Saturday 17 September 2022

গ্রেসফুল অভিনয়, অভিনেতার স্টেটাস :

রাদ আহমদ ও শাহনাজ জাহানের সাথে কথোপকথন!

'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকে
শিশির রহমান, পারভিন পারু, জুনাইদ ইউসুফ

২০১৮ সালের প্রথম মাসে  ‘ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব’ নাটকটি শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে দেখবার পর কবি রাদ আহমদ একটি বিস্তারিত রিভিউ করেন, যা প্রকাশিত হয় ‘ছাড়পত্র’ ওয়েবজাইনে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮। একই শো তে দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন তখনো চারুকলার ছাত্রী শাহনাজ জাহান, যার রিভিয়ু ছাপা হয় ২৭/১/২০১৮ দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায়।

ঢাকাই ঘাট, অঘাটের ঝক্কিমারি পার হয়ে সেগুনবাগিচার শিল্পকলা ভবনের কোরিডোর, লিফটের গোলকধাঁধায় রাদ ও শাহনাজ অবশেষে খুঁজে পেয়েছিলেন নাটকটির নির্ধারিত প্রেক্ষাগৃহটি। শাহনাজ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে, রাদ গিয়েছিলেন একা। হাহ, আমার এই দুই অনুজ বন্ধুপ্রতিমের দ্বিতীয় সাক্ষাতের আগে প্রথম বাই ডিফল্ট সাক্ষাত হলো ‘জুলেখা ট্রিলজির’ ‘ডৌল’ পর্বে! দুজনকে ‘জুলেখা ট্রিলজি’ প্রকল্পের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

কোভিড অতিমারির দীর্ঘ আটকের পর ২০২২এর সেপ্টেম্বার, অর্থাৎ এ-মাসের ২৯শে বৃহস্পতিবার এবং ৩০শে শুক্রবার পারফর্মেন্স আর্টসের সংগঠন ‘পরিসরের’ আয়োজনে  নাটকটি আবার মঞ্চায়িত হবে শিল্পকলার স্টুডিও থিয়েটারে। সে-উপলক্ষে শাহনাজ ও রাদের রিভিউ-সূত্রে কথাচ্ছলে এই ক্ষনে লিখছি, ‘গ্রেসফুল অভিনয় ও অভিনেতার স্টেটাস’। 'গ্রেসফুলনেস' ব্যাপারটা একটু বলে নেই :

রাজহাঁসের সাঁতার, বাঘের নড়াচড়া গ্রেসফুল। রাজহাঁসের গ্রেসফুলনেস চাইকোভস্কি ধরেছে ‘সোয়ান লেকে’। শেকসপিয়ারের লক্ষ্য থাকতো সংলাপে রাজহাঁসের পেলবতা, চিতার ক্ষিপ্রতা, এলবাট্রসের আকাশগামীতা, সবচেয়ে ছোট চরিত্রও ঠিক ইঁদুর হবে না, এমন কি ইঁদুরের চরিত্র হলেও। এখানে ‘টেম্পেস্টের’ কালিবান এবং কৃষন চন্দরের গাধা চরিত্রকে গ্রেসফুলের দৃষ্টান্তে আনা যায়। 

আমাদের পরিচিত শিল্পীদের ভেতর স্মিতা পাতিলকে গ্রেসফুল অভিনেত্রী বলা যায়, সেটা বস্তির দরিদ্র চরিত্র হোক বা ধনির দুলালী হোক। স্মিতার ভাগ্য ভালো, যাদের স্ক্রিপ্টে কাজ করতো তারা টাইপড ভাঁড়ামি চরিত্রে ঢোকাতো না, বা স্মিতা থিয়েটার থেকে আসলেও, দর্শক কি খাবে সেসব মাথায় নিয়ে, একটা চরিত্রের ম্যানার আরেকটা চরিত্র ঢোকাতোনা। বলতে চাচ্ছি, গ্রেসফুল অভিনয়ের সাথে চরিত্রের স্টেটাস নির্ণয় এবং উপস্থিতি আলাদা করা গুরুত্বপূর্ণ। এ-প্রসঙ্গে মোহসিন পরিচালিত ‘বাঁদি থেকে বেগম’ একটা উল্লেখযোগ্য কাজ। সব রানি ম্যানারে এক হবে না, সব বাঁদিও ম্যানারে এক হবে না। ম্যানারের টাইপ বা টাইপড-ম্যানার কি?

ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব
এখানে আমার ঢাকা থেকে ওয়ারী বটেশ্বওয়ারগামী এক বাসযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার অধ্যাপক লিপনের সাথে একটা কথোপকথন মনে পড়ছে। পরে ‘পরিসরের’ প্রতিষ্ঠাতা   জুনাইদের কাছে কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম আমার মঞ্চায়নের ভঙ্গির সাথে উনি একমত নন। আমাকে কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জেরাকারীর কি এরকম হবার কথা নয়, সেরকম হবার কথা নয়, জেরাকারী কেনো চিৎকার দিচ্ছিলো না?

যা বুঝেছিলাম, চরিত্রের টাইপ নিয়ে বা টাইপড-চরিত্র নিয়ে লিপনের যে-স্কুলিং,চরিত্রের স্টেটাস সেখানে গুরুত্বহীন। অর্থাৎ পুথি পাঠকারী এভাবে মাথা দোলাবে, ওভাবে সুর করে পড়বে, পুলিশ এভাবে দাঁড়াবে, বড়লোকের ছেলেমেয়ে এভাবে বলবে, গরিব ওভাবে বলবে এসব। এই টাইপড-ম্যানারকে কেউ কেউ বলে থাকে ‘স্টাইলাইজেশান’, যার একাগ্র অনুশীলন করে থাকে জাপানের কাবুকি ও নো শিল্পীরা, ভারতীয় কত্থক নাচিয়েরা। কাবুকিতে এবং ধ্রুপদ কত্থকে একজন শিল্পী আজীবন একটি ভঙ্গিমাকে সুচারু করতে থাকে। ভারতীয় রাগ সঙ্গীতেও স্টাইলাইজেশানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, যা থেকে বেরিয়ে এসেছিল মাইহার ঘরানাতে আলাউদ্দিন খানের ছাত্রছাত্রীরা। 

কাবুকি, কত্থকের যে স্টাইলাইজেশান সেটা পাওয়া যাবে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদের যে কোনো খেলায়। এক মিনিটের স্প্রিন্ট দৌড়ের জন্য এথলেট তার পেশি, শ্বাসযন্ত্র, নড়নচড়ন, খাদ্যাভ্যাসকে যেভাবে বছরের পর বছর একাগ্রভাবে তৈরি করে, টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে সেট খেলা টেনিস খেলোয়াড়, টেস্ট ক্রিকেটারও সেভাবে প্রস্তুতি নেয়। এগুলো সবই মহাকাব্যিক বা এপিক প্রস্তুতি। এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার কোনো নিদর্শনে, স্টাইলাইজেশানের লক্ষ্যে এই এপিক প্রস্তুতির কোনো লক্ষণ দেখা যাবে না। যা দেখা যাবে, তা হলো ক্রিকেটের ক্ষেত্রে একদিনের বেশি হলেই দম হারিয়ে ফেলা, আর পারফর্মেন্সে অভিনয়কে গুরুত্বহীন বলবার বা দেখাবার প্রবণতা এবং নক্সাগত কারসাজিতে তা ঢাকবার প্রয়াস। ঢাবি নাট্যকলার কোনো মঞ্চায়নে গ্রেসফুল অভিনয় দেখা যায় না, এমন কি  তার প্রয়াসও আমার চোখে পড়ে নি। তারা যখন বাইরেও কাজ করে, টাইপের বাইরে আসতে পারে না। এটা জাহাঙ্গির নগর নাট্যকলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, 'নভেরার' সামিউজ্জামান দোলাকে ব্যাতিক্রম ধরে নিয়ে।  

মহড়া, ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব

রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীতে ইব্রাহিম আল কাজি অভিনয়কে কেন্দ্রে রেখে, তাদের সমকালীন নাট্যচর্চায় কেনো এরই ভেতর হাজার বছর ধরে দাঁড়ানো ভারতীয় কথিত ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গিমাগুলো এড়িয়েছিল, এই জিজ্ঞাসা বাংলাদেশে সেলিম আল দিন প্রভাবিত স্কুলের কাছে মুখ্য নয়। ফ্রাঙ্কো জেফ্রেল্লি, বাজ লুরমান শেকসপিয়ারের টেক্সটের প্রতি সম্পূর্ণভাবে অনুগত থেকেও কেনো উপস্থাপনা বদলে দিচ্ছে সে জিজ্ঞাসাও এদের কাছে মুখ্য নয়। উৎপল দত্ত, বিজয় তেন্ডুলকর, আবদুল্লাহ আল মামুন, আলী যাকের এমনকি দেশি, বিদেশী লোকজ গল্পের বেলায়ও কোথায় তাদের চরিত্রদের স্টেটাস ও গ্রেসকে সমন্বয় করছে তাও এরা বুঝতে পারছে বলে আমার মনে হয় নি। মাপামাপির জন্য প্রকৌশল বিদ্যা আছে, স্থাপত্য আছে। মাপ বা টাইপ ভাঙ্গার জন্য যে একজন পিটার ব্রুককে মঞ্চ খালি এবং নিরাভরণ করতে হয়, যেখানে কুশীলব ও দর্শকের ভেতর একমাত্র যোগসূত্র সংলাপ, তার মূলে যাওয়াটাও এদের লক্ষ্য নয়। 

লিপনকে আমি বলেছিলাম যে ‘জুলেখা ট্রিলজির’ ‘ডৌল’ পর্বে, জেরাকারী স্বয়ং রাষ্ট্র, তার চিৎকারের কি দরকার আছে? যেটা আর লিপনকে বলি নি, সেটা হচ্ছে, কি কারণে জুলেখা চরিত্রটির স্টেস্টাস বেড়ে যাচ্ছে?

জুলেখা শিক্ষক, এই কারণে কি তার স্টেটাস বেড়ে যাচ্ছে? না কি সাহিত্যিক বলে তার স্টেটাস বেড়ে যাচ্ছে? মূলত মঞ্চে তার স্টেটাস বেড়ে যাচ্ছে, রাষ্ট্র তাকে হুমকি মনে করবার ফলে। তার লেখা শিশুদের মনে গভীর রেখাপাত করতে পারে, সেটা রাষ্ট্র ভাবছে বলে। অনেকের লেখাই রেখাপাত করতে পারে, কিন্তু অনেকের লেখাই ব্যাপক পাঠকের কাছে পৌছায় না। এদিক থেকে জুলেখা হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, তসলিমার মিশেল। সে রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়েছে, দমকল বাহিনীর নয়। ‘জুলেখার জেরা পর্ব’ দেখবার পর রাদ আহমদ জুলেখা চরিত্রটির স্টেটাস নিয়ে তার রিভিউটির শুরুতেই লিখেছে, 

''এই জুলেখা অত সরল জুলেখা নয়। একইসাথে সে বাদশা নামক কৃষকের মেয়ে, শিশুতোষ ছড়ার চরিত্র, একজন লেখিকা, আবার আরবে উদ্ভূত একাধিক একেশ্বরবাদী ধর্মকাহিনীর অন্তর্গত সেই সুপরিচিত ইউসুফ-জুলেখার জুলেখাও বটে। আরব কেন্দ্রিক এই ধর্মগুলোকে অনেকে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সাথে মিলিয়ে চিন্তা করে থাকে। সেই হিসাবে জুলেখার চরিত্রটা যে `অপ্রেসড` (নির্বাপিত) হবে, সে বিষয়টা প্রথমেই সামনে চলে আসে।''

জেরাকারী ইউসুফ চরিত্রটির স্টেটাস রাদের কাছে মঞ্চায়নে এভাবে ফুটে উঠেছে, 

''ইউসুফের চরিত্রটা পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিভূ হিসাবে দেখানো হলেও মাঝে মাঝে নিতান্ত মানবিক মনে হয়েছে। একইসাথে ধর্মরক্ষার দায়, মনের সায়, আত্মার সায় খুঁজে ফিরছেন একজন মানুষ। কী করবেন ঠিক যেন বুঝতে পারছেন না। এই দোটানা ভাবও চলে এসেছে চরিত্রে। ফলে শেষ পর্যন্ত বেশ ন্যাচারাল আর মানবিক হয়ে উঠেছে চরিত্রটা।''

বিড়াসবেশি ইউসুফ এবং শায়িত জুলেখা।ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব।

মঞ্চায়নটির ডিজাইনগত নির্দেশনা সম্পন্ন ও প্রিমিয়ার  হয়েছিল ২০১৬ সালে। দীর্ঘ দু' বছর বিরতির পর আবার কিছু মঞ্চায়ন হয় ২০১৮সালে, যার একটি দেখে শাহনাজ লেখে,  

 ‘’এই নাটকের লাইট, মিউজিক প্রশংসার দাবিদার, সেই সঙ্গে অভিনয় শিল্পীদের নান্দনিক অভিনয় নাটকটিকে আরো ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। নাটকের অভিনয় শিল্পী জুনাইদ ইউসুফ ঢাকার মঞ্চের গুনি লাইট ডিজাইনার, অন্যদিকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতি রয়েছে শিশির রহমানের। এই নাটকেও তারা অভিনয়ের পাশাপাশি লাইট ও সঙ্গীতে মুগ্ধ করেছে। পারভিন পারু এর আগে প্রাচ্যনাটের 'ট্রাজেডি পলাশবাড়ীতে' অভিনয়ের মাধ্যমে ঢাকার মঞ্চে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। 'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকেও তার অভিনয়ের প্রশংসা করতেই হবে। তবে 'ট্রাজেডি পলাশবাড়ী' নাটকের তারাভান থেকে জুলেখা হয়ে দর্শকের হৃদয়ে স্থান করে নিতে তাকে আরো কিছুটা পরিশ্রম করতে হবে।নয়তো যারা 'ট্রাজেডি পলাশবাড়ী' দেখেছেন, তারা হয়তো মাঝে মাঝেই জুলেখা চরিত্রের মাঝে তারাভানের ছাপ পাবেন।তবে জুলেখা কিম্বা তারাভান দুজনেই নারী।তাই হয়তো এক সুতোয় এসে মিলে যায়।’’ 

দুজন নারী দুজন ব্যাক্তি সব সময়য়েই ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। কিতাবের জুলেখা, আমার বলা জুলেখা, পারভিন পারু, শাহনাজ জাহান সবারই পটভূমির দিক থেকে ভাষাগত, কিছুটা সংস্কৃতিগত মিল থাকতে পারে, তার পরও ভিন্ন, আবার 'এক সুতোয় মিলে যায়', য্যানো ছিন্ন হলেও বিজড়িত।  ব্যাক্তিত্বের জন্যই মানুষ অন্য স্তন্যপায়ীদের চেয়ে ভিন্ন। খুব স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন গ্যাপে এক মঞ্চায়নের ম্যানারিজম আরেক মঞ্চায়নে ঢুকে পড়তে পারে, না ঢুকলেই ভালো। এটা অসচেতনতা থেকে হতে পারে, ক্লান্তি থেকে হতে পারে, ভুলে যাওয়া থেকে হতে পারে। আমরা আসলে এতো ইনস্ট্যান্ট প্রতিক্রিয়াতে থাকি যে ইনোসেন্ট মিস্টিফিকেশান হারিয়ে ফেলি, যার সবচেয়ে বড় খেসারত হচ্ছে তুলনা করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। তুলনা এক দিক থেকে সংযোগসূত্র, আরেক দিক থেকে তুলনাকে আমরা দেয়াল হিসেবে ব্যাবহার করতে পারি, যাতে বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের স্টেটাস ও টাইপ আলাদা করতে পারি। পারভিন পারুকে আমি শাহনাজের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে বলবো এবং জানামতে পারু এই রিভিউটি শেয়ার করেছিল। ২০১৬তে নির্দেশনার আগে খুব শিঘ্রি পারু, জুনাইদের অন্য কাজগুলো দেখে নিয়েছিলাম, শিশিরের গানের ভঙ্গি শুনে নিয়েছিলাম  যাতে টাইপ জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে পারি, সচেতন ছিলাম, যাতে তিনজন নিজেদের পুনরাবৃত্তি না করতে পারে।

সূত্রধর শিশির রহমান।ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব।

নির্দেশনাতে আমি উচ্চকিত হস্তক্ষেপ করি না, সচকিতভাবে শিল্পীর ফ্লো তৈরি হতে দেই, সে-ফ্লোতে কোনো ম্যানারিজমের পুনরাবৃত্তি দেখলে হস্তক্ষেপ করি। এখানে লম্বা লম্বা সংলাপগুলোকে মনোগ্রাহী সুরে আনার ব্যাপারে শিশিরে প্রয়াস দ্রষ্টব্য। প্রথমত লম্বা বয়ানগুলোকে সুরে কিভাবে বাধবে, তা নিয়ে শিশির দ্বিধাগ্রস্ত ছিলো। আমি মূল স্টাইলে পূর্ব ও পশ্চিমের মেলবন্ধন চাইছিলাম। শিশিরকে বলেছিলাম, টেক্সট বার বার পড়তে। একদিন জানলো কিছু টিউন ওর মনে এসেছে, যা আমাদের শোনাতে চায়। এটা হচ্ছে ফ্লো, যা তৈরি হয়েছে টেক্সট থেকে। যেহেতু শিশির অনেকগুলো বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী, চরিত্রায়নে পারভিন পারু ও জুনায়েদ ইউসুফকে শিশিরের সহায়তায় সংলাপ ও সুরের সমন্বয়ে অপেরাধর্মি উপস্থাপনায় আনতে বেগ পেতে হয় নি। স্বরলিপির আক্ষরিক ভিত্তি হচ্ছে স্বর,  সেখানে পৌছোতে সংলাপ নিজেকে শোনানো, বার বার শোনানো অপরিহার্য।

দীর্ঘ বিরতির পর আবার মঞ্চে আসছে ‘ডৌল জুলেখার জেরা পর্ব’। টেক্সটের দিকে আবার সূত্রধর ও কুশীলবদের একটু মনোযোগ দিতে বলি। শাহনাজ জাহান, তার রিভিউতে দুবার কোট করেছে, ''আমি যারে মারি, সে কি আমায় মারে না, আমি যারে অন্ধ করি, সে কি আমায় অন্ধ করে না।'' অরিজিনাল লাইন,

 ''যে আমাকে মারে, সেও কি মরিতে চাহে না?

 আমি যাকে অন্ধ করি সে কি আমাকেও অন্ধ করে না?''

ওপরে যে লাইন বদলে গেলো, তা হয়তো শাহনাজের কানের ভুল কিম্বা পারুর প্রক্ষেপনের ভুল। আমরা অনেক সময় টেক্সটের পরম্পরায় মনোযোগ দেবার অনুশীলন হারায়ে ফেলার ফলে, ভালো কার্পেটেরও বারোটা বাজাই। টেক্সটের পরম্পরা কি? শামসুর রাহমান লিখলেন, ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’, সৈয়দ শামসুল হক রিভিউতে লিখলেন, ‘শেরপা নিঃসঙ্গ নয়’। এলান বেনেট লিখেছিলেন, ‘Uncommon Reader’, সেটা ছিলো ভার্জিনিয়া উলফের  ‘Common Reader’ এর একটা প্রতিক্রিয়া। সেরকম ''যে আমকে মারে, সেও কি মরিতে চাহে না......''..... উত্তমর্ণ রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর কথোপকথনের প্রতি অধমর্ণ চয়নের একটা যুক্ততা বা নৈবেদ্যর প্রয়াস।

ভাষার মিশ্রণে পুরো 'জুলেখা ট্রিলজিতে' এই নুয়ান্সগুলো খেলানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এরকম পরম্পরাগত নুয়ান্স  তৈরি করেছে বলরাম হাড়িসহ আরো অনেকের সাথে তার গানের বানিতে, উপন্যাসে, মঞ্চায়নে। রবীন্দ্রনাথ যখন বিখ্যাত হয় নি, তখন যেরকম শান্তিদেব, কণিকা তার বানিতে মনোযোগ দিয়েছে, বিখ্যাত হবার পর মনোযোগ বেড়ে যায় নি, বরং পরম্পরাটা বজায় থেকেছে, তারা বলরাম হাড়ির বানিও খুঁজে নিয়েছে। একই ব্যাপার  নজরুলের সাথে কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের সম্পর্কে পাওয়া যাবে।

'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব' সহ পুরো 'জুলেখা ট্রিলজি' আসমানি কিতাবগুলোর  উলটো বয়ান হলেও, জুলেখাকে বার বার সমকালীন ঘটনার কেন্দ্রে নিয়ে আসলেও, সূত্রধরের বয়ানে নুয়ান্সগত, শৈলীগত, সংলাপগত পরম্পরা তৈরি করা হয়েছে তুরস্কের রুমি, পারস্যের যামী ও বাংলার মধ্যযুগের কবি শাহ সগীরের সাথে। এখানে চর্যার পাঁশে এসেছে আন্তিগোনে, ময়মনসিংহ গীতিকায় মিশেছে সৌরিন্দ্র মোহন ঠাকুর। আর এ-পরম্পরাকে এগিয়ে নিতে কুশীলব পারভিন পারু, শিশির রহমান, জুনাইদ ইয়ুসুফের সাথে এক কাতারে মিলেছে শাহনাজ জাহান, রাদ আহমেদসহ অনেকে। এখানে মঞ্চের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ একাকার হয়ে থেকে যায় একটা মূর্ছনা, পর পর অনেকগুলো সার্ফিং-ঢেউ!     


চয়ন খায়রুল হাবিব 

১৭/০৯/২২

ব্রিটানি, ফ্রান্স


রেডিও স্বাধীন পরিবেশিত 'ডৌল পর্ব' পডকাস্ট