Sunday 17 January 2021

জনরা কি?মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তবতা ও রায়হান উদ্দিনের গান!

আব্বার থেকে পাওয়া রায়হান উদ্দিনের গানের বই

মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তবতা

কোনো একটি সুনির্দিষ্ট ধরনের আঁকাআঁকি, সঙ্গীত ও সাহিত্যকে জ বা জনরা বলা যায়।চলচ্চিত্র পরে শব্দটি ধার নিয়েছে সঙ্গীত ও সাহিত্য থেকে।আমাদের জন্য এর কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে ধারা, ঘরানা, তরিকা।

চর্যা, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদি, মাইকেল মধুসূদনের মিত্রাক্ষর, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথের কৈশোরের ভানুসিংহের পদাবলী, নজরুল গীতি আমাদের ঘরোয়া জনরা।খেয়াল করলে দেখবো, যারা জনরা বা ধারা তৈরি করছে তারা কেউ আনুষ্ঠানিক অধ্যাপক নন, সবাই অনানুষ্ঠানিক চর্চাকারি।লেখক, গীতিকার, শিল্পীদের ভেতর সনাতন থেকে বের হয়ে নতুন ধারার কাজ করার তাড়না সৃজনশীলতার একটা বড় প্রণোদনা।

ভারতীয় রাগ  সংগীতের বিভিন্ন ঘরানায় যারা একটা পর্যায়ে পৌছাতে পারে তাদের বলা হয় পণ্ডিত।এ যাত্রাপথের পুরোটাই অনানুষ্ঠানিক।অনানুষ্ঠানিকেরা ঘরানা বা তরিকা দাড় করান, পরে আনুষ্ঠানিক অধ্যাপকেরা তা নিয়ে আলোচনা করেন, অনেক সময় সেসব আলোচনা ঠিক থাকে, আবার অনেক সময় তা বিভ্রান্তি তৈরি করে।এর উদাহরণ হতে পারে কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২) শিরোনামের সংগ্রহটা।মাইকেল যেরকম সনেট বা ১৪পদী মিত্রাক্ষরের প্রকরণ নিয়েছিল পশ্চিম থেকে, মান্নানের পরাবাস্তব কবিতার রীতি, প্রবর্তনাও বিদেশি, সুনির্দিষ্ট করে বলতে হলে ফরাসি সাহিত্য আন্দোলনগুলোর একটি ধারা।

স্বস্ত্রীক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ

সুদূর বাংলাদেশে মান্নান সৈয়দ যেরকম পরাবাস্তব জনরাতে প্রভাবিত হয়েছে, সেরকম আফ্রিকার লিওপোল্ড সেঙ্ঘর,এমে সেজার তাদের নেগ্রিচ্যূড আন্দোলনে গ্রহণ করেছিল পরাবাস্তববাদীদের উপস্থাপনা রীতি।পরাবস্তব বা সুঋয়ালিস্ট আন্দোলনের ফরাসি হোতারা হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধত্তোর কবি ও চিত্রশিল্পীরা, এর সাথে জড়িত ডাডাবাদিরাও।আবার ডাডা, সুঋয়ালিস্ট জনরাগুলোর শেকড়ে আছে উবু রাজা নাটক খ্যাত উনবিংশ শতকের আলফ্রেড জারি।মান্নান সৈয়দ সারা জীবন কাব্য চর্চার পাশাপাশি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, অনেক গবেষণা গ্রন্থ রেখে গেছেন।কিন্তু তার পরাবাস্তব কবিতা বইটির আকর চিন্তাগুলো নিয়ে ক্যাননিকাল লেখা রেখে যান নাই।মান্নান সৈয়দসহ তার ষাট দশকিয় সতীর্থরা, বিশেষ করে যারা স্বাক্ষর পত্রিকায় জড়ো হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ পরাবাস্তবতাকে উপস্থাপনা রীতি বা ফ্যাশন হিশেবে নিলেও তাদেরকে পরাবাস্তববাদী বলা যাবে না।মান্নান সৈয়দের সামগ্রিক, সাহিত্য চর্চাকে কেন্দ্রনিবিড় বলা গেলেও পুরোপুরি মৌলবাদী বলা যায় না, ফররুখ আহমদিয় মৌলবাদের ছায়াপুস্ট, যেখানে পরাবাস্তববাদীদের অন্তরঙ্গ ও বহিরাঙ্গিক প্রবণতা দুটোই কেন্দ্রছুট ও কেন্দ্রাতিত।তাই বলে মান্নানের চর্চাতে যে আন্তরিকতার অভাব ছিল তা নয়।বরং হয়তো আন্তরিকতার কারণে ,মান্নান দেখতে পেয়েছিলেন যে ডাডা ও পরাবাস্তব ঘরানার আদিগুরু আলফ্রেড জারি এবং যে আপোলিনেয়ারের কলম ধরে সুঋয়ালিস্ট শব্দটা এসেছে, এরা ঘোরতর ধর্ম ও ধর্মাচার বিরোধী।নিজের যাপিত সংসারী প্রণোদনার সাথে যা মেলে নাই, তাকে শুধু অধ্যাপনার গবেষণাপত্রের সনদে মান্নান বেধে রাখতে চান নাই।তার পরাবাস্তব কবিতা বইটি ধরে,আমরা আপোলিনেয়ার ও আলফ্রেড জারিতে পৌছাতে পারবো।জনরা একাধারে ধারা ও সেতুপথ।  

আমরা যে বলি ট্রাজেডি, কমেডি বা করুনরস, হাস্যরস, বীররস, বীভৎস-রস, এসবও একেকটা জনরা।ইংরেজ উইলিয়াম ব্লেক ও ফরাসি ভিক্টর হুগো লেখালেখির পাশাপাশি আঁকাআঁকিতে নিয়মিত ছিলো।ব্লেক ও হুগোর গথিক আকা, লেখা থেকে তৈরি হয়েছে ডার্ক রোমান্টিসিজম জনরা।রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিতণপাষাণকে বলা যাবে এই জনরার কাজ, তার কাদম্বিনী, যোগমায়া, মণিমালাদের বলা যাবে ডার্ক রোমান্টিক চরিত্র।মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল যখন যে জনরার খোজ পেয়েছে তাতে অবগাহন করেছে এবং সেখান থেকেই আমাদের আধুনিক ও উত্তর আধুনিকেরা বিচিত্রিতা পিয়াসি হয়েছে।জনরা বা ধারাগুলো ধ্রুপদ থেকে আধুনিক, উত্তর আধুনিকে অবিরাম চলিষ্ণু থাকছে।কখনো আবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।

পশ্চিমে গানের ক্ষেত্রে ধ্রুপদ অপেরা ধারা গড়িয়েছে জ্যাজ, ব্লুজ, সৌল, কান্ট্রি, রক, হিপ হপ, র‍্যাপে।গীতল লোকজ ধারাকে কবিতায় এনে ইংরেজ অডেন ও চিলির নেরুদা তৈরি করেছিল ক্যালিপ্সো।আমাদের কাছাকাছি কুমিল্লার আলাউদ্দিন খান উত্তর ভারতে যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জনরা দিয়ে গেছে, তার সমঝদার হতে পি, এইচ, ডি করবার দরকার নাই।একই কুমিল্লার সচিন কর্তা ও তার ছেলে রাহুল দেব বর্মণ বলিউডকে দিয়ে গেছে দেশোয়ালি বাংলা লোকজ সুরের জনরা।তারপর আছে লালনের জনরা, হাসন রাজার জনরা।জনরার ক্ষেত্রে এই যে মহাজনদের মেলা, তাতে বিশ্বের সব প্রান্তে জড়ো হয়েছে অপরিচয়ের স্পর্শ মাখা লাখো লাখো চারণ, ত্রুবাদুর ও গায়েনরা।সেই রকম একজনে গায়েন রায়হান উদ্দিন।

রায়হান উদ্দিনের প্রেম পুস্পহার 

১৯৯৯ সালে স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া ও আমি ঢাকাতে গেলে আমার আব্বা হাবিবুল বশর আমাকে একটি পুরনো, জীর্ণ মুদ্রিত গানের বই উপহার দিয়ে বইটিকে যত্ন করে রাখতে বলেন।সেটা ছিল নিরক্ষর গায়েন রায়হান উদ্দিনের লেখা গানের বই।সাথে আব্বা আরো জানান যে আমার দাদা সুফি পির হজরত জমির উদ্দিন আহম্মদের জীবনী তিনি লিখে শেষ করেছেন এবং ছাপার জন্য তা আমাকে দেয়ার ইচ্ছা ছিলো।কিন্তু আমি দীর্ঘকাল নিরুদ্দিষ্ট থাকায় পাণ্ডুলিপিটা ছাপানোর উদ্দেশ্যে আমার অগ্রজ চাচাতো ভাই গাজি মিয়াকে দিয়েছেন।আমার জানামতে কয়েকটা খাতায় হাতে লেখা এই পাণ্ডুলিপিটা আমার আব্বার হাতের লেখার শেষ নিদর্শন।সে পাণ্ডুলিপি নির্ভর করেই আমার দাদার বংশতালিকা ও জীবনী ছাপানো হয়েছে।১৪শ শতকে সুদূর আফগানিস্তানের বলখ নগরের শাসক শাহ আলি আসগরের ছেলে সুলতান শাহ রাজ্য ত্যাগ করে কিভাবে বাংলাতে চট্টগ্রাম উপকুলে এলেন, সেখান থেকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে বগুড়ার মহাস্থান গড়ে যাবার পথে চৌদ্দগ্রামের ডিমাতলি গ্রামে থামলেন, বিবাহ করলেন এবং একমাত্র শিশু ছেলে সুলতান মাহমুদ বালখিকে সেখানে রেখে রেখে মহাস্থান বা তখনকার পুণ্ড্রবর্ধনে গেলেন সেখানকার অত্যাচারী রাজার মুখোমুখি হতে।সুলতান শাহ বালখির আরেক নাম ছিল, মাহরুহী বা মাহিসওয়ার বা মাছের সওয়ারি।সে হিশেবে আমাদের বংশ প্রতীক বা কোট অফ আর্মস হচ্ছে মাছের সওয়ারি এক উভচর মানুষ।তারপর প্রামাণ্য বংশলতিকায় ৬ শো বছরের ব্যবধানে জন্ম হয় দাদার।

১৯৯৯ বাংলাদেশ সফর ছিল  ছিলো আব্বার সাথে আমার শেষ সাক্ষাত।সে সময় বাংলাদেশকে ঘাটি করে প্যাট্রিসিয়া আর আমি চার মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি।প্যাট্রিসিয়াকে দেখিয়ে এনেছিলাম  ৌদ্দগ্রামের তৃষ্ণা গ্রামে দাদার মাজার।ফাকে ফাকে ঢাকার আজিমপুরের বাসাতে মুমূর্ষু আব্বা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে য্যানো কয়েক দিনের ভেতর বলে ফেলতে চাচ্ছিলো কয়েক শো বছরের কাহিনীর ভেতরের কাহিনী,সুফি গানগুলো কিভাবে ফারসি, উর্দু শের থেকে সরে এসে ভাটি ও উজান অঞ্চলের কাদা, মাটিতে মিশে আরো রসবান, আরো বেগবান হয়েছে তার কাহিনী।তখন বাংলাদেশে ভরা বর্শা।বাংলো-বাড়ির লাগোয়া বাগানের রক্তজবার ঝাড় বেয়ে থেকে থেকে মুশল ধারে বৃষ্টি।একটু দূরে আম্মা বসে আছে।কঙ্কণ, প্যাট্রিসিয়া ও আমি কান পেতে শুনছি আব্বার বয়ান।কণ্ঠ ক্ষীণ হলেও কনকন আর আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, গল্প বলবার সময় আব্বা নিজেই সিন্দাবাদ, আলিবাবা হয়ে যাবার কথা!

এর পর বিলাতে বহু বাসা বদলে, পরে বিলাত থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফ্রান্সে চলে আসার সমস্ত পালাবদলে রায়হানের বইটিকে আমি সন্তানসম আগলে রেখেছি।বইটির নাম প্রেম পুস্পহার।বইটির আদি মলাট হারিয়ে গেছে।বইটি আব্বাকে দেয় দাদার খাদেম মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ।১৯৮৬ সালে আব্বাকে দেয়ার আগে আব্দুর রশিদ বইটিকে আবার বাধাই করে এবং নূতন মলাটে হাতে লেখা, ''গজলে রায়হান, বিষয় : প্রেম পুস্পহার, নাম :

মোঃ আব্দুর রশিদ, ঠিকানা : হস্তমৃত্যা চিয়ড়া, কুমিল্লা, সন--১৯--৫/১২/৮৬''।

তার নিচে ছাপা অক্ষরে, আবুল কালাম বুক বাইন্ডিং হাউজ, নিজাম রোড, ফেনী।

আব্বার লিখিত পাণ্ডুলিপির বরাতে এবং দাদার মুদ্রিত জীবনী গ্রন্থ থেকে জানতে পাই। নিরক্ষর কাঠুরিয়া রায়হান ওরফে রায়হান উদ্দিনের জন্ম বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বৃহত্তর কুমিল্লায় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী চিওড়া উপজেলাতে।পেষাতে কাঠুরিয়া,বসবাস চিয়ড়ার জামকুরা গ্রামে, কাঠ কাটতে যায় ত্রিপুরা পাহাড়ের জঙ্গলে।দাদা জমির উদ্দিন শাহ ও কাঠুরিয়া রায়হান উদ্দিন কেউ কাউকে চেনে না।

দাদা বিভিন্ন খানে সুফি মতবাদ প্রচার করে বেড়ায়, হলকা ঝিকিরের আয়োজন করে তার ভক্তরা।এসব নিয়ে বেধে গেলো দেওবন্দিদের সাথে।এক পর্যায়ে কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যস্থতায় সামনাসামনি সহিংসতা বন্ধ হলো।স্থানীয় দেওবন্দি নেতারা গোপনে রায়হানকে ঠিক করলো দাদাকে খুন করতে, রায়হানও রাজি।দাদা একদিন এদিক ওদিক সফরের সময়, রায়হানের বাড়িতে হাজির, জানে না যে রায়হানকে তাকে খুন করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে।রায়হান তখন কাঠ কাটতে পাহাড়ে।বাড়ির লোকজন দাদাকে বসালো, অন্যান্য গ্রাম থেকেও দাদার আসার খবর পেয়ে রায়হানের বাড়িতে ভিড় বাড়তে থাকলো।ইতিমধ্যে রায়হান কাঠ কাটাশেষ করে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে, ভিড় দেখে কারণ জানলো যে নুর নগরীর আগমনে লোকজন এসেছে।রায়হানের মাথায় রক্ত চড়ে গেলো।মাথার ওপর লাকড়ির বোঝা দূরে ছুড়ে ফেলে কুড়াল হাতে ছুটে গেলো দাদার দিকে।সবার সামনে দাদাতে হত্যা করতে উদ্যত হলো, কুড়াল উঁচিয়ে নামাতে গিয়ে পারলো না।খুনের উন্মত্ততা রায়হান ভুলে গেলো দাদার নুরানি জলওয়াতে।দাদার পা ধরে ঝর ঝর করে কাঁদতে থাকলো।সে অভিজ্ঞতা থেকে রায়হান বাধলেন গান,

'হীনের তল্লাসে কেনে এসেছ গহিন বনে।

তব পদ্দধুলির যোগ্য নহী, এত দয়া কেন মনে।

হীনের গায়ে দিতে নাহি টাট, কই পাবো তোমার যোগ্য খাট।

বৈস ২ দয়ার নাথ, বৈস হীনের হৃদ আসনে।

মধু মিশ্রি সার ব্যঞ্জনে, না রুচে যাহার মনে।

কি বা ভক্ষণ দিব হীনে, হীনের মস্তক বিনে।

তোমার পাইয়ে প্রাণ বালা, পাইয়াছিরে গাউছ মালা,

খণ্ডিবে ভবের জ্বালা চন্দ্র মুখ দরশনে।।'

(প্রেম পুস্পহার বা গজলে রায়হান,

গজল নং ৯৩, পৃষ্ঠা ৬০)

নিরক্ষর কাঠুরিয়া রায়হানের ভাষা য় অধিকার সচেতনতা দেখা যাক :

'আইছ ভবে যাইতে হবে আছে হিসাব কিতাব বেশুমার।

একদিন দায়ের হবে আদালত উচ্ছেদের মোকদ্দমা,

কোর্ফা জমিনে চাষা কেহ থাকতে পারবিনা।

মাওলায় ঢুলকি দিয়ে ভাঙ্গবে দখল, তখন মন কি করবি আর।'

পরিশিষ্ট

৩০শের দশক থেকে ৭০দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতাতে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের যে দৌরাত্ম তাকে ছন্দ প্রকরণ ছাড়িয়ে অক্ষরবৃত্ত জনরা বলা যেতে পারে।এই জনরাতে আবুল হাসান, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আবিদ আজাদের মতো অনেকে উৎকর্ষ দেখাতে পেরেছে, তাদের পাশাপাশি অনেকে ক্রল করে করে থাকতে চেয়েছে।এ পর্যায়ে কবিতা ও গানের বানীর রাজপথ, গলি, উপগলিতে জনরা বা ধারাগুলোতে বিভ্রান্তি তৈরি হতে হতে জনরার লিগগুলো ক্রমশ নিচে নেমে জলো হয়ে গেছে।গদ্যছন্দের কবিতাও যে চোরাগোপ্তা লিরিকে ভর করে চলে এটা অনেক কবিরা জানে না।এক দল ছন্দ বলতে বুঝেছে ছড়াকে, আর সুরকে মনে করছে আলাদা করে গানের ব্যাপার।অনেকে অক্ষরবৃত্তকে গদ্যছন্দ বলে ভুল করেছে।বার বার পড়ে আমাদের সুরকাররা অক্ষরবৃত্ত পর্যন্ত আয়ত্ত করতে পারে নাই।

পশ্চিমে রক গানগুলোর ভিত্তি হচ্ছে ব্ল্যাংক ভার্স, যার ভিত্তিতে পরে ফরাসি য় মার্কিন গায়কেরা টানা সব কাব্যিক বানির সুর তুলতে পেরেছে গিটারে, অর্গানে।আমাদের অনেকে বলেছে যে জীবনানন্দ এবং ৩০শের কবিরা গান থেকে কবিতা আলাদা করে ফেলেছে।এটা পাঠের এবং বোঝার ভুল।৩০শের প্রধান  কবিরা হিন্দু ধর্মেরআবহে বেড়ে ওঠায় পারিবারিক, সামাজিক নৈমিত্তিকতায় স্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি তাল ও লয় আশ্রয়ী থেকেছে এবং রাগের বিচিত্রতাকে অনায়াসে খেলাতে পেরেছে।নজরুলসহ বাঙালি মুসলিম কবিদের অনেকে নিয়মিত আজান শুনতে শুনতে বড় হয়েছে এবং তা থেকেও সুরের মূর্ছনা প্রাণস্পন্দনে অনুরণন তুলেছে।ধর্মাচারের আরোপিত জবরদস্তি, নৃশংসতা প্রাণস্পন্দনের সুরের টিউনিং নষ্ট করে। এই টিউনিং নষ্ট হবার অভিঘাত এসে পড়েছে ভাটি ও উজান উভয় অঞ্চলের প্রায় সমস্ত জনরায়, ভাষা ও বিষয় হয়ে গেছে বিমূর্ত।জনরা বিষয়ে ওয়াকিবহাল না হওয়াতে মূর্তটা বলতে অনেকে বুঝেছে কথিত দ্রোহের কবিতা বা প্রেমের কবিতাকে, এগুলোকে জনরা বা ধারা না বলে বলা যেতে পারে জনরার এলার্জি।

ভাষা ও সুর পারস্পরিক।আমরা যখন বলি, বাঙালীত্ব নিয়ে জানি কিরকম করছে সবাই।এটা সুরের টিউনিং হারিয়ে ফেলার ফলাফল।যদি স্বীকার করে নেয়া হয় যে সুর নিখোঁজ হয়েছে, তাহলে তাকে ফেরানোর ও নবায়নের আয়োজন বাড়বে।


চয়ন খায়রুল হাবিব

১৮/০১/২১

ব্রিটানি, ফ্রান্স