Sunday 14 August 2022

বাঙালির পরিচয় কাব্য : বঙ্গবন্ধু যেভাবে আমাদের বন্ধু!

পাঠকক্ষে বঙ্গবন্ধু।ধানমন্ডি, ঢাকা।

কিছু ঘটনা, কিছু ব্যক্তিত্ব ছুঁতে দরকার হয় মহাকাব্যের। আর সে-মহাকাব্যে পৌছাতে অনেক ছোট ছোট গান, অনেক অনেক সনেটের সোপান তৈরি করতে হয়। 'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছে', ৪ নং সনেটে লিখেছিলাম, 

''বর্ষবরণের খোপায় ঘুরে বেলি হেসেছে

  টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে'',

সনেটটির প্রত্যেক চরণে একেকটি ফুলের নামে রক্তাক্ততা, নির্লিপ্তি, মুগ্ধতা, তাণ্ডব, হাসি, অভিমান, সমর ও বিচ্ছেদ জাতীয় আবেগগুলো ধরতে চেয়েছিলাম। সংগ্রহটির ৩০টি সনেটে বাঙালির যাপিত দৈনন্দিনতা, আশির দশকের নাগরিক যাপন, পানির সঙ্কটের পাশাপাশি এসেছে সিস্টিন চ্যাপেল, মিরাবো সেতু, ম্যাডিসন স্কয়ার, সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কোলে ঠাই নিয়েছে চ্যানেল পার, ফ্রান্সের পশ্চিম তীরে ব্রিটানির সৈকত। ওখানে গৌতম, ক্ষণা, ক্লিওপেট্রা, মেরিলিন মনরো, সিরাজ শাঁই, রবীন্দ্রনাথে বিশ্বায়িত অর্কেস্ট্রাকে পূর্ণতা দেবার প্রয়োজনেই য্যানো ২৩ নং সনেটে লিখেছিলাম, 

''গৃধ্রকুট পাহাড়ের পাদদেশে

নেমেছিল গোপনিয়তায় গোমরানো লাভা

 ৭ই মার্চ ১৯৭১ আমার উঠানে মুজিবের সভা

যারা এসেছিল তারা স্বাগত

যারা আসেনি তারা বিগত''

                                                     '৭ই মার্চ', সনেট।'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ'।

রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছের'  সনেটগুলো শেষ করেছিলাম ২০০৭এর সেপ্টেম্বার থেকে ডিসেম্বার, চার মাসে।তার পর এটা ওটা খুচরা লিখে ২০১০ থেকে ২০১৯, টানা ৯ বছর ধরে যে 'জুলেখা ট্রিলজি' নাট্যত্রয়ী লিখি, তার শেষ পর্ব 'ওড়নায় অক্টোপাস : মুক্তিযোদ্ধা জুলেখা'য়, একের পর এক কুহেলিকা পেরোচ্ছে জুলেখা। পথ দেখানোর নামে ওর সাথে ছলনা করছে শুকপাখি। এসময় এক ছায়া-নিবিড় অরণ্যে জুলেখার যে প্রবীণ, প্রবীণার সাথে দেখা হয় নাটকে তাদের নাম না নেয়া না হলেও, গোলাগুলি ও সংলাপের আবহে বোঝা যায় তারা বঙ্গবন্ধু ও ওনার স্ত্রী। ওনারা দুজন জুলেখাকে  শুকপাখির ধোঁকাগুলো দেখিয়ে দেয়। 'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ' থেকে 'জুলেখা ট্রিলজি', দীর্ঘ বারো বছর আমাকে একটা অতৃপ্তি, একটা ক্ষুধা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, আর তা হচ্ছে আমি যে বাংলা ভাষাতে লিখি, তাকে ব্যক্তিক অবয়বে দেখবার, বুঝবার, ধরবার বাসনা। সে-তাড়না থেকে যখন একের পর এক চরণ মূর্ততা পেলো, তখন বাংলা ভাষা ও বঙ্গবন্ধুর চারিত্র একত্র করে পূর্ণতা পেলো 'বাঙালির পরিচয় কাব্য',

''আমাদের যাপনের মাঝপথে, কোনো এক সময় তুমি আসো 

খোজাখোজির পেরেশানি দেখে স্মিত হেসে পাশে এসে বসো। 

আলোর অরণ্যে নামে আধার, 

কি খুঁজে বেড়াচ্ছি মনে করতে পারি না কেউ আর।


কোন সে অরণ্য তা মনে রাখাটাও কি যে কঠিন।

বন্যতা, বর্বরতা, রুক্ষতার ভেতর এক নির্মেদ সরলতা!

ভাবতে গেলে ভয় হয়, আবার ভাবনাটা বার বার আসে,

কালো ডাটির চশমা পরা চোখে আন্তরিক আত্মীয়তা।

...........................

উত্তরের ভঙ্গিতে সে ছুড়ে দিলো এক প্রশ্ন অমোঘ!

আমরা কি হতে চাই, কোন শব্দে ফোটে আমাদের বুলি?

বাঘের হুঙ্কার, না কি আমরা বাঘের বাসাতে ঘোগ?

জানালাম, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, হতে চাই বাঙালি।


তখন সে জানালো, যাদের এখনো জন্ম হয় নাই,

তাদের সাথে আমাদের বার বার দেখা হবে।

তাদের অনেকে জন্মাবে না, অনেকে জন্মাবে।

শরীরী অশরীরী সকলে ৭ই মার্চের জনসভায় যাবে! 


১৯৭১, ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে জাগে বাঙ্গালির হুশ

শব্দের সম্ভ্রমে জাগে এক কীর্তিমান সুন্দর মানুষ''

                                                                       'বাঙালির পরিচয় কাব্য'
                                                         
৩৫ স্তবকের মহাকাব্যিক 'বাঙালির পরিচয় কাব্যের' সার-সুধা দিতে গিয়ে, ওপরের বিচ্ছিন্ন ৫ স্তবকে, যাকে আমি 'কীর্তিমান সুন্দর মানুষ' বলেছি, তার সাথে আমাদের মানস সংযোগ হয়ে গেলে, বিবিধ পরিচয়, অপরিচয়ের গুণাগুণে লাভক্ষতির হিসেবগুলোর ভার আর আমাদের নিতে হয় না।

বাংলাদেশের উদ্যোক্তা আলফাজ হোসেন, ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান 'বাংলা মেলা'র প্রতিষ্ঠাতা এমদাদ হকের সাথে আমার কখনো চাক্ষুষ সাক্ষাত হয় নাই, অনলাইনে সামাজিক মাধ্যমেও কোনো যোগাযোগ নাই। ওনারা কয়েকজন মিলে তৈরি করেছেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান 'মেধা'। ফ্যাশন জগতে নেতৃস্থানীয় এমদাদ হক ও শিল্পপতি আলফাজ হোসেন ছড়ানো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছেন। 'মুজিব বর্ষে' মেধার পক্ষ থেকে পাঠের জন্য ওনারা উপযুক্ত কবিতা খোজ করছিলেন। সুহৃদ বাবলী হকের কাছে কবিতাটার খসড়া পড়তে পাঠিয়েছিলাম, তার মাধ্যমে কবিতাটার খোজ পায় এমদাদ ও আলফাজ। কথিত আবৃতিযোগ্য কবিতার অতিমারি ও কোভিডের ভরা দুর্যোগের ভেতর চেনা সীমানা ভেঙ্গে অচেনাকে বরন করে নিলো 'মেধা'। উল্লেখিত সবার ভেতরে বিনি সুতার মালায় গাথা মণিহার হয়ে থাকলেন বঙ্গবন্ধু।

আমার আরো কিছু প্রকাশনার সাথে পুরো কবিতাটি সহ 'বাঙালির পরিচয় কাব্য' সংগ্রহটি সামনে প্রকাশ করবে 'জাগৃতি' প্রকাশনি। পাণ্ডুলিপিতে কবিতাটির শেষে আমি কাঠামোগত উধারের স্বীকৃতি দিয়েছি, ভার্জিলের ইনিড মহাকাব্য,  পাবলো নেরুদা Cancion de Gesta/Song of protest, W. H. Auden, "Calypso", "Refugee Blues" কাজগুলোকে। শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটির সাথে ফরাসি পল এলুয়ারের 'লিবার্তে' কবিতাটির মিল পাওয়া যাবে।। নেরুদার অনেক কবিতাকে মনে হবে 'গীতাঞ্জলীর' স্প্যানিশ অনুবাদ,  যে 'গীতাঞ্জলি' কিশোর নেরুদা পড়েছিল জিমেনেথের অনুবাদে । রবীন্দ্রনাথ একই সাথে সংস্কৃত প্রাচীন সাহিত্য এবং পশ্চিমের অনেক গানের কথা ও সুর আত্মস্থ করে পরিবেশন করেছে। ফরাসি বোদলেয়ার, বাঙালি জীবনানন্দ মার্কিন এডগার এলান পোতে জীবনভর আত্মহারা। বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতাগুলোর একটি 'বনলতা সেনকে' এলান পোর 'হেলেনের' পাশাপাশি পাঠ করলে মনে হবে, দুই কবি দুই ভাষাতে একই মানস প্রতিমার কথা বলছে। ভাবগত এরকম আদানপ্রদান বিশ্ব সাহিত্যে অনবরত ঘটছে। শেকসপিয়ার তার সনেট, নাটকে পাইকারিভাবে ইটালিয়ান সাহিত্য থেকে নিয়েছে। যে কোনো ভাষার প্রমিত ও নান্দনিক চলিষ্ণুতা সমৃদ্ধ হয় আদানপ্রদানের পথে। এগোনোর খাতিরে বিরামচিহ্নগুলোর খোজে, 'বাংলা ভাষার কোনো হুমকি আছে কি না', ২০১২সালে আফসান চৌধুরীর এরকম এক প্রশ্নের উত্তরে বিডিআর্টসে দীর্ঘ উত্তরের একাংশে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলাম এভাবে,  

''ক. বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ… আঞ্চলিক, কথ্য, শুদ্ধ, অশুদ্ধ তর্কের ঊর্ধ্বে মিথে পরিণত হয়।

খ. রবীন্দ্রনাথ কি কোলকাতার ভাষায় লিখতেন? সন্দেহাতীতভাবে না। অন্যান্য কোলকাতাবাসীর মত ঠাকুরবাড়ির লোকদেরও দন্ত্য স, তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ উচ্চারণে সমস্যা ছিল। কবিগুরুকেও নিজের সাহিত্য ভাষাকে কথ্যভাষার অকথ্য উচ্চারণ রীতি থেকে সরিয়ে অন্য আরেকটি মান তৈরি করতে হয়েছিল। মাইকেলও কোলকাতার ভাষায় না লিখে মিশনারি বাংলায় মহাকাব্য লিখতে ব্রতী হন। তবে রবীন্দ্রভাষাই মানভাষা হিশেবে চালু হয়ে যায়।

গ. মুজতবা আলী সিলেটের ভাষায় বা জীবনানন্দ বরিশালের ভাষায় লিখলে ওদের সাহিত্যের কী পরিণতি হতো বলা মুশকিল।

ঘ. কিশোরগঞ্জ থেকে আসা নীরদ চৌধুরী থেকে একই অঞ্চলের পরের সাহিত্যিকদের লেখনভঙ্গির যে বিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে মজার লেখা হতে পারে।

ঙ.মানিকের কুবের মাঝির কথনে চরিত্রের প্রয়োজনে এবং গ্রহণযোগ্যতার দাবিতে স্বাভাবিকভাবেই আঞ্চলিকতা আসবে!কিন্তু লেখক যখন সাহিত্যে ঘটনার বর্ণনা দেবে তখন সে বর্ণনা কোন ভাষায় হবে? সে ভাষাটি হবে প্রমিত বাংলা।''

পাঠরত বঙ্গবন্ধু
আফসান চৌধুরীর সাথেও আমার কোনো পরিচয় নেই, কিন্তু উনি কিম্বা অন্য যে কেউ আমার কাছে বাংলা ভাষা, বাংলা কবিতা, বাংলা নাটক, বাঙালি জাতি, বাঙালির মহাকাব্য নিয়ে জানতে চাক, বঙ্গবন্ধু আমার কাছে দরকারি ও জরুরি সূত্রচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় স্পেসে ভাসমান মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের মত। 

অনেকে বলে, 'সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করেছে।' বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে যেভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে তাকে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ফরেনসিক যেভাবেই দেখা হোক, তাতে তার নারকীয়তার মাত্রা কমে না। মাত্র কয়েক বছর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একই নির্মমতায় বাঙালি জাতীর নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। 

শিশু হত্যা, নারী হত্যা, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হত্যা সব দিক থেকে ১৯৭৫এর ১৫ই অগাস্টকে বলা যায় ১৯৭১এর 'অপারেশান সার্চলাইট' ও পোড়ামাটি-নিতির সম্প্রসারণ। সে বছর ১৫ই অগাস্ট থেকে ৭ই নভেম্বার অবধি যেসব সামরিক অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান ঘটেছে, তার সবই সেনাবাহিনীর অফিসারদের সরাসরি বা পরোক্ষ ক্ষমতা গ্রহণের ষড়যন্ত্র, জনগণকে ভয় দেখিয়ে অনির্বাচিত-ভাবে শাসন। ৭ই নভেম্বারকে 'সিপাহি বিপ্লব দিবস' আখ্যা দিয়ে এই পৈশাচিক অধ্যায়কে জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে অন্তরায়। কথিত কিছু বামপন্থি শক্তি এসব অভ্যুত্থানে জড়িত থাকায় এবং পরে এদের এজেন্টরা সামরিক সরকারের সাফাই ভাষণ দেবার ফলে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বুনিয়াদও দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সেনা শাসকেরা যদি ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক লেবাস নিয়ে ফেলতো, তাহলে সেই তল্পিবাহক বামপন্থিরা বাঙালিকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের ফাঁদে ফেলতেও পিছপা হতো না। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী পেছন থেকে শাসন করে দেশকে নিয়ে গেছে দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ ও চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে।বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি বিধান করে, অন্তত এই সিদ্ধান্তটুকু বাংলাদেশের নিতি নির্ধারকেরা নিয়েছে যে বাঙালি আইনরক্ষীরা বাঙালির বেতনে বাঙালিকে হত্যা করতে পারবে না। পরবর্তীতে পিলখানাতে সীমান্ত রক্ষীদের হাতে সেনা অফিসারদের বর্বর হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশ উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে নাগরিকের সম্পর্ক কি হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংস্কারমূলক কাজ করা হয় নি। যতবার বলা হয়, 'সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করেছে', ততবার সেনাবাহিনীর সংস্কার ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতার পথে অন্তরায় তৈরি করা হয়, ততবার আমলাতান্ত্রিক শাসনের পথ প্রশস্ত করা হয়।           

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে কবার সেনাবাহিনী সরাসরি বাংলাদেশে শাসন করেছে সবসময় তা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ১৯৭২এর সংবিধানের বিরোধীতা করে শাসন বজায় রেখেছে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামাতি ইসলামিকে পুনর্বাসন করেছে। গত কয়েক যুগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও প্রবাসে তার প্রভাবে আমি বাংলা ভাষায় কার কি রকম অধিকার সে-বাবদ বিভক্তিমূলক বক্তব্য শুনেছি। এ-বক্তব্যগুলো যে স্বাধীনতা বিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে বলিয়ান করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঈশ্বর, আল্লা, ভগবান, জল, পানি, গোস্ত, মাংস, পূজা, মহররম, দেব, দেবী, ফেরেশতা, পরি, ইসা, মুসা, গুরুনানক, বৈষ্ণব, সুফি, দেহতত্ব, আউল, বাউল, রাবেয়া বসরি, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম সবই বাংলা ভাষা। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাংলা শব্দ, বাংলা বাক্য ব্যাবহার করছে বলে আমরা কি বাংলায় কথা বলা, লেখা বন্ধ করে দেবো? বরং বাংলাতে আরো বেশি বলবো, আরো বেশি লিখবো, যাতে আমরা যাকে 'প্রাগ্রসর' বলি তা আরো সমৃদ্ধ হয়। সে-লক্ষ্যে বিজয়ীয় গৌরবে আমরা সবখান থেকে নেবো। 

দেশ-বিভক্তির সিজোফ্রেনিয়াকে ভাষা বিভক্তির দিকে নেয়াটা মানসিক বিকলাঙ্গতা ও সাংস্কৃতিকভাবে আত্মঘাতী। আমাদের মনে করতে হবে বিশ্বের সব ভাষাই বাংলা। ব্রিটেন তার বৈশ্বিক ক্ষমতা হারানোর পর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতার বলয় থেকে বেরিয়ে যাবার পরও ইংরেজি প্রমিতের চলিষ্ণুতায় পারস্পরিক থেকেছে। বিশ্বের অপরাপর অনেক ভাষায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক বিভক্তির পর যখন ভাষার ক্ষেত্রে পারস্পরিক থাকতে পারে নি তখন তাদের সংস্কৃতি প্রতিক্রিয়াশীল পিছুটানের কবলে পড়েছে, যার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত  পাকিস্তান, প্রতিবেশী আসাম, শ্রীলঙ্কার  রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা। ভারতের সব ভাষার সাথে এবং বিশ্বের অপরাপর ছোট, বড় ভাষার সাথে লেনদেন বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলা ভাষাতে যেরকম রক্তস্রোত বাড়বে, সেরকম বাঙালির অবয়বও আরো বিশ্বায়িত হবে।

স্বর ও ব্যঞ্জন মিলে বাংলা বর্ণমালাদের একে অপরের পারস্পরিক হয়ে ওঠা হিমালয় গিরি-শিখরদের একে অন্যকে আগলে অন্যের চেয়ে একটু উঁচুতে, মেঘদল ছাড়িয়ে আকাশের আরেকটু কাছে যাওয়ার মত, যেখানে পাদভুমির ভিত্তি সবাইকে একসাথে ধরে রাখছে। পুরো হিমালয় যেখানে পৃথিবী নামের তুমুল তরীটির বিপুল এক পাল, সবাইকে একসাথে একই সাথে মহাসাগরের দিকে, মহাকাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । পাদভুমির তলদেশ অল্প একটু কাঁপলে এখানে ওখানে প্রবল ভূমিধ্বস ঘটে যায়। আবার সে কাঁপাকাঁপির উৎক্ষিপ্ততাতে শিখরগুলো আরেকটু উঁচুতে ওঠে, হিমালয় থেকে ছুটে আসা নদীগুলো প্রবলতর বেগে সাগরের দিকে ধায়। 

পরিবেশ ও মানুষের এই একে অন্যকে আগলে রাখাটা শোষণের জবরদস্তিতে ঘটে না। একসময় বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন জনপদ বর্ণাশ্রম ছেড়ে ব্যাপক ভাবে বৌদ্ধ দর্শনকে তাদের জীবানাচারে গ্রহণ করেছিল, পালি হয়ে উঠেছিল সাধারণের বুলি। সারা ভারত প্রবলভাবে শাসন করে, বাংলাতে বিপুল সব বৌদ্ধ ধর্মিয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে সম্রাট অশোক এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের সেই ব্যাপকতা বজায় রাখতে পারে নাই, লোকমুখ থেকে পালি ভাষা হারিয়ে গেছে। পরিবেশগত মৌলিক প্রাণস্পন্দনের জায়গা থেকে বাঙালি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করেছে, যার শেকড়ে আছে বঙ্গবন্ধুর বজ্রপাতসম আহবান, 

                            '''কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না, 

......এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।'' 

১৫ই অগাস্টকে আমরা কেউ বলছি শোক-দিবস, কেউ বলছি শক্তিদায়ক। দুটোই যথার্থ, শোক ও শক্তি মিলে যে আবেগ, তার ফলশ্রুতি উদযাপন। জিসাসের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু করুন-রসের বিয়োগান্ত কাহিনী হবার পরও, সে-দিবসটিকে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বলে 'উত্থান দিবস', জিসাসের জন্মদিনকে বলে 'বড়দিন' এবং দিনটিকে মহা সমারোহে উদযাপন করে। আফসান চৌধুরী, এমদাদ হক, আলফাজ হোসেন, বাবলী হক যখন বাংলা ভাষাতে আরেকটি নুতন কবিতা আবিস্কার করে  , তখন বার বার আমরা 'মুজিব বর্ষ' উদযাপন করি। সেন্সরের মুখে শামসুর রাহমান যাকে টেলিমাকাস বলেছে, স্যামসন বলেছে, সেই হয়ে ওঠে 'বাঙ্গালির পরিচয় কাব্যের' মহানায়ক। তার যাপনের প্রতিটা অংশ হয়ে ওঠে  মহাকালের আবর্তে আবহমান বাংলা বর্ণমালা!


চয়ন খায়রুল হাবিব 

১৪/০৮/২২

ব্রিটানি, ফ্রান্স  


ছবি সূত্র : গুগল, আলোকচিত্রগ্রাহকদের নাম জানতে পারি নাই।চখাহা।