় মুনশিরা তার কাছে তাদের পত্রপত্রিকা পৌছে দিয়েছে, লেখা চেয়েছে।কিন্তু এসবের মুনশিয়ানাতে তার একটা অনীহা দেখা গেছে, এগুলো নিয়ে কোনো পক্ষপাত করেন নি। 

যেসব সমকালীন ও অনুজেরা এমন কি শিবনারায়ণের সাথে কাজ করেছেন, তারা নিজেদের পক্ষপাতদুষ্টটা এবং ভিতিবোধ থেকে তার তুলনামূলক দর্পণ থেকে যথার্থ প্রতিফলন নিতে পারে নি। জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকে যে পরিমাণে চিঠিপত্র লিখেছে, তরুণ শিবরামের সাথে লেখাগত পারস্পরিকতার সেরকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই। সমর্থন বা স্বীকৃতির জন্য  নয়, বরং ডিস্কোর্সের প্রয়োজনে   রবীন্দ্রনাথের বদলে শিবনারায়ণদের সাথে জীবনানন্দের সংলাপ হলে সময়খন্ডগত দৃষ্টিকোণের আরো নবায়ন আমরা পেতে পারতাম। বাংলাদেশে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী,  সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,  হুমায়ুন আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ যে পারস্পরিক রিভিউ, টিকা টিপ্পনী, উপসম্পাদকীয়, কলামগুলো লিখেছে তা থেকে এই দৃষ্টিকোণের নবায়নের পাশাপাশি তিরিশিও কলাকৈবল্যবাদ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হয়েছে।

 রাহুল, শিবনারায়ণ ও আহমদ শরীফের প্রাগ্রসর দৃষ্টিপাতের সাথে আমার কোনো দ্বিমত না থাকলেও, আশির  দশক থেকে আমরা যারা বাংলাদেশের কবিতায় মেতে উঠেছিলাম এবং এখনো সক্রিয় তারা কবিতায়, গল্পে, নাটকে, উপন্যাসে পঞ্চাশ ও সত্তরের শৈলী পেরিয়ে এসেছি, যে পঞ্চাশের শৈলী বাংলাদেশে হ্যাঁচকা টানে তিরিশিও ভঙ্গিকে পেছনে ফেলে এসেছে। তিরিশের ভঙ্গি নিয়ে আমাদের কোনো নস্টালজিয়া ছিলো না। শিবনারায়ণের মতো একজনের সাথে আরেকজনের প্রতিতুলনা না  করে, আমরা তিরিশ ও পঞ্চাশকে দেখেছি সময়খন্ড হিশেবে। অন্যান্য দশকগুলোর এবং আশিতেও গৌণ সৃজনশীলেরা নস্টালজিয়াতে মেতে,  ক্রল করে বিনয় মজুমদারের শব্দ ধরে ধরে জীবনানন্দে পৌছাতে চেয়েছে আড্ডায় চমকে দিতে। কিন্তু আমাদের অনেকের হয়ে তিরিশিয় প্রবণতার মূল সোপানকে শিব নারায়ণ বলে গেছেন, ''কোনও প্রবহমানতা নেই।'' এই আবদ্ধতাকে বা এরেস্টেড প্রবণতাকে  চিহ্নিত করতে শিবনারায়ণ একটা আগাম কাজ করে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সৃজনশীল ধারায় এই এরেস্টেড প্রবণতা বা আবদ্ধতা দেখা যাবে লোকজ ধারার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ও প্রায় বিকলাঙ্গ আনুগত্যে,  নিজস্ব সৃজনশীলতার দুর্বলতা আড়াল করতে কখনো লাতিন আমেরিকার বাস্তবতাকে, কখনো মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতাকে নিজের বলে ভেবে নিয়ে ভ্রান্তিবিলাসে ভুগতে। শিবনারায়ণ সারা জীবন  ভ্রান্তিবিলাসগুলো চিহ্নিত করে দরকারি পথগুলো প্রশস্ত করেছে।

রাহুল, শিবনারায়ণ, আহমদ শরীফ ত্রিভুজের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য আদর্শায়ন এবং নৈতিকতা। এই আদর্শায়নে নৈর্ব্যাক্তিকতার হেরফের হলেও এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উভলিঙ্গ। ভারতে নারী, পুরুষের মেলামেশার সামাজিক সীমাসরহদ্দগুলো দর্শন, সাহিত্যের পাতা পেরিয়ে সিনেমার পর্দায় আছড়ে পড়েছে। দার্শনিকতার এবং তুলনামূলক সাহিত্যেও আমরা যে চেহারাগুলো পাই তাতে পেলবতা, পেশলতার রকমফের থাকলেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষালি। গায়ত্রী চক্রবর্তি স্পিভাক যেভাবে তার অবস্থান থেকে দেরিদা ও মহাশ্বেতা দেবীকে তুলে ধরেন,  রাহুল, শিবনারায়ণ, আহমদ শরীফ বিচিত্রগামি হয়েও তা পারেন না। এই না পারাটা আমাদের সাহিত্যের লিঙ্গগত ভারসাম্যে প্রভাব ফেলেছে, নারী চরিত্রের উন্মোচন পুরুষ ও নারী লেখক উভয়ের কাছে কঠিন করে তুলেছে। 

এখনো দেখা যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের সংখ্যা অনেক কম। নারীরা প্রেমিকা হলে পুরুষ হিশেবে আমরা তাদের সাথে মিশবার সুযোগ পেয়েছি, কিম্বা দুর্গা, কালির কৌম থেকে আসবার পরেও প্রেমিকা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আমরা নারীদের মানস প্রতিমা বানাতে পারছি না।  বিনয় মজুমদার এতোবার তাদের সমসাময়িক গায়ত্রী স্পিভাককে 'চাকা' বলে তার কবিতায় স্মরণ করেছে, তাতে মনে হতে পারে যে তাদের ভেতর কোনো লেনদেন ছিলো,  অথচ তাদের কোনো পরিচয় ছিলো না। কিশোরী ওকাম্পোকে 'বিজয়া' বানিয়ে রবীন্দ্রনাথের উৎকেন্দ্রিকতা এবং বিনয়ের গায়ত্রী বন্দনার ভেতর গুনগত তেমন পার্থক্য নেই। দীর্ঘদিন পশ্চিমে থাকলেও এবং উদার মানবতাবাদী হলেও লিঙ্গগত আলোচনা শিবনারায়ণে এবং তার সম্প্রসারিত উত্তরসূরিদের মাঝে চোখে পড়বার মত কম। 'জুলেখা ট্রিলজি'র জুলেখাকে বাসরঘরে, ড্রাগ ডেনে, যৌনায়নে, লিঙ্গায়নে অবয়ব দেবার সময় এই আদর্শায়িত সমষ্টিক দর্পণ আমাকে সেরকম সহায়তা করে নি। কাজল শাহনেওয়াজের বিভিন্ন গল্পে যে নারীবাচক 'শে' শব্দটি দেখা গেছে, পর্বান্তরে যা তার প্রথম উপন্যাসের শিরোনাম হয়েছে, সেই 'শে'র ক্ষেত্রেও নৈতিক আদর্শায়ন কোনো প্রভাব ফেলে নি, বরং  লিঙ্গায়িত ব্যাক্তিগত, অজ্ঞাতকে জ্ঞাত পরিসরে উন্মোচন করা হয়েছে।  

রাহুল, শিবনারায়ণ, আহমদ শরিফ  ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্যের কথা বললেও ব্যক্তিগতকে উন্মোচন করেন নি। 'জুলেখা ট্রিলজিতে' জুলেখাকে আগের চারণদের খলনায়িকা, অতিনায়িকার যায়গা থেকে বের করে এনে রাগে, অনুরাগে, ক্রোধে, অস্তিত্বের সংগ্রামে রক্ত, মাংস, হাড়, মজ্জায় অবয়ব দেবার সময়  যেরকম বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়কালীন প্রেমিকা নীলার আকাঙ্ক্ষা ও পরিস্থিতিগত সীমাবদ্ধতা মনে পড়েছে,  যেরকম বৈমানিক বড় ভাইর বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর চারুকলার ছাত্রী যমজ বোন কঙ্কণ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে তার চারপাশে সামাজিক আয়োজনগুলো ক্রমশ সঙ্কুচিত হবার যে অভিজ্ঞতাগুলো আমার বাংলাদেশে হয়েছে, তার তুলনায় ফরাসি তরুণী প্যাট্রিসিয়া লিঙ্গায়িত, বর্নগত সীমান্তগুলো কিভাবে ভাংছে দীর্ঘদিন তা ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ একজন জুলেখাকে আবেগের জায়গাতে  বিশ্বায়িত করেছে।        

শিবনারায়ণ যথার্থ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসিক বলেছেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর 'লাল শালু' নিয়ে তার আলোচনা এবং অন্যান্য বিস্তারে বোঝা যায় বাংলাদেশ ও ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে কি পরিমাণ ব্যথিত হতেন। ওনার  সম্পাদনায় আমার যে 'রক্তবীজ' নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল, তার বর্তমান সংস্করণের প্রকাশক জাগৃতির প্রতিষ্ঠাতা ফয়সল আরেফিন দীপনকে ২০১৫ সালের ৩১শে অক্টোবার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে মৌলবাদী জঙ্গিরা হত্যা করে। একই দিনে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল, তার বন্ধু তারেক রহিম ও রনদিপম বসুকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় মৌলবাদী জঙ্গিরা। শিবনারায়ণ রায় কখনো তার কলমে উৎপীড়ক, আগ্রাসীকে সমর্থন করেন নাই। যে-অস্ট্রেলিয়াতে তিনি দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন, সেখানের স্থানীয়দের কিভাবে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিকরা উচ্ছেদ করেছে তার বিবৃতি দিয়ে গেছেন একের পর এক শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘শেক্সপীয়রের তিন বেগানা’ প্রবন্ধে  বলেছেন,  'টেম্পেস্ট' নাটকের ক্যালিবান চরিত্র হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার ভাড়ারে লুকানো পরাজিতের কঙ্কাল। সহিংসা বা অহিংসার কোনো পথেই যে শিবনারায়ণ চাপানো চিন্তা নিতেন না, তত্বের জোতদারি মানতেন না  তা তার প্রত্যেকটি লেখাতে স্পষ্ট।

একজন শিবনারায়ণকে নিয়ে লেখার শিরোনামে  শেষাংশে যোগ করেছি,  'বইপত্রের মিথ্যামিথ্যি বিজ্ঞপ্তি'! যেভাবে অন্যান্য পেশাজীবীদের সাথে মিশে গিয়ে কথিত লেখক, শিল্পীরা দেশে ও প্রবাসে কপটাচার করছে তাতে মননশীলতার সত্যাসত্য আমাদের কাছে ক্রমশ ধুসরতর হয়ে উঠছে। কিম্বা কপটাচারীরা যেভাবে সৃজনশীলতায় ঢুকে যাচ্ছে তাতে মিথ্যাটাকে স্বপ্ন বলে ভুল হতে পারে। তার পর আছে না পড়তে পড়তে দৃষ্টিপাত ভোতা হয়ে যাওয়া অথচ ওপরচালাকি করে যাপন চালিয়ে যাওয়া। কিম্বা চটুল অর্থে সেসব পরম্পরাবিহীন  ভাম এবং তাদের কথিত তরুণতর মোসাহেবরা যারা সাহিত্যকে ঢেকে দিচ্ছে অসাহিত্যের কচুরিপানায়, যাদের দৌরাত্মে নাটক, কবিতাসহ একের পর এক জন্রে বাংলা ভাষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞপ্তিতো ছোট্ট হবার কথা, চুম্বক অংশ দিয়ে শেষ হবার কথা। বইপত্রেও যেরকম বানিয়ে, বানিয়ে কথা বলা যায়, বিজ্ঞপ্তিতে তা আরো বেশি করা যায়। নিজের কাছে এটুকু পরিষ্কার যে এটা বইপত্র বা আমার বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড বা আমার স্বামী, স্ত্রী দাম্পত্যের পারস্পরিক পিঠ চুলকানি নয়। এক শিবনারায়ণ রায়ের কিছু দিক-নিরূপিত লেখালেখি ও সম্পাদনা ধরে  বইপত্রে প্রকাশিত ততটুকু সত্যে পৌঁছানো, সময়ের ছাকনিতে যা থেকে যাবে, যেটুকু সত্য নিস্পত্তিহীন! শিবনারায়ণের প্রয়াণেও তার স্মিত হাসি মাখা আশীর্বাদ যে-সত্যকে কেবল সামনে এগিয়ে দেয়, যে-সত্য কেবল বিস্তৃত হতে থাকে।


চয়ন খায়রুল হাবিব

৩/১০/২২

ব্রিটানি, ফ্রান্স